বিস্মৃতির অন্তরালে জলধর সেন — দীপক সাহা
কালের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া বঙ্গদেশের অন্যতম কর্ম প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব জলধর সেন। তিনি ছিলেন উনিশ ও বিশ শতকের সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক সংযোগ সেতু। তিনি একাধারে কৃতী ভ্রমণ কাহিনী, রম্যরচনা, উপন্যাস লেখক এবং সাংবাদিক। প্রায় আশি বছরের জীবন তিনি উৎসর্গ করেছিলেন সাহিত্যসাধনা ও সাময়িকপত্র-সম্পাদনা কর্মে। জলধরের সাহিত্যকৃতিতে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ তাঁর সংবর্ধনা উপলক্ষে লিখেছিলেন -‘….বাংলা সাহিত্য সমাজে আপন স্নিগ্ধ সহৃদয়তাগুণে বর্তমান সাহিত্যসাধকদের হৃদয় জয় করিয়াছেন প্রবীণ সাহিত্যতীর্থপথিক শ্রীযুক্ত জলধর সেন।’
জলধর সেন ১৮৬০ সালের ১৩ মার্চ, ১২৬৬ বঙ্গাব্দের ১লা চৈত্র মঙ্গলবার কুষ্টিয়া জেলার (তৎকালীন বৃহত্তর নদিয়া জেলা) কুমারখালী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ও সংস্কৃতিবান পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। হরিনাথ মজুমদার, যিনি বাঙালির নিকট কাঙাল হরিনাথ নামে পরিচিত। কাঙাল হরিনাথের জন্মও কুমারখালীতে। কাঙাল হরিনাথই হলধরের শিশুপুত্রের নাম রাখেন জলধর। তবে জলধরের আদি নিবাস বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসতের নিকট অবস্থিত দেগঙ্গা। তাঁর প্রপিতামহ কুমারখালীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেশম-কুঠির দেওয়ানির কাজ পেয়ে কুমারখালীতে যান এবং সেই থেকে তাঁরা সেখানে বাস করেন৷ তাঁরা দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থ এবং ‘দেগঙ্গার সেন’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর পিতার নাম হলধর সেন। জলধরের যখন তিন বছর বয়স তখন তাঁর বাবা মারা যান। তাঁর স্কুল শিক্ষা জীবন অতিবাহিত হয় কুমারখালীতেই। ১৮৭৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত কুমারখালী হাইস্কুল থেকে এন্ট্রাস (বর্তমান সময়ের মাধ্যমিক সমমান) পরীক্ষায় পাস করেন। ১০ টাকা বৃত্তিও পেয়েছিলেন এন্ট্রাস পরীক্ষা পাস করার পর তিনি উচ্চতর শিক্ষা লাভ করার জন্য চলে আসেন কলকাতা শহরে। গণিত শাস্ত্রের দিকে তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিল, তাই তাঁর ইচ্ছে ছিল এঞ্জিনিয়ারিং পড়া। কিন্তু অর্থাভাবে তাঁর ইচ্ছে বাস্তবে পরিণত হয়নি। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জেনারেল এসেম্বলি ইনস্টিটিউশনে তিনি ফার্স্ট আর্টস বা এফএ ক্লাসে (বর্তমান কালের উচ্চ মাধ্যমিক সমমান) ভর্তি হন। কিন্তু নানা কারণে তিনি এফএ পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিদূর না এগোলেও তিনি ঘরে বসে প্রচুর লেখাপড়া করেছিলেন।
জলধর সেনের কর্মজীবন শুরু হয় একজন স্কুল শিক্ষক হিসেবে। ১৮৮৩ সালে তিনি গোয়ালন্দ হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৮৮৭ সালে তাঁর জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। মাত্র ১২ দিন বয়সে তাঁর শিশুকন্যার মৃত্যু হয়। আরও ১২ দিন পর তাঁর স্ত্রী সুকুমারী দেবীর অকাল প্রয়াণ ঘটে। তিন মাস পর তাঁর মা কালীকুমারী দেবী ইহলোক ত্যাগ করে চলে যান। স্বজন বিয়োগের শোকে উদভ্রান্ত হয়ে জলধর সেন মানসিকভাবে শান্তি লাভ করার জন্য ১৮৯০ সালে হিমালয়ের পথে যাত্রা করেন। হিমালয়ে থাকাকালীন তিনি কিছুদিন দেরাদুনের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এবং হিমালয় থেকে ফিরে এসে ১৮৯১ সালে মাসিক ৪০ টাকা বেতনে মহিষাদল রাজ বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে যোগদান করে ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত এই বিদ্যলয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৮৯৩ সালে, উস্তির দত্ত পরিবারের হরিদাসীদেবীর সঙ্গে তাঁর পুনর্বিবাহ হয়।
১৮৯৯ সালে শিক্ষকতার চাকরি ইস্তফা দিয়ে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় এসে শুরু হয় তার অন্য পেশা। তিনি শুরু করলেন সাংবাদিকতা। তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু হয় সাপ্তাহিক ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকায়। এই পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে তিনি কাজ করতেন। সাপ্তাহিকে ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকার কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন সাপ্তাহিক ‘হিতবাদী’ পত্রিকায়। এই পত্রিকায় তিনি কাজ করেন ১৮৯৯ সাল থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে ‘হিতবাদী’ পত্রিকায় তাঁর কাজ করা সম্ভব হয়নি। তিনি এই পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কিছু সময় পর টাঙ্গাইলের জমিদার বাড়ির গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। কিছু সময় পর তাঁকে নিযুক্ত করা হয় জমিদার বাড়ির দেওয়ান। ১৯০৯ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত তিনি জমিদার বাড়ির দেওয়ান হিসেবে কাজ করেন। তাঁর কর্মদক্ষতা সবারই প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। জমিদার বাড়ির চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি আবার সাংবাদিকতায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯১১ সালে তাঁর সম্পাদনায় ‘সুলভ সমাচার’ নামক একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিছু সময় পর তিনি যোগদান করেন ‘মাসিক ভারতবর্ষ’ নামক বিখ্যাত পত্রিকায়। তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ‘মাসিক ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় তিনি কাজ করেন একটানা ছাব্বিশ বছর। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই পত্রিকায় কাজ করেন। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে অনেক লেখক সৃষ্টি হয়েছে এবং অনেক খ্যাতনামা সাহিত্যসেবী ‘মাসিক ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় লিখেছেন। এই পত্রিকাটি সারা বাংলায় জনপ্রিয়তা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। ‘মাসিক ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে কাজ করার সময়কে জলধর সেনের কর্ম জীবনের স্বর্ণ অধ্যায় বলা যায়।
জলধর সেন শুধু পত্রিকা সম্পাদনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি নিজে লেখালেখিও করতেন। আজীবন সাহিত্য সাধনা করে গেছেন এবং নিজেকে একজন সাহিত্যিক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর সাহিত্য শিক্ষাগুরু ছিলেন কাঙাল হরিনাথ ওরফে হরিনাথ মজুমদার। জলধরের কথায়, “হরিনাথ আমার শিক্ষাগুরু, দীক্ষাগুরু, আমার জীবনের আদর্শ।” কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজে হরিনাথের জলধরের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য, একইসঙ্গে হরিনাথের ‘ফিকিরচাঁদ’-এর বাউলসঙ্গীত দল গঠনেও তাঁকে প্রথম সারিতে দেখা যায়। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গান গেয়ে মানুষকে বিমোহিত করার কাজে হরিনাথের ছায়াসঙ্গী ছিলেন জলধর। মূলত কাঙাল হরিনাথের অনুপ্রেরণাতেই তিনি সাহিত্য সাধনা শুরু করেন। সাহিত্যের অন্যতম প্রধান শাখা গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদি বিভাগে তাঁর সহজ পদচারণা ছিল। তাঁর সর্বমোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বিয়াল্লিশটি। জলধর সেন বেশ কিছুদিনের জন্য হিমালয় ভ্রমণে গিয়েছিলেন। হিমালয় ও তার পারিপার্শ্বিক অঞ্চলের ভ্রমণবৃত্তান্ত জলধর সেন তার ” প্রবাসচিত্র ” (১৮৯৯) , ” হিমালয় ” (১৯০০) , ” পথিক ” (১৯০১) , ” হিমাচল বক্ষে ” (১৯০৪) –এই চারিটি গ্রন্থে প্রাঞ্জল ও চিত্তাকর্ষক ভাষায় লিপিবদ্ধ করেন। হিমালয় ভ্রমণের উপর রচিত এই চারটি গ্রন্থ সেইসময় বাংলার পাঠকসমাজে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। এ ছাড়াও ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানের ভ্রমণ নিয়ে রচিত তার অপর বইয়ের নাম ‘প্রবাসচিত্র’। এই বইটি সহজ ও চিত্তাকর্ষক ভাষায় রচিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ভুবনে যে সকল লেখক বাংলা ভাষায় ভ্রমণসাহিত্য রচনা করে বাংলার পাঠকমহলে প্রশংসিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন জলধর সেন। তাঁর রচিত গল্পের বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘নৈবেদ্য’, ‘কাঙ্গালের ঠাকুর’, ‘বড় মানুষ’ প্রভৃতি । তাঁর রচিত উপন্যাস হল ‘দুঃখিনী’, ‘অভাগী’, (তিন খণ্ডে রচিত) ‘উৎস’ প্রভৃতি । ‘কাঙাল হরিনাথ’ (দুই খণ্ডে সমাপ্ত) তাঁর রচিত জীবনী গ্রন্থ। তাঁর সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘হরিনাথ গ্রন্থাবলী’, ও ‘প্রমথনাথের কাব্য গ্রন্থাবলী’। জলধর সেনের কোনও কোনও লেখায় পতিতাদের প্রতি সহৃয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। এটা তাঁর মহানুভবতার পরিচয় বহন করে। বিধবা বিবাহের প্রতি তাঁর সমর্থন তাঁর সহৃদয়তার পরিচয়।সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল এবং অনেক সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়েছিলেন। ১৯২৯ সালে কর্ম প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার জলধর সেনকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি প্রদান করে। দেশবাসীর নিকট তিনি ‘দাদা’ উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। তিনি দুইবার বিখ্যাত সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের’ সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে কলকাতায় রামমোহন লাইব্রেরি মিলনায়তনে বঙ্গবাসীর পক্ষ থেকে জলধর সেনকে বিপুল সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন বাংলার অপরাজেয় কথাশিল্পী সাহিত্য সম্রাট শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম জীবনের লেখায় জলধর সেনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কোনো রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি বড় কথা নয়, দেশের সংস্কৃতিমনা মানুষের কাছ থেকে তিনি যে বিপুল ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন তার তুলনা হয় না। এখানেই তিনি অনন্য।
১৩৪৫ বঙ্গাব্দের ৮ই মাঘ দ্বিতীয় স্ত্রীর মৃত্যু হয় এবং অল্পকাল পরেই ২৬শে চৈত্র রবিবার ইংরেজি ১৯৩৯ সালে ১৫ মার্চ কলকাতার বাগবাজারাস্থ বাড়িতে লেখক, সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক জলধর সেনের জীবনদীপ নিভে যায়। মৃত্যুৃকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। জলধর সেনের ব্যক্তিত্ব, সম্পাদক হিসেবে তাঁর দক্ষতা এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ পরবর্তী বাঙালি প্রজন্ম স্মরণে রাখেনি। হাতে গোনা কয়েকজন মনীষী ছাড়া বাঙালি তাঁর পূর্ব প্রজন্মের খ্যাতনামাদের ভুলে যাচ্ছে। আশঙ্কা জাগে, বাঙালি কি সত্যিই বিস্মৃতপ্রায় জাতি!
তথ্যসূত্রঃ ১।জলধর সেনের আত্মজীবনী– নরেন্দ্রনাথ বসু। প্রবর্ত্তক পাবলিশার্স, এপ্রিল ১৯৫৬।
২। উইকিপিডিয়া