বিস্মৃতির অন্তরালে : অক্ষয়কুমার দত্ত – দীপক সাহা

শেয়ার করুন

প্রথম বাঙালি সমাজবিজ্ঞানী অক্ষয়কুমার দত্ত বিস্মৃতির অন্তরালে

(জন্ম:- ১৫ জুলাই, ১৮২০ – মৃত্যু:- ১৮ মে, ১৮৮৬) 

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অক্ষয়কুমার দত্ত বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক। অর্থাৎ তাঁরও দুশো বছর পূর্ণ হল। এ বছর ১৫ জুলাই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ ও প্রথম বাঙালি সমাজবিজ্ঞানী অক্ষয়কুমার দত্তের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে সকল কারণে আমাদের  হৃদয়জুড়ে আছেন ঠিক একই কারণে বা তার চেয়েও বেশি কারণে অক্ষয়কুমার দত্ত প্রাতঃস্মরণীয় হওয়ার কথা। কিন্তু এই মহান মনীষীর আদর্শ, চিন্তাধারা, অক্ষয় কাজ কোন কিছুই আমরা সঠিক মূল্যায়ন করিনি। আজও করছি না। 

অক্ষয়কুমার দত্ত একাধারে গ্রন্থকার, প্রাবন্ধিক, বাংলা গদ্যের রূপকার, দার্শনিক, ফলিত বিজ্ঞান গবেষক, বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক, ধৰ্মীয় ছুঁতমার্গহীন মানুষ। তিনি ছিলেন বিশুদ্ধ জ্ঞানের উপাসক ,তত্ত্বানুসন্ধিৎসু বুদ্ধিমান মানুষ। সমকালীন বিশ্ব মানসিকতা তাঁর মধ্যে সংকলিত হয়েছিল। অগস্ত্যত কোঁৎ-এর প্রত্যক্ষবাদ ও মানবতার আদর্শ, বেন্থাম-মিলের হিতবাদ বা উপযোগাত্মকতা, এমনকি হারবার্ট স্পেন্সারের সংশয় বা অজ্ঞেয়তা পর্যন্ত তাঁর চিত্তে প্রতিফলিত হয়েছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন কঠোর নীতি পরায়ণ, বিনয়ী এবং দরিদ্রের প্রতি দয়াশীল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যথার্থই বলেছেন, “তিনিই বাঙালির সর্বপ্রথম নীতি শিক্ষক।” মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণার কেন্দ্র রূপে তাঁর অকৃত্রিম দানেই গড়ে উঠেছিল আজকের ” ইন্ডিয়ান আ্যসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়েন্স “। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব মনীষীদের সঙ্গে তাঁর ছিল আত্মিক সংযোগ। তাঁর শয়নশিখরে থাকত ডারউইন ও নিউটনের প্রতিকৃতি, ঘরের দেওয়ালে থাকত জ্যোতিষ্ক -লেখা গগনপট, নরকঙ্কাল, এবং পশুপঞ্জর (জাস্টিস সদাচরণ মিত্রের ভাদ্র ১৩১২ বঙ্গাব্দের বঙ্গদর্শনে প্রদত্ত বিবরণ)। 

অক্ষয়কুমার দত্ত

বর্ধমান জেলায় নবদ্বীপের কাছে চুপী গ্রামে ১৮২০ সালের ১৫ জুলাই জন্মেছিলেন অক্ষয়কুমার। পিতা পীতাম্বর দত্ত এবং মাতা দয়াময়ী দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র অক্ষয়কুমার। তাঁর পিতা কলকাতায় পুলিশে চাকরি করতেন। গ্রামের স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর তিনি কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়তে আসেন। কয়েক বছর পড়াশোনা করার পর পিতার মৃত্যু হলে তাঁকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এত দূর পর্যন্তই। পিতার মৃত্যুর পর দারিদ্র্য-দশার ভিতর প্রতিপালিত হয়েছেন। এরপর তিনি অর্থোপার্জনে উদ্যোগী হন। কিন্তু পাশাপাশি অদম্য ছিল তাঁর জ্ঞানস্পৃহা। তাই বাড়িতেই নিজ উদ্যোগে পড়াশোনা চালিয়ে যান। স্কুলের ইংরেজ শিক্ষক বহুভাষাবিদ পণ্ডিত জেফ্রয়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর কাছে গ্রিক, ল্যাটিন, জার্মান, ফরাসি ও হিব্রু ভাষা ছাড়াও শেখেন পদার্থবিদ্যা, ভূগোল, জ্যামিতি, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, সাধারণ বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি। আর আমিরউদ্দীন মুন্সির কাছে শেখেন ফারসি ও আরবি ভাষা। পরবর্তীকালে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক থাকার সময় কিছুদিন তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে গিয়ে অতিরিক্ত ছাত্র হিসেবে উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র ও প্রকৃতিবিজ্ঞান পড়েছিলেন।

ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ গঠন করলে তিনি তার সভ্য হন এবং ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে মাসিক আট টাকা বেতনে ব্রাহ্মদের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক নিযুক্ত হন। এই বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় পাঠদানের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাংলায় এসব বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক না থাকায় তিনি ১৮৪১ সালে ‘ভূগোল’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২১। তখনও বিদ্যাসাগরের কোনো বই প্রকাশিত হয়নি। এই গ্রন্থটি অক্ষয় দত্তের প্রথম গদ্যগ্রন্থ হলেও তাঁর ভাষা পূর্ববর্তী বাংলা গদ্যের তুলনায় অনেক প্রাঞ্জল ও সরল। এই গ্রন্থে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় যতি চিহ্ন ব্যবহার করেন। এই সেই ভাষার নমুনা: ‘পৃথিবীর আকৃতি প্রায় গোল যেমন কমলালেবু গোলাকার। অথচ তাহার বোঁটার নিকট কিঞ্চিৎ নিম্ন, সেইরূপ পৃথিবীও গোল কিন্তু উত্তর দক্ষিণে কিঞ্চিৎ চাপা।’ 

 দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেই তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। আগস্ট ১৬, ১৮৪৩ তারিখে তাঁর সম্পাদনায় ব্রাহ্মসমাজ ও তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপাত্র ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। রচনাসম্ভারে ও পরিচালনার গুণে পত্রিকাটি শ্রেষ্ঠ বাংলা সাময়িকপত্রে পরিণত হয়। যদিও পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মধর্ম প্রচার, কিন্তু অক্ষয় দত্ত ও তাঁর বন্ধু বিদ্যাসাগরের কারণে এটি সে সময়ে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, পুরাতত্ত্ব, ভূগোল,  ইতিহাস ও সমাজ সংস্কার, বিষয়ে একটি অগ্রণী পত্রিকায় পরিণত হয়। স্ত্রী-শিক্ষার প্রসার ও হিন্দু-বিধবাদের বিবাহের সমর্থনে এবং বাল্যবিবাহ ও বিবিধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তিবহুল বলিষ্ঠ লেখাও এতে প্রকাশিত হত। সচিত্র প্রবন্ধও থাকত। নীলকর সাহেব ও জমিদারদের প্রজাপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি এই পত্রিকায় নির্ভীকভাবে লেখনী চালনা করেন। দীর্ঘ বারো বছর তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

হিন্দু বিধবাবিবাহকে তিনি কতটুকু সমর্থন করতেন, ‘ছন্দের জাদুকর’ পৌত্র সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনীতে বর্ণিত একটি ঘটনা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার অক্ষয় দত্তের এক কর্মচারী কয়েক হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। তাঁকে চিঠি লিখে জেল-পুলিশের ভয় দেখালে তিনি জবাবে তাঁকে জানান, ‘আপনি আমাকে বলেছিলেন আমি বিধবাবিবাহ করলে আমাকে পুরস্কার দেবেন। আমি বিধবাবিবাহ করেছি।’ অক্ষয়কুমার খোঁজ নিয়ে জানলেন, সত্যিই তিনি একজন বিধবাকেই বিয়ে করেছেন। তিনি সেই কর্মচারীকে চিঠি লিখলেন, ‘তোমার সকল অপরাধ ক্ষমা করলাম’।’

‘ভূগোল’ প্রকাশের পনেরো বছর পর প্রকাশিত তাঁর ‘পদার্থবিদ্যা’ বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানের বই। এ ছাড়া বিজ্ঞানের ও সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা ‘চারুপাঠ’ (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড) পাঠ্যপুস্তক হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল। এসব গ্রন্থে তিনি বিজ্ঞান ও ভূগোলের অসংখ্য পারিভাষিক শব্দ তৈরি করেছিলেন। মাধ্যাকর্ষণ, আহ্নিক গতি, বিষুব রেখা, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমা, চুম্বক, বিকিরণ, তড়িৎ, সুমেরু, কুমেরু, স্থিতিস্থাপকতা, আপেক্ষিক গতি, ভারকেন্দ্র, দূরবীক্ষণ, অণুবীক্ষণ, জ্যোতির্বিদ্যা, দাহ্য পদার্থ, পরিমিতি, জড়, জোয়ার, রামধনু, ধ্রুবতারা, গ্রহণ, অঙ্গার, বাষ্প, বজ্র, সৌরজগত, মানমন্দির, জ্বালামুখী, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদি অসংখ্য পরিভাষা আজ বাংলা ভাষার অঙ্গীভূত হয়েছে এবং আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছি। বাংলা ভাষা নির্মাণে ও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা প্রবর্তনে অক্ষয় দত্তের যে অবদান, তার গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁর কীর্তির অলক্ষ্য প্রভাব আমাদের ওপর এখনও বহমান। 

অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অপর ২১ জন বন্ধুর সঙ্গে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য এই দলই প্রথম দীক্ষিত ব্রাহ্ম। অক্ষয়কুমার তেইশ বছর বয়সে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীন চিন্তা ও নিবিড় বিজ্ঞানচর্চার কারণে এই সমাজবিজ্ঞানী সব ধরনের ভাববাদিতা ও সংস্কার থেকে মুক্ত ছিলেন। যাত্রার ‘শুভ-অশুভ’ ক্ষণ বলে কিছু যে নেই তা প্রমাণ করার জন্য শাস্ত্রে ‘অশুভ’ এমন দিনক্ষণ দেখে তিনি ভ্রমণে বেরোতেন। অক্ষয় দত্তও হিন্দু ও ব্রাহ্মদের নিকট ঐশ্বরিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত বেদকে মানুষের রচনা এবং সে কারণে অভ্রান্ত নয় বলে ঘোষণা করেন। ব্রাহ্মসমাজে সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষায় ঈশ্বরোপাসনার তিনি অন্যতম প্রবর্তক। পরে তিনি প্রার্থনাদির প্রয়োজন স্বীকার করতেন না এবং শেষ বয়সে অনেকটা অজ্ঞাবাদী হয়ে পড়েন। ধর্ম–সম্পর্কিত এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ব্রাহ্মসমাজের পত্রিকা ‘তত্ত্ববোধিনী’তে কাজ করা অক্ষয় দত্তের জন্য অসুবিধাজনক হয়ে ওঠে। অন্যদিকে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য, প্রচলিত পথের বাইরে হাঁটার জন্য তৎকালীন সমাজপতিরা  তাঁকে একঘরে করার চেষ্টা করেন ও কিছুক্ষেত্রে সফলও হন। 

অক্ষয় দত্তের শিক্ষাচিন্তার আধুনিকতা এবং আজকের প্রাসঙ্গিকতা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। এখন আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে মুখস্থনির্ভরতা থেকে মুক্ত করা নিয়ে চিন্তিত। দেড়শ বছর আগে অক্ষয় দত্ত কী বলেছিলেন শুনুন— ‘কালেজ ও স্কুলে যেরূপ শিক্ষাপ্রণালী ব্যবহৃত হইতেছে তাহা কেবল স্মরণশক্তি উন্নতিসাধনপক্ষে বিশেষ অনুকূল, বুদ্ধিবৃত্তির পরিচালনা ও উন্নতিসাধনের পক্ষে তত অনুকূল নহে। শুনিতে পাওয়া যায় যে, প্রধান প্রধান কালেজের অধ্যাপকেরা ছাত্রদিগকে কোনো প্রশ্ন করেন না। কেবল গ্রন্থের ব্যাখ্যা করিয়া যান, ছাত্রেরা কেবল নোট লয়। ইহাতে বুদ্ধিবৃত্তির কীরূপ পরিচালনা হইতে পারে, পাঠকবর্গ তাহা সহজে বুঝিতে পারেন।’

তিনি চেয়েছিলেন বিজ্ঞানচর্চা সুগম হবে মাতৃভাষায়। সাবলীল হবে অভ্যাস। উনিশ শতকে অক্ষয়কুমার দত্তের হাত ধরেই বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত। এমনকি বাংলাভাষাকে তিনি  বিজ্ঞানচর্চার উপযোগী, দর্শনচর্চার এতটা  উপযোগী করেছিলেন যে অনেক সময় মনে হয় বিদ্যাসাগরের চেয়েও তিনি কয়েক কদম এগিয়ে ছিলেন। পাশ্চাত্যী বেকনীয় দর্শনের অন্যতম গুণগ্রাহী অক্ষয়কুমার দত্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বাংলা ভাষার প্রসারে তিনি যে গুরুত্ব দিতেন, তা অতুলনীয়। তিনিই প্রথম  অফিস–আদালত ও উচ্চশিক্ষাসহ সব স্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের কথা বলেছিলেন। প্রখ্যাত শিক্ষাব্রতী ডেভিড হেয়ারের মৃত্যুর পর তিনি প্রথা ভেঙে বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। 

অক্ষয়কুমার দত্ত বিশেষ করে আমাদের যে ঐতিহ্য সেটা নতুনভাবে বিশ্লেষণ করতে শিখিয়েছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছেন সবটাই আমাদের ধর্মের ঐতিহ্য নয়। আমাদের দেশে যুক্তিবাদের ঐতিহ্য ছিল, নিরীশ্বরবাদের ঐতিহ্য ছিল। যেটাকে আমরা হিন্দু ঐতিহ্য বলছি তারমধ্যেই একটা বড়ো অংশ অনিশ্বরবাদ নিয়ে তিনি আলোকপাত করেছেন। তিনি উদাহরণ দিয়েছেন সাংখ্য দর্শন, মীমাংসা দর্শন যেগুলি খোলাখুলি ঈশ্বরবিরোধী ছিল। 

অক্ষয়কুমার দত্ত শারীরিক অসুস্থতার জন্য বেশি ঘোরাঘুরি করতে পারতেন না। ফলে তাঁর সামাজিকভাবে উপস্থিতি ক্রমশ কমে আসছিল। সেটা অবশ্য সাপে বর হয়েছিল। প্রচন্ড শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চাকুরি করা থেকে বিরত হন ও ১৮৫০ এর দশকে তিনি বালিতে এসে বসবাস করতে শুরু করেন। তাঁর জীবনের শেষ তিরিশটি বছর (১৮৫৬-১৮৮৬) তিনি বালিতে কাটান। আজ দেওয়ান গাজী তালায় যেটি ‘হরমিলার ডক’ বলে পরিচিত, সেটি তাঁর শেষ জীবনের বসতবাড়ি । উদ্ভিদপ্রেমিক অক্ষয়কুমার বাড়িটির নাম দিয়েছিলেন ‘শোভনোদ্যান’। ৩৫ রকমের গাছ , ১৫ রকমের ফুলগাছ, ১৬ রকমের মশলাজাতীয় গাছের কথা পাওয়া যায় এই উদ্যানে। বাড়ির ভেতরে ছিল ভূতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা। জীবাশ্ম, প্রবাল, নানাবিধ পাথর ছিল তাঁর  সংগ্রহশালায়। নিরিবিলি প্রকৃতির সান্নিধ্যে  বালির বাড়িতে বসে নিরলস গবেষণার ভিত্তিতে  আমৃত্যু যে কাজগুলো করে গেছেন সেগুলো আমাদের অক্ষয় ঐতিহ্য, অমূল্য ঐতিহ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমরা তাঁকে উপযুক্ত গুরুত্ব দিইনি, আজও দিচ্ছি না। তিনি যে সময় কালজয়ী কাজগুলো করে গেছেন, তখন বাংলাদেশে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল না এইসব কাজ করার। বালির বাড়িতে এসে  বিদ্যাসাগর রসিকতা করে বলেছিলেন, শোভনোদ্যান হচ্ছে অক্ষয়কুমারের  চারুপাঠ চতুর্থ খণ্ড। নিরিবিলিতে বালির বাড়িতেই রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন এই অসাধারণ বইটির জন্য অক্ষয়কুমার দত্তের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই বইয়ের দুটি খণ্ড এই বাড়িতে বসেই তিনি লেখেন। প্রথম খণ্ড ১৮৭০ সালে প্রকাশিত হয়, দ্বিতীয় খণ্ড তেরো বছর পর ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত হয়। 

অক্ষয় দত্তের এই একখানা মাত্র বই কালের অবলেপন এবং উত্তরসূরিদের অবহেলার কবল থেকে বেঁচে গেছে। আমাদের কাছে তাঁর প্রদত্ত ‘অক্ষয়’-সম্পদ হয়ে টিকে থেকেছে। ভারতবর্ষের উপাসক সম্প্রদায়ের ইতিহাস মানে তো ভারতের যাবতীয় ধর্মীয় সম্প্রদায়েরই ইতিবৃত্ত বর্ণন। মনে হয়, তিনি সচেতনভাবেই ধর্মীয় শব্দটি বাদ দিয়ে উপাসক শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ভারতে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যা নেহাত খুব কম নয়। তিনি হাত দিলেন একশ বিরাশিটি সম্প্রদায়ের কাহিনিতে। পুরোটাই তিনি একা নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে করে সম্পন্ন করেছেন। বইপত্র পড়ার পাশাপাশি সরাসরি ক্ষেত্রসমীক্ষা করে অনেক রকম তথ্য পেয়েছেন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে থেকেছেন, মিশেছেন, কথা বলেছেন, বুঝেছেন। তবে লিখেছেন। এই কারণেই ভারতীয় সমাজ তথা ধর্মীয় সমাজের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সাপেক্ষে বইটির আজও একটি আকর গ্রন্থমূল্য আছে। 

আরও লক্ষণীয়, যুক্তিবাদী বিজ্ঞানলেখক অক্ষয়কুমার দত্ত প্রথম বইটিতে ভারতবর্ষের বহু বিচিত্র ধর্মসংস্কৃতি বিশিষ্ট মানব গোষ্ঠী সম্পর্কে তাঁর বহুদিনের পরিশ্রমজাত ও বৈজ্ঞানিক বিধিসম্মত অনুপুঙ্খ ক্ষেত্রসমীক্ষার ফলাফল লিপিবদ্ধ করেছেন; আর দ্বিতীয় বইতে তিনি তাঁর নিজস্ব দার্শনিক বিচার, ভারতীয় চিন্তাশীলদের বিভিন্ন দার্শনিক মতের পরিচয়, পারস্পরিক তর্কবিতর্ক খণ্ডন-বিখণ্ডন, ভারতীয় প্রাচীন মনন-ঐতিহ্যে নিরীশ্বরবাদ এবং বস্তুবাদের নানা শাখার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, ভারত গ্রিস ও রোমের প্রাচীন সংস্কৃতির মধ্যে ভাষা তথা অন্য নানা বিষয়ে সাদৃশ্য, ইত্যাদি বহু চিত্তাকর্ষক বৌদ্ধিক উপকরণ তুলে ধরেছেন। এখানে আছে শুধু যুক্তিবাদী বিচারধারা নয়, যুক্তিবাদের মননশীল ফসল। এতে পাওয়া যায় শুধু মাত্র বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আবাহনী নয়, আগমনি নয়, তার পাশাপাশি আমরা পাই সমাজ সংস্কৃতি ভাষা দর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অখণ্ড বিজ্ঞানমানস প্রয়োগের ফলস্বরূপ এক উৎকৃষ্ট বিচারপদ্ধতি ও অভাবিতপূর্ব সিদ্ধান্তরাশি। প্রথম বই শেখায়, কোনো একটি সমাজতাত্ত্বিক বিষয়ে কীভাবে তথ্যানুসন্ধান করতে হবে। দ্বিতীয় বই থেকে শেখা যায়, কোনো একটা দেশের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে দীর্ঘপ্রচলিত বিভ্রান্তিগুলিকে কীভাবে কাটানো যায়। বৈদিক সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর স্বাধীন ও মুক্তমন অধ্যয়নের দ্বারা অর্জিত উপলব্ধি তিনি পাঠকের কাছে তুলে ধরেন এইভাবে: “এখন বেদপ্রাণ হিন্দুমণ্ডলি! শ্রবণ কর! তোমাদের প্রাচীন মীমাংসকগণ অর্থাৎ বেদমন্ত্রের মীমাংসাকারী পূর্বকালীন আচার্যগণ না ঈশ্বরই মানিতেন না দেবতাই স্বীকার করিতেন। তাঁহারা নির্দেব ও নিরীশ্বর।” ম্যাক্সমুলার এই বইটি সম্বন্ধে জেনে অক্ষয়কুমার দত্তকে প্রসংসাসূচক চিঠি লেখেন। 

 বিদ্যাসাগর পুরস্কার প্রাপক গবেষক আশীষ লাহিড়ী আক্ষেপ করে বলেছেন,  ‘ভারতীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইটি যদি ইংরেজিতে তর্জমা করা যেত তবে প্রমাণ করা যেত তাঁর চিন্তাধারার স্বাতন্ত্র্য অন্যদের থেকে কতযুগ এগিয়ে ছিল। সেটা সামাজিক দিক থেকে, দার্শনিক দিক থেকে, ইতিহাসের দিক থেকে এমনকি সাহিত্যগত দিক থেকে। বাংলাদেশের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অক্ষয়কুমার দত্ত গবেষক সাইফুল ইসলামের কথায়, আমরা যা কিছু আত্মসাৎ করতে পারি না তা ভস্মসাৎ করার চেষ্টা করি। ওনার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। ওনার পাণ্ডিত্য , অকাট্য যুক্তির জন্য তৎকালীন বঙ্গসমাজ ওনাকে আত্মসাৎ করতে পারেনি।

১৮৮৬ সালে ১৮ মে প্রয়াত হন জ্ঞানতাপস অক্ষয়কুমার দত্ত। ৩৬৭, জিটি রোড, বালি, হাওড়ায় তাঁর সাধের শোভনোদ্যান বাড়িটি এখন ভগ্নপ্রায়, অন্তিম দশা। আজ অবধি কোনো দেখভাল, সংরক্ষণ হয়নি। যদিও ২০০৬ সালে তদানীন্তন রাজ্য  সরকার ‘হেরিটেজ’ -এর একটি ফলক লাগিয়েই তার দায়িত্ব সম্পাদন করে। বর্তমান সরকারও উদাসীন। এখন বাড়িটির অবস্থা করুণ। অতিসত্বর আশু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। বহু স্মৃতিবিজড়িত বর্তমানে জরাজীর্ণ বাড়িটিকে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করে অক্ষয়কুমার দত্তের কাজের উপর একটা গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারলে আপামর বাঙালি তথা ভারতবাসীরই উপকার হবে। 

অক্ষয়কুমার দত্তের ভগ্নপ্রায় বাড়ি

ধর্মতত্ত্ব থেকে ভাষাবিজ্ঞান পর্যন্ত  যে দীর্ঘপ্রকার জ্ঞানভূমির মধ্যে ছিল তাঁর অনায়াস পদচারণা, বাঙালি পাঠককে হাত ধরে সেই জ্ঞানজগতের সিংহদ্বারে তিনিই পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাই তাঁর কাছে আধুনিক ভারতবাসীর ঋণ অপরিশোধ্য। মাতৃভূমি থেকে যাবতীয় অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, কদাচার ও দুর্বলতা দূর করাই ছিল অক্ষয়কুমার দত্তের ব্রত। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, কেন ভারতের বামপন্থী মার্ক্সবাদী যুক্তিবাদীরা এযাবৎ অক্ষয়কুমার দত্তকে বিদ্যাসাগরের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব এবং শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়ে সামনে তুলে আনার প্রয়াস করলেন না? বিনয় ঘোষ, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রমুখর ভারতীয় দর্শন ও প্রাচীন সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে এত ভালো ভালো কাজ আছে, অথচ তাতে অক্ষয়কুমার দত্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেলেন না কেন, “ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়” বইটি কোন জায়গা আদায় করতে পারল না কেন— মনে জাগে বিস্ময় প্রশ্ন। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর মৃত্যুর পর ক্রমে ক্রমে বাঙালিদের চিন্তা জগত থেকে তিনি কার্যত বিস্মৃতির অন্তরালে তলিয়ে গেছেন। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে অক্ষয়কুমার দত্তের আদর্শ ও দর্শন খুবই প্রাসঙ্গিক। বর্তমানে ধর্মীয় উন্মাদনা ও অন্ধবিশ্বাসের গ্যাঁড়াকলে অনেকক্ষেত্রে আমরা আলোর থেকে অন্ধকারের দিকে এগোচ্ছি। এটা যদি ঠেকাতে হয় তবে সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার আমাদের কাছে অক্ষয়কুমার দত্ত।           

বাড়ির হেরিটেজ ফলক

ঋণস্বীকার – সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান ( ১ম খণ্ড), গবেষক আশীষ লাহিড়ী, গবেষক ও শিক্ষক অর্ণব চ্যাটার্জি, শিক্ষক অনু বর্মন, সাহিত্যিক কুশল মৈত্র   

ছবি ঋণস্বীকার – অর্ণব চ্যাটার্জি       

শেয়ার করুন

Similar Posts

3 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *