|

বিচ্ছিন্নতা – সাবা বাবিকের ইব্রাহিম সানহোরি অনুবাদক: রাজীবকুমার ঘোষ

শেয়ার করুন

[ মূল গল্প — ‘আইসোলেশন’। আরবি ভাষার গল্প। লেখিকা সাবা সানহোরি নামেই বেশি পরিচিত। সুদানের লেখিকা, আরবি ভাষায় লেখেন। জন্ম ১৯৯০, সুদানের খার্তুমে। তার ছোটো গল্পগুলি, কবিতা আর ‘প্যারাডাইস’ বইটির জন্য তার পরিচিতি। বহু ভাষায় তার গল্পগুলি অনূদিত হয়েছে। লেখা ছাড়াও তিনি সুদানের নবীন প্রজন্মকে নিয়ে (১৮ থেকে ২৮ বছরের লেখকদের নিয়ে) লেখার ওয়ার্কশপ করেন, যার মধ্যে জেলবন্দী লেখকরাও আছে। এই ওয়ার্কশপের অন্য নানা সংস্থার পাশাপাশি ইতালির দূতাবাসের সাংস্কৃতিক বিভাগ এবং খার্তুমে (জার্মানীর) গ্যেটে-ইনস্টিটিউটের সহযোগীতা আছে। ২০০৯ সালে এই গল্পটি তায়েব সালিহ ক্রিয়েটিভ রাইটিং পুরস্কার পায়। ২০১৩ সালে গল্পটি নিয়ে একটি শর্ট মুভিও হয়েছে। ২০১৯ সালে তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল, নাম ‘প্যারাডাইস’। মূল আরবি থেকে ম্যাক্স শুমখের এবং নাজলা এলটম কৃত ইংরাজি যে অনুবাদ, তা থেকে বাংলার অনুবাদ করা হয়েছে। ম্যাক্স শুমখের কমম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, সুদানের সমসাময়িক সাহিত্য নিয়ে, আরবি ভাষা নিয়ে তার কাজ। বহুবছর তিনি কায়রোতে থেকেছেন এবং মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে বেড়িয়েছেন। নাজলা এলটম সুদানের লেখক ও অনুবাদক। ]

খুব গরম, দম আটকে যাবার মতো গরম। চারটে দরজা আর বারোটা জানালা নিয়ে আয়তাকার একটা হলঘর। মাঝখানে এই টেবিলটা ছাড়া আর কিছুই নেই। টেবিলটার ওপর আমি শুই। হলঘরের প্রতি দিকেই একটা করে দরজা। প্রস্থ বরাবর দুই দেয়ালে দু’টো করে জানালা, মাঝে একটা দরজা। দৈর্ঘ্য বরাবর দেওয়াল দু’টোর একটায় দরজার বাঁদিকে দু’টো জানালা আর অন্যটায় দরজার ডানদিকে দু’টো জানালা।

শহরটা একেবারে খালি — এই কথাটা ভাবলেই মাথায় রাগ চড়ে যাচ্ছে। এই হলঘরে আমি একা, একা এই টেবিলটার ওপরে, একা এই শহরে। আমি, একাকী, একমাত্র একজন — মৃত্যু যার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখায়নি। আমি, নিঃসঙ্গ আর এখন গা বিছিয়ে পরে আছি টেবিলটার ওপরে। এই টেবিলেই আমি ডুবে যেতে থাকি, মিশে যেতে থাকি। টেবিলের কাঠের তক্তাগুলো যেন আমার হাড়ের মজ্জা হয়ে ওঠে। এই অবস্থা থেকে উঠতে হলে অসম্ভব চেষ্টা করতে হবে, অনেকটা যেভাবে সাপ তার খোলস থেকে বেরিয়ে আসার জন্য হাঁচোড়-পাঁচোড় করে। আমি ওঠার জন্য ভীষণরকম চেষ্টা করতে থাকি। আচ্ছা কোথায় আমি আমার বাক্সটা রেখেছিলাম? আশ্চর্য! ওটা নিশ্চয়ই বাইরে কোথাও আছে। টেবিলটা হলঘরের মাঝামাঝি, তাহলে আমাকে দৈর্ঘ্যের দিকের দু’টো দরজার কোনো একটা দিয়ে বেরোতে হবে। প্রস্থের দিকের দরজার কোনো একটা দিয়ে বেরোতে গেলে সেটা তুলনায় দূরে হয়ে যাবে, আমাকে দ্বিগুণ প্রচেষ্টা করতে হবে।

ভেতরের মতোই বাইরেও গরম। আহা, এই তো এখানে বাক্সটা, দরজার পাশেই উবু হয়ে যেন বসে আছে। আমি জানিনা ওটা কোথা থেকে এসেছিল। আমার চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি একটু একটু করে ফিরে আসছিল, তাই মনে পড়ল বাক্সটায় ছিল সযত্নে সংরক্ষিত করা বহুকালের পুরনো দুর্মূল্য সব মদের বোতল। অবশ্য সে সব মদের কোনো প্রভাব পড়েনি আমার ওপর। কোনো কিছুই আর প্রভাব ফেলতে পারবে না। ভেতরে ভেতরে কোথাও একটা আশা ছিল যদি এই মদ আমার কিছু উপকারে লাগে, যদি আমার কোনো কিছু মনে পড়তে সাহায্য করে। যে কোনো কিছু, যাই হোক কিছু। অন্তত যদি আমি মনে করতে পারি — আমি আসলে কে, আমার নাম কী, আমি কোথা থেকে এসেছি। বাকি সবাই বা কোথায় গেল আর তারা কারা হতে পারে।

খুব গরম, দম আটকে যাবার মতো গরম। এই জায়গাটাই যেন দুনিয়ার একমাত্র জায়গা যেখানে সূর্যকে আগুন ঢালার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আর হাওয়ার অবসর নেওয়ার বয়স হয়ে গেছে, হয়ত সে এর মধ্যে মরেও গেছে। আমি একটা বোতল টেনে পান করতে শুরু করলাম। শেষ হলে বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। এখনো আমি পুরো হুঁশে আছি। আমার মাথায় একটা ভাবনা আসল, হয়ত আমার শহরটা ঘুরে দেখা দরকার। আমি রাস্তা ধরে চলতে শুরু করলাম। লোকজন সব কোথায় গেল? আমার খুব আশ্চর্য লাগছে। আমি খুব আশা করছিলাম অন্তত একটা জীবিত কোনো প্রাণী সামনে আসুক, একটা লোক অথবা একটা পশুই হোক, গৃহপালিত বা বন্য যা খুশি — কোনো অসুবিধা নেই। আমিই বা এখানে কেন একা পড়ে আছি?

শহরটা নিশ্চল, স্তব্ধ। একমাত্র যে শব্দ আমার কানে আসছে তা আমারই বুকের ধুকপুক শব্দ। একটা বাড়িতে আমি ঢুকে পড়লাম সহজেই, দরজা আটকানো ছিল না। ঘরটায় আলো আঁধারি থাকলেও চোখ চলছিল। আহা, কী সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র ঘর জুড়ে! দেওয়ালে ঝোলানো কয়েকটা ছবির দিকে আমার নজর গেল। মনে হল ছবিগুলো সব একই পরিবারের সদস্যদের। আহা! যুবকটি কী সুদর্শন! আর এনারা নিশ্চয়ই ওর মা-বাবা? তাই তো মনে হচ্ছে। কী আশ্চর্য! ওরা সব এখন কোথায়? হঠাৎ একটা হিমশীতল অনুভূতি আমায় গ্রাস করল আর আমি বাড়িটা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে চাইলাম।

আমি রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। রাস্তার দু’ধারে বাড়িগুলো নিথর, নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে। দাঁড়াও, ওখানে ওটা কী? একটা হাওয়াকল, কী পরিহাস! হাওয়াকলটা মনে হয় হাওয়া যখন অবসর নেয়নি সেই সময়ের। তখন নিশ্চয়ই হাওয়া এখানে বইত। ভেতরে কি কেউ আছে? আমি উঁকি দিলাম, মাকড়সার জাল চারিদিকে কিন্তু সেই জালগুলোও মনে হচ্ছে পরিত্যক্ত। কোথায় মাকড়সাগুলো? আমি এদিক-ওদিক মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম। কয়েকটা ময়দার বস্তা পড়ে আছে, একটা পাত্রে না ভাঙানো কিছু শস্যদানা। কারো অবশ্যই এখানে থাকা উচিত ছিল। অদ্ভুত যে এখানে কেউ নেই, একজনও নয় এমনকি একটা মাকড়সাও নয়। একটা ইঁদুর দেখলেও শান্তি পেতাম। আমি তোমাদের দেখা পেতে চাইছি, দয়া করে সাড়া দাও। আমি প্রাণপণে চেঁচাতে চাইলাম যতটা আমি গলা তুলতে পারি, সব ক্ষমতা দিয়ে। দাঁড়াও, আমি খুব লোভী হয়ে পড়ছি কি? অনেকের দেখা পাবার আশা করছি! ঠিক আছে অত লোভ করছি না, অন্তত একজনের দেখা পেলেই আমার চলবে, একজন সাড়া দিলেই হবে। বেশ, আমি ডাক ছাড়তে চাইলাম … কিন্তু হে ভগবান, আমি কেন চেঁচাতে পারছি না? শব্দরা আমার মধ্য থেকে কেন বেরিয়ে আসতে পারছে না? একটা একটা করে অক্ষরগুলো উচ্চারণ করলেই তো হবে কিন্তু দাঁড়াও আমি কোন ভাষায় কথা বলব? আমি জানি আমি অবশ্যই কথা বলতে পারি, আমি নিশ্চিত, কারণ আমি সবসময় এই ভাষাতেই তো ভাবি, চিন্তা করি। যদিও আমি শুধু নিজের সঙ্গেই কথা বলেছি আর নিজের সঙ্গে কেই বা জোরে কথা বলে। আমি কি এই জন্যই ভয় পাচ্ছি, যে আমাকে লোকে পাগল বলবে অথবা এই জন্য যে, আমার এই গোপন কথাটা কেউ জেনে যাবে? আমি নিশ্চয়ই চাইনা যে লোকে আমাকে পাগল বলুক। আচ্ছা ওদের আমার সামনে আসতে দাও, আমাকে বলুক পাগল তবু আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাব।

আমি তো জানি, কেউ যদি নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে তাহলে লোকে আড়ি পেতে তা শুনবেই শুনবে যাতে তার সম্পর্কে বেশ গল্প ছড়ানো যায়। আমার বোধহয় দুনিয়ার সব ভাষায় কথা বলা দরকার আর যতটা পারি চেঁচিয়ে উঁচু গলায় বলা দরকার, মানুষ নিশ্চয়ই ছুটে আসবে। কিন্তু এখন এসব ভেবে কিছু হবে না। আমার শেষ আশাটাও চলে গেল, আমি আমার বাকশক্তি হারিয়েছি অনন্তকালের জন্য। কী যে হারালাম! একটা কন্ঠ তো লোকজনকে আকর্ষিত করে ঠিক যেমন মধুর টানে পিঁপড়ে আসে। আরে! আমি কি এইমাত্র ‘মধু’ শব্দ উচ্চারণ করলাম? আহা! আমার মনে পড়ল যে বাড়িটায় আমি ঢুকেছিলাম সেখানে মধু দেখেছিলাম। দারুণ! মধু … পিঁপড়ে, আমি তাহলে উপায় পেলাম। বেশ। আমি হাওয়াকল ছেড়ে যে পথে এসেছিলাম সেই পথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে চললাম। বাড়ির দরজা ঠেলে সবেগে ঢুকে পড়লাম। মনে করার চেষ্টা করতে থাকলাম কোথায় মধুটা দেখেছিলাম। এই তো এখানে। আমি মধু নিয়ে বেরিয়ে আসলাম। খুব শক্ত করে জারের মুখটা বন্ধ ছিল কিন্তু এটা কোনো সমস্যা নয় বিশেষত এমন একজনের কাছে যে সব আশা হারানোর মুহুর্তে সহসা অপ্রত্যাশিতভাবে একটা আশার ঝলক দেখতে পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আমি এখন একটা পাহাড়ের চেয়েও শক্তিশালী। ঢাকনাটা আমার হাতের মধ্যে খুলে গেল। আমি মধুর স্বাদ নিলাম — খারাপ নয়। এখনো মধুর মতোই স্বাদ আছে। আমি মধুর জারটা আঁকড়ে রাস্তায় ফিরে দৌড়াতে থাকলাম। হাতের জার থেকে মধু পড়ে যাচ্ছিল, আমি পড়তে দিলাম। মধু শেষ হয়ে আসল। ঠিক আছে, আমি যতটা জায়গা জুড়ে ছড়াতে পেরেছি তাতে কাজ হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

এবার আমি পিঁপড়েদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। আশা করা যায় ওরা বেশি সময় নেবে না। অবশ্যই আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না, আমি জানি পিঁপড়ের দলের ওই সরু সরু পিঁপড়েগুলোর ঘ্রানশক্তি সবচেয়ে জোরালো। ওরা ঠিকই মধুর গন্ধ পাবে আর অন্য পিঁপড়েদের খবর দেবে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমি পিঁপড়ের দেখা পাব। যখন ওরা আসবে, ছোট্ট ছোট্ট জ্যান্ত অপূর্ব সেইসব পিঁপড়েদের দেখে, অন্য এক জীবিত প্রাণীকে দেখে আমার আর আনন্দের সীমা থাকবে না। শেষ পর্যন্ত আমি তাদের পায়ের নড়াচড়ায় প্রাণের প্রবাহ দেখতে পাব। আমাকে অবশ্যই বসে অপেক্ষা করতে হবে। সূর্য দিগন্তে ঢলে পড়ছে, পিঁপড়েদের এখনো কোনো দেখা নেই। ঠিক আছে, অসুবিধা নেই, আমি অপেক্ষা করব। অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার মতো কাজও নেই।

অপেক্ষা করতে হবে। ওরা আসবেই। আমি জানি পিঁপড়ে কখনো মধুর প্রলোভন উপেক্ষা করতে পারে না। আমি তাই অপেক্ষা করতে থাকলাম।

আমি অনেক্ষণ বসে রইলাম। শেষে যখন সূর্য কাজ সেরে একেবারে বিদায় নিচ্ছে, তখন আমি বুঝতে পারলাম আমার আর অপেক্ষা করার উপায় নেই। আমাকে ফিরে যেতে হবে আমার কাঙ্খিত সেই টেবিলের কাছে। টেবিল ছাড়া অন্য কোথাও রাত কাটানো আমার কাছে অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আমার পিঠে আমি যেন সেইসব ঘায়ের যন্ত্রণা অনুভব করতে পারছি যেগুলো তৈরি হয়েছে ব্যবচ্ছেদের ফলে। পিঠ থেকে টেবিলকে যেন ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে। ফেরার সময় পথের গোলমাল হয়নি। শেষ পর্যন্ত আহা! আমার টেবিল। আমি আবেগে টেবিলকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম, টেবিলের চারদিকের প্রতিটা দিককে এক এক করে জড়িয়ে ধরলাম, চুম্বন করলাম আর তারপর বরাবর যা করে এসেছি তাই করলাম। নিজেকে বিছিয়ে দিলাম টেবিলের ওপরে। শেষ পর্যন্ত একধরণের শান্তি আর নিরাপত্তা আমার চেতনায় নেমে আসল, সেইসব কল্পিত ঘায়েদের যন্ত্রণাও আর টের পাচ্ছিলাম না।

আচ্ছা যুদ্ধ কি এই অঞ্চলকে ছুঁয়ে গেছে? যদি তাই হয়, ধরে নিলাম সবাই যুদ্ধে মারা গেছে তাহলে আমিই বা বেঁচে গেলাম কীভাবে? আর মৃতদেহগুলোই বা কোথায় গেল? যদি বহুকাল আগে এই যুদ্ধ হয় তাহলেও তো দেহের কিছু না কিছু অবশেষ পড়ে থাকবে অন্তত হাড়গোড়গুলো তো থাকবেই। আবার সেইরকম ঠান্ডা এক অনুভূতি আমার গ্রাস করল। একটা গোপন কথা বলেই দিই, যখন গরম বাড়তে বাড়তে আমার রাগকে তাতাতে শুরু করে তখনই আমি এইসব কথা ভেবে এই ঠান্ডা অনুভূতিটা তৈরি করি, এতে গরমটা অনেক সহনীয় হয়ে যায়। আমি রীতিমতো এই ব্যাপারটা উপভোগ করি। আমার মনে হয় এই কৌশলটা কাজে লাগাতে লাগাতে আমি শেষ পর্যন্ত এটাতে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছি। কিন্তু আমার ভয়ও হয়, আমি বোধহয় এটা করতে গিয়ে আমার মস্তিষ্কের কিছু কোষকে প্রতিবার ধ্বংস করে ফেলছি। এভাবেই মনে হয় একদিন কৌশলটার লাগাম আমার হাতছাড়া হয়ে যাবে। যখন সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার এক মনোভাব আমাকে গ্রাস করে তখন এটা শুরু হয়।

আবার একবার আমি এই হলে একা, টেবিলের ওপর, এই শহরে আমি একা — এমন একজন মৃত্যুও যার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এখন গা বিছিয়ে পরে আছি টেবিলটার ওপরে। এই টেবিলেই আমি ডুবে যাচ্ছি, মিশে যাচ্ছি। টেবিলের কাঠের তক্তাগুলো যেন আমার হাড়ের মজ্জা হয়ে উঠছে।

আর শেষ পর্যন্ত আমি এই সিদ্ধান্তে এলাম, আমি যখন এই শহরে কথা বলার মতো কাউকে পেলাম না তখন আমার সঙ্গী খোঁজার জন্য অন্য পথ বার করতে হবে। ভাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঠিক করলাম যে আমি নিজেকে দু’টো কাল্পনিক অস্তিত্বে ভাগ করে ফেলব। একটা হবে ‘আমি’ আরেকটা ভাগ হবে ‘সে’। এই ‘সে’ হবে ওই মদের বোতলের গায়ে আমার প্রতিচ্ছবিটার মতন। তাহলে, হে আমার সপ্রতিভ বুদ্ধিমান সঙ্গী কী নামে তোমাকে ডাকা যায়?

“আমার সত্যিই কোনো ধারণা নেই এখন কী ধরণের নাম চলছে” আমি বললাম, “কিন্তু তোমার কেমন লাগবে যদি আমি হই ‘আমি’ আর তুমি হও ‘সে’?”

আমি তার মুখে, কাঁচের গড়নের মতো ঢালের ওপর রাগের আভাস ফুটে উঠতে দেখলাম।

সে বলল, “আমি কেন ‘আমি’ হব না আর তুমি ‘সে’?”

“কারণ বন্ধু আমিই হলাম আসল।”

“না। আমিই হলাম আসল আর আমাকে ছাড়া তোমার কোনো অস্তিত্বই নেই।”

“বেশ। রেগে যেও না, হে প্রিয় অস্তিত্ব। তোমার চেয়ে আমার অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান অনেক বেশি। তাছাড়া আমি বিষাদ, ভয়, আতঙ্ক, বিছিন্নতার অনুভবের মধ্য দিয়ে এসেছি। এই ধরণের ছোটোখাটো তুচ্ছ ব্যাপার পাত্তা দিই না। ঠিক আছে, আমি হব ‘সে’ আর তুমি হবে ‘আমি’। এবার তুমি খুশি?”

“এখনো অনেক কটা ব্যাপার ঠিক করা বাকি।”

“কী বলতে চাইছ?”

“সব চেয়ে আগে, ওই মদের বোতলগুলো আমার চাই।”

“কী!”

“না দিলে তুমি আর আমায় দেখতে পাবে না আর আবার একাকীকত্ব তোমায় ঘিরে ধরবে।”

“এটা ব্ল্যাকমেল ছাড়া আর কী! আচ্ছা ঠিক আছে ওগুলো নাও।”

“আর, আমার প্রিয় বন্ধু, তোমার জন্য একটা নতুন কোনো শোবার জায়গা খুঁজে নাও, এখন থেকে এই টেবিলে আমি শোব। উঠে পড়ো হে।”

“না উঠলে কী? টেবিলের দিকে হাত বাড়িও না, স্বপ্নেও নয়! টেবিল আমি দেব না। আমারই একটা অংশকে আমি ছাড়তে পারি কি? তুমি এটা বুঝতে পারছ না?”

“কিন্তু তুমি তো ওটা থেকে বিযুক্ত তো হয়েই গেছ ঠিক যখন তুমি আমাকে অস্তিত্ববান করেছ। আমার মনে হয় টেবিলটাকে ছেড়ে দেওয়া তোমার পক্ষে আর শক্ত হবে না। তাছাড়া তুমি তো আমাকে তোমার একটা অংশ দিয়েও দিয়েছ।”

“না, তুমি আমার কোনো অংশ নও। এই টেবিলটা বরং আমার অংশ। টেবিলটাই আমার বাবা, মা আমার পরিবার, টেবিলটাই আমি। তুমি কিচ্ছু নও, তুমি শুধু একটা ভ্রান্তি, কাঁচের ওপর একটা প্রতিচ্ছবি।”

সত্যি সত্যিই সে বিভ্রান্ত হয়ে গেল আর আমি একের পর এক মদের বোতলগুলো তার দিকে ছুঁড়ে দিলাম। চিৎকার করে বললাম, “বেরো, কিম্ভূত গ্যাদগ্যাদে মাল, জাহান্নমে যা।” ওটা, যেটা আমার মতোই দেখতে সেটা মিলিয়ে গেল। আমি টেবিলের দিকে একটা কোমল চাউনি দিলাম, দ্রুত গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

“ভয় পাস না, কোনো কিছুই তোকে আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না, মৃত্যুও না। তুই ভালোভাবেই জানিস মৃত্যু না পারবে আমাকে গিলতে না পারবে হজম করতে। আমার মতোই তুই-ও এখানে খাপছাড়া, তাই তো তোকে এত ভালোবাসি।”

প্রথমবারের মতো আমি গভীর এক ঘুমে ডুব দিলাম আর স্বপ্ন দেখতে থাকলাম। স্বপ্নে দেখছিলাম আমি যেন লোককথা-পুরাণের সেই ছেলেটা, যে সমুদ্রের জলের ওপর ফুটে ওঠা তার প্রতিবিম্বে বিভোর থাকত। আমার স্বপ্নে অবশ্য সমুদ্রের কাছেই আমি টেবিল থেকে ঝুঁকে সমুদ্রের জলে দেখছি আমাদের ফুটে ওঠা প্রতিবিম্ব—টেবিলের আর আমার। ঈশ্বর ছেলেটাকে শাস্তি দিয়েছিলেন, তাকে একটা ফুল করে দিয়েছিলেন, যা রয়ে গেছে নিশ্চল। সেই একই ঈশ্বর আমাদের বেলায় আমাদের বানিয়েছেন দু’টো ফুল।

ঘুম ভাঙার পর ছাদের দিকে তাকিয়ে খানিকটা সময় কাটালাম। মেজাজটা বেশ শরিফ ছিল। একটু পরেই অবশ্য ধীরে ধীরে ফুরফুরে ভাবটা চলে গেল। আসলে এই হলঘরে আমি তো একা, একা এই টেবিলটার ওপরে, একা এই শহরে। আমি, একাকী, একমাত্র একজন—মৃত্যু যার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখায়নি। আমি, নিঃসঙ্গ আর এখন গা বিছিয়ে পরে আছি টেবিলটার ওপরে। টেবিলেই আমি ডুবে যেতে থাকছি, মিশে যেতে থাকছি। টেবিলের কাঠের তক্তাগুলো যেন আমার হাড়ের মজ্জা হয়ে উঠছে।

আমি সেই সুখকর অনুভূতিটা ফিরিয়ে আনতে চাইলাম, যে অনুভূতিতে মিশে আছে সুগন্ধ… কীসের! আমি জানি না! আমি চেষ্টা করছি কিন্তু বোধহয় আর মনে পড়বে না। বেশ, এখনো আমার কিছু স্বপ্ন আছে। না, আমি ওইরকম কোনো বস্তুতে পরিণত হতে চাই না। যদিও মনে হচ্ছে এখন আর কোনো উপায় নেই। ব্যাপারটা খুব একটা খারাপও নয়। আমি এখন একদলা সবুজ বস্তু, একটা জঘন্য, বেহুদা বস্তু। কোনো প্রাগৈতিহাসিক, সান্দ্র, এককোষী জীব। আমার দু’টো প্রকাণ্ড থকথকে চোখ আছে যার সাহায্যে আমি মাথা না নাড়িয়েই ডান আর বাঁদিকে তাকাতে রাখি — পলকহীনভাবে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *