ভোজ কয় যাহারে (সপ্তদশ পর্ব) : ওল- সত্যম ভট্টাচার্য
সেই যে আছে, যা আমরা বঙ্গসন্তানেরা সবাই প্রায় পড়েছি ছোটবেলায়, বর্ণমালা মুখস্থ করবার সময়-
ওল খেও না ধরবে গলা
ঔষধ খেতে মিছে বলা…
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ছড়াটির লেখককে কোনোদিন কি ওল খেয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিলো? হয়তো তাই। না হলে কেন এমন একটি চমৎকার সবজিকে তিনি এমন ভাবে দেগে দেবেন যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বড় হবে একটি সবজি সম্পর্কে দুর্নাম শুনে যা আবার পরবর্তীতে গিয়ে তাদের খেতেই হবে, কারণ প্রতি বছরই এমন একটি সময় আসে যখন নিরামিষ খাবার বলতে হাতে পড়ে থাকে শুধু এই ওল। কারণ, পটল ঝিঙে খেতে খেতে ততদিনে আমাদের সকলের প্রায় একপ্রস্থ দফারফা হয়ে গিয়েছে।
আবার কথায়ও আছে- যেমন বুনোওল তেমনি বাঘা তেঁতুল, এখন এই ছড়াকারের যদি কোনোদিন ওল খেয়ে গলা চুলকেই থাকে, তাহলে অবশ্যই সেটি বুনোওল ছিল বলেই ধরে নেওয়া যায়। কারণ বাজারে ওল বলতে যে গোলাকার, চ্যাপ্টা পৃথিবীর মতো জিনিসটি বিক্রি হয়, যা কাটলে ভেতরটি সুন্দর ক্রিম কালারের দেখায়, তা খেয়ে আমার তো কেন, আমার আশেপাশের কারুরও কোনোদিন গলা চুলকেছে বলে শুনিনি। তা হলে এক্ষেত্রে ছড়াকারেরই চয়েসের ভুল ছিল বলে মনে হয় আর সেকারণেই এমন একটি নিরীহ সবজিকে তিনি এমনভাবে কাঠগড়ায় বসিয়ে দিয়ে গেলেন। ক্ষমতা হাতে থাকলে মানুষ কি না করতে পারে। আচ্ছা এই লাইনটি যাকে নিয়ে ছড়াকারকে গালমন্দ করে চলেছি তিনি কি যোগীন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন? কে জানে? ঠিক মনে পড়ছে না।
যাই হোক অদ্যাবধি যা বলেছি এই হিসেবে আমাকে যদি ওলবাদী হিসেবে ধরে নেওয়া যায়, তাতে আমার কোন অসুবিধা নেই। এখন এই ওলের একটা বিশাল এডভান্টেজ হচ্ছে যে ওল দিয়ে রাঁধা তরকারিটি নিজে থেকেই বেশ ঘন হতে থাকে এবং একটু মশলাপাতি ব্যবহার করেই একে বেশ রিচ করে রান্না করা হয়েছে বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। যেটা অন্য নিরামিষের ক্ষেত্রে হয় না। পটলের ডালনা নিজে থেকে জমে ঘন হয় না। এমনকি নিরামিষের যে কুলীন, পনীর, তারও এই জন্মগত ক্ষমতা নেই।
এর মধ্যেই কোথায় যেন পড়ছিলাম যে জেলে প্রতিদিন খাবার দেওয়া হত এই ওলের ঝোল আর ভাত। এতসব পজিটিভ জায়গা থাকবার পরও ওলের কিন্তু সেই কপাল মন্দই থেকে গেলো। আবার বেশ কয়েকজন এমন লোকের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে যারা ওলের নাম শুনলেই নাক সিঁটকোয় আর এই সকল লোকের মধ্যে একটা ফ্যাক্টর কমন, তাদেরকে দীর্ঘদিন হোস্টেলে কাটাতে হয়েছে যেখানে নিরামিষ মানেই ওলের ঝোল।
এবারে আসি সে কথায় যে ওল কিভাবে তরিজুত করে খাওয়া যাবে। ওলের তো মূল খাবারই হচ্ছে ওলের ডালনা। এছাড়া খেয়েছি বা খাই ওলসিদ্ধ। আর ওল কোনোভাবে খাওয়া যায় কি না তা আমার জানা নেই। এবারে এই ওলের ডালনাকেই কিভাবে আরেকটু স্বাদু করা যায় তার জন্য মা হাজাররকম চেষ্টা চালাতেন। না হলে নিরামিষের দিনগুলো তিনি পার করবেন কি করে প্রতিবাদহীন ভাবে?
মানে ওল আর তার সাথে আলু, এই দুটোকে ছক্কার থেকে একটু বড় করে কেটে নিয়ে আদা জিরে বাটা সম্বারে রান্না করা। তো এই করতে করতেই একবার মা ওলের ডালনাতে দিলেন বাদামবাটা । মানে বাদামকে শুকনো কড়াতে ভেজে নিয়ে তার খোসা ছাড়িয়ে সেটাকে পেস্ট করে ডালনাতে দেওয়া। চমৎকার একটা স্বাদ ও গন্ধ হল এবং দীর্ঘদিন মা ওলের ডালনাতে বাদামবাটা দিয়ে নিরামিষের দিনগুলো উতরে গিয়েছেন।
যাই হোক, ভাতে ওল সিদ্ধ দিয়ে খেতে বসার আগে তাকে ভাত থেকে বের করে কাঁচাতেল আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে মেখে খেতে কি যে স্বাদ, তা একমাত্র জিভের সঠিক ব্যবহার যারা জানেন তারাই বলতে পারবেন। তাই দুর্নামের ভাগী হলেও ওল কিন্তু খেতে খারাপ নয় মোটেই।