ভোজ কয় যাহারে (একাদশ পর্ব) : কাকরোল – সত্যম ভট্টাচার্য
যেকোনো জিনিসের ক্ষেত্রেই মনে হয় যে আমরা পরিশ্রম করতে খুব একটা পছন্দ করি না। মানে এটাই স্বাভাবিক যে মস্তিষ্কই মানুষকে চালিত করে সেই পথে যে পথে পরিশ্রম কম করে সহজে উতরে যাওয়া যাবে। এইজন্যই মনে হয় যে ধরা যাক ২৫শে বৈশাখ বা অন্য যে কোনো ওই ধরনের মনীষীর জন্মদিনে আমরা তাঁকে নিয়ে যতটা আবেগে গদগদ হয়ে কথা বলি তার সিকিভাগও তার লেখা খুব একটা বেশি মন দিয়ে পড়িনি। কারণ লেখালেখি পড়তে গেলে তার একটা পরিশ্রম আছে। তার থেকে অনেক সোজা সকালে সেজেগুজে সুন্দর একখানা শাড়ি পড়ে বা পাঞ্জাবি গলিয়ে তাকে নিয়ে আবেগে গলা কাঁপিয়ে বক্তৃতা করা। তাই আমরা সহজটাই করি।
আর মস্তিষ্ক যা করবে তা তো শুধুমাত্র এক জায়গায় করবে না। তা সবেতেই করবে। তাই এই সূত্র জীবনের সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। শুধু শিল্পসংস্কৃতির ক্ষেত্রেই মানুষ যে এরকম ওপরচালাকি করে পার পেয়ে যাবার চেষ্টা করে তা কিন্তু নয়। রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই। যতদিন যাবে এই ওপরচালাকি তত বাড়বে।
আমাদের ছোটোবেলায় শীতকালে ফুলকপির ডাঁটার চচ্চড়ি ছিল একটি পরম উপাদেয় বস্তু। সেই ডাঁটার সঙ্গে লম্বা সরু ফালি করা আলু সর্ষে দিয়ে গরম ভাতে যারা খায়নি তারা সে স্বাদ কল্পনাও করতে পারবে না। অথচ এই প্রজন্মের অনেক বাচ্চাকেই এইসব পদের কথা খেয়েছে কি না জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে না। কারণ যত দিন যাচ্ছে আমরা চালাক হচ্ছি আর একই সাথে পরিশ্রমবিমুখও। অবশ্য সাথে সাথে একটা কথাও এখন উঠে আসবে যে ভয়ানক পরিমাণে রাসায়নিক সারের ব্যবহারের কারণে এখন এসব জিনিস না খাওয়াই ভালো। এই কথাও ঠিক।
যাই হোক, মূল কথায় আসা যাক। অনেক গৌরচন্দ্রিকা হয়েছে। ভ্যানতারা করলে আবার পরে করা যাবে। আজকের আমাদের আলোচনার সবজি কাকরোল। বস্তুটির গরমকালে বাজারে আগমন ঘটে এবং প্রথম প্রথম গরম ভাতে গোল চাক চাক ভাজা খেলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু দিন তো সবার এক যায় না। এই দুনিয়ায় সবার জীবনে সাধারণত ল অব এভারেজ মেইন্টেন হয়। সবজির ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। ওমন সুন্দর সবজি যে কাকরোল দুদিন পরে যখন তাকে পাঁচমিশেলি সবজিতে দেওয়া হয় তখন কিন্তু আর ততটা ভালো লাগে না।
তখন আমাদের মফঃস্বল শহরটিতে শ্যামলছায়ার কবিতার আড্ডা জমজমাট। শহরের আমরা তো আছিই। দূর থেকে এই জগতের কেউ শহরে আসলেও সে চেষ্টা করে এই আড্ডাতে একবার ঘুরে যেতে। কবি প্রবীর রায় তখনও অবসর গ্রহণ করেননি এবং তার বিদ্যুৎ দপ্তরের উচ্চপদস্থ চাকুরিরত হবার সুবিধা তিনি না নিলেও আমরা বেশ ভোগ করি। কেউ এটা সেটা খাদ্যদ্রব্য উপঢৌকন দিলে প্রবীরদা বড়োই বিড়ম্বনায় পড়ে যান। কিন্তু আমরা তার যোগ্য সদব্যবহার করি।
তো এরকম এক রোববারে প্রবীরদার অফিসের গাড়ির ড্রাইভার দেখলাম টিফিন ক্যারিয়ারে কিছু একটা নিয়ে এসে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। খানিক পড়ে প্রবীরদাও বাড়ির ভেতরে গেলেন। আমরা সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি যে আমরা কিছুর ভাগ পাব কি না। বাড়ির ভেতরে একটা চাপা শোরগোলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
অবশেষে আমাদের সবার জন্য এল। ড্রাইভার ভদ্রলোক কাকরোলের পুর বানিয়ে এনেছেন বাড়ি থেকে আর প্রবীরদার বাড়িতে এভাবে যে কাকরোল খাওয়া যেতে পারে তা জানত না। তাই উত্তেজনা। আমাদের কারুর বাড়িতে এভাবে কাকরোল খাওয়া জানত কি না জানা নেই, তবে আমার বাড়িতে বিলক্ষণ জানত। রোববারের পাঁঠার মাংসের সাথে এই পদটি আমার মায়ের আমলে ছিল কমন। বহুবছর পর এই পদটি সেদিন মামাবাড়িতে খেতে পেয়ে মন ভরে গিয়েছে।
কাকরোলটিকে অর্ধেক করে তাকে সেদ্ধ করে ভেতরের সমস্ত কিছু বের করে তার সাথে সর্ষে পোস্ত লঙ্কা বেটে পুর বানিয়ে সেটাকে কাকরোলের খোলের মধ্যে দিয়ে তাকে ব্যাটারে ডুবিয়ে ভাজতে হবে।ভাজার আগে গায়ে একটু হাল্কা করে পোস্ত লাগিয়ে নিলে ভালো। গরম গরম তার স্বাদ, আহা!