বারীনদার সঙ্গে – স্বপন রায়
(কবি বারীন ঘোষাল, ১৯৪৪-২০১৭, এখানে ছিলেন, এই জীবনে। চলে গেলেন। ২৯ অক্টোবর,২০১৭। আমার স্মৃতি অনেক। এখানে কিছু দিলাম। মানুষের মত মানুষ ছিলেন। আর একটা পাসওয়ার্ড পকেটে নিয়ে ঘুরতেন। ভালবাসা। সবাইকে বিলিয়ে দিতেন বলে, সবার কাছে, সব পরিচিতদের কাছে রয়ে গেছে, একটুকরো ভালবাসাই। আমার কাছেও আছে। আমি চাপকান্নায় ধুয়ে তাকে সাফ সুতরো রাখছি। কাউকে দেয়ার সময় যেন মালিন্য না থাকে। অমলিন হাসি হেসেই তো বারীনদা ছড়িয়ে দিত ভালবাসাগুলো..)
১.
১৯৯৩। আমার বাড়ির গৃহপ্রবেশ। খড়গপুরের বাড়ি। অর্থাভাবে প্লাস্টার করতে পারিনি। একটি মাত্র ঘর পুরোটা হয়েছে। আমি কবিদের ডেকেছিলাম। কবিতা পড়ে ঘরে ঢুকবো। আমার পুজো। ধীমান, অলোক, প্রণব, রঞ্জন আর বারীনদা। একটা ৪০ ওয়াটের বাল্বের আলোয় সারারাত কবিতা পড়া হল। আমার ঘর শুদ্ধ হয়ে উঠছিল কবিদের উচ্চারণে। আমি তখন একটা এক কামরার ঘরে ভাড়ায় থাকতাম। একটা ছোট স্পেস ছিল তার সঙ্গে। লাগোয়া রান্নাঘর। ওই স্পেস জুড়ে একটা চৌকি। সেখানে দু/তিন ধরে কবিতার ওয়ার্কশপ। বারীনদা থাকতোই। তার সঙ্গে আমরা। ওই যাদের কথা উপরে লিখলাম। আমার ছেলের বয়স তখন তিন। শ্রীলার ২৩/২৪। ও এতগুলো লোকের রান্না, জলখাবার জানিনা কোন মন্ত্রবলে জানিনা, ঠিক সামলে দিত। গৃহপ্রবেশের দিন শ্রীলা আমাদের খাইয়ে ফ্লাস্কে চা দিয়ে ছেলেকে নিয়ে ভাড়াবাড়িতে চলে যাওয়ার পরে বারীনদা আমায় বলেছিল, যদি কোনদিনও শুনি ওকে (শ্রীলাকে) তুই কষ্ট দিয়েছিস তাহলে তোর সঙ্গে আমি কোন সম্পর্ক রাখবো না। আমি জানিনা শ্রীলাকে কষ্ট দিয়েছি কিনা। কিছুতো দিয়েইছি। তবে আজো আমরা লড়ে যাচ্ছি একসঙ্গে। যেদিন বারীনদার খবর এল, শ্রীলা সারাদিন কেঁদেছে, আর আমি….
২.
দার্জিলিং মেল। জলপাইগুড়ি থেকে ফিরছি। আমি, রঞ্জন, ধীমান, বারীনদা। একে একে প্যাসেঞ্জাররা আসছে। যে যার সিট দেখে নিচ্ছে। কেউ টান টান করছে নিজেকে। মেয়েদের মধ্যে পা ব্যথা থেকে ঠোঁট পরিচর্যার নানা অভিব্যক্তি। আমাদের সিট ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কে বলেছিল মনে নেই, মালদা স্টেশনে নাকি পেপার রোটি পাওয়া যায়। কাগজের মত পাৎলা। ঝাল তরকারি, আলুর। তাই রাতের খাওয়ার নেয়া হলনা। নিজেদের মধ্যে গল্প করছি, তখন দু’জন হাল্কা লাগেজ নিয়ে আমাদের ওখানেই এল।
-হেলো! বলল বারীনদাকে। বারীনদা দেখছে, আমরা দেখছি। সাইজ। ১২০ কেজি তো হবেই। সঙ্গের লোকটি হাসল। সে অসাধারণ নয়, ওজনে।
বারীনদা জিগগেস করল, শিয়ালদা?
-হ্যাঁ দাদা, শিয়াল দাদার কাছেই।
ওজনে আছে আবার রসিকতাতেও।
-আপনারা?
-ওই আপনার দাদার কাছেই, বলল বারীনদা
লোকটি পুরো ওজন কাঁপিয়ে হাসল।
-আপনার সঙ্গে জমবে মনে হচ্ছে!
জমানোর যা কিছু লোকটির কাছেই মজুদ। সৌরভের ছক্কা থেকে পুল করার কোমরের না নড়া, মুখ্যমন্ত্রীর দাড়ি, প্রধানমন্ত্রীর হাসি, রফি আর মান্না দে’র ঘুড়ি ওড়ানো। ক্রমাগত চলছেই। বারীনদা কয়েকবার বলল, এবারে ঘুমিয়ে পড়ুন।ঘুম যে কতটা ভয়ানক হতে পারে ট্রেনে এবার শুরু হল সেই গল্প। মালদা এল। সেই পেপার রুটি আর ঝাল তরকারি খাওয়া হল। অত্যন্ত বাজে। যাইহোক ট্রেন আবার চলছে। লোকটা মালদার আমি নিয়ে পড়েছে এবার। আমি বারীনদাকে বললাম, তুমি শুয়ে পড়ছো না কেন? -আমার নাক ডাকে, তো এ আমার উল্টোদিকে, যদি ঘুমোতে না পারে? -আরে দূর, ও যখন শোয়ার শোবে, তুমি ঘুমোও… বারীনদা আর দেরী করেনি। আমরাও। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা। প্রবল আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। আওয়াজ বলে আওয়াজ। সমুদ্রের গর্জন, পাহাড়ের অ্যাভালাঞ্চ, সাপের হিসহিস মেশানো ঐ মারাত্মক আওয়াজ শুনে উপরের বার্থে উঠে বসে নিচে তাকালাম। দেখি রঞ্জন, ধীমান, বারীনদা সহ আশেপাশের সবাই জেগে বসে আছে। বারীনদা ঈশারায় পাশের বার্থটা দেখালো। আমি ঝুঁকে দেখলাম সেই ১২০ কেজির বিশাল ভূঁড়ি হাপরের মত উঠছে, নামছে। আর লোকটা নাক দিয়ে মুখ দিয়ে সমুদ্রের গর্জন, পাহাড়ের অ্যাভালাঞ্চ, সাপের হিসহিস উগরে দিচ্ছে। নাক ডাকা, মুখ ডাকা আর ঐ বেলি থুড়ি ভূঁড়ি ডান্স….ট্রেনের আওয়াজও লজ্জা পেয়ে স্তিমিত এখন। আর আমরা শব্দাতঙ্কে যে যার বার্থে বসে আছি…এভাবেই ভোর হল। সঙ্গী লোকটার মনে হয় অভ্যাস আছে। সে পাশের ক্যুপে ছিল। হাই তুলে বলল, সুপ্রভাত। বারীনদা জিগগেস করল, ঘুম হয়েছে? -দারুণ। আপনার? -নিদারুণ বারীনদার কথা ঠিক বুঝল না মনে হয়। গর্জনরত বন্ধুকে ওঠালো। বন্ধু উঠেই একগাল হাসি। গুড মর্নিং এভরিবডি। আমরা উত্তর দিইনা। লোকটা আবার বলল, গুড মর্নিং! আমি নিচেই আছি তখন। বললাম, গুড নাইট! লোকটা না বুঝতে পেরে তাকালো। বারীনদা বলল, সারারাত ঘুমোয়নি তো, এবার ঘুমোবে -সেকি কেন? বারীনদা এবার হাসল।লোকটিও হাসছে। হাসি, হাসি আনে।বলল, হাসছেন যে? -আপনার নোজডাস্ট দেবেন একটু? -বুঝলাম না, লেগডাস্ট বলছেন নাতো? লেগডাস্ট নিয়ে প্রচুর গল্প আছে। বারীনদা ওকে থামিয়ে বলল, আমি নোজডাস্টই বলেছি। কাল সারারাত আপনার নাক আমাদের ঘুমোতে দেয়নি, এমন নাক তো লাখে একটা দেখা যায়, একটু নাকধুলো পেলে লকারে রাখতাম আরকি! লোকটি লজ্জা পেয়ে গেল। বলল, আরে এ জন্যই তো আমি ঘুমোই না, সবার শেষে ঘুমোই যাতে কারো ডিস্টার্ব না হয়…কিন্তু ইয়ে হয়…মানে কন্ট্রোল হয়না আরকি…হে হে.. আমি বারীনদার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। কাল রাতে বারীনদা সবার শেষে শুতে চাইছিল। যদি নাকডাকায় কারো ঘুম ভেঙে যায়! বারীনদাও হাসছে। ওইসময়ে আমরা জেনে গেছি, ঘুম সবার, ঘুম ভাঙানিয়া এখানে একজনই…
৩.
বারীন দা বলল, এই হলো পুটুস ফুল, দেখেছ শেখর দা?
দলমা পাহাড় এই ঢাবাকে ছুঁয়েই উঠে গেছে।আমি তো হাতীদের মোবাইল কথাবার্তাও শুনতে পাচ্ছি। যখন একটু টলায়মান বারীনদা (বারীন ঘোষাল) শেখর দাকে (শেখর বসু) পুটূস ফুল চেনাচ্ছিল, কমল দা (কমল চক্রবর্তী) সেই কবেকার বাজাজ স্কুটার থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলো, কিরে আছে তো?
এক সর্দারজী কি বুঝলো কে জানে, আমাদের উত্তর কেড়ে নিয়েই বলে উঠল, ও জী..চলে আও.. ভরপুর হ্যায়। কমল দা প্রায় উড়ন্ত ভাংড়ার মুদ্রায় সর্দারের কাছে পৌছে গেল। আমি একটু দূর থেকে দেখছিলাম। সর্দার হাসছে, কমল দা হাসছে, পেগ উড়ছে। অভীদা (অভী সেনগুপ্ত) আর রঞ্জন হঠাৎ কিছু একটা গেয়ে উঠতেই কমলদা উঠে এলো, আমায় বলল, স্বপন কেলো হয়ে গেছে একটা বুঝলি…বলতে বলতেই রঞ্জনকে উৎসাহ দিল, ইয়েটা গা না., ওইযে তুই যেটা গাস, আমার মল্লিকা বনে…তারপর আমায় বলল, ওই সর্দারজী কি কবি? তোরা ডেকেছিস?
-আমরা? আমি তো ভাবলাম তোমার দোস্ত! যে ভাবে একগাল হেসে প্রায় উড়ে চলে গেলে। কমলদা বলল, আরে আমি কি জানি? আমি তো সরদারকে বলছি, কবিতা শুনাও তো গুরবানী শোনাচ্ছে। তো আমিই ওকে আলফাল কয়েকটা শুনিয়ে দিতে ও তেড়েফুঁড়ে গাইতে আরম্ভ করে দিল, ম্যায় কহিঁ কবি না বন যাউঁ তেরে প্যার মে এয় কবিতা…
আমরা হাসতে থাকি, সর্দার তাকায়, সেও হাসে। বলে, আরে শায়র দাদা চলে আও…প্রনবদা (পাহাড়ু প্রণব দে) বলে, সর্দার তোমায় প্রেম সে ডাকছে, চলে যাও…
কমল দা বলল, মাথা খারাপ, আমার একটাই ইয়ে…নে নে ঢাল….
আকাশটিপসি। এই শব্দটা আমায় পেয়ে বসেছে। শীতের দল্মাভাবিত ঢাবায় আমি, ধীমান, রঞ্জন, বারীনদা,শেখরদা, অভীদা, অলোক, প্রণবদা আর কমলদা। এইতো কবিতার দুরাচারী নির্জনতা, দল্মার ঢালে যে রোদের ছলাং তার অনেকটাই নিচে এসে চ্ছল চ্ছল,কবিতা পড়ার সময় কাৎ হয়ে পড়ে যাচ্ছে প্রায় স্বনির্ভর হয়ে। বিলম্বেই তার লীয়মান পড়ে যাওয়া, টিপসি!
তখনকার কৌরব আমার বা আমাদের (কবিতা ক্যাম্পাস তখন মধ্য গগনে) পান্থতায় এক অনিবার্য সখা ছিলো, বারীন ঘোষাল। সে এক আশ্চর্য দোস্তানা। এই দল্মা হাইরোডের ঢাবা তার সাক্ষী। আর সাক্ষী সেই পি/১৪ নম্বরের কোয়ার্টার। টেলকোয় বারীন দার ঠেক। আজ সকাল থেকেই শেখর দা যাই যাই করছিল।এখন হাসছে। তুচ্ছ যাওয়ার কথা না ভেবে, কলকাতায় পত্রিকা দপ্তরের জরুরী কাজের কথা ভুলে গিয়ে, হাসছে। কারণ সস্ত্রীক পৌঁছে গেছে বুলা। মণি দার (গৌতম চট্টোপাধ্যায়) ভাই। গান বাজছে দল্মার অববাহিকায়, আর আমি গড়ে উঠতে দেখছি একটা কমনরুম, ডুরে কমনরুম!
সোনালি, দুধেলি জলের মিশ্রিত নেশার ক্যাটালগ পেরিয়ে সেদিন সারারাত আড্ডা হয়েছিল বারীনদার ওখানে। বুলার ইনোভেটিভ গানের ভেলায় রাত বাড়ে, একে একে যোগ দেয় যাদব দত্ত, দোলন, দেবজ্যোতি দা। শেখরদা বলে দেয়, আমি কলকাতায় যাবো না। আমি এখানেই থাকবো..
রাত টিপসিনাশক নয়, মোহিনী যদিও! জামশেদপুর আমায় ঋণী করতে থাকে….
৪.
বারীনদা একটু আবছা কি এখন? কুয়াশা নাকি? কুয়াশা কেবিন, দেখতে পেলে? জিগগেস করলাম।
হিলে, সিকিম। মনে পড়লো। একটা আলগা মেঘ আমাদের পায়ের নিচে ভাসাভাসি করছে। আর কুয়াশার দলা মাথার ওপরে। ‘the author enters into his own death, writing begins..’ এখানেও বার্থ কথিত হাঙ্গামাটা শুরু হবে নাকি? হিলের উচ্চতা ৯০০০ ফুট। এখানেই? লেখকের মৃত্যু তার উপাদানে সেঁধিয়ে থাকে। তাকে শুষে নেয় চরিত্র, সময়, চরিত্রদের স্বভাব, উচ্চারণ, আঘাত, প্রতিঘাত। লেখক অক্ষিপটল তোলে। অভিমন্যু সিনড্রোম। আজ নিচের মেঘে, উপরের কুয়াশায় যাবতীয় শোষকের আয়োজন দেখছি যেন। লেখকের, কবির কাছে তার লেখা চাইছে এই মেঘকুয়াশার যুগলসন্ধি। লেখো নইলে হারিয়ে যাও, ভার্সের রাস্তা উপরে ডাকছে।
বারীনদা বলল, তোরা যা। এই হাঁটু নিয়ে আমি যেতে পারবোনা।
-চেষ্টা করো, বললাম, কিছুটা ওঠো।
চেষ্টা করল। অল্প উঠতেই কুয়াশা মেঘের শ্বাসান্বিত দরজায় কড়া নাড়ছে, দেখলাম। সবাই আবছা তখন।কবি, পরিব্রাজক সবাই। লেখা আর লেখক মুছে যাচ্ছে। শ্লেটে পরিষ্কার কালো। যে কেউ লিখতে পারে। যে কেউ। ইনহিবিশন বাদ দিয়ে, যাবতীয় অর্জন বাদ দিয়ে। আমার সাহস হলনা। চাইছিলাম কিছু লিখি। আবার নালেখা রাস্তাটা ডাকছে। যৌন যৌন। হাঁটার অপেক্ষায় সে, সুরভি লুঠের ডাক নিয়ে। তো, এরপরে সব শাদা-অন্ধকারে ডুবে যায়। বারীনদা বলে, আমি কবিতা লিখি তার চেয়ে, তোরা যা…আমরা লুঠেরারা অগত্যা হাঁটা শুরু করলাম। বারীনদা পাহাড়ের গায়ে আটকানো চৌকিদারের কুঠিয়ায় বসে লিখবে বলে আজ মেঘ বলছে যাবো যাবো, কুয়াশা বলছে যাই। কিন্তু যাচ্ছেনা কেউ। কবির মৃত্যু হয়, যখন লেখে। জন্মে ওঠে কবি আবার লেখার পরেই, সে বার্থ সাহেব যাই বলুন না কেন! বারীনদা ফিরে যাচ্ছে লেখকের মৃত্যুর দিকে। সেখানে বসে লিখবেঃ
‘যতক্ষণ আলো আছে ততক্ষণ পাখি
ওরা কি আলোর পাখি
বাদবাকি বিরক্ত জীবন
অতএব কী ভীষণ পাখির উপমা
মানায়না আর কাকলি
মানুষকে আর মানায়না, মানুষের ছেলেমেয়েদের
তার চেয়ে শব্দের পাড়ায়
জলের দাগ, নৌকো, এই অন্ধকার থেকে
কি করে হারায় তারা পথ, বাল্যকাল
বলা ভাল
দু একটা আলো আসে
দু একটা পথের জন্য আসা’