পুজোয় ভ্রমণ: বারাণসী ধাম – অর্কব্রত চট্টোপাধ্যায়
বলা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম জনপদ কাশী। শিবের ত্রিশূলের উপর এর অবস্থান। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম হলেন বিশ্বনাথ। এহেন কাশীতে প্রায় ৮০০০০ বাঙালির বাস, সেখানে যে শিবের ঘরনি দুর্গাকে একটু বিশেষ আদর-আপ্যায়ন করা হবে এটা তো বলাই বাহুল্য। দুর্গাপুজোর সময় বেনারস স্টেশন থেকে যত গোধূলিয়ার দিকে এগিয়ে যাবেন তত বুঝতে পারবেন হাওয়ায় এক স্বর্গীয় সুগন্ধ ভাসছে। ধূপ, ধুনো, কর্পূর, ঘি, সমিধ মিশ্রিত সেই গন্ধ। বাঙালিরা যখন দুর্গাপুজোয় মেতে ওঠে, অবাঙালিদের তখন চলে নবরাত্রি। সে আপনি ধার্মিকই হোন আর নাস্তিকই হোন মনটা এক অদ্ভুত আবেগে প্লাবিত হবেই। তবে বেনারসে বাঙালি রীতির দুর্গাপুজোও খুব জনপ্রিয়। ১৭৭৩ সালে বাঙালি রীতিতে দুর্গাপুজো শুরু করেন জমিদার আনন্দময় মিত্র।
যদি কখনও পুজোর সময়ে বেনারস যেতে চান পঞ্চমী বা ষষ্ঠীর রাত্রে বেনারস বা মোগলসরাই-গামী যে-কোনো ট্রেন ধরে পরেরদিন সকালে পৌঁছে যান। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ুন দুর্গা কুণ্ড মন্দিরের উদ্দেশ্যে। পুজো দেওয়া তো আছেই, উপরি পাওনা হিসেবে পেয়ে যাবেন একটা প্রাচীন ঐতিহ্যকে। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে নাটোরের রানি ভবানী এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরের সঙ্গে যে কুণ্ড রয়েছে তা সরাসরি গঙ্গার সঙ্গে যুক্ত।
দেবী ভাগবত পুরাণের ২৩ তম অধ্যায়ে আছে— কাশী নরেশের কন্যা শশীকলা বারাণসী যুবরাজ সুদর্শনের সঙ্গে গোপনে প্রণয়াসক্ত হন। কিন্তু এসব ঘটনা না জেনেই কাশী নরেশ তাঁর কন্যার সয়ম্বর সভা আমন্ত্রণ করেন। সয়ম্বর সভায় তো মহা ধুন্ধুমার। শশীকলা সুদর্শনকে মালা দেওয়ায় বাকি পাণিপ্রার্থীরা তাদের উপর আক্রমণ করেন। কথিত আছে, সেই সময় সুদর্শন সিংহবাহিনী দেবী দুর্গার স্মরণাপন্ন হলে দেবী সেখানে প্রকট হন এবং সুদর্শনকে বিপন্মুক্ত করেন।
দুর্গামন্দির ঘুরে এসে দুপুরবেলা যেতে পারেন পাঁড়ে ধর্মশালার দিকে। বাঙালি খাওয়া-দাওয়ার সুযোগ পাবেন। এই ধর্মশালাতে ঢুকলে মনে হবে চলে এসেছেন ১৯০০ সালের কোনো এক জমিদার বাড়ির ঠাকুর দালানে। তিনদিক ঘেরা বারান্দা আর তার পিছনে ঘর, সেখানে মায়ের পুজো হচ্ছে। পাঁড়ে ধর্মশালার ঠিক কাছেই হরসুন্দরী ধর্মশালা। সেখানেও ঘুরে আসতে পারেন।
এরপর বেড়িয়ে পড়ুন যে-কোনো দিকে। চারদিক আলো করে আরাধনা চলছে ভবর ঘরে ভবানীকে। ও হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে আপনার গৃহিণী নেই তো! বেনারসে কিন্তু কলাবউকে লালপাড় সাদা শাড়ি পরানো হয় না, বেনারসিই পরানো হয়। গোটা শহরে কম-বেশি তিনশো-র উপর দুর্গাপুজো হয়। একটা জিনিস লক্ষ করবেন দুর্গাপুজো নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে যে সেন্টিমেন্ট কাজ করে, ঘরের মেয়ে উমা চারদিনের জন্য এসেছে বাপেরবাড়ি, এমনটা আপনি এখানেও পাবেন। এখানে মহালয়া থেকে ঘরে ঘরে নবরাত্রি পালন শুরু হয়ে যায়। পিতৃপক্ষের পরে দেবীপক্ষের শুরুতে শুভশক্তির আরাধনাই এই নবরাত্রির উদ্দেশ্য। দক্ষিণ কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গাতে যেমন থিমের পুজোর রমরমা তেমনটা কিন্তু এখানে নয়। বরং উত্তর কলকাতা এবং মফস্বলের পুজোর সঙ্গেই বেনারসের পুজোর মিল পাবেন। বলা হয় বাঙালিরা যেখানেই বসতি স্থাপন করে সেখানেই আবেগ দিয়ে ভক্তি দিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতির বাতাবরণ তৈরি করে নেয়, সে দিল্লিই হোক, চেন্নাই বা ব্যাঙ্গালোর অথবা লন্ডন, প্যারিস বা ইউএসএ হোক। বেনারসেও দেখি সন্ধেবেলা মণ্ডপে দেবীর সামনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। ধুনুচি নাচ, মোমবাতি জ্বালানোর প্রতিযোগিতা, প্রেসিডেন্টের মেয়ে বা সেক্রেটরির বউয়ের বেসুরো গলায় গান, সব মিলেমিশে আপনিও ফিরে যাবেন আপনার শৈশব বা কৈশোরের কোনো স্মৃতিতে।
পরের দিন সকালে বেরিয়ে পড়তে পারেন বিন্ধ্যাচলের উদ্দেশ্যে। বেনারস থেকে ৬৩ কিমি দূরত্বে দেবী বিন্ধ্যবাসিনী বিরাজমানা (বিন্ধ্যাচল ও রামনগর বা সারনাথ যাবার জন্য গোধূলিয়া থেকে গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। তবে অবশ্যই আগের দিন রেট ও সময় কনফার্ম করে নেবেন)। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত দুর্গা সপ্তশতীতে উল্লেখ আছে মহিষাসুরকে বধ করার সময়ে দেবী অনেকগুলি রূপ ধারণ করেন, তার মধ্যে একটি হল দেবী বিন্ধ্যবাসিনী। অথবা যেতে পারেন গোধূলিয়া থেকে দেড়-দুই কিমি দূরত্বে রামকৃষ্ণ মিশনের পুজো বা সিগরা-তে ভারত সেবাশ্রমের পুজোতে অংশ নিতে। দুপুরে গেলে সেখানে চমৎকার ভোগ খেতে পারবেন। খাওয়া-দাওয়ার প্রসঙ্গে বলি, ভালো কচুরি খেতে চলে যান বিশ্বনাথ মন্দিরের গলিতে। এখানে ভালো রাবড়িও পাবেন কিন্তু সকালে না খেয়ে রাত্রিবেলা রাবড়ি চেখে দেখুন। আলাদাই মজা। আর আছে পান। মজার ব্যাপার বিশ্বনাথ মন্দিরের কাছে বেশিরভাগ পানের দোকানের মালিকই বাঙালি।
বেনারসে এসে একদিন ভোরবেলা চলে যান দশাশ্বমেধ ঘাটে। নৌকা ভাড়া করে প্রথমে যাবেন অহল্যাবাঈ ঘাট, কেদার ঘাট, নারদ ঘাট পেরিয়ে হরিশ্চন্দ্র ঘাট অব্দি তারপর সেখান থেকে চলুন রাজেন্দ্র প্রসাদ ঘাট, মানমন্দির ঘাট, ললিতা মন্দির ঘাট পেরিয়ে মণিকর্ণিকা ঘাট পর্যন্ত। যদি ভালো মাঝি হয় সে আপনাকে দেখাবে কিশোর কুমারের বাড়িটাও। প্রত্যেকটা ঘাটের আছে ইতিহাস, আছে গল্প। ভোরের সূর্যের আলো ধীরে ধীরে পুব দিক থেকে বারাণসীর ঘাটগুলোতে পড়ছে। আর সেই সঙ্গে দেখবেন কেউ স্নান শেষে সূর্যপ্রণাম করছে, কেউ স্নান করছে, কেউ বা স্নান সেরে তিলক কাটছে, আবার কোনো সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা গান গাইতে গাইতে হেঁটে চলেছে তীর বরাবর, অথবা কোনো বিদেশি ট্যুরিস্টের ক্যামেরার সামনে পোজ দিচ্ছে এক জটাধারী সাধু। সব মিলিয়ে চলমান ছবি যেন। দূরে দূরে ভেসে বেড়াচ্ছে আরও আরও নৌকা, বজরা। ঘাটের লোকদের কী কী কাজ করতে দেখেছে তার একটা নম্বর দেওয়া লিস্ট করতে গিয়ে ১১৩-তে থেমে গেছিল তোপসে। সেটা ফেলুদা পড়ে বলেছিল “দিব্যি হয়েছে— কেবল গোটা ত্রিশেক বাদ পড়েছে।” আপনিও যখন যাবেন খুঁজে দেখবেন কটার লিস্ট বানাতে পারেন।
তবে এখন বেনারস গেলে একটা চমৎকার দৃশ্য উপভোগ থেকে বঞ্চিত থাকবেন। বিজয়া দশমীর বিকেলবেলা ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ ঘাটে ভারত সেবাশ্রমের সন্ন্যাসীদের লাঠি খেলা, ছুরি খেলা, তরোয়াল নৃত্য এবং বজরায় রয়েছে ভারত সেবাশ্রমের প্রতিমা। আর পাশেই দশাশ্বমেধ ঘাটে আরেকটি বজরার উপর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিমা উপবিষ্টা। ঠিক সন্ধে ছটার সময় ঘাটে যখন গঙ্গারতি শুরু হত, তার সাথে একই তালে বজরার উপর আশ্রম ও সংঘের সন্ন্যাসীরা করতেন প্রতিমা বিসর্জনের আরতি। আরতি শেষে বজরা এগিয়ে যেত মাঝনদীতে। হত প্রতিমা নিরঞ্জন। এরপরই বেনারসের ঘাটগুলোতে ভিড় করে আসে অন্যান্য বারোয়ারি পুজোর প্রতিমা। তারপর নৌকা করে কিছুদূর গিয়ে একেবারে ঝপাং। এখানে ইছামতীর মতো অত দৃষ্টিনন্দন ভাসান আপনি দেখতে পাবেন না। কত বিচিত্র রকম ভাসান দেখেছি বেনারসের গঙ্গায়। একবার একাদশীর সকালে দেখেছিলাম একটা বড়ো নৌকাতে পঞ্চাশ-ষাট জন লোক বসে আছে। একজন ঠাকুরের কাঠামোর দড়িটা টান করে ধরে রেখেছেন আর চার-পাঁচ জন করাত নিয়ে কেটে যাচ্ছে কাঠামোর নীচের কিছুটা অংশ। এভাবে কাঠামোর কিছুটা রয়ে যাবে নৌকাতে আর মা চলে যাবেন গঙ্গাগর্ভে।
আরেকবার দেখেছিলাম একটা ট্রাক্টর এসে থামল একটা ব্রিজের মাঝ বরাবর। কিছু বোঝবার আগেই ট্রাক্টরের ডালা খুলে ব্রিজের উপর থেকেই মাঝগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হল ঠাকুর। ড্রাইভারের সাথে কথা বলে বুঝলাম কম বাজেটের পুজো বলে গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত যাওয়া, নৌকা ভাড়া করা সবটাই তাদের কাছে বাহুল্য।
২০১৩-তে এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে গঙ্গাতে প্রতিমা বিসর্জন বন্ধ হয়ে গেছে। ২০১৬-তে যখন শেষবার বেনারস যাই এই নিয়ে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে প্রচুর অভিযোগ দেখেছিলাম। এটাও শুনেছিলাম বেশ কিছু পুজো কমিটি গত দু-বছর বিসর্জনের এই সমস্যার জন্য প্রতিমার বদলে ছবিতে বা ঘটে পুজো করেছিল। বেশ কয়েকবার পুজোয় বেনারসে গিয়ে দেখেছি ওখানে দশমী বিহিত পুজো সমাপ্ত হওয়ার পরেই শুরু হয়ে যায় প্রতিমা বরণ ও মহিলাদের সিঁদুরখেলা। বরণের সময়ে এয়োস্ত্রীরা একটি ছোটো ঘটে জল নিয়ে গিয়ে প্রতিমার সামনে যে মঙ্গলঘট থাকে সেখানে ঢালে আবার সেই মঙ্গলঘট থেকে কিছুটা জল নিয়ে বাড়ি ফেরে পরিবারের মঙ্গল কামনায়।
বেনারসের বারোয়ারি পুজোগুলোর মধ্যে বাঙালিটোলার কাছে গোল্ডেন স্পোর্টিং ক্লাবের কথা না বললেই নয়। বহুচর্চিত এই পুজো। বেনারসের ওই সরু গলির মধ্যে প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ টনের প্রতিমা পুজো হয়। দশমী থেকে দ্বাদশী সারা বেনারসের ঠাকুর ভাসান হওয়ার পরে ত্রয়োদশীর দিন এই ঠাকুর ভাসানের অনুমতি মেলে। প্রথমে মাউন্টেড পুলিশ, তারপর র্যাফ, ইউপি পুলিশ আর শোভাযাত্রার শেষে থাকে কমব্যাক্ট অ্যাকশন ফোর্স। এদের প্রোটেকশনে ভেলুপুরা থেকে মদনপুরা হয়ে গলিপথ ধরে প্রতিমা এসে পৌঁছায় গোধূলিয়া লংকা রোডে, এই ৬ কিলোমিটার রাস্তাটা অত্যন্ত সংবেদনশীল। প্রতি বছর বিজয়া দশমীতে কয়েক হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন এই শোভাযাত্রায়। কোনোরকম অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর জন্য প্রশাসন থেকে এতটা দায়িত্ব নেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও, বেশ কয়েকবার তুচ্ছ কারণে মারাত্মক গোলযোগ হয়ে গেছে। এরপর রাত বারোটার সময় যখন গোধূলিয়ার মোড়ে ঠাকুরকে ঘোরানো হয়, পুরো বেনারস ভেঙে পড়ে প্রতিমাকে শেষ দর্শনের জন্য।
বেনারস ছাড়বার আগে ঘুরে আসতে পারেন কেদারনাথ মন্দিরের কাছে দুর্গাবাড়ি থেকে। শোনা যায় একবার ভাসানের সময় দেবী স্বপ্ন দেন তাঁকে বিসর্জন না দিয়ে সারা বছর শুধুমাত্র ছোলা-গুড় দিয়ে পুজো করলেই হবে। প্রায় তিনশ বছর এই প্রথা চলে আসছে।
তবে হ্যাঁ, এবার তো আপনাকেও ফিরতে হবে নিজের ঘরে। বাড়ি ফেরবার আগে গোধূলিয়া থেকে যে রাস্তাটা কাল ভৈরবের মন্দিরের দিকে গেছে, সেদিকে একটু এগিয়ে গেলেই দেখবেন রাস্তার ধারে অনেকগুলি প্যাঁড়ার দোকান। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর জন্য প্যাঁড়া কিনতে ভুলবেন না।
শেষের বিসর্জনের ছবিটি ছাড়া বাকি সমস্ত ছবির স্বত্ব লেখকের।
খুবই মনোগ্রাহী লেখা ! ছেলেবেলায় গেছি ! এ লেখা পড়ে আবার বেনারস যেতে ইচ্ছে করছে ! একটাই অনুরোধ, মনমতো থাকার জায়গা’র হদিশ চাই ! এমন প্রাঞ্জল লেখা আজকাল বিরল !
প্রাঞ্জল.. সহজ বিস্তার।
বেনারসে বছর খানেক আগেই ঘুরে এসেছি। একটা অদ্ভুত অনুভূতি ঘিরে থাকে এখানে থাকার সময়ে সেই অনুভূতি টা এই লেখাটা পড়ে আবার ফিরে পেলাম। পুজোর সময়ে এখানে ঘুরতে আসার পর কিভাবে পুরো সময়টা সুন্দর করে গুছিয়ে ঘোরাঘুরি করা যায় সেটার জন্য বেস্ট গাইড। খুব খুব ভালো লাগলো এতো সুন্দর informative লেখা পেয়ে। শুভেচ্ছা নিস ❤️