আত্ম-প্রতিকৃতির আমি তুমি – গৌতম চক্রবর্তী
ছবিটাকে মাথার ভেতরে নিয়ে আমি হেঁটে চলি। একটা ঘর; ঘরের ভেতরকার একটা অংশ; যেখানে একটা জানলা আছে, জানলার নীচে আর পাশে থাকা সীমাহীন দেয়ালের আভাস আছে, যেমনটা আর দশটা গড়পড়তা বাড়িতে দেখা যায়; অনেকটা যেমন শহর বা শহরতলির আমার বা আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের, চেনা মানুষজনের বাড়িতে বছরের পর বছর দেখেছি, গিয়েছি কিংবা থেকেছি, ঠিক সেরকম। বিড়বিড় করে নিজের মনে কথাগুলো বলছিলাম আর ছবিটাকে দেখে ভেতরে-ভেতরে কেন এতটা অস্থির হয়ে পড়েছি সেটা বোঝবার চেষ্টা করছিলাম।
‘আমি একজন ক্লান্ত ছাপোষা মানুষ।’ নিজের ঘরে, যে ঘর জুড়ে কেবল দেয়াল আছে আর একটা জানলা; যে জানলা আমি আজ-কাল রাতের বেলা সবসময় বন্ধ রাখি আর দিনের বেলায় বেশির ভাগ সময় থাকি না বলে বন্ধ থাকে, তার পুরোনো মেঝে; – যে মেঝের রং একসময় কী ছিল আজ আমার আর মনে নেই, সেই মেঝের ওপর পায়চারি করতে করতে অস্ফুট স্বরে বলে উঠি।
আর ছবিটাকে মাথার ভেতরে নিয়ে আমি পায়চারি করে চলি। ছবির শরীর জুড়ে এক অন্তহীন দেয়ালের আভাস আর একটা বন্ধ জানলা। সামনের দিকে একটা ফুলদানির গড়নের হাতছানি যার ওপর বসানো ক্যানভাসের বাকি সবকিছুকে ছাপিয়ে একজন মাঝবয়সি মানুষের মুখ। এমন মুখ আমি, আমরা, আমার পাড়াপড়শিরা, বন্ধুবান্ধবেরা, এই শহর আর তার আশেপাশের মানুষেরা, এই শহরের আশেপাশের ছোটো-বড়ো, নতুন, পুরোনো কলোনির মানুষজনেরা গত কয়েক দশকে দেখেছি বহুবার।
এমন মুখ আমরা কয়েকবার দেখেছিলাম বছর কুড়ি আগে আমাদের তল্লাটের সরকারি বাস ডিপোর বিকেলগুলোতে। মাথাভরা উশকোখুশকো ময়লা চুল আর দাড়ি, খালি-গা আর কোমর-আঁকড়ানো বোতাম-ছেঁড়া খাকি ফুলপ্যান্ট। মানুষটা দেখতে এমনটাই ছিল। আমরা কোনও বাস এসে দাঁড়ালে লাইন দিয়ে উঠবার উপক্রম করলেই সে গম্ভীর মুখে এসে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে নিজে আগেভাগে বাসের মধ্যে উঠে যেত। তারপর সতর্কতার সঙ্গে প্রত্যেকটা বসবার সিটের পেছন আর নীচ দেখে নিয়ে একসময় নেমে আসত। সে নেমে আসলে পরে বাস কনডাক্টর মুখে সিরিয়াস ভাব এনে জিজ্ঞেস করত সব ঠিক আছে কিনা! প্রতিবারের মতন সে ঘাড় নেড়ে আশ্বস্ত করত আর আমরা সবাই বাসে উঠে পড়তাম। একসময় বাস চলতে শুরু করত আর মানুষটা ধীরে-ধীরে হারিয়ে যেত আমাদের মাথার ভেতরের হাজারো গলিঘুঁজির কোনও এক গলির ভেতরে।
আমাদের মাথার ভেতরের জানা-অজানা অলিগলিগুলোর মতন আমাদের শহরের ভেতরের আর চারপাশের চেনা-অচেনা গলিগুলোতে এমন মুখ আর অভিব্যাক্তি প্রকাশ করতে পারে, এরকম মানুষ বেশ কিছুদিন পরে পরেই ভেসে উঠছিল। ঘরের ভেতরে চেয়ারে বসে আমি দুলে চলি আর স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই। পনেরো বছর আগেকার এমন সব গলিগুলোর একদিকে থাকত উঁচু লম্বা দেয়াল আর অন্যদিকে থাকত আবর্জনা ফেলা যায় এমন এঁদো পুকুর অথবা কাঁচা নালা। দেয়ালের ওপারে থাকত কোনও বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার কাঠামোর বেওয়ারিশ খাঁচাটা। তল্লাটের ডিসকভারি কিংবা ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলের অ্যাডভেঞ্চারারদের মতন সুলুকসন্ধানী মানুষেরা মাঝেমধ্যেই সেই কারখানা থেকে এটা-সেটা নিজের মনে করে নিয়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে গলিতে নেমে এসে হাঁটা লাগাত। আর উশকোখুশকো ময়লা চুল আর দাড়ি, খালি-গা আর কোমর-আঁকড়ানো বোতাম-ছেঁড়া খাকি ফুলপ্যান্ট পরা মানুষটা এলাকার কুচোকাঁচাদের এইরকম গলিতে দাঁড়িয়ে চোস্ত ইংরেজি বলিয়ে-কইয়েদের ঢং-এ পুরো ব্যাপারটার ধারাবিবরণী দিয়ে যেত আর এইসবের উপকারিতা সম্পর্কে মত প্রকাশ করত। অবশ্য আমাদের মতন একটু বড়োসড়ো চেহারার লোকজন দেখলে উত্তেজিত ভাবে আমাদের দিকে এগিয়ে আসাটা বাঞ্ছনীয় মনে করত। তার হাবেভাবে আমরা কখনও ভয়, কখনও বিরক্তি অথবা মাঝেসাঝে কৌতূহলী হয়ে জানতে পেরেছিলাম সে পাঁচিলের ওপারের কারখানাটায় কিংবা ওইরকম অন্য কোথাও কোনও একসময় কাজ করত। মালিক বহুদিন নিখোঁজ। এ বিষয়ে আমরা কী ভাবছি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা মতপ্রকাশ করতাম না। তাকে এড়িয়ে নিজেদের বাড়িতে ঢুকে যেতাম আর নিজেদের মধ্যে আলোচনার সময় এইরকম শ্রেণির মানুষের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে শুয়ে পড়তাম।
বিছানার ওপর উপুড় হয়ে, মাথার পেছনে দু-হাত দিয়ে চেপে ধরে আমি শুয়ে থাকি। কী মনে হয় আবার উঠে বসি আর ফ্যামিলি অ্যালবাম ঘাঁটতে শুরু করি। কয়েক লহমা পরেই উঠে আসে ক্যানভাসে দেখা মুখের বছর দশেক আগে তোলা একটা ফটোগ্রাফ যার গড়ন অবিকল আমার বাবার শেষ বয়সের মুখের মতন। বাবা নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে নিয়েছিল। গুটোতে গুটোতে গুটোতে একসময় শুধু শ্বাস নেওয়া আর ছাড়া আর খুব প্রয়োজনীয় কাজের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ করে নিয়ে আমাকে নিঃশব্দে তার চোখ দিয়ে বলেছিল সে নেহাতই একজন অসহায় ছাপোষা মানুষ।
আয়নার দিকে তাকিয়ে আমি আগেও দেখেছি আর এখনও দেখি আমার চেহারা আর মুখ। উপলব্ধি করেছি আমার মুখের সঙ্গে বাসডিপোয় দেখা মানুষ, গলির ভেতরে ঘুরে-বেড়ানো সেই মানুষ, অ্যালবামে দেখা মানুষের সাদৃশ্য আছে। সাদৃশ্য আছে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা মানুষের সঙ্গেও যা আদতে শিল্পীর নিজেরই প্রতিকৃতি।
আমি লাল, নীল, সবুজ আর কোথাও কোথাও মেটে রঙ দিয়ে ক্যানভাসের শরীর আঁচড়ে-আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা মুখ, দেয়াল আর বন্ধ জানলা মাথার ভেতরে নিয়ে আবার ঘুরে বেড়াই। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে অনুভব করার চেষ্টা করি ক্যানভাসের মধ্যে আর বাকি সবকিছুর সঙ্গে ভারসাম্য রেখে পজিশন করা শিল্পীর মুখ যা এক অর্থে আমাদেরও মুখ। গভীরভাবে বোঝবার চেষ্টা করে চলি ছবির ভেতর খেলা করে চলা রংবেরং-এর রেখাগুলোকে, রং-এর ব্যবহারকে যা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে, আবহমান পণ্যসমাজে কীভাবে একজন শিল্পী বা মানুষকে ব্যবহৃত করা হয় সেই পদ্ধতিকে।