অমিত ও তার বান্ধবীরা – অভিজিৎ চৌধুরী
খুব
সাদামাটা জীবন অমিতের । মা ইস্কুলে পড়াত । সর্বশিক্ষার স্কুলে, মাইনে ৫
হাজার টাকা । বাবার গ্রসারি শপ মানে মুদির দোকান । ধার চাহিয়া লজ্জা দিবেন
না ~ এই প্রঘোষণ টাঙানোর আগের ধার দিতে দিতে বাবা দোকানটাই যাকে বলে
লালবাতি জ্বালিয়েছে ।
ছোট
ভাই পড়তে গেছিল কলকাতায় , ফিরল বিয়ে করে । এখন পরিবারের সদস্য সংখ্যা
অকারণে একজন বেড়ে গেছে । অফিসে ঢোকার আগে বাইকে করে মা-কে স্কুলে পৌঁছে
দিতে যায় অমিত । কলতলায় শ্যাওলায় পড়ে গিয়ে মায়ের পায়ে প্লাস্টার । ফলে
ইদানিং রান্না করে , ঘর মুছে আসতে হচ্ছে ।
‘গর্ভমেন্ট
অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’- মুখ-পত্রিকায় দেওয়া থাকলেও সে অস্থায়ী কর্মী । প্রচুর
খাটতে হয় কিন্তু তবুও মন্দ লাগে না । ছ’ হাজারের মনসবদারিতে পাবলিক আওয়াজ
দেয় ওরা অমিতের বান্ধবী । কেউ কেউ শিস দিয়ে বলে গার্ল ফ্রেন্ড ।
১ – ‘সাবিরা’
এই যে শুনছেন !অমিত কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় – হ্যাঁ , বলুন । মেয়েটি বলে , আমার নাম সাবিরা ।অমিত বলে , সাবিরা খাতুন । কন্যাশ্রী । কোন্ স্কুল !কোন উত্তর না পেয়ে অমিত যন্ত্রের মতো বলে , স্কুলের ভেরিফিকেশন হয়েছে ! জিরো ব্যালেন্স অ্যাকাউন্ট । না , আমি গৌরব গুঁই কলেজ ।অমিত মজা করে এবার বলে ,আপনি কি করে গৌরব গুঁই কলেজ হলেন !এবার সাবিরা বলে , ছাত্রী ।ও ! তো কি বলছেন !আমার সাদি আজকে ।অমিত এবার বুঝতে পারে , বলে – হয়ে গেছে ! না , হবে ।রূপশ্রী । ২৫,০০০ টাকা । কিন্তু বিয়ের আগেই ত জানানো উচিৎ ছিল । হয়নি । বিয়ের কার্ড সঙ্গে রয়েছে ।সবারই থাকে । বাজার থেকে কিনতে পাওয়া যায় । আমার হাজবেন্ডও সঙ্গে রয়েছে ।এবার অমিত মুখ তুলে তাকায় । সাবিরা বলে মেয়েটির সঙ্গে এক যুবকও রয়েছে ।অমিত এবার বলে – কেসটা কি !সাবিরা এবার বলে – ‘ও’ সৌদি আরবে যাবে , টাকাটা ভীষণ দরকার ।কিন্তু ‘মোহর’ তো পাত্রপক্ষ দেবে ।ওরা পারবে না দিতে , গরিব ।মহব্বতের কেস ।জি । সাবিরা উত্তর দেয় ।অমিত এবার বলে – ‘সাদি’ কোথায় হচ্ছে !ডুকি নবকলা ।ইন্সপেকশনে যেতে হবে । পেট্রল পুড়বে বাইকের । সরকার অস্থায়ী কর্মীকে পেট্রল দেয় না ।সাবিরা একটা ‘দশ’ টাকার ময়লা নোট বের করে বলে , ভাইসাব আপনার রাহা খর্চা ।অমিত নোটটা দেখে হাসে । তার মতন ক্যাজুয়াল কর্মীরা এসব নেয় । কিন্তু এক্ষেত্রে টাকাটা এত কম যে অমিত মহানুভব হয়ে যায় । সে বলে , লাগবে না ।কিন্তু ইন্সপেকশন !একটা ফর্ম বের করে অমিত , এগিয়ে দিয়ে বলে – ফিল আপ করতে পারবে তো !সাবিরার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ।এবার সে বলে – অমিত , আমায় চিনতে পারছো না !চশমার পাওয়ার পালটানো দরকার । আপাতত হলুদ গেঞ্জির প্রান্ত দিয়ে চশমার কাচ ঘষে নেয় ।তারপর বলে , কে তুমি !বি. এ. সেকেন্ড ইয়ার ।ভালো করে দেখে অমিত । মুখে হাসি ফোটে , বলে – তুই সাবিরা !সাবিরা বলে – হ্যাঁ-রে অমিত ।একসময় সাবিরার জন্য অমিত মন-ফরিরা ছিল । তারপর ধর্মের ব্যবধান ভেবে কেউ এগোয়নি ।ওদের বিদায় দিতে বাইরে এসে দাঁড়ায় অমিত ।কন্যাশ্রীর সাইকেলটা সাইকেলটা এখনও আছে ।প্যাডেলে চাপ দিয়ে যাওয়ার আগে একবার তাকায় অমিতের দিকে । সাবিরার চোখের কোণায় এক বিন্দু জল টলটল করছে । ভুল দেখল নিশ্চয় অমিত ।
২ – ‘পম্পা’
তুমি কি খুব রাগী তাই না !কে বলল !অনিমেষ সাবধান করে দিয়েছে। ঢপ দিলে পেঁদিয়ে খাল খিঁচে নেব ।অমিত চমকে উঠেছিল । ক্যাজুয়াল কর্মীর বাইরে সে একজন এজেন্ট । কোম্পানির নাম ‘ ট্রেনিং অ্যান্ড মিরব’ । অমিত কোনক্রমে ঢোক গিলে বলল – বিশ্বাস না করলে এলে কেন !পম্পা এবার নরম হয়ে বলল – নার্সের চাকরিটা হবে তো !আগে তো ট্রেনিং করতে হবে ।‘ভাও’ কত !1.5 Lakh.পম্পা এবার বলে – তোমার হিস্সা মানে কমিশন কত !ছেলেদের জাহাজ মানে মেরিন আর মেয়েদের নার্সিং ।আমার ফাইভ পার্সেন্ট ।পম্পা চট করে হিসেব করে বলল – সাড়ে সাত হাজার । ওটা এখন বাদ দিতে হবে । মানে , এটা কোন্ মামদো-বাজি হচ্ছে !চাকরি পেলে সাড়ে সাত তোমায় দেব ।অমিত এবার সাহস করে বলল – এত বহুত লাফড়া হচ্ছে । পম্পা এবার অপাঙ্গে দেখল অমিতকে । সামান্য হৃদ-কম্পন হল অমিতের । এবার সে বলল – আমায় বিয়ে করবে !অমিত সোজা-সাপটা বলল – না ।কেন ?অমিত বলল – আমি তোমাকে শুধুমুদু বিয়ে করতে যাব কেন !তখনই আচমকা এক কোকিল ডেকে উঠল ।পম্পা বলল – দেখলে ।কি দেখব ! সেন্টিতে আমি ভুলছি না ।যদিও অমিত চমকে চব্বিশ হয়ে যাচ্ছিল ।পম্পা এবার বলল – তুমি কি একেবারেই ফ্রাস্টু !বার খাওয়াবে না আমায় । এক দেখাতেই বলছ বিয়ে করবে !এবার পম্পা বলল – তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি খুব ল্যাদ খাওয়া পাব্লিক । কেন ?দুনিয়ার লোককে জাহাজি বানিয়ে নিজে স্থলে রয়ে গেলে !এবার ফ্লার্ট করল অমিত – তোমার জন্য পম্পা । পম্পা কিন্তু সুন্দরী । মুখটা ফ্লাস করল ।তবুও অমিত বলল – তুমি আমাকে অত ক্যালানে ভেবো না । মাইরি বলছি , সাড়ে সাত হাজার কম হচ্ছে ।অমিত বলল – সেই কারণে তুমি একজন অচেনা ছেলেকে বিয়ে করবে !পম্পা হেসে বলল – লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট ।
পম্পা নার্স হয়েছে । সাড়ে সাত হাজার ফেরৎ দিয়ে অমিতকে জানিয়েছে ,মিস ইউ । অপেক্ষা করছি ।কিন্তু পম্পার বিয়ে হয়ে গেল । ডাবচা নবকলায় মেহবুব ব্যান্ড এসেছিল । এক জাহাজি যুবক ।বিয়ের পিঁড়িতে বসেও পম্পা বলেছিল – এখনও পালাতে পারি । অমিত হেসে বলেছিল – ইলোপ করব তোমায় !বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পম্পার বিয়ে ভেঙে গেল । সে নাকি কুরুম বা অপয়া ।সেই থেকে পম্পা প্রতিদিন সন্ধেবেলায় অমিতের কাছে আসে । তখন হাতের কাজগুলো ঘেঁটে ‘ঘ’ হয়ে যায় ।কখনও কখনও পম্পাকে বলে , কেমন আছো ?পম্পা বলে – বেঁচে আছি ।অমিত বলে – বিন্দাস আছো তবে !পম্পা বলে – বেঁচে থাকার আরেক নাম মৃত্যু ।ছোট ভাইটা চাকরি পেল না এখনও । বাবার দোকানে তালা পড়ে গেছে একেবারেই ।চেনা গল্প বহুবার বলেছে পম্পাকে । অফিসে আসার আগে বাইকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসে মা-কে ।কখনও কখনও পম্পাকে বলে – ডিভোর্স পেলে !ডিভোর্স পেলে কি হবে ! তুমি আমায় বিয়ে করবে !পম্পার কথা মা-কে বলেছে । আপত্তি নেই কারুর । তবুও উৎসাহ পায় না অমিত । ইদানিং একটু উন্নতি হয়েছে । মাকে ছাড়াও সে পম্পাকে স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পৌঁছে দেয় ।কেউ কেউ বলে – অমিতের বান্ধবী ।আবার তখন কেউ কেউ বলে – কলির কেষ্ট অমিত । সহস্র গোপিনী । আবার তখন কেউ কেউ বলে – অমিতের অনেক বান্ধবী । তারই একজন পম্পা, বিশেষ একজন ।অমিত কোনো উত্তর দেয় না । সামান্য হাসে । কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক কয়েকদিন ধরে খারাপ হয়ে ছিল । এখন ঠিক করতে ৬০ ঘন্টা লাগবে । ব্যাক আপ নিতে হবে । কাজ হচ্ছে না কিছু । তাই সে আরো আরো অপেক্ষা করে পম্পার জন্য । একটা গোটা জীবনে অমিতের তেমন কোনো স্বপ্ন নেই ।রাতে নিঃস্ব এক পেঁচা ডেকে ওঠে প্রায়ই ।জ্যোৎস্না রাতে পম্পাকে নিয়ে সে যখন পথ পার হয় , মনে হয় আকাশ , বাতাস মুগ্ধতা নিয়ে তাদের দেখে । কোনো অনুষঙ্গ ছাড়াই বিষাদ ভেসে চলে যায় ।তখন পম্পাও বলে ওঠে – জীবনটা জীবনই । মৃত্যু নয় ।
অভিজিৎদা র গল্প মানেই অন্য রকম স্বাদ।খুব ভালো লাগলো