এয়ারগান – অর্ণব সাহা

শেয়ার করুন

দোতলার উত্তরের বড়ো ঘরের দরজায় আলতো চাপ দিতেই খুলে গেল। দেখলাম সোফায় বাবা বসে আছে বরাবরের মতো। আর একটু ভেঙেছে শরীরটা। মাথার সাদা চুল প্রায় হালকা হয়ে এসেছে। চোখ দুটো গর্তে বসে গেছে। ইংরেজি খবরের কাগজের পাতা উলটে চলেছে একমনে। কিছুক্ষণ ঘোলাটে চোখে আমায় দেখল বাবা। তারপর ধীর গলায় বলল— “আয়, বোস”।

মৃত্যুর পর এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখলাম বাবাকে। প্রথমবার দেখেছিলাম যশোর রোডের মোড়ে রাস্তা ক্রস করার সময়। স্পষ্ট দেখলাম, কিনার ঘেঁষে একলা হেঁটে চলেছে। খুব ধীরে, হাতে একটা বাজারের ব্যাগ। মা চলে যাবার পর সম্পূর্ণ একলা হয়ে গিয়েছিল বাবা। কনকদি এসে রান্না করে দিত, দুপুরবেলায় ঘরদোর পরিষ্কার করে দিয়ে যেত। ঘর থেকে প্রায় বেরোতই না বাবা, ওই সপ্তাহে একবার বাজারটুকু করা ছাড়া। বাবা-মাকে ছেড়ে দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাটে নিজের আলাদা সংসারে উঠে গিয়েছিলাম প্রায় আট-দশ বছর আগেই। চাকরিসূত্রে কলকাতার বাইরে থাকি। নিয়মিত আসার চেষ্টা করলেও একটানা যোগাযোগ রাখতে পারতাম না। সুবর্ণা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একটা প্রত্যন্ত স্কুলে পড়ায়। দিনের মধ্যে এগারো ঘণ্টা বাড়ির বাইরে থাকে। আমার মেয়ে এখন ক্লাস ফোর। আয়ার কাছে থাকে সারাদিন। বাবা-মা দুজনেই চলে যাবার পর দমদমের এই বিচ্ছিন্ন পাড়ায় পৈতৃক বাড়ি আর রেখে দেওয়া সম্ভব নয়। পাড়ার চেনা প্রোমোটার রাজুর সঙ্গে কথা বলে এই দোতলা ভূতের মতো নিঃসঙ্গ বাড়িটা ফ্ল্যাট করার জন্য দিয়ে দেওয়াই স্থির করলাম আমি। আসবাবপত্র আগেই বেশ কিছুটা সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। বাকি জিনিসগুলোর গন্ধ আর মায়া আমাকে এই রবিবারের দুপুরগুলোয় ইদানীং টেনে আনছে এই বাড়িতে। একলা বন্ধ ঘরগুলো খুলে পুরোনো, ধুলোয় মোড়া কাগজের স্তূপ, বইপত্র, রংচটা আয়না, মলিন দেয়াল আর ফসিল হয়ে-যাওয়া এক টুকরো ইতিহাসের ঘ্রাণ নিতে আসি আমি। বাবার পাশের ঘরটা বন্ধই থাকত বরাবর। আজ মরচে-পড়া তালা খুলে ভিতরে ঢুকলাম। প্রায়-অন্ধকার ঘর। দেয়ালে দুটো ছবি। একটায় সেন্ট পিটার্সবার্গের জনসভায় বক্তৃতারত কমরেড লেনিন আর পাশেরটায় আমার অকালপ্রয়াত মেজোকাকা। এই দমদম-জপুর-চাষিপাড়া-লালগড় ১৯৭০-৭১ সালে যাদের হাত ধরে হয়ে উঠেছিল ‘মুক্তাঞ্চল’, কাকা ছিল সেই বোকা স্বপ্নচারীদের কমান্ডার। একাত্তর সালের মার্চ মাসে চাষিপাড়ার মসজিদের দেয়ালে সার দিয়ে দাঁড় করিয়ে যে সাতজন যুবককে গুলি করে মারে পুলিশ, কাকা ছিল তাদেরই একজন। তখন তার বয়স উনিশ। বাবার চেয়ে বছর আটেকের ছোটো ছিল মেজোকাকা। আমার জন্মেরও ঢের আগের ঘটনা সেইসব। কাকাকে আমি ছবি ছাড়া কোনোদিন চোখে দেখিনি ।

—কী করছ এই অন্ধকার ঘরে একলা ভূতের মতো বসে?

সম্বিৎ ফিরল মেয়েলি কণ্ঠস্বরে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম তানিয়া। কৈশোরের সঙ্গিনী। আমার বালকবেলার প্রথম রোমাঞ্চ। আজ সে-ও চল্লিশ পেরিয়েছে। চোখের তলায় স্পষ্ট বলিরেখা। আমার একটু হাসিই পেল। যে অতীত আমরা একবার হারিয়ে ফেলি, তা আর ফিরে আসে না কোনোদিন…

—তুই? হঠাৎ এই অসময়ে?
—তোমায় বিকেলে দেখলাম বাড়িতে ঢুকছ। বেশ কদিন ধরেই ভাবছি একদিন আসব দেখা করতে। কেমন আছো বাপ্পাদা?
—ভালো। তোর ছেলের কোন্ ক্লাস হল রে?
—এই তো, সবে ক্লাস থ্রি… সেন্ট মেরিজে পড়ে…
—রূপক এখনও ব্যাঙ্গালোরে?
—হ্যাঁ। এবার পুজোয় আসবে। থাকবে সপ্তাহ খানেক… কী খুঁজছ তুমি?

যদি বলতাম আমার হারিয়ে যাওয়া শৈশব আর নস্টালজিয়ার পিছুটান ভূতগ্রস্ত করে তোলে আমায়, তাই আমি ছুটে আসি বারবার এই জীর্ণ, প্লাস্টার-ওঠা ভাঙাচোরা হাভেলিতে। যে বাড়ির মায়ায় জড়িয়ে রয়েছে আমার জীবনের প্রথম ষোলোটা বছর। আমার প্রথম প্রেম, প্রথম নিজের শরীরকে চিনে ওঠার অসহ্য মুহূর্তগুলো। এই বাড়ির তালাবন্ধ মেজোকাকার ঘর, ছাদের কার্নিস, হাতলভাঙা অ্যান্টেনায় ঝুলতে থাকা পেটকাটি চাঁদিয়াল, চিলেকোঠার সিঁড়িতে বসে ষোলো বছর বয়সে প্রথম চুমুর স্বাদ, ওই জঞ্জাল ভরা ঘরে অযত্নে ফেলে রাখা ভাঙা গ্রামোফোন, যার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার শৈশবেই… যে মেয়েটি আমার সকালসন্ধে আচ্ছন্ন করে রাখত একদিন, সেই তানিয়া, আজ মধ্যবয়স্ক গৃহিণী, আজ পাশে বসে রয়েছে আমার। আশ্চর্য, আমার ভিতরে কোনো রোমাঞ্চ তো দূরস্থান, আলাদা অনুভূতিও হচ্ছে না আর। কাকার ঘরেই প্রথম দেখেছিলাম ‘দেশব্রতী’ পত্রিকার পোকায় কাটা সংখ্যা, ছেঁড়া লিফলেট, চারুবাবুর আটটি দলিল, আরও অজস্র চটি রাজনৈতিক পুস্তিকা। গা শিউরে ওঠে আমার । থমকে যাওয়া মৃত ইতিহাসের টুকরো হাতে নিয়ে বসে থাকা কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি আবার নিজের ভিতরে হারিয়ে যাই…

—ওই ফাইলগুলোয় কী আছে গো?
—ওগুলোয় বাবার হাজারটা কাগজপত্র। এলআইসি, পেনসনের পাসবই, আরও নানারকম হাবিজাবি…
—কাকিমা চলে যাবার পর একদম বেরোত না বাইরে। কতদিন দেখেছি দোতলার বারান্দায় একলা চেয়ারে বসে আছে রাত পর্যন্ত…
—আর আছে একগাদা পুরোনো ফোটোগ্রাফ… এটা দ্যাখ, বাবা আর কাকা ঘাটশিলা বেড়াতে গেছিল ঠাকুরদার
সঙ্গে। একটা পাথরের উপর উঠে বাবা এয়ারগান দিয়ে পাখি মারছে। পাশে কাকা… ছবিটা জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে… দেখতে পাচ্ছিস?
—এই এয়ারগানটাই তো তোমার ঠাকুরদার ঘরে এখনও রাখা আছে, তাই না?
—হ্যাঁ। ওই ঘরেই বাবা থাকত… এই, এইটা দ্যাখ…
—কী গো?
—একটা কবিতা। বাবার লেখা। আমার মেয়েকে নিয়ে…

তানিয়া আরও একটু ঝুঁকে আসে আমার কাছে। আমার ষোলো বছর পেরিয়েছে তখন, ওর সদ্য তেরো। স্নান সেরে খোলা চুলে ছুটে এসেছে কতবার আমাদের বাড়ি। চিলেকোঠার সিঁড়িতে বসে পাকা কুল খেতাম দুজনে। ঠাকুমা সারাক্ষণ নজরে নজরে রাখত আমাদের। বুড়ি কীভাবে যেন বুঝে ফেলেছিল ওর সঙ্গে মনে-মনে জড়িয়ে আছি আমি। আমি পড়তাম দমদম কিশোর ভারতীতে। আর তানিয়া আমাদের পাড়ার প্রাচ্যবাণী বিদ্যামন্দিরে। ওর বাবার বেশি বয়সের একমাত্র সন্তান ও। তানিয়ার ভাই জন্মের তিনমাসের মাথায় দুরারোগ্য অসুখে মারা যায়। তাই ওর বাবা-মা ওকে চোখের আড়াল করত না এক মুহূর্ত। ওর বাবা ছিল আমার কাকার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, যদিও বয়সে কিছুটা বড়ো। একটা দামাল, ঝোড়ো স্বপ্নের ভিতর জড়িয়ে গেছিল তারা দুজনেই। কাকা মারা যায়। তানিয়ার বাবা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে ছিল পাঁচ বছরেরও বেশি। সাতাত্তরের শেষদিকে ছাড়া পায় দীনেশকাকু। কোনোদিন চাকরিবাকরি করেনি। তানিয়ার মা ছিল স্কুলটিচার। খুব সুদর্শন, অভিজাত মহিলা। আমাদের ওই শেঠবাগানের পাড়ায় একেবারেই মিসফিট। শুনেছি এই পুরো এলাকার জমিদারি একসময় ছিল কাকিমাদের। আমরা দূর থেকে শুধু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম কাকিমার দিকে। খুব মিষ্টি, আন্তরিক ব্যবহার ছিল ওঁর। প্রত্যেকবার পুজোর পর ওদের বাড়িতে গেলেই নারকেলের নাড়ু আর কুঁচো নিমকি খাওয়াতেন আমায়…

—কই, দেখি কবিতাটা!
—পড়ে দ্যাখ । ভাঁজ করা পাতাটা খুলে তানিয়ার হাতে দিই আমি…
—বাব্বা! এ তো অদ্ভুত লেখা বাপ্পাদা…
—হ্যাঁ। পুরোটা পড়…

‘সোনাই কোথায়? সোনাই কোথায়? ডাকে রাঙা নদী!
একটিবার বারান্দায় তাকে দেখতে পেতাম যদি
প্রাণটা যেত জুড়িয়ে আর মনটা যেত ভরে
সোনাই তোমায় সেই কথাটা বোঝাই কেমন করে?
সবাই থাকে ব্যস্ত কাজে, বাবাও কাছে নাই।
দাদুর বাড়ি আসবে তুমি কেমন করে ভাই?
তার-ছাড়া বীণ কেমন করে বাজায় মীরাবাঈ?’

আমার মেয়েকে আদর করে সোনাই বলে ডাকত বাবা। হাজারটা কাজে জড়িয়ে থাকি। বাবা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকত কবে ছোট্ট নাতনি আসবে দেখা করতে। একরাতও মেয়েকে নিয়ে এ বাড়িতে থাকিনি। আমার বউও দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাট ছেড়ে এই উত্তরের গলিঘুঁজির ভিতর পোড়ো বাড়িতে আসতে চাইত না বিশেষ। বিজয়ার প্রণামটুকু করা ছাড়া সেভাবে আসতই না এখানে। মেয়েকেও আসতে দিতে চাইত না। আমার বুড়ো, নিঃসঙ্গ বাবা সারাজীবন লোকের বিয়ে, অন্নপ্রাশন, অনুষ্ঠানে এইসব অ্যামেচারিশ ছড়া লিখে গেছে। আমি কোনোদিনও সেভাবে গ্রাহ্যই করতাম না এইসব লেখাকে। এই লেখাটাও আদৌ কোনো মনে রাখার মতো কবিতা নয়। কিন্তু আজ, তানিয়া পাশে বসে আছে, আমার চোখের কোণে অলক্ষ্যে জল চলে এল। বাড়ির পিছনে বিশাল এক পুকুর। নাম পাগলিপুকুর। আমার মেয়েকে ছোটোবেলায় একবার বাবা শিখিয়েছিল ওই পুকুরটা আসলে এক নদী। ওর নাম ‘রাঙানদী’। মায়ের নাম ছিল ‘মীরা’। সোনাই যখন চার বছরের, মা চলে যায় মাত্র দু-মাসের অসুখে ভুগে। কবিতার শেষ পঙ্‌ক্তির অর্থ বোঝা যাবে না এই কথাগুলো জানা না থাকলে। আজ যখন বাবা-মা কেউই আর ইহজগতে নেই, এক নিরুক্ত শূন্যতা থমকে রয়েছে এই ভূতের মতো বিশাল বাড়িতে, পুরো শৈশব আর কৈশোরের মুহূর্তগুলো দম-আটকানো বাতাসের মতো গিলে খেতে আসছে আমাকে, আমি তানিয়ার চোখের দিকে তাকাই। ও আমার পাশটায় বসে আছে, অথচ, সেই কৈশোরে ওর শরীর থেকে যে গন্ধটা ভেসে আসত, তা আজ আর অবশিষ্ট নেই। অথচ, ওর স্বভাবটা আজও একইরকম উচ্ছল আর প্রাণবন্ত। টের পাই, ওর মনের ভিতরে এখনও এক চঞ্চল হরিণী খেলা করে। যদি টাইমমেশিনে চড়ে ইচ্ছেমতো নিজেদের মুঠোয় বদ্ধ সময়কে আগুপিছু করতে পারতাম আমরা, পৌঁছতে পারতাম সেই শেষ আশি-নব্বই দশকের গোড়ার দিনগুলোয়, যখন ধীরগতিতে হলেও বদলে যাচ্ছে আমাদের সাবেকি পাড়া, ফিকে হয়ে যাওয়া স্মৃতির মতো একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে সত্তর দশক। একটা-দুটো পুরোনো বাড়ির রং-ওঠা দেয়ালে তখনও আলকাতরায় লেখা স্লোগান— ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’, স্টেনসিলে আঁকা মাও-এর মুখ। সার-সার বন্ধ কারখানা। অন্ধকার গলিঘুঁজির মধ্যে দিয়ে একলা সাইকেল চড়ে ঘুরে বেড়াতাম। তখনও পিছনের চাষিপাড়া আজকের মতো ফ্ল্যাটের জঙ্গলে পরিণত হয়নি। ভূগোল বদলে যায়নি কালিন্দীর। পাতিপুকুর রেলইয়ার্ড থেকে ট্রেন সান্টিং-এর আওয়াজ আসত মাঝরাতে। সকাল ন-টায় সময়ের জানান দিত বহুযুগ আগে ঝাঁপ ফেলে দেওয়া ব্লেড কারখানার সাইরেন। আমি অবশ্য নব্বই-এর একেবারে শেষদিকে বাড়ি ছেড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বাইরে চলে যাই। প্রথমে চেন্নাই। পরে চাকরিসূত্রে দীর্ঘদিন থাকি উত্তর ও মধ্যভারতের একাধিক শহরে। কলকাতায় ফিরে বিয়ে করি। বেশ কিছুদিন ছিলাম এখানে। শেষ কয়েকবছর ধরে আবার চাকরির জন্য ধানবাদে থাকি। মাসে দু-বার ফিরি বাড়িতে। দমদমে আসার সময়, সুযোগ কোনোটাই সেভাবে পেতাম না আর…
—আমাদের বাড়িতে একবার যাবে না বাপ্পাদা?
—তুই মা-বাবার সঙ্গেই থাকিস এখন?
—কী করব বলো? বাবার প্যারালাইসিস। মা বিছানা থেকে উঠে একা বাথরুম যেতে পারে না। রূপক থাকে বাইরে। আমি না থাকলে মা-বাবাকে দেখবে কে?
—শ্বশুরবাড়ি যাস না?
—কে বলল যাই না? প্রত্যেক হপ্তায় শ্যামবাজার যাই। রূপকের বড়দি আমার শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকে…
—আর দীপকদা?
—ওমা! তুমি জানো না? বড়দা তো ফ্যামিলি নিয়ে সেই কবেই সেটল করেছে আমেরিকায়। এখন শিকাগোয় থাকে ওরা…
—আর কলকাতায় ফিরবে না ওরা?
—মনে হয় না। দু-তিন বছর অন্তর একবার আসে বাড়িতে…

ঠাকুরদার এয়ারগানটা পাড়ার নকশাল ছেলেরা একবার নিয়ে গিয়েছিল। সেটা উনিশশো সত্তর সাল। যদিও ঠাকুরদা ছিল পাঁড় কংগ্রেসি, তবু ওই উদ্দাম আঠারো-উনিশ-কুড়ির রাগী ছেলেগুলোকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত সে। ঠাকুমার মুখে শুনেছি, পুলিশ অপারেশনের সময় একবার বেশ কয়েকটা ছেলেকে ছাদের চিলেকোঠায় সেলটার দিয়েছিল ঠাকুরদা। একাত্তরে বাবা যেদিন বিয়ে করে বউ নিয়ে পাড়ায় ঢুকছে, গাড়ি আটকায় ‘রেড মিলিশিয়া’। কিন্তু ওদেরই একটা ছেলে চিনতে পারে বাবাকে। বলে— “আরে, অহীনদার গাড়ি, ছেড়ে দে…।” তখন প্রত্যেক সন্ধেয় ওয়াগন ব্রেকারদের সঙ্গে ওই নকশাল ছেলেদের বোমার লড়াই শুরু হত। নামী ডাক্তাররাও ফিজ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল পাইপগান আর ওয়ান শটারের ভয়ে। এইসব গল্প আমি অবশ্য অনেক পরে শুনেছি বাবার মুখে। নিজে কস্মিন্‌কালেও রাজনীতি করেনি। নির্বিবাদী মানুষ। এফসিআই-তে চাকরি করত। কেবল একবার, ১৯৭৪-এ সারা ভারতব্যাপী রেল-ধর্মঘটের সময়, কী একটা মিছিলে হেঁটে কয়েকঘন্টার জন্য গ্রেপ্তার হয়েছিল বাবা। কিন্তু আজ, এতগুলো বছর বাদেও আমি ফেলতে পারি না আমার শৈশব-কৈশোর আর প্রথম যৌবনের দিনগুলোকে। এই মূল কলকাতার ঔদ্ধত্য, অহংকার আর আলো-ঝলমলে হিংস্র বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই পাড়া, এই রংচটে যাওয়া মলিন বাড়িগুলো। যা আর কোনোদিনও রঙিন হবে না। বাবা ওই বিস্মৃত সময়ের অংশিদার ছিল, কিন্তু প্রধান বা পার্শ্বচরিত্র কোনোটাই ছিল না। আমি, সেই ট্র্যাডিশন কিছুটা ভাঙার চেষ্টা করেছিলাম আমার কম বয়সে। বোধহয় সেই কারণেই দীনেশকাকুর সঙ্গে ক্লাস টেনে পড়ার সময়েই আমার ওইরকম গভীর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এক-একসময় মনে হয়, যেন আমার জন্মের আগে থেকে শুরু করে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কয়েকবছরের দিনগুলো আজও স্থাণু, অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর আমি আমার শৈশবের সমস্ত পিছুটান আঁকড়ে লুপ্ত ন্যাসপাতির গন্ধ খুঁজে ফিরছি। ক্লাস এইট-নাইনেও বৃষ্টির নিজস্ব গন্ধ টের পেতাম আমি। কীরকম একটা ভিজে চন্দনকাঠের সুবাস আসত উত্তরের জানলা খুললেই। ওই মুহূর্তগুলোই পবিত্র আর প্রচণ্ড কষ্টদায়ক। যখন সকাল-দুপুর-সন্ধে আর রাতের রং ক্রমাগত বদলে বদলে যেত। দীনেশকাকুর কাছেই আমি শুনতাম ডেবরা-গোপীবল্লভপুরের গল্প। কীভাবে এক গরিব চাষির বাড়িতে রাত কাটানোর মুহূর্তে গোটা পাড়া ঘিরে ফেলে কম্বিং অপারেশন চালায় পুলিশ আর বাড়ির উঠোনের খড়ের গাদায় লুকিয়ে পুরোটা রাত কাটিয়েছিল দীনেশকাকু। “তোমার ভয় করত না?”— এই কথাটা আমি প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম আর হো-হো করে শরীর কাঁপিয়ে একটা অদ্ভুত হাসিতে ফেটে পড়ত কাকু। আমাদের এই বাড়ির পিছনেই ছিল ধোপাদের বস্তি। ওরা প্রত্যেক বছর দোলের আগের রাতে বিশাল ন্যাড়াপোড়া করত। সেই আগুনের লেলিহান শিখা আজও বেশ মনে আছে। স্মৃতির একটা দাহিকাশক্তি থাকে। আজ এই বয়সে এসে আমি সেটা স্পষ্ট টের পাই।

হেমন্তের সন্ধে খুব দ্রুত ঘন হয়ে নামে। কাকু-কাকিমার সঙ্গে কথা বলে আসব বলে, সদর দরজায় তালা লাগিয়ে আমি আর তানিয়া বেরোই। ঠিক কয়েকটা বাড়ি পরেই তানিয়াদের একতলা বাড়ি। আচ্ছা, এই যে এতদিন বাদে আমায় এই পাড়ায় ঢুকতে দেখে, কোনো আগাম খবর না দিয়েই তানিয়া এসে বসল আমার পাশে, এর ভিতরেও কি আর একটা প্রায়-মুছে-যাওয়া গল্প লুকিয়ে নেই? ও কি আজও ভালোবাসে আমায়? ওর নিজের কাছে কি পরিষ্কার ছিল সেইসব মুহূর্তগুলোর অর্থ? ফিকে-হয়ে-যাওয়া সেপিয়া রিলের মতোই এই টুকরো গল্পের অংশগুলো আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। অদৃশ্য ঘোড়ায় চেপে যেন ঝড়ের গতিতে বদলে যাচ্ছে আমাদের দমদমের এই লোকালয়। আমি তানিয়ার সঙ্গে ওদের বাড়িতে ঢুকি।

এক মুহূর্তের জন্য পিছন ফিরে দেখতে পাই বুড়ো ডানা-ভাঙা জটায়ুর মতো ঝিমোচ্ছে ওই হাভেলি। আর মাত্র কয়েকদিন পরেই বাড়ি ভাঙা শুরু হবে। ওখানে ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাট উঠবে। মালপত্র আপাতত বেশিরভাগটাই রাজুর একটা অন্য প্রোজেক্টের প্রায়-তৈরি বাড়ির গোডাউনে রাখা থাকবে, যতদিন না বিক্রি হয়ে যায়। কেবল ঠাকুরদার এয়ারগানটা হাতছাড়া করব না আমি। এটা নিয়ে যাব আমার নিজের ফ্ল্যাটে। তানিয়াকে বললাম, “এয়ারগানটা আমি নিয়ে যাব, বুঝলি?”

—“কোনটা? ওই ভাঙা বন্দুকটা?” ও আমার কথা বুঝতে সময় নেয়…

হ্যাঁ তানিয়া। সেই বন্দুকটা। যেটা থেকে গর্জন অথবা আগুন— কোনোটাই আর বেরোয় না— মনে-মনে বলি আমি…

শেয়ার করুন

Similar Posts

3 Comments

  1. দারুণ স্যার। আগের দিন যে লেখা টা পড়েছিলাম সেখানেও ওই ছোট্ট কবিতা টা ছিল। খুব ভালো লেগেছে আমার কবিতাটা। আর গল্পটাও ভীষণ মন কেমন করা। অসাধারণ স্যার।

  2. “স্মৃতির একটা দাহিকা শক্তি থাকে। আমি এই বয়েসে সেটা স্পষ্ট তের পাই” আর গর্জন আর আগুন দুটোই বেরোয় বন্দুক টা থেকে। অতীত কে আমরা ফেলে আসতে পারলেও ভুলতে কিছুতেই পারি না,আর ভুলবই বা কেনো ভবিষ্যতে এটাই চলবার পথ হবে। স্যার আপনার পুরনো দিন গুলো এই রকম না থাকলে,দমদম এ আপনার ছোটবেলা না কাটলে,নকশাল আন্দোলন এর সাইনিফিকেন্স না থাকলে,আজ এয়ারগান গল্পটা পেতাম না। আর পরিবারের গল্প আর রাজনীতি এমন ভাবে মিলে যায় এই গল্পটা,আগের গল্পটা আর “হস্ত মৈথুনের মুহূর্তে এমনটা ঘটে থাকে” না পড়লে বুঝতে পরতাম না।অসাধারণ স্যার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *