বর্ষশেষের কলকাতা : কলকাতার ক্রিকেট (পর্ব ৫) – সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়
পঞ্চম পর্ব
বঙ্গভঙ্গ চলাকালীন কলকাতার ক্রিকেট খেলায় কোনও প্রভাব পড়েনি। তবে বড়ো কোনও ম্যাচের খবর সেভাবে নেই। কিন্তু এরই মধ্যে ১৯০৯/১০ সালের ডিসেম্বর মাসে ওয়ানডে সিঙ্গল ইনিংসের খেলা হয়েছিল ময়দানে। বাংলার অন্যতম প্রাচীন পাটশিল্পের কারখানা গৌরীপুর জুট মিল যা ম্যাকলিন বেরী বানিয়েছিলেন নৈহাটিতে, তাঁদের সঙ্গে অ্যালায়েন্স ইউনাইটেড জুট মিলের (বিবাদী বাগে অফিস আছে) খেলা হয়। অ্যালায়েন্স ৪ উইকেটে ১২২ করলেও গৌরীপুর ৫৯ রানে অল আউট হয়ে যায়।
পরের বছর আবার অন্য খবর। বেশ বড়ো ম্যাচ। রাজধানী হিসেবে কলকাতার বিলুপ্তির আগে অন্যতম বড়ো ট্যুর হল ১৯১০ সালের ডিসেম্বরে।
কলকাতায় প্রিন্স রঞ্জি শেষবারের মতো খেলতে এলেন। ততদিনে তিনি জামসাহেব হয়ে গেছেন। টেস্ট আর খেলেন না, কিন্তু মাঝে মধ্যে গিয়ে কাউন্টি খেলেন। এই সময় তিনি পাতিয়ালার মতোই একটা দল তৈরি করেন যাঁর নাম ছিল যোধপুর-জামনগর সম্মিলিত দল। এই দলে বেশ কিছু অনবদ্য ক্রিকেটার ছিলেন। যেমন পৃথিবীর প্রথম এক ইনিংসে ৪০০ রানকারী (অবশ্যই প্রথম শ্রেণির খেলায়) আর্চিবোল্ড ম্যাকলারেন। ল্যাঙ্কশায়ার দলের এই ক্রিকেটারটি ৩৫টি টেস্ট খেলেন, যার মধ্যে ২২ টি টেস্টে উনি অধিনায়ক ছিলেন। টেস্টে ১৯৩১ রান করেন ৫টি শতরান সহ। প্রথম শ্রেণির খেলায় ২২,২৩৬ রান করেন ৪৭টি শতরান সহ। সেই সময় ম্যাকলারেন, রঞ্জির এডিসি হিসেবে কাজ করতে ভারতে আসেন।
তৎকালীন এডিসি ছিলেন হ্যারি সিমস। তিনি ৩১৫০ রান করেন প্রথম শ্রেণির খেলায় ও ২২০ টি উইকেট পান। ম্যাকলারেন ও সিমস ছাড়াও টেস্ট ক্রিকেটার এ ই রেলফ ছিলেন দলে, ১৩টি টেস্টে ৪১৬ রান ও ২৫টি উইকেট ছিল তাঁর। প্রথম শ্রেণির খেলায় ২২,২৩৮ রান ও ১৮৯৭ উইকেট দখল করেন তিনি। তাঁর ভাই রবার্ট রেলফও ছিলেন, যাঁর সংগ্রহে ছিল ১৪,৫২২ রান ও ৩১৭ উইকেট (প্রথম শ্রেণির খেলায়)। এছাড়া ছিলেন ই কিলিক। ১৮৭৬৮ রান ও ৭২৯ উইকেট পাওয়া কিলিক কোনোদিন টেস্ট খেলেননি অবশ্য।
২২ ও ২৩ ডিসেম্বর ১৯১০ সালে কলকাতার বন্ডেল গেটে অবস্থিত নাটোর পার্কে নাটোর দ্বাদশ দলের বিরুদ্ধে যোধপুর-জামনগর সম্মিলিত দ্বাদশ দলের এই ম্যাচটি অজ্ঞাত কারণে প্রথম শ্রেণির তকমা পায়নি, অথচ তিনজন টেস্ট ক্রিকেটার সহ দুই দলে ২০ জনের বেশি প্রথম শ্রেণির খেলোয়াড় ছিল।
নাটোর প্রথম ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৯৮ রানে সবাই অল আউট হয়ে যায়। বালু (১৯), ম্যাসি (১৯), প্রিন্স হিতেন্দ্রনারায়ণ (১৪) ও মেটা (১৪) ছাড়া বাকিরা দুই অঙ্কে যায়নি। সিমস ৩৩ রানে ৮ উইকেট নেন, এ ই রেলফ ৩২ রানে ৩ উইকেট নেন।
এরপর বালু আর ওয়ার্ডেনের অনবদ্য বোলিং জামনগর-যোধপুর কে ২২১ রানে আটকে দেয়। রঞ্জি ২৪ রানে অপরাজিত থাকলেও কিলিক (৩০) আর অগাধশঙ্কর (২৪) ছাড়া বলার মতো কেউ কিছু করতে পারেননি। বালু একাই ৬৮ রানে ৬ উইকেট পান। ওয়ার্ডেন ৩৪ রানে ৪ উইকেট নেন।
নাটোর দ্বিতীয় ইনিংসে বেশ ভালোই ব্যাট করে। ম্যাসি (৪৫) আর ওয়ার্ডেনের (৪০) জন্য ১৭৯ রান তোলে তাঁরা। জামনগর জবাবে ৩৪/২ তুললে ম্যাচের সময় শেষ হয়ে যায়।
নাটোর দলের মূল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়। কোচবিহার এর দুই রাজকুমার হিতেন্দ্রনারায়ণ ও ভিক্টর নিতেন্দ্রনারায়ণ দুজনেই এই ম্যাচে খেলেন। হিতেন্দ্রনারায়ণ সমারসেট দলের হয়ে কাউন্টি খেলেন, ভিক্টর প্রথম শ্রেণির খেলায় প্রথম বাঙালি অধিনায়ক। ছিলেন পালওয়ানকর বালু ও তাঁর দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান ভাই পালওয়ানকর বিঠঠল। বিঠঠল প্রথম ভারতীয় যিনি ইডেনে শতরান করেন। নাটোর দলে ছিলেন কলকাতার মাঠে ৫ বলে ৫ উইকেট নেওয়া অলরাউন্ডার ওয়ার্ডেন (পারসি), শেষচারীর মতো উইকেট কিপার।
এরপর অবশ্য রঞ্জির দল কলকাতায় আরও তিনটি ম্যাচ খেলে। কিন্তু একটাতেও রঞ্জি খেলেননি। এরমধ্যে ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বরের ম্যাচে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের বিরুদ্ধে ইডেনে খেলা হয়। স্বয়ং বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ, এককালে যিনি ক্রিকেট খেলেছেন, তিনি দেখতে আসেন ম্যাচ। হ্যারি সিমস হ্যাটট্রিক সহ ৬ রানে ৯ উইকেট নেন, ফলে ক্যালকাটা মাত্র ৫৬ রান করে। এর পর সিমস ব্যাট হাতে ৯৫ করেন। এ ই রেলফ করেন ৫৮। দ্বিতীয় ইনিংসে এ ই রেলফ ১০ রানে ৬ উইকেট নিয়ে ক্যালকাটা কে ১০৯ রানে অল আউট করে দেন। যোধপুর-জামনগর ইনিংস ও ৫৮ রানে জয়ী হয়। ক্যালকাটা দলে ১২ বছর আগের জন গাইজ ছিলেন। সঙ্গে এস সি বি লী ছিলেন।
২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর, ইডেনেই বিহার ওয়ান্ডারার্স-এর বিরুদ্ধে খেলতে নামে যোধপুর-জামনগর। উল্লেখ করা যায়, এই বিহারের দলটিও তখন কলকাতা সফর করছিল। যোধপুর-জামনগর ২৯১ করে। রবার্ট রেলফ সেঞ্চুরি করেন। জবাবে বিহারের দলটি ৬৯ ও ৬১ তোলে। সিমস প্রথম ইনিংসে ৩২ রানে ৬ উইকেট পান। এ ই রেলফ পান ২৬ রানে তিনটি। দ্বিতীয় ইনিংসে সিমস ১৭ রানে ২ টি, এ ই রেলফ ৩৭ রানে ৪ টি। তবে সবাইকে চমকে দেন পিয়ারা খাঁ। হ্যাটট্রিক মিস করলেও মাত্র ২ রানে ৪ উইকেট পান তিনি।
৩১ শে ডিসেম্বর ও ১ লা জানুয়ারি হওয়া বালিগঞ্জের ম্যাচটি ড্র হয়। যোধপুর-জামনগর দল ১১০ ও ২৯১/৪ করে। দ্বিতীয় ইনিংসে রবার্ট রেলফ কলকাতায় দ্বিতীয় শতরান পান (১৩৭) এবং সিমস দ্বিতীয়বার শতরান মিস করেন (৯৩)। জবাবে বালিগঞ্জ ১৩৮ ও ২০৬/৬ তোলার পরে ম্যাচের সময় শেষ হয়ে যায়। এই ম্যাচে সিমস ৫টি, এ ই রেলফ ৩ টি, রব রেলফ ২ টি ও পিয়ারা খাঁ ২ টি উইকেট পান। বালিগঞ্জের শ্যালো দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৩, ডসন ৫৮ ও শেরম্যান ৪৫ রান করেন।
সফরে ৩৫ টির বেশি উইকেট নেন সিমস। নিয়মিত রান করেন। এ ই রেলফ-ও ২০ টি মতো উইকেট পান।
সেই সময় কলকাতায় আরও একটা ম্যাচ হয়েছিল। খিদিরপুর এলাকার ওরিয়েন্ট স্পোর্টিং ক্লাব খেলতে নামে ডেভনটন কলেজের বিরুদ্ধে। আজকের পার্ক স্ট্রিটের নিকটবর্তী পার্ক ম্যানসন যেখানে, সেটাই ছিল ডেভনটন কলেজ। ওরিয়েন্ট দলের বেশিরভাগ মুসলিম (বাঙালি কি অবাঙালি বলা মুশকিল), কয়েকজন পারসি। ডেভনটনের বেশিরভাগ ব্রিটিশ (অ্যাংলো হওয়া বিচিত্র নয়)। তিনজন ভারতীয় ছিলেন। জনৈক হক, জনৈক দাস (Dass) এবং জনৈক ধর্ম।
১৯১৩/১৪ সালে কলকাতায় প্রথম ক্যালকাটা ট্রায়াঙ্গুলার টুর্নামেন্টের আসর বসে। বলে রাখা ভালো, সেই সময় (১৯০৬-১৯৪৫) ভারতে প্রচুর ট্রায়াঙ্গুলার, কোয়াড্রাঙ্গুলার, হত। যেমন বোম্বে, নাগপুর, ইন্দোর, লাহোর, করাচি। এগুলোর মধ্যে বোম্বে, করাচী ফার্স্ট ক্লাস টুর্নামেন্ট। লাহোর কোনও কোনও বছর ফার্স্ট ক্লাস স্ট্যাটাস পায়। কিন্তু বাকিগুলো কোনোদিন পায়নি।
এই প্রতিযোগিতাগুলির মধ্যে একটাই মিল। দলগুলি সম্পূর্ণ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে গঠিত হত। যেমন পারসি, ইউরোপিয়ান, হিন্দু, মুসলিম দল ছিল বোম্বেতে। উল্লেখ করা যায় ১৯৩৭ এর পরে সেখানে একটি রেস্ট বা অবশিষ্ট দল রাখা হয় মূলত ভারতীয় খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও সিংহলী ক্রিকেটারদের জন্য। আবার লাহোরে কখনও কখনও শিখ দল খেলেছে। বোম্বেতে অবশ্য শিখ সম্প্রদায় হিন্দু দলে খেলতেন। করাচিতে হিন্দু, মুসলিম ও ইউরোপীয় দল খেলত।
একমাত্র ধর্ম নিরপেক্ষ দল ছিল কলকাতায়। এখানে প্রথমবার ইউরোপিয়ান, ক্যালকাটা ও রেঙ্গুন জিমখানা খেলে। তবে কোনও ভারতীয় সুযোগ পাননি।
ইউরোপিয়ান দল বেশ শক্তিশালী ছিল। পাঁচজন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার খেলেন এই দলে। এঁদের মধ্যে ভিভিয়ান ক্রফোর্ড সারে ও লিস্টার্স এর হয়ে কাউন্টি খেলেন। প্রথম শ্রেণির খেলায় ১১,৯০৯ রান (১৬টি সেঞ্চুরি) ছিল তাঁর। ছিলেন সমারসেটের বিল গ্রেসওয়েল। জিনি প্রথম শ্রেণির খেলায় ১৩৪ টি ম্যাচে ৫৪০ উইকেট পেয়েছিলেন।
ক্যালকাটা দলের ৬ জন প্রথম শ্রেণির খেলোয়াড়দের মধ্যে সেরা ছিলেন আলেকজান্ডার লিন্ডসে হোসী। বাংলার প্রথম রঞ্জি অধিনায়ক ছিলেন তিনি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, হ্যাম্পশায়ারের হয়ে খেলা হোসি পরে ইউরোপিয়ান দলের হয়ে কোয়াড্রাঙ্গুলার ও বাংলার হয়ে রঞ্জি খেলেন। প্রথম শ্রেণির খেলায় ১৩৩ ম্যাচে ৬১৯৫ রান করেন। ফুটবলে খুব ভালো ব্যাক হিসেবে খেলতেন ক্যালকাটার হয়ে। লীগ, শিল্ডে ভালো খেলেছেন।
রেঙ্গুনের হয়ে জনা ছয়েক প্রথম শ্রেণির খেলোয়াড় ছিলেন। এঁদের মধ্যে চার্লস হর্সফ্যাল ছিলেন সবথেকে আকর্ষণীয় লোক। জীবনে একটাই প্রথম শ্রেণির খেলা খেলেন মাত্র কয়েক বছর আগে। তাও আবার আর্চি ম্যাকল্যারেনের এম সি সির বিরুদ্ধে। কাদের হয়ে? আর্জেন্টিনা। চমকে উঠলেন? আরও বলি? অতিকষ্টে ম্যাচ জিতেছিল এম সি সি। দুই উইকেটে। ইনি পরে শ্রীলঙ্কা (তখন সিংহল) ও বার্মায় খেলেন। ইনি স্কোয়াশ খেলতে খেলতে মারা যান।
২৫ শে ডিসেম্বর, ১৯১৩। বড়োদিনের সময় প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি ইউরোপীয় দল (মূলত কলকাতায় বসবাসকারী CCC ছাড়া অন্য দলের ব্রিটিশ ক্রিকেটার) ও ক্যালকাটা (অর্থাৎ ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব বা CCC)।
ইউরোপীয় দল ক্রফোর্ডের ৩৬ এর দৌলতে ১৭৫ করে। এসেক্স ও কেমব্রিজ ব্লু রিচার্ডসন ৫৯ রানে ৫ উইকেট নেন। জবাবে ক্যালকাটা এস সি বি লী-র ৫০ রানের জন্য ১৯১ রান করে। যদিও গ্রেসওয়েল ৭১ রানে ৪ উইকেট পান।
এরপর জনসন ৩১ করলে ইউরোপীয় দল ১৭৩/৯ তুলে ইনিংস ঘোষণা করে। ক্যালকাটা ৫ উইকেটে ১১৮ তোলার পরে খেলা শেষ হয়ে যায়, ম্যাচ ড্র। কার্টার একাই অপরাজিত ৫৯।
২৭ ডিসেম্বর রেঙ্গুন ও ক্যালকাটার ম্যাচ হয়েছিল। বহু খুঁজেও তার স্কোর পেলাম না।
২৯ ডিসেম্বর রেঙ্গুন ১৭৪ তোলে ইউরোপীয় দলের বিরূদ্ধে। হার্পার ৪২ করেন। গ্রেসওয়েল ৮১ রানে ৭ উইকেট নেন। জবাবে ইউরোপীয় দল ২৪৯ তোলে। ফকেট ১১৪ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মাত্র ২৫ বছর বয়সে মৃত কানিংহ্যাম ৭৫ রানে ৪ উইকেট নেন। উইলিয়ামস ৫০ রানে ৪ উইকেট নেন।
জবাবে ক্যানিংহ্যামের ৯৩ ও ও হার্পারের ৫১ রেঙ্গুনকে ২৯১ অবধি নিয়ে যায়। গ্রেসওয়েল আবার ১১৯ রানে ৬ উইকেট নেন। ম্যাচে ২০০ রানে ১৩টি।
জবাবে ইউরোপীয় দল দুই ঘণ্টায় ৪২.৫ ওভারে ২ উইকেটে ২২০ করে ৮ উইকেটে জিতে যায়। সাসেক্সের জন ভিডনার অপরাজিত ১০৪ করেন। ফকেট করেন ৫৭।
এরপরেই লেগে গেল বিশ্বযুদ্ধ।