অর্বাচীনের চোখে একটি ফ্যাসিবিরোধী নাটক – অন্বেষ বন্দ্যোপাধ্যায়
‘মিথ্যে মিথ্যে মিথ্যে
মিথ্যে এত চমৎকার
মিথ্যে এত সমঝদার
তোমায় করবে ভাগ্যবান
তোমায় করবে স্বাস্থ্যবান।’
মেফিস্টো কী? মেফিস্টো কে? মেফিস্টো কি একজন শিল্পীর দ্বৈতসত্ত্বা? একজন থিয়েটার অভিনেতার অন্তর্দ্বন্দ্ব? নাকি অন্য কিছু? প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে নাটক শুরু হওয়ার সাথে সাথেই। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় হেনরিক হপকিনের চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্য্যের ও অটো উলরিশের ভূমিকায় অনির্বাণ চক্রবর্তীর দুর্দান্ত অভিনয়। ক্লাউস মানের কালজয়ী ফ্যাসিবিরোধী উপন্যাস অবলম্বনে সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ২ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের দীর্ঘ নাটকটির প্রেক্ষাপট অবশ্যই নাৎসি জার্মানি। জার্মানির হামবুর্গ শহরের একটি বিপ্লবী নাট্যদল ‘পেপার মিল’। দলের পরিচালক হেনরিক হপকিন। হপকিন সহ নাট্যদলের অধিকাংশ সদস্যই কমিউনিস্ট ও ইহুদী। তবে সেই সঙ্গে দলে রয়েছে হিটলারের নাৎসি পার্টির সমর্থকরাও। এরা প্রত্যেকেই অভিনেতা এবং নিজ নিজ রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী। হিটলার তখনও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়নি। কমিউনিস্টরা নাৎসিদের ঘৃণা করে, হিটলারকে ক্লাউন বলে মনে করে। নাৎসিরাও থিয়েটারি কমিউনিস্টদের অভিজাত, শৌখিন, সমাজের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন বলে পালটা জবাব দেয়। কিন্তু সবার আগে তারা নাট্য অভিনেতা—এটাই তাদের প্রধান সত্ত্বা, সবচেয়ে বড়ো পরিচয়। হাইনরিখ হপকিন জার্মানির শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হতে চায়। সে প্রেমে পড়ে এক কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ের। নাট্যদলের অভিনেত্রীরা সমাজ বিচ্ছিন্ন আভিজাত্যে ডুবে থাকে। অন্যদিকে কমিউনিস্ট ও নাৎসিদের মতাদর্শগত রেষারিষি অব্যাহত থাকে। এই তীব্র দ্বন্দ্বই আগামীর অন্ধকারের ছায়ার আভাস দিয়ে যায়। কমিউনিস্টরা তাদের আদর্শের প্রতি অবিচল ও সৎ। তবে তাই বলে তারা নিজেদের জার্মান সত্ত্বা বিসর্জন দেয়নি। নাৎসিরা খাঁটি জার্মান রক্তের বিশুদ্ধ আধিপত্যে বিশ্বাসী। তারা চায় সকল জার্মান এক বিশ্বাসযোগ্য, অনুসরণযোগ্য অথোরেটেরিয়ান পার্সোনালিটির চারপাশে ঐক্যবদ্ধ হোক, ভার্সাই চুক্তির অপমানের জবাব দিক। এই সময়েই জার্মানির ভাগ্যাকাশে সংকট ঘনিয়ে আসে। আকাশ থেকে নেমে আসে মেফিস্টো। প্রথমে মেফিস্টোকে শয়তানের দূত বলে বোধ হয়। পরে বোঝা যায়, মেফিস্টো আসলে শয়তানের হাতের পুতুল। সেই শয়তানই হল ফ্যাসিবাদ। আর মেফিস্টোর ভূমিকায় অভিনয় করছে হাইনরিখ হপকিন, যে একদিকে কমিউনিস্ট, অন্যদিকে ন্যাশনাল হিরো। এতদিন হাইনরিকের নেতৃত্বে তার বিপ্লবী নাট্যদল অভিনয়ের মাধ্যমে নাৎসি বিরোধী প্রোপাগান্ডার প্রচার করে তাদের সামাজিক কর্তব্য পালন করে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ একদিন নাৎসিরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পার্লামেন্টে ক্ষমতায় চলে এল। হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলার নির্বাচিত হলেন। মঞ্চের ওপর নেমে এল নাৎসিবাদের প্রতীক স্বস্তিকা লাঞ্ছিত লাল কাপড়। আতঙ্ক গ্রাস করল হাইনরিকের নাট্যদলকে। দল ভেঙে গেল। হাইনরিক স্ত্রী, প্রেমিকা, বন্ধু, সহকর্মী সকলকে রেখে হামবুর্গ ছেড়ে বার্লিন পালিয়ে গেল, নিজ স্বপ্নপূরণের উচ্চাশায়। কিন্তু “সব ট্রেন বার্লিন পৌঁছয় না।” তাই তার থিয়েটারের বাকি শিল্পীরা হামবুর্গেই থেকে গেল। থাকবে নাই-বা কেন? তারা কমিউনিস্ট তো কী হয়েছে? জার্মানি তাদের জন্মভূমি, মাতৃভূমি। ইতিমধ্যে নাৎসি অফিসার জসথিঙ্কেল হয়ে এলেন হামবুর্গ থিয়েটারের সুপারিনটেনডেন্ট। সে শর্ত চাপাল, থিয়েটারে টিকে থাকতে গেলে ইহুদী স্ত্রীকে, ইহুদী পরিবার পরিজনদের পরিত্যাগ করতে হবে। বিপ্লবী থিয়েটারের অভিনেতারা তাদের আদর্শের প্রতি সৎ। তারা এতে রাজি হল না। ফলস্বরূপ তাদের কর্মচ্যুত হতে হল। তবু রুজি-রোজগার হারিয়েও তারা কম্প্রোমাইজ করল না। যদিও এর পরিণাম যে আরও কত ভয়ঙ্কর হতে পারে তার পূর্বাভাস পেতে দেরি হল না। শেষ রাতের মালগাড়ি, তাতে বোঝাই হয়ে চলেছে শয়ে শয়ে মানুষ। তারা চিৎকার করে নিজেদের নাম বলার চেষ্টা করছে। কমিউনিস্ট নাট্যকর্মীদের সুপ্তোত্থিত সামাজিক দায়বদ্ধতাবোধ চাগাড় দিয়ে উঠল। তারা নাৎসি জার্মানির নির্মম সত্যগুলো তাদের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে থেকেই প্রচার করতে শুরু করল। ফলে তাদের ওপর নেমে এল প্রাণঘাতী নির্যাতন। টানা ৯ দিন ধরে পিটিয়ে তাদের শরীরের সমস্ত হাড় ভেঙে ফেলা হল। রক্তে মাখামাখি মাংসপিণ্ডে পরিণত হল তাদের শরীর। ঘনিয়ে এল মৃত্যু। তবু দুটো উজ্জ্বল চোখ দিয়ে তারা হাইনরিককে ধিক্কার জানিয়ে গেল শেষমুহূর্তে। কেন? ধিক্কার কেন? হাইনরিক যে তখন জার্মানির শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হওয়ার স্বপ্নে মশগুল হয়ে বার্লিনে গিয়ে নাৎসি বাহিনীর সামনে আত্মসমর্পণ করে নিয়েছে। “হাইল হিটলার” বলতে তার আজ বিবেকে বাধে না। সে তার কমিউনিস্ট, বিপ্লবী শিল্পী সত্ত্বা—যার কাজ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ধ্বনিত হওয়া, সে পরিচিতিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। সে নাৎসি জার্মানির প্রধানমন্ত্রীর অনুগ্রহ লাভ করেছে। জার্মানির অভিনয় জগতে তার পদোন্নতি হয়েছে ঝড়ের গতিতে। সত্যিই সে একদিন জার্মানির শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পদে অধিষ্ঠিত হল। একটিই মন্ত্র কাজ করল এই অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে—প্রশ্নহীন আনুগত্য। কিন্তু হাইনরিক হপকিনের পূর্বজীবন তাকে এত সহজে পরিত্রাণ দিল না। সে যে ফ্যাসিস্ট প্রোপাগান্ডা বিরোধী প্রচারে সামিল ছিল। সে যে কমিউনিস্ট ছিল। সে যে কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ের সাথে প্রণয়বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। এসব অপরাধ নাৎসি সরকারের কাছে ক্ষমার অযোগ্য। তাই সে প্রাণপণে তার অতীত জীবনকে লুকিয়ে রাখতে চায়। তার কৃষ্ণাঙ্গ প্রেমিকা বার্লিনে এসে উপস্থিত হলে তাকে সে তাড়িয়ে দিতে, ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করে। তখনই প্রেমিকা তাকে জানায়, তার বন্ধুরা বাইরে অত্যাচারিত হচ্ছে। আর যাদের হাতে তারা মার খাচ্ছে, সেই নাৎসি বর্বরদের অনুগ্রহে ক্ষমতার অলিন্দে, টাকার ঘেরাটোপে বসে হাইনরিক নিজের সাথে প্রতারণা করছে। তার আত্মীয়, পরিজন, ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহকর্মী, সকল কাছের মানুষ, ভালোবাসার মানুষ আজ ঘৃণা করছে তাকে, তার বিবেককে বিসর্জন দেওয়ার জন্য। হাইনরিক ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে অন্তর থেকে আরও ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। সে নাৎসি প্রধানমন্ত্রীর হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে মেফিস্টোর ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছে। “যেমন নাচাবো তেমনি নাচো”-র সামনে মাথানত করে দিয়েছে। সে নাচতে নাচতে উচ্চারণ করছে, “যে কোনও নারী আপনি ছিনতাই করুন/ মস্তি, মস্তিতে মেতে উঠুন/ গভীর করে মাল খান, উল্টে দিন ফূর্তির পেয়ালা/ যে কোনও হিসেবি মানুষ কলুর বলদ/ পাশেই সবুজ ঘাস/ সেদিকে না চেয়ে/ পচা শুকনো খড় চেটে চেটে/ ঘুরছে তো ঘুরছেই, ঘুরছে তো ঘুরছেই…”—যা আসলে সত্য থেকে এসকেপিজেমেরই নামান্তর। হাইনরিকের নির্যাতিত সাথীদের একজন কোনোক্রমে নাৎসি কবল থেকে পালিয়ে এসে তাকে তার পুরনো নাট্যদল পেপার মিলের প্রিয়তম বন্ধু অটো উলরিশের মৃত্যুর খবর দিচ্ছে, যাকে স্রেফ পিটিয়ে মেরে ফেলেছে নাৎসি ঝটিকা বাহিনী, কমিউনিস্ট হওয়ার অপরাধে। কান্নায় ভেঙে পড়ছে হাইনরিক, কিছু টাকা দিয়ে পলাতক সাথীকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে, আপ্রাণ চেষ্টা করছে নির্মম সত্যের মুখোমুখি না হতে। অন্যদিকে তার নাৎসি সমর্থক সহকর্মীরা হিটলার রাজত্বে আরও সুন্দর সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছিল। তারা বিশ্বাস করেছিল যে জাতিয়তাবাদী সমাজতন্ত্রই পুঁজিতন্ত্রের জুলুমকে রুখে দিতে পারবে। ইহুদীরাই হল যত নষ্টের গোড়া। তাই তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে পারলেই সকল সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু বাস্তবে তারা দেখছে ইহুদীরা দেশ থেকে চলে গেলেও পুঁজিবাদের দাপট বেড়েছে বই কমেনি। তারা হামবুর্গ থিয়েটারের সুপারিনটেনডেন্টকে প্রশ্ন করছে, “কেন আমাদের সরল বিশ্বাসগুলোকে ঠকালেন?” তখনই সুপারিনটেনডেন্ট এর নির্দেশে কমিউনিস্ট প্রচারে মাথা বিষিয়ে যাওয়ার অপরাধে নৃশংসভাবে খুন হতে হচ্ছে তাদের, যারা প্রথম থেকে নাৎসিদের বিশ্বাস করে তাদের সঙ্গে ছিল। খুন হতে হচ্ছে তাদের অভিনেতা সত্ত্বাকে। প্রশ্ন উঠল, পুরনো নাৎসি সমর্থকরাও ফ্যাসিবাদের মিথ্যাচার, প্রতারণা ও নগ্ন স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারল, অথচ হাইনরিক তা পারছে না? সে স্বস্তিকা ও ঈগল লাঞ্ছিত পতাকার নীচে ডুবে গিয়ে পথ হাতড়াচ্ছে। সে আয়নায় নিজেকে আর দেখতে পাচ্ছে না। বিবেকের যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়েও তার কিচ্ছু করার ক্ষমতা নেই। সে হাহাকার করে উঠছে, “আমি তো শুধু একজন অভিনেতা হতে চেয়েছিলাম!” কিন্তু অভিনেতা হতে গিয়ে তাকে হারাতে হল কাছের সমস্ত মানুষদের, আদর্শচ্যুত হয়ে বিকিয়ে দিতে হল নিজের স্বাধীন চেতনাকে।
এখানেই শেষ হয়ে যায় নাটকটি। ফলে বক্তব্যের অসম্পূর্ণতা চোখে পড়েছে বড্ড বেশি। সত্যিই কি ফ্যাসিবাদের সামনে দাঁড়িয়ে শিল্পীরা অসহায়? তাদের কিছুই করার নেই? কোনও অনুসরণযোগ্য, সমাধানযোগ্য পথের দিশা তো মেফিস্টো নাটক দেখিয়ে গেল না! কেবল একটি পরিস্থিতিকে, সংকটকে ব্যাখ্যা করল। উত্তরটা সহজ। এর সমাধান খুঁজতে গেলে খাঁটি মার্কসবাদে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু আজকের বাংলা থিয়েটারে দুর্ভাগ্যজনকভাবে “ধরি মাছ না ছুঁই পানি” ওরফে পিঠ বাঁচানোর রোগ অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত। আর এখানেই মনে পড়ে উৎপল দত্তের ব্যারিকেড নাটকটি। ব্যারিকেডের প্রেক্ষাপটও নাৎসি জার্মানি। সেখানেও ফ্যাসিস্টদের আক্রমণের মুখে কমিউনিস্টদের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হতে দেখা যায়। কিন্তু সেখানে শেষ দৃশ্যে নাৎসি বাহিনীর গুলিতে কমিউনিস্ট কর্মীরা মৃত্যুবরণ করতে করতেও শক্ত করে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে থাকে কাস্তে হাতুড়ি খচিত লাল নিশান, যা কোনোরকম অস্পষ্টতা না রেখে স্পষ্ট রাজনৈতিক পথের হদিশ দেখিয়ে দিয়ে যায়। এখানেই কমিউনিস্ট প্রোপাগান্ডিস্ট উৎপল দত্তের শ্রেষ্ঠত্ব।
চিত্র: অর্পণ চক্রবর্তী