|

আবর্জনা – মার্কো তুলিও আগিলেরা অনুবাদ: আনিসুজ জামান

শেয়ার করুন

মার্কো তুলিও আগিলেরা গার্‌রামুনঞ

স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: আনিসুজ জামান

[মার্কো তুলিও আগিলেরা গার্‌রামুনঞ (জ. ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯) সমকালীন লাতিন সাহিত্যে অন্যতম অগ্রগণ্য লেখক। তিনি ঔপন্যাসিক, সাহিত্য-সমালোচক এবং সাংবাদিক। কলোম্বিয়ার বোগোটায় জন্মগ্রহণকারী এই লেখক দর্শন ও সাহিত্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। তিনি মেহিকোতে বসবাস করেছেন এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। পঞ্চাশটির মতো বই প্রকাশিত হয়েছে এবং লাতিন সাহিত্যের অনেক উল্লেখযোগ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁকে বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলোম্বীয় লেখক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।]

আমি টের পাচ্ছিলাম বমি উদ্রেককারী তার উপস্থিতি সরাসরি আমার কাঁধে নিশ্বাস ফেলছে। আমি কিন্তু ভয় পাইনি। কারণ আমি দুর্বল চিত্তের নারী নই। আমি ভীতুও নই, যদিও আমি বলতে পারি না যে আমি আমাজনীয়১ নই। আমি বরঞ্চ সাধারণ: আমার কিছু সহজাত ভয় রয়েছে, আপনারা ধরে নিতে পারেন প্রচলিত যে ভয়গুলো থাকে, যেমন ইঁদুর, সাপ, তেলাপোকা এগুলো দেখে আঁতকে ওঠা। আমার দিকে পুরুষদের ছ্যাবলার চাহুনি আমাকে বিরক্ত করে না। বরঞ্চ এতে আমি মজাই পাই। আমি কোনও মহিলা না, নারী, অপূর্ব সুন্দরী ওয়াকেরিয়া যেমন দুর্দান্ত প্রশংসার দাবিদার। আমার আকর্ষণীয় নিতম্ব আছে। আর আমার স্তনদুটি? হ্যাঁ, প্র্যাক্সেটিলসের২ প্রতিমার মতো। (আমাকে নীচতলায় থাকা এক চারুকলার আঁতেল শিক্ষার্থী এটা জানিয়েছিল, যে আমাকে তাঁর জ্ঞান দিয়ে মুগ্ধ করতে চেয়েছিল। সম্ভবত সে উপরতলার নিঃসঙ্গ প্রতিবেশীকে পটিয়ে এবং অনিবার্যভাবে কিছু উপহার না দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে বসবাস করতে চেয়েছিল)। (আমি কেন একা থাকি সেটা আপনাদের না জানলেও চলবে। এটুকু জানাই যথেষ্ট যে আমি পাগল বা অসামাজিক নই।) আর আমি কোনো ছোটো অবলা প্রাণী না। আমি কারাতে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছি এবং উল্কি ও পুরুষ্টু দ্বিশি পেশীওয়ালা অনেক ম্যাচোর মুখের উপর ডানপায়ের পাতা রেখেছি। এই কারণেই আমি যখন আমার ঘাড়ের পিছনে তার নিঃশ্বাস অনুভব করি তখন ভয় পাইনি। এই ধরনের পরিস্থিতির সর্বোত্তম প্রতিষেধক হল জানা যে খুব শীঘ্রই বা বিলম্বে আপনারও সময় আসবে এবং আপনার নখরটি লুকিয়ে রেখে আপনাকে অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। ঘ্যানঘ্যান করা যাবে না। পাতাল রেলের ভিড় আপনাদের যে শিক্ষা দেয় তা তুচ্ছ মনে করবেন না। যেমন কেউ একজন বলেছে: সাইকোপ্যাথের এই শহরে আমাদের নারীদের শীতল হৃদয় এবং প্রতিদিনের প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। সামান্য অসহায়ত্বও দেখানো যাবে না। আমি এক তেজস্বী ঘোটকী, যে জানে কীভাবে তার কনুই এবং হাঁটু ব্যবহার করতে হয়। বরঞ্চ (আমি আমার শীতল রক্তের যথার্থতা বুঝিয়ে দেব) লোকটিই তুলনামূলক বিচারে তুচ্ছ হয়ে যাবে।

কয়েক সেকেন্ড আগে ওকে দেখেছিলাম একটি বিল্ডিংয়ের আবর্জনার পাত্রের পাশে। সে সেখানে দাঁড়িয়ে কী করছিল, তাকে ভালো করে দেখলেই মনে হয় তার হাবভাব সন্দেহজনক। একাকী নারীরা সাবধান! লোকটি একটি ভৌতিক গল্পের কুয়াশাচ্ছন্ন। একটি হাস্যকর মুকুট পরে আধা-বৌদ্ধিক ভাব ধরা এবং এমন একটি ওভারকোট পরে আছে যেটা নিউ ইয়র্ক শহরের কোনো ভিক্ষুক কি পরতে পারে? এমনকি ধূমপানও করছিল না। যেন সেখানে থাকা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। যেন নিজের চিন্তার মধ্যে হারিয়ে গেছে। তবে বিচলিত হওয়ার মতো কিছু দেখিনি। এই অন্ধকার জঙ্গলে ধর্ষকদের পরিসংখ্যান ইত্যাদি জেনেও ঠিক রাত ১২টায় আমাদের পরিপাটি আবাসিক ইউনিটের এই সুনসান অঞ্চলে আমি কী করছিলাম? তবে, আপনি নিজেকে বলেছেন: এটি অন্য গ্রহে ঘটে, এমনটি আমার সাথে কখনও ঘটবে না। ঠিক আছে, উন্মাদ হয়ে বা বরং বেপরোয়া ও অলস হয়ে শান্তভাবে সাগরে নিক্ষেপ করে এমন একজনের মতো নিজেকে রাতের মধ্যে নিক্ষেপ করেছি: রান্নাঘরে বেসিনের নীচে, বাথরুমে, শোবার ঘরে আবর্জনা জমে থাকতে দেখেছি। পনেরো দিনের জমা জঞ্জাল। শুয়োর, নিজেকে বললাম, ঘরটিকে বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। ঘুম আসছিল না, শরীরে ছিল পূর্ণশক্তি ও উদ্দীপনা, কিন্তু কিছুই করার ছিল না। আমার কাছে ভালো বইও ছিল না, টেলিভিশনটি ভেঙে গেছে এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। আর স্বমেহন? তাও ভালো লাগছিল না। প্রেমিকবিহীন পূর্ণবয়স্ক নারী আমি, প্রেমটেম করার ইচ্ছাও নেই। এটাই আমি; এবং আরও অনেক কিছুই যা আমি আপনাকে বলব না। সুতরাং আমার জীবনের সেই মোড়ে এই মুহূর্তটির যুক্তি (আমি জানি দায়িত্বজ্ঞানহীন) বিদ্যমান।

প্লাস্টিকের ব্যাগে সমস্ত আবর্জনা ভরে ফেলতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। জানি না কীভাবে আপনাদের এই পরিস্থিতি নিয়ে বলব আর সে কারণেই আমি ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যাই। মানুষ আসলে কী? অনেক শাখাবিশিষ্ট একটি গাছ। যথেষ্ট হল, আবার আমার ঘাড়ে পিছনের সেই নিশ্বাসে ফিরে আসা যাক। সিনেমার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিবর্তে তাকে না দেখা পর্যন্ত আমার মুখটি আস্তে আস্তে ঘুরিয়েছি, যতক্ষণ না তার মুখটি ৫ সেন্টিমিটার দূরে দেখেছি। তার বড়ো বড়ো চোখ দেখে মুগ্ধ হই।

চোখের প্রসারিত মণিদুটো মরা মাছের মতো স্থির, নিশ্চল, ভেজা। না কামানো দাঁড়ি, চুলগুলো নোংরা, উসকোখুসকো। তার নিশ্বাসের দুর্গন্ধে জড়োসড়ো না হয়ে সহ্য করেছি এবং তার অঙ্গভঙ্গিতেই প্রকাশ পাচ্ছিল: আমি খুব খারাপ, খুব খারাপ লোক। ওর নিশ্বাসটা ছিল অনেক দিনের অনাহারীর মতো, জৈব আবর্জনায় ফেলা বাসি মাংসের মতো, বমি বমি ভাব জাগায় এমন মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ। শুধুমাত্র যা জৈব তাই পচে যায়, সৃষ্টিকর্তার কী আজব লীলা! যদি থেকে থাকে। মাথা খারাপ গন্ধ। আমার ঝিমুনি আসছিল, তবে অল্প সময়ের মধ্যেই কেটে গেল। নিজেকে বলি: এটি একটি পরীক্ষা, তুমি শ্যালী কোন ধাতু দিয়ে বানানো এখনই জানতে পারবে।

বন্ধু, আমরা কিন্তু একা। লোকটি বলে। কোট সামান্য ফাঁক করে পুরাতন এক কসাইয়ের চাকু দেখায়, সস্তা সেটা (সস্তা তবে কার্যকরী, ব্রাজিলিয়ান স্টেইনলেস চাকু। এমনকি আমার হাসি পাই, কারণ আমার অ্যাপার্টমেন্টে একই রকম আরেকটা আছে)।

পনেরো বা বিশ সেন্টিমিটার ত্রিভুজাকার ব্লেড (বিষমভুজ ত্রিভুজ)-এর ডগায় একটি খাঁজযুক্ত কালো হ্যান্ডেল রয়েছে যা আমাদের ভবনের শেষ জ্বলন্ত লণ্ঠনের আলোয় প্রতিফলিত হচ্ছিল। খাঁজগুলি সম্পর্কে বলতে (পরবর্তী প্রজন্মের পাঠকদের বিষয়ে বলতে গেলে খুব নির্দিষ্ট করে বলতে হয় শুধুমাত্র যারা অ্যারিস্টটল পড়েছেন তারাই বুঝতে পারবেন), আমি ওগুলো পছন্দ করি না, আমার পছন্দ আমি যা তাই, যেমন একজন ভবঘুরে বা একজন পৌরাণিক ও ঔপন্যাসিক (এবং ভৌতিক উপন্যাস ও বোর্হেসের ছোটোগল্পের একজন ভালো পাঠক। এর জন্যই আমি নিজেকে বলি: যা ঘটছে তা হেলাফেলা না।)।

শোনো বন্ধু, আমি তোমার কোনো ক্ষতি করতে চাই না, (এভাবেই বলছিল, “ক্ষতি”) আর বলছি যে, আমার আদেশগুলো যদি ঠিকমতো পালন না করো তাহলে ছয় জন মেয়ের সঙ্গে যা করেছি সেটা তোমার সঙ্গে করতে আমার মোটেও বাধবে না।

তুমি জানো ছোট্ট কাটা দাগগুলো কি? এই বাচ্চা মেয়ে, আমি তোমাকে নিশ্চিত করে বলছি, আমি রীতিমতো ব্যাপারটা চর্চা করছি। আমি একরকম শিক্ষানবীশ সার্জন। এবং যেহেতু দোযখ আমার জন্য নিশ্চিত হয়ে আছে—একটা কম বা বেশি তাতে কীই-বা আসে যায়! ভয় পাচ্ছ?

ভয়? আপনাদের নিশ্চিত করছি, না। বরঞ্চ এটা এক ধরনের বিশেষ অনুভূতি। আমি আসলে মূল চরিত্র নই, স্টিফেন কিংয়ের গল্পের উপর ভিত্তি করে নির্মিত ভৌতিক এক চলচ্চিত্রের দর্শকমাত্র।

জানি তুমি থাকো একা। জানি কেউ তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসে না। আজ রাতে আমার বান্ধবী হও এটাই আমি চাই, আর ঘটুন না, ঈশ্বর যা চান তাই…তারপর যা হওয়ার তাই হবে।

তার দিকে তাকিয়ে হাসি। জানি আপনারা আমাকে বিশ্বাস করছেন না। আমি ওকে বলি: ভাইজান, যন্ত্রটা জায়গামতো রাখো, পাছে একটি টহল পুলিশ এসে দেখে এবং মনে করে তোমার খারাপ উদ্দেশ্য আছে।

আমাদের দেখলেই বোঝা যায় আমরা একে অন্যের সঙ্গে যাই না। আমাকে কী বলতে হবে যে লোকটি আমার কথায় বিভ্রান্ত হয়েছিল? সে কাঁপতে কাঁপতে আমার বাহু ধরে পাখি বা কুক্করের চকিত দৃষ্টি দিয়ে চারপাশে তাকায়।

জানি না লক্ষ করেছেন কিনা কুক্কর সব সময় ওর মাথা নাড়ায় থেমে থেমে, যেন লাফিয়ে লাফিয়ে। লোকটি আমার ভবনের দিকে তাকায়। দেয়ালে ময়লা থেকে হওয়া সবুজ শ্যাওলা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গ এক হ্যারিকেনের আলোয়। চিন্তিত হয়ো না, ওখানে কোনো ক্যামেরা নেই।

প্রতিবেশীরা কঞ্জুস, যদিও একজন আরেকজনের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, ওরা একমত হতে পারে না তুমিই মাসে একবার আমাদেরকে ছিনতাই করো। কিন্তু তোমাকে খারাপ দেখাচ্ছে না, হয়তো একটু নোংরা। আমাকে বোকা বানাতে পারবে না। আমি বাজি ধরে বলতে পারব তুমি সাধারণ কোনো ছিচকে চোর না। মুঠো আরও শক্ত করে চেপে ধরে, টেনে নিশ্বাস নেয় যেন পানিতে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে এবং তাতে মনে হল সে হাস্যকরভাবে অপমানিত হয়েছে। বলে, গাধা, তুই কি বুঝতে পারছিস আমার ছুরিতে এই ছোট্ট দাগগুলি কী?

আমাকে দেখানোর জন্য আবার সে বের করে। খুব বেপরোয়া হাতলটিতে আমার আঙুল বোলাতে দেয়।

বিপদের সময় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আত্মরক্ষার মৌলিক কৌশলটি প্রয়োগ করার তখনই ছিল মোক্ষম সময়: তার কব্জি শক্ত করে ধরে বিদ্যুৎগতিতে ছুরিটাকে ধাক্কা দিয়ে অন্য হাতে সে জয়েন্টটি বাঁকিয়ে নেবে যাতে আঙুল আলগা হয়ে যাবে এবং ছুরি পড়ে যাবে নীচে, ধপাস! পরে অণ্ডকোষে ঝেড়ে এক লাথি, ধপাস! আমি এটি অনুশীলন করেছি এবং ভালোই কাজে দিয়েছে। প্রতিদিন জিমে যাই এবং সপ্তাহে একবার জুজুৎসু ও কারাতে ক্লাস করি। কিন্তু আপন মনে ভাবি: এই তুচ্ছ লোকটা দৌড়ে পালাবে এবং মুখোরোচক গল্প শোনার জন্য লালায়িত সহকর্মীদের বলার মতো কিছু থাকবে না। আমি যে কী কাজ করি সেটা আপনাদের জিজ্ঞাসা না করাই ভালো। শুধু এটুকু বলতে পারি দিনের আটটি ঘণ্টা আমি তেলাপোকা হয়ে থাকি। এবার তীব্রতার সাথে সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকাই। সেই শিশুতোষ খেলাটির মতো যেখানে দুইজন প্রতিপক্ষ একে অপরের দিকে চোখ ঠিকরে রাখে কার চোখের পলক আগে পড়ে। যে হেরে গিয়েছিল সে আমি। পলক ফেললাম। চোখে জল এসে গিয়েছিল। লোকটি ধারণার চেয়েও শক্ত ছিল। আমি আমার চোখের পাতা চেপে ধরলাম এবং যখন খুললাম তখন বললাম: তুমি জিতেছ, তোমারই জয় হয়েছে, কিন্তু হাতিয়ারটি লুকিয়ে রাখো। চলো আমার অ্যাপার্টমেন্টে যাই। এখানে অনেক ঠান্ডা।

সে আমার বাহু ধরে, কনুইয়ের একটু উপরে, যেন সে গত বিশ বছর ধরে আমার স্বামী। বিল্ডিংয়ের দিকে এগোই। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় দেখলাম আমার পরচর্চাকারী প্রতিবেশী, আমি তাকে ক্যাপ্টেন কামুক নামে ডাকি, তার অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে রেলিংয়ের উপর ঝুঁকে ধূমপান করছে। সে ভাব ধরে যেন তার কিছুই আসে যায় না কিন্তু বিরক্ত বা ক্রোধসূচক অর্ধেক হাসি সে এড়াতে পারে না। সে যদি সত্যিকার অর্থে লালসাপূর্ণ মাংসাশী যে কিনা সর্বক্ষণ হস্তমৈথুনে আচ্ছন্ন হয়ে না থাকত তাহলে সে ভালো প্রতিবেশীর মতো সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে থাকত, শুভরাত্রি বলত এবং তারপরে আমার সঙ্গী কী ধরনের খারাপ লোক সেটা বুঝতে পারত। গাধা! আমার প্রিয় নায়ক হওয়ার সুযোগ হারিয়ে ফেলল। সে আসলে একজন ক্রীড়াবিদ, চটপটে ছেলে, যে কিনা ধর্ষণে অভিযুক্ত, খুনি, আততায়ী বা যে কোনো কিছুকেই পিষে ফেলতে পারত। কিন্তু সত্য হল লোকটিকে হটাতে তার সেটা প্রয়োজনই হত না অথবা সবচেয়ে কম প্রয়োজন হত। এটা সে করলে আমার পরিকল্পনায় বাধার সৃষ্টি করত, যা ছিল… ঠিক আছে, সত্য হল যে আমার পরিকল্পনাগুলি বিখ্যাত আঁকাবাঁকা পথগুলোর মতো। ধরে নিচ্ছি আপনারা জানেন আমি কী নিয়ে কথা বলছি।

আমার পড়া বোর্হেসের বিখ্যাত গল্পের কথা বলছি না অথবা আমি যেমন বলব (আমি লিখতাম, ভালো করে বলতে গেলে বোর্হেস কখনও কিছু বলেনি, তিনি সবসময় লিখতেন যেন তার ঠোঁট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে এক পুস্তক দাঁড়িকমাসহ—বালু দিয়ে তৈরি এক অসীম পুস্তক), বোর্হেস যেমন বলতেন (বিশেষ করে ওই বইগুলোর কথাই বলছি) খুব গভীর রাত পর্যন্ত তোমাদের ক্লান্ত করে দিয়েছি। আমরা যাই করি না কেন সেটাই হচ্ছে আগের কোনো কাজের সন্তান এবং একইসাথে পঞ্চাশ অথবা তারও বেশি কাজের সম্ভাবনার পিতা। কী বিশ্লেষণাত্মক মন, তাই না? এইভাবে একজন যুক্তিবিদ্যার অধ্যাপক আমাকে বলেছিলেন যিনি আমার অনেক, অনেকেরও বেশি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। আমরা সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়, আমার বিশ্লেষণাত্মক মন সম্ভাব্য ভবিষ্যতের মধ্য দিয়ে ছুটে যায়: ১, শিকারটি গলা বাঁধা এবং বাঁধা (ধরা যাক পর্দার তার দিয়ে), ড্রয়ার খুলে ঘাটাঘাটি করছে (বেচারা কি আশা করতে পারে): কী চুরি করবে? বোর্হেস নাকি সারামাগোর বই? (আমার উপকারই করবে যদি সারামাগো নিয়ে যাও)। হাঁড়িপাতিল? কিছু না পেয়ে হতাশার সঙ্গে বলে: এই কুত্তি, কাপড় খুলে ফেল!

কিন্তু কীভাবে, আমি তো বাঁধা?

ধূর্ত লোকটা চিন্তা করতে থাকে, বিছানায় গিয়ে বসে।

হাতটা তো খুলে দিতেই পারো, আমি বলি। কথা দিচ্ছি, ভালো আচরণ করব। হাসি (আমার)। কামোদ্দীপক।

আমি সঙ্গীহীন।

জানি, সে বলে।

বাঁধনটা খুলে দাও না। তোমাকে একটি লোভনীয় মাংস এবং মদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি—একটু পুরনো কিন্তু এখনও ভালো আছে। আরে! দিশেহারা। সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে স্থির দৃষ্টিতে।

সত্যিই? তুমি ভয় পাচ্ছ না?

না, তোমার নাম?

এখন দেখা যাচ্ছে পুলিশের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করছ!

না, বিশ্বাস অর্জনের জন্য নামটা প্রয়োজন।

আগে খাই, পান করি, তারপর যা হবার হবে।

তাই?

হ্যাঁ তাই।

তুমি কি এই বিষয়টা শোনোনি, মেয়েরা, সব মেয়ে, আমরা ধর্ষিত হতে চায়?

ঠিক আছে, হ্যাঁ, কিন্তু না, সত্য হল যে, সম্ভবত, মোক্ষম সময়টাতে ঠিকই সব দিয়ে দেয়, সে বলে।

কিন্তু সবাই তা নয়। বরং আমি মনে করি তারা অজ্ঞান হওয়ার ভান করে।

এটাই, আমি সেটাই বলছি।

আমি ওদের মতোই, একাকী এক মেয়ে ধর্ষিত হতে চাই।

তাই?

হ্যাঁ। তাই।

জানি না আমার পরিকল্পনাটা বুঝতে পারছেন কিনা।

আমরা পৌঁছে গেলাম। করিডরে কেউ ছিল না। শহরের আলো আকাশটার সঙ্গে মিলে এক আনন্দের ঐকতান সৃষ্টি করেছে। দরজা খুলি। ভেতরে আসুন, বললাম ভীষণ সৌজন্যের সাথে। মুহূর্তের জন্য লোকটি সম্মানিত অতিথির মতো অনুভব করল।

ধন্যবাদ, মিস। তখন তার হাতে আর ছুরি ছিল না। সেটা গোঁজা ছিল হতচ্ছাড়া এক বেল্টের সঙ্গে।

এখানে যা দেখছেন সেটা আমার বসার ঘর। অনুগ্রহ করে বসুন।

হঠাৎ করেই সে আসল রূপে ফিরে আসে, আগের থেকেও নিষ্ঠুর হয়ে।

তুমি কি জানো আমি তোমাকে ধর্ষণ করতে যাচ্ছি?

আমি আগে থেকেই কল্পনা করেছি। কিন্তু চিন্তার কী আছে? আসুন খাওয়া-দাওয়া করি, পান করি। তারপর যা হওয়ার হবে। ছুরিটা বেল্ট থেকে খুলে টেবিলে রাখল। আমি মাইক্রোওয়েভে কেএফসির অর্ধেক চিকেন গরম করলাম। দু গ্লাস পাদ্রে কিনো৩ পরিবেশন করি। আমরা চিয়ার্স করে খাওয়াদাওয়া সারি। সে আমাকে তার গল্প বলেছিল। আমি তাকে আমারটা শোনাই।

মিস, জানো কি? তোমার আর কোনো ক্ষতি চাই না। তার চেয়ে ভালো আমি যাই।

যাবেন না, স্যার। আপনাকে ভালো লাগতে শুরু করেছে। আসুন বিছানায় যাই। সুন্দর কিছু একটা হোক না।

ঘটনাটি ঘটে গেল। অথবা ঘটে যাওয়ার ভান করলাম। এমনকি আমার ধর্ষকের ভিতরে ঢোকার সময়টুকুও হল না। তার ক্ষুধা এতোই বেশি ছিল যে কেক ওভেনে প্রবেশ করানোর আগেই পুড়ে গেল। কিছু অপ্রীতিকর বিবরণ ছিল যা আমাকে অবশ্যই এড়িয়ে যেতে হবে। এটি স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত। সে এলিয়ে পড়ল। আমি হাতকড়া বের করে তার কব্জিতে পরিয়ে বিছানার লোহার পায়ার সাথে বেঁধে দিলাম। এরপরে যা ঘটেছিল তা আপনাদের কল্পনার উপরই ছেড়ে দিলাম। একই ছুরি দিয়ে আমি আরেকটি খাঁজ বানাই, কিন্তু তার অস্ত্রের হাতলে নয়, বরঞ্চ আমার নিঃসঙ্গ বিছানায়, যে বিছানাটা আমাকে এত্ত আনন্দ দিয়েছে।


টীকা:

১. আমাজনে বসবাসরত আদিবাসী নারীদের অত্যন্ত সাহসী বলে গণ্য করা হয়।

২. প্র্যাক্সেটিলস খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর এথেন্সের অন্যতম প্রধান ভাস্কর। তিনিই প্রথম নারীর নগ্নরূপকে জীবন্তসদৃশ করে উপস্থাপন করেন।

৩. পাদ্রে কিনো রান্নার মদ, সাধারণত ভদ্রসমাজে এটা পানীয় হিসেবে গ্রহণ করা হয় না।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *