হাসান আজিজুল হকের হেমিংওয়ে চর্চা ও অনুবাদ – মোজাফ্ফর হোসেন
মার্কিন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ের (জুলাই ২১, ১৮৯৯-জুলাই ২, ১৯৬১) জন্ম শিকাগো নগরের শহরতলির ছোটোশহর ওক পার্কে। বাবা ক্লেয়ারেন্স এন্ডমন্ডস হেমিংওয়ে পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। তাঁর ছিল দুটি নেশা—শিকার করা আর মাছ ধরা। তাঁর মা গ্রেস হল ছিলেন চার্চ-গায়িকা। বাবা-মা দুজনই চাইতেন হেমিংওয়ে তাঁদের মতো হোক। ফলে বাবা কিশোর হেমিংওয়েকে কিনে দিলেন মাছ ধরার ছিপ ও বন্দুক। মা কিনে দিলেন যথারীতি বাদ্যযন্ত্র—‘চেলো’। মাছ ধরা, শিকারে যাওয়া ও যন্ত্রসংগীতে সময় কাটানোর পাশাপাশি হেমিংওয়ে কিছুদিন মুষ্টিযুদ্ধেও তালিম নেন। লেখালেখির শুরু স্কুলে থাকতেই। সাপ্তাহিক স্কুল ম্যাগাজিন ট্রাপিজ-র সম্পাদক হওয়ার কারণে নিয়মিত ‘খবর ও গাল-গল্প’ নামে একটি কলাম লিখতেন। এই সময় তিনি সেপিজিনগান নামে প্রথম গল্পটি লেখেন। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত ছোটোগল্পের বই ইন আওয়ার টাইম তেমন সাড়া ফেলতে না পারলেও ১৯২৬ সালে প্রথম উপন্যাস দি সান অলসো রাইজেস দিয়ে তিনি আলোচনায় আসেন। প্রথম বছরেই বইটির ছয়টি সংস্করণ বের হয়। মৃত্যুর আগে এক মিলিয়নের বেশি বিক্রি হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে ফেয়ারওয়েল টু আর্মস প্রকাশের প্রথম চার মাসেই প্রায় আশি হাজার কপি বিক্রি হয়। ফর হুম দ্য বেল টলস (১৯৪০) প্রকাশের প্রথম ছয় মাসে বিক্রি হয় পাঁচ লাখ কপি। ১৯৫১ সালে উপন্যাসিকা দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি প্রকাশের পরপরই আগের সব বিক্রির রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। এরপর ১৯৫৪ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
হেমিংওয়ে-উত্তর বিশ শতকের কথাসাহিত্যে তাঁর নির্মেদ ও নিরাবেগী ভাষার ভীষণ প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিশ শতকের বিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি তাঁর অধিকাংশ সাহিত্যকর্ম রচনা করেছিলেন। ১৯৬১ সালে আত্মহত্যা করেন এই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষটি।
মেদহীন ঝরঝরে গদ্যে, অল্প কথায়, জীবনের সবচেয়ে জটিল সমস্যাগুলো বলে ফেলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা এই কথাসাহিত্যিক। তাঁর লেখনীর ধরনকে ব্যাখ্যা করা হয় ‘আইসবার্গ থিওরি’ হিসেবে, যেটি ‘theory of omission’ হিসেবেও ব্যাখ্যাত। যে কারণে হেমিংওয়ে-উত্তর সাহিত্যবিশ্বে খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর প্রিয় লেখক হেমিংওয়ের মৃত্যুসংবাদে আহত হয়ে স্থানীয় কাগজে যে শ্রদ্ধার্ঘ্য লেখেন সেখানে উল্লেখ করেন, ‘তাঁর (হেমিংওয়ের) লেখা আপাতদৃষ্টিতে সহজ সরল স্পষ্ট, এমনকি নাটকীয় মুহূর্তেও প্রায় সময় নির্লিপ্ত। কিন্তু সাদাসিধে এই সাহিত্যের তলদেশে লুকিয়ে আছে, একে উঁচু করে তুলে ধরেছে নিগূঢ় প্রজ্ঞা।’ [অনুবাদ : যুবায়ের মাহমুদ/বিডিআর্টস ]।
হেমিংওয়ে ছিলেন ‘ওয়ার প্রোডাক্ট’। গোটা মার্কিন সাহিত্যে তাঁর মতো করে যুদ্ধকে আর কেউ উঠিয়ে আনতে পারেননি। ফলে বিশ্বসাহিত্যে ওয়ার রাইটিংস বা যুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যকর্মের প্রসঙ্গ উঠলেই চলে আসে তাঁর নাম। হেমিংওয়ের সাহিত্যে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও যুদ্ধ-পরবর্তী নিঃসঙ্গতা বা হতাশার কথা যেভাবে এসেছে তিনি নিজে যুদ্ধসৈনিক না হলে হয়তো সেভাবে আসত না। ব্যক্তিজীবনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাংবাদিক হিসেবে ফ্রন্টে কাজ করেছেন। যুদ্ধে আহতও হয়েছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে হেমিংওয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র। ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে আমেরিকা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। জার্মান ও অস্ট্রিয়ার বিপক্ষ জোটে শরিক হয়। ১৮ বছর পূর্ণ হলে হেমিংওয়ে আর্মিতে নিজের নাম লেখানোর চেষ্টা চালান; কিন্তু বাঁ চোখে সমস্যা থাকার কারণে বাদ পড়ে যান। যখন তিনি জানতে পারেন যে, রেড ক্রস স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার নিচ্ছে, তিনি দ্রুত নিজের নাম লেখান। তিনি কানসাস শহরে কাজ করেন। এই শহরের কথা তাঁর ছোটোগল্প ও উপন্যাসে উল্লেখ আছে। যুদ্ধ চলাকালে স্টার নামক সংবাদপত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে ফিকশন লেখার ক্ষেত্রে তাঁর জন্য বড়ো সম্পদ হয়ে দাঁড়ায়। ছোটো ছোটো বাক্য, সংক্ষিপ্ত কার্যকরী বয়ান, অতিকথন বর্জন—এগুলো তিনি সংবাদমাধ্যমে কাজ করতে করতে আয়ত্তে আনেন বলে ধরে নেওয়া যায়।
যুদ্ধকালে হেমিংওয়ে প্রথমে যান প্যারিসে, এরপর মিলানে। যেদিন তিনি মিলানে পৌঁছান, সেদিনই সামরিক ভাণ্ডারে বিস্ফোরণ ঘটে। হেমিংওয়ে সৈনিকদের ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া শরীর মর্গে বয়ে আনেন। তিনি ওই প্রথম প্রত্যক্ষ করেন যুদ্ধের বীভৎস চিত্র। এরপর তিনি নিজেও অস্ট্রিয়ার মর্টার সেলে আহত হন। ওই সময় তিনি ইটালিয়ান সৈন্যদের মধ্যে চকোলেট ও সিগারেট বিলি করছিলেন। আহত অবস্থায় তিনি মিলানের একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে নার্স Agnes von KurowsKz-এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। পরিচয় থেকে প্রণয়। যার অনুপ্রেরণায় তিনি লেখেন পৃথিবীবিখ্যাত উপন্যাস এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস। একইভাবে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস দ্য সান অলসো রাইজেস, আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস আইল্যান্ডজ ইন দ্য স্ট্রিম-ও তাঁর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে রচিত। এর বাইরেও তাঁর প্রায় প্রতিটি রচনায় কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধোত্তর সমাজব্যবস্থার ছোঁয়া আছে।
হেমিংওয়ের বিখ্যাত ছোটোগল্প ইন্ডিয়ান ক্যাম্প বের হয় ১৯২৪ সালে প্যারিসের একটি পত্রিকায়। এই গল্পে হেমিংওয়ের প্রায় আত্মজৈবনিক চরিত্র নিক অ্যাডামসের প্রথম আবির্ভাব ঘটে। শিশুচরিত্র নিকের বয়ানেই গল্পটি বলা। এই গল্পে শিশু নিক তার ডাক্তার বাবার সঙ্গে ইন্ডিয়ান ক্যাম্পে যায় এক মহিলার সন্তান জন্ম দিতে। অবস্থা ক্রিটিক্যাল দেখে ডাক্তার মহিলাকে সিজার করার সিদ্ধান্ত নেন। সহযোগিতা করে নিক। তখনকার যুগে সিজার করাটা আজকের মতো সহজ ছিল না। অজ্ঞান বা অবশ না করে পেট কাটার কারণে স্বামী তার স্ত্রীর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে চাকু দিয়ে নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করে। এই গল্প দিয়েই হেমিংওয়ে তাঁর স্বকীয় স্বর নিয়ে ছোটোগল্পের জগতে আবির্ভূত হন। পরবর্তীকালে তাঁর ছোটোগল্পের সিগনেচার টোন হয়ে ওঠে এই মৃত্যু-আতঙ্ক ও একাকিত্ব।
আমরা জানি এরপর হেমিওংয়ে প্রায় দুই ডজন গল্প লিখেছেন নিকের বয়ানে বা নিককে অন্যতম চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করে। হেমিংওয়ের মৃত্যুর পর এই গল্পগুলো নিয়ে The Nick Adams Stories শীর্ষক একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। এই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এই সিরিজ গল্পে আমরা শিশু থেকে তরুণ নিক অ্যাডামসকে পাই।
১৯২৫ সালে ১৫টি গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয় হেমিংওয়ের প্রথম ছোটোগল্পের সংকলন ইন আওয়ার টাইম। বইটি তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সাড়া ফেলতে পারেনি। ইন্ডিয়ান ক্যাম্প ছাড়াও এই সংকলনে স্থান পাওয়া উল্লেখযোগ্য গল্পগুলোর ভেতর আছে ক্যাট ইন দ্য রেইন, সোলজার’স হোম, দ্য ডক্টর অ্যান্ড দ্য ডক্টর’স ওয়াইফ, দুই খণ্ডে দ্য বিগ টু হার্টেড রিভার, অণুগল্প এ ভেরি শর্ট স্টোরি প্রভৃতি।
দ্বিতীয় গল্পসংকলন প্রকাশিত হয় মেন অ্যান্ড উইমেন শিরোনামে ১৯২৭ সালে। এই সংকলনে স্থান পায় ১৪টি গল্প। উল্লেখযোগ্য গল্পগুলোর ভেতর আছে— ‘আনডিফিটেড’, ‘ইন অ্যানাদার কান্ট্রি’, ‘হিলস লাইক হোয়াইট এলিফেন্টস’, ‘দ্য কিলারস’, ‘টেন ইন্ডিয়ানস’, ‘বেনাল স্টোরি’ প্রভৃতি।
তৃতীয় গল্পসংকলন উইনার্স টেক নাথিং প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালে। এই সংকলনেও ১৪টি গল্প স্থান পায়। হেমিংওয়ের লেখা আমার নিজের সবচেয়ে প্রিয় গল্প ‘আ ক্লিন, ওয়েল-লাইটেড পেইস’ আলোচ্য গ্রন্থভুক্ত গল্প। এই সংকলনের ‘হোমাজ টু সুইজারল্যান্ড’, ‘আ ন্যাচারাল হিস্টোরি অব দ্য ডেড’, ‘আফটার দ্য স্টর্ম’, ‘দ্য সি চেঞ্জ’, ‘আ ডে’স ওয়েট’, ‘দ্য মাদার অব আ কুইন’ প্রভৃতি গল্পও অনেকের প্রিয়।
১৯৩৮ সালের The Fifth Column and the First Forty-Nine Stories শিরোনামে হেমিংওয়ের ছোটোগল্পের একটি অ্যানথলজি বের হয়। সেখানে উল্লিখিত তিনটি গ্রন্থের গল্পগুলোর পাশাপাশি হেমিংওয়ের তিনটি বড়োগল্প স্থান পায়—‘দ্য শর্ট হ্যাপি লাইফ অব ফ্রান্সিস ম্যাকম্বার’, ‘দ্য ক্যাপিটাল অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ এবং ‘ওল্ড ম্যান অ্যাট দ্য ব্রিজ’। ‘আপ ইন দ্য মিশিগান’ গল্পটিও কিছুটা সম্পাদনার পর হেমিংওয়ে এখানে স্থান দেন। এরপর ‘ওয়ান ট্রিপ অ্যাক্রোস’ এবং ‘দ্য ট্রেডসম্যান’স রিটার্ন’ গল্প দুটি থেকে তিনি ১৯৩৭ সালে টু হ্যাভ অ্যান্ড হ্যাভ নট শিরোনামে একটি উপন্যাস প্রকাশ করেন।
হেমিংওয়ের জীবদ্দশায় অগ্রন্থিত গল্পগুলোর ভেতর উল্লেখযোগ্য ছিল—‘নাইট বিফোর ব্যাটল’, ‘আন্ডার দ্য রিজ’, ‘নোবডি এভার ডাইজ’, ‘দ্য গুড লাইন’, ‘দ্য স্ট্রেঞ্জ ক্যান্ট্রি’, ‘এ ট্রেন ট্রিপ’ প্রভৃতি। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত দ্য নিক অ্যাডামস স্টোরিজ গল্প সংকলনে অগ্রন্থিত ‘সামার পিপল’ এবং ‘দ্য লাস্ট গুড কান্ট্রি’ স্থান পায়। হেমিংওয়ের মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পর ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত উপন্যাসিকা দ্য গার্ডেন অব ইডেন-এ ‘অ্যান আফ্রিকান স্টোরি’ গল্পটি অন্তর্ভুক্ত হয়। গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত এবং ছোটো-বড়ো সব মিলিয়ে হেমিংওয়ের ৭০টির মতো গল্প আমরা পাই।
উল্লিখিত গল্পগুলোর ভেতর থেকে বিশেষভাবে আলোচিত পাঁচটি গল্প অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশ তো বটেই গোটা বাংলা সাহিত্যেরই খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। গল্প পাঁচটি হল ব্রিজের ধারের বৃদ্ধ, একটি পরিচ্ছন্ন আলো ঝকঝকে জায়গা, কিলিমানজারোর বরফপুঞ্জ, একটি মহৎ সিংহের উপাখ্যান এবং শ্বেতহস্তির মতো দেখতে পাহাড়গুলো। সম্প্রতি গল্পগুলো বেঙ্গল পাবলিকেশনস থেকে ‘কিলিমানজারোর বরফপুঞ্জ ও অন্যান্য গল্প’ শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। নির্ঝর নৈঃশব্দের প্রচ্ছদ ও অলংকরণে দৃষ্টিনন্দন এক প্রকাশনা।
হাসান আজিজুল হকের অত্যন্ত প্রিয় লেখক ছিলেন হেমিংওয়ে। তাঁর নানা লেখা ও সাক্ষাৎকারে তার কারণ তুলে ধরেছেন। একবার আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হেমিংওয়ের ছোটোগল্প নিয়ে তিনি বলেন: “হেমিংওয়ের ডায়লগ খুব শার্প বটে। ডায়লগের সংক্ষিপ্ততা, দৃঢ়তা, সেটিই আমার বেশি ভালো লাগে। আর মাঝে মাঝে খুব ব্যঞ্জনাময় বাক্য থাকে। বর্ণনাগুলোও মারাত্মক। হেমিংওয়ে ইউরোপের বিনষ্টিটা দেখেছিলেন। তাঁর লেখার মধ্যেই আছে, তাঁরা যখন একশহর থেকে আরেক শহরে যাচ্ছেন, দেখা যাচ্ছে শহর ফাকা পড়ে আছে। বাড়ির দেয়ালগুলো সব ফুটো ফুটো হয়ে পড়ে আছে। শরতে গাছের পাতাগুলো ঝরছে। ঠান্ডায় মরা পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে। নিক অ্যাডামস চরিত্রকে নিয়ে যে গল্পগুলো আছে, সেগুলো পড়লে বোঝা যাবে। ছোট ছোট কাহিনি। নিকের বাবা একজন ডাক্তার, সবজায়গায় তাকে কাজ করতে হয়। ব্রোথেলে গিয়েছে, নিগ্রোপল্লীতে গিয়েছে। নিগ্রোপল্লীতে এক মেয়ের প্রসববেদনা উঠেছে কিন্তু প্রসব করতে পারছে না। থাকার একটাই ঘর। ঘরের কোণায় একটা বাঙ্কারের ওপর মেয়েটির স্বামী শুয়ে আছে। সেও সহ্য করতে পারছে না স্ত্রীর এই যন্ত্রণা। আনেসথেসিয়া নেই। অজ্ঞান না করেই নিকের বাবা মেয়েটির পেট কাটছে। সেকি চিৎকার আর যন্ত্রণা! সন্তান যখন হয়ে গেল তখন, ডাক্তার ‘ইউ হ্যাভ এ বেবি বয়’ বলতে গিয়ে দেখল যে, মেয়েটির স্বামী স্ত্রীর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজের হাতের ব্লেড দিয়ে নিজের গলা কেটে মরে পড়ে আছে। এসব বাস্তবতা হেমিংওয়ের গল্পে আছে।”
হেমিংওয়েকে অনুবাদ করার কারণ হিসেবে হাসান আজিজুল হক ইসমাইল সাদীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন: “হেমিংওয়ে আমার প্রিয় লেখকদের একজন। তাঁর লেখা প্রথম পড়েছি ১৯৫৮ সালে—আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস। তখন আমি গ্র্যাজুয়েশন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। অনেক দিন আগে প্রথম আলোতেই একটি গল্প অনুবাদ করেছিলাম ‘ব্রিজের ধারে একটি বৃদ্ধ’ নামে। মূল গল্পের নাম ‘দ্য ওল্ডম্যান অ্যাট দ্য ব্রিজ’। তাঁর বলার ভঙ্গি আকর্ষণীয় আমার কাছে। খটখট করে বলে যাওয়া—বিশেষণবর্জিত গদ্য—স্টেটমেন্টের মতো করে গদ্য লেখেন। বিশেষণ ব্যবহার করতেই চান না। এটা আমাকে টানে। মৃত্যু, জরা প্রভৃতি হেমিংওয়ের লেখার বিষয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বব্যাপী সংঘটিত ধ্বংসলীলা তিনি দেখেছেন। ওই সময় ইউরোপ টুকরোটাকরা হয়ে গিয়েছিল। এসব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে মানবিক পতন দেখেছেন। দেখেছেন, মানুষের সুকুমারবৃত্তিগুলো প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তার প্রতীকী বর্ণনা ছিল এ রকম: মানুষের পুরুষত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, মানুষের মেরুদণ্ড থেকে শিশ্ন পর্যন্ত ভেঙে পড়েছে। বলতে পারো, হেমিংওয়ে আমার খুব ভালো করে পড়া আছে। সে কারণেই অনুবাদের মাধ্যমে পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করার চেষ্টা করছি।” [৪ এপ্রিল ২০১৭, প্রথম আলো]
হেমিংওয়ে সম্পর্কে হাসান আজিজুল হকের পর্যবেক্ষণ ও তাঁকে অনুবাদের কারণ আমাদের কাছে পরিষ্কার এখন। যে পাঁচটি গল্প তিনি অনুবাদ করেছেন সেই পাঁচটি গল্প আরেকটু জানা যাক। ‘কিলিমানজারোর বরফপুঞ্জ’ গল্পটি ১৯৩৬ সালে লেখা। প্রকাশিত হয় Esquire ম্যাগাজিনে। হেমিংওয়ের সবচেয়ে দীর্ঘ এবং বহুলপঠিত গল্পগুলোর একটি। গল্পটি অবলম্বনে একই শিরোনামে ১৯৫২ সালে আমেরিকান এবং ২০১১ সালে ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কিলিমানজারো দিয়ে গল্পটি শুরু হয়। এই গল্পে হেমিংওয়ে স্ট্রিম অব কনসাসনেসের ব্যবহার করেছেন।
‘শ্বেতহস্তির মতো দেখতে পাহাড়গুলো’ গল্পের সেটিং স্পেন। শুরুতেই পাহাড়-গাছপালাবেষ্টিত রেলস্টেশনের ডিটেইল বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। মাদ্রিদের ট্রেন ধরার জন্য এক আমেরিকান তার বান্ধবীকে নিয়ে স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছে। ওরা বিয়ার অর্ডার করে। বান্ধবী বলে যে সামনের পাহাড়টা দেখতে শ্বেতহস্তীর মতো। আমেরিকান পুরুষটি তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছে না বলে জানায়। তারা পান করতে থাকে। বান্ধবী ফের বলে, পাহাড়টি আর সাদা হাতির মতো দেখাচ্ছে না। তারপর তারা মেয়েটির সম্ভাব্য অপারেশন করা নিয়ে আলাপ করে। হেমিংওয়ের ‘ক্যাট ইন দ্য রেইন’ গল্পের মতো এখানেও প্রেমিক-প্রেমিকা আলাপ করছে পাশাপাশি বসে কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে। দুজনের কথা দুজন মন দিয়ে শুনছে বলে মনে হয় না। অর্থহীন আলাপ করে তারা সময় অতিবাহিত করে মাত্র। চরিত্রদের ভেতর বোঝাপড়ার অভাব, যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতা, সকলের মাঝে থেকেও একাকিত্ব বোধ করা হেমিংওয়ের প্রায় সব গল্পেরই প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাই তাঁর গল্প নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আলোচককে হয়তো একই কথা বারবার বলতে হতে পারে। যেমন ‘ক্যাট ইন দ্য রেইন’ গল্পে দেখা যায়, শুরুতে বেড়াল আমেরিকান স্ত্রীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও শেষদিকে এসে গুরুত্ব হারায়। এখানেও আমরা দেখছি সাদা পাহাড়কে আমেরিকান লোকটির বান্ধবী আর গুরুত্ব দিচ্ছে না। সম্ভাব্য গর্ভপাত নিয়ে আলোচনা করছে দুজনে। হেমিংওয়ের গল্পে সন্তান প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা এবং গর্ভপাত দুটোই মেজর বিষয়। নারীদের চুল ছোটো করে ফেলার প্রসঙ্গটিও বারবার এসেছে।
‘একটি পরিচ্ছন্ন আলো ঝকঝকে জায়গা’ গল্পে প্রায় শেষরাতে পানশালা থেকে বাড়ি ফেরে বধির বৃদ্ধ চরিত্রটি। পান করছে, দুজন ওয়েটার তার উঠে যাওয়ার অপেক্ষা করছে। তারা তাকে নিয়ে নিজেদের ভেতর কথা বলছে। একজন ওয়েটার জানায় যে বৃদ্ধ সম্প্রতি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে। কারণ হিসেবে তারা হতাশাকে চিহ্নিত করে। হতাশার কারণ একজন ওয়েটার জিজ্ঞেস করলে অন্যজন উত্তর করে, ‘নাথিং’। ‘কারণ তার অনেক টাকা আছে’, এরপর যোগ করে সে। ওয়েটাররা দেখে রাতের অন্ধকারে এক সৈনিক এক মেয়েকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ওয়েটারের একজন বৃদ্ধের গ্লাসে ব্রান্ডি দিতে দিতে বলে, ‘আপনার সেদিন মারা যাওয়া উচিত ছিল।’ যুবক ওয়েটারটি প্রার্থনা করে বৃদ্ধ যেন জলদি উঠে পড়ে, তাহলে সে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর কাছে যেতে পারবে। ওয়েটারটি ক্যাফে পরিষ্কার ও আলোকোজ্জ্বল করে রাখার কথা চিন্তা করে। সে শেষদিকে ‘আইডিয়া অব নাথিংনেস’ নিয়ে ভাবতে থাকে। এই গল্প থেকে আমরা হেমিংওয়ের সিগনেচার রাইটিং স্টাইল সম্পর্কে জানতে পারি। হেমিংওয়ের মেদহীন ঝরঝরে গদ্য, ছোটো ছোটো সরল বাক্য, একটি দুটি শব্দে ডায়লগ, চরিত্রদের মূল কথা বাদ দিয়ে হেঁয়ালি করে কথা বলা, পরস্পরকে ঠিকমতো বুঝতে না পারা, কালক্ষেপণের বিষয়টি অর্থাৎ কখন বৃদ্ধের গ্লাসে ব্রান্ডি ঢালা হচ্ছে, কখন বৃদ্ধ উঠে যাচ্ছে সেটি উল্লেখ না করা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য এই গল্পে আছে। আইরিশ কথাশিল্পী জেমস জয়েস গল্পটি পড়ে বলেছিলেন, “হেমিংওয়ে সাহিত্য ও জীবনের মাঝের পর্দাটা সরিয়ে দিয়েছেন। পৌঁছে গেছেন সেখানে, প্রতিটি লেখক যেখানে পৌঁছতে চান।”
আলোচ্য সংকলনে স্থান পাওয়া হেমিংওয়ের মিতব্যয়ী কথনের গল্প ‘ব্রিজের ধারের বৃদ্ধ’ (‘ওল্ড ম্যান অ্যাট দ্য ব্রিজ’) প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে কেন ম্যাগাজিনে। গল্পটি যুদ্ধ ও মৃত্যু নিয়ে। স্প্যানিশ সিভিল ওয়ার চলাকালীন একজন যোদ্ধা এবং ৭৬ বছর বয়সি বৃদ্ধের কথোপকথন। সকলে ব্রিজ পেরিয়ে শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। বৃদ্ধ যেতে চায় না। হয়তো এই ব্রিজের ধারেই তার মৃত্যু হবে।
একটি মহৎ সিংহের উপাখ্যান হল শিশুতোষ ফেবল। এটি ভালোর সঙ্গে মন্দের বিরোধ নিয়ে রচিত। একদিকে হ্যারল্ড ক্রেবজ যান যুদ্ধে, অন্যদিকে ভালো সিংহটি যায় আফ্রিকা। সেখানে তাকে মন্দ সিংহরা গ্রহণ করতে চায় না। গল্পে ভ্রমণের গুরুত্বটাও উঠে এসেছে।
এ পর্যায়ে হাসান আজিজুল হকের অনুবাদ নিয়ে কথা বলার জন্য তাঁর একটি অনুবাদকে বেছে নেওয়া যেতে পারে। হেমিংওয়ের ছোটোগল্পের ভেতর খুব সম্ভবত ‘একটি পরিচ্ছন্ন আলো ঝকঝকে জায়গা’ গল্পটি বাংলায় সবচেয়ে বেশি অনূদিত হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যের জমজমাট গল্প বলার জনপ্রিয় ধারার বিপরীতে যে অন্য একটি ধারা তৈরি হয়েছে, যাকে আমরা ‘গল্পহীন গল্প’ বা ভাবাশ্রীত গল্প বলতে পারি, আলোচ্য গল্পটি সেই ধারার। গল্পকার এখানে পরিবেশ তৈরিতে যতখানি গুরুত্ব দিয়েছেন, গল্প-উদ্ঘাটনে ততখানি গুরুত্ব দেননি। গল্পের সমস্ত শরীরজুড়ে একটা গুমোট নিস্তব্ধতা সেঁটে দেয়া হয়েছে। গল্পকথকের ভাষা ও স্বর থেকে মূল গল্পটা আমাদের ধরে নিতে হয়। এই গল্পটি ফরম্যালিস্ট অ্যাপ্রোস (Formalism is the study of a text without taking into account any outside influence) গল্পের মর্মবাণী উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। কারণ গল্পের মূল বক্তব্য এখানে অব্যক্ত থেকে গেছে। তাই সেটি বের করতে হলে স্ট্রাকচারালিস্ট অ্যাপ্রোস (Structuralism, in a broader sense, is a way of perceiving the world in terms ofof larger structures) থেকে গল্পটি পাঠ করতে হবে। একইসঙ্গে গল্পটির সাইকোএনালিটিক ইন্টারপ্রিটেশন বা মনস্তাত্ত্বিক পাঠ থেকে বৃদ্ধ কেন আত্মহত্যা করতে চান সেটি জানা যাবে। গল্পটির ঐতিহাসিক পাঠ থেকে আমরা জানতে পারব প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে মানুষের মনে এক ধরনের শূন্যতার রোগ দেখা দেয়। মানুষ সবকিছুর মধ্যে অর্থহীনতা খুঁজে পায়—কী বেঁচে থাকাতে, কী মৃত্যুতে। জন্ম হয় একটা ‘লস্ট জেনারেশন’-এর। সেই জেনারেশনেরই প্রতিনিধিত্ব করেন গল্পের প্রধান চরিত্র। গল্পের লেখক-জীবনীভিত্তিক পাঠ থেকে জানতে পারব হেমিংওয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যোদ্ধা ছিলেন। হেমিংওয়ে নিজেও সেই লস্ট জেনারেশনের একজন হয়ে ওঠেন। জীবনের প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণাবোধ তৈরি হয়। গল্পের প্রধান চরিত্রের মতো হেমিংওয়ে নিজেও আত্মহত্যা করেন।
হাসান আজিজুল হক ছাড়াও গল্পটি ইতোপূর্বে অনুবাদ করেছেন অনেকেই। আমি তুলনামূলক পাঠের জন্য কবীর চৌধুরী এবং মীর ওয়ালীউজ্জামানের অনুবাদকে বেছে নিচ্ছি। হাসান আজিজুল হক গল্পের শিরোনামের (অ্যা ক্লিন ওয়েল লাইটেড প্লেইস) অনুবাদ করেছেন ‘একটি পরিচ্ছন্ন আলো ঝকঝকে জায়গা’, কবীর চৌধুরী করেছেন ‘একটি পরিচ্ছন্ন সুআলোকিত জায়গা’, আর মীর ওয়ালীউজ্জামান মূল শিরোনামের কোনো বাংলা করেননি, প্রতিবর্ণীকরণ করেছেন মাত্র।
মূল গল্পটি শুরু হয়েছে এভাবে, একটা দীর্ঘ বাক্য দিয়ে—It was late and every one had left the cafe except an old man who sat in the shadow the leaves of the tree made against the electric light. In the daytime the street was dusty, but at night the dew settled the dust and the old man liked to sit late because he was deaf and now at night it was quiet and he felt the difference.
হাসান আজিজুল হকের অনুবাদে—রাত অনেকটা হয়ে গেছে। কফি হাউস থেকে সবাই চলে গেছে। একজন বৃদ্ধ শুধু জানালার কাছে বসে আছেন। দিনের বেলাটায় রাস্তা ছিল ধুলোভরা, এখন শিশিরে ভিজে ধুলো আর উড়ছে না। বৃদ্ধ মানুষটি এখানে চুপ করে বসে থাকতে পছন্দ করেন, কারণ তিনি বদ্ধ কালা। আর এখন রাত্রি এতই শান্ত যে, তিনি রাতের সঙ্গে দিনের তফাতটা ধরতে পারেন।
কবীর চৌধুরীর অনুবাদে—বেশ রাত হয়েছে। ইলেকট্রিক আলোটাকে আড়াল করা গাছের পাতার ছায়ায় এক বুড়ো ছাড়া ক্যাফে থেকে সবাই চলে গেছে। দিনের বেলায় রাস্তা ছিল ধূলিধূসরিত, কিন্তু রাতে শিশির পড়ে ধুলো থিতিয়ে গেছে, আর বৃদ্ধ মানুষটা অনেক রাত পর্যন্ত এখানে বসে থাকতে ভালোবাসতো, কারণ সে ছিল কালা আর এখন রাতে সব শান্ত আর পার্থক্যটা সে অনুভব করে।
মীর ওয়ালীউজ্জামানের অনুবাদে—রাত বেশ হয়েছে। ক্যাফেতে যারা ছিল, প্রায় সবাই বেরিয়ে গেছে। কেবল এক বৃদ্ধ টেরাসের যেখানে এখনো গাছের ছায়া, গাছের ডালপালা আর পাতার কারণে যেখানে বিদ্যুতের আলো সরাসরি পড়ছে না, সেখানে বসে আছেন। দিবাভাগে রাস্তায় ধূলো উড়ছিল। রাতে শিশির পড়ায় ধূলো আর দৃশ্যমান নয়। বৃদ্ধ বেশ রাত পর্যন্ত ওখানে বসে থাকতে পছন্দ করেন। যদিও উনি বধির, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটা যে নির্জন ও শান্ত হয়ে আসে ক্রমশ:, সেটা তিনি উপলব্ধি করেন, পরিবেশের পরিবর্তনটা টের পান।
হাসান আজিজুল হক তাঁর অনুবাদে মূল বাক্যটা ছোটো ছোটো করে বেশকটি বাক্য করে নিয়েছেন। এটা পড়ার সময় অনুবাদ পড়ছি বলে মনে হয় না। তিনি বিশ্বস্ত অনুবাদ করলেও গল্পের এই অংশটা—‘who sat in the shadow the leaves of the tree made against the electric light’ সংক্ষিপ্ত করে কেবল ‘জানালার কাছে’ বলে ছেড়ে দিয়েছেন। যেখানে কবীর চৌধুরী এবং মীর ওয়ালীউজ্জামান আরেকটু আক্ষরিক থাকার চেষ্টা করেছেন। কবীর চৌধুরী শেষাংশে বাক্যটা দীর্ঘ করার কারণে পাঠের আনন্দটা মরে যায়। মনে হয় অনুবাদ পড়ছি। একটু বেখাপ্পাও ঠেকে। এই অংশে তিনজনের অনুবাদের ভেতর তাঁর অনুবাদটাই তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়েছে। বিশ্বস্ততার দিক দিয়ে হাসান আজিজুল হকের চেয়ে মীর ওয়ালীউজ্জামান এগিয়ে। তবে তাঁর ব্যবহৃত ‘দিবাভাগে’, ‘ধূলিধূসরিত’, ‘দৃশ্যমান’, ‘বধির’ শব্দের চেয়ে হাসান আজিজুল হকের ‘দিনের বেলাটায়’, ‘ধুলোভরা’, ‘থিতিয়ে গেছে’, ‘বদ্ধ কালা’ শব্দগুলো আরো চলতি ও প্রাণময়।
প্রথম প্যারা শেষ হলেই গল্পটি ডায়লগে চলে গেছে। হেমিংওয়ের ভাষায়—
“Last week he tried to commit suicide ,” one waiter said.
“Why?”
“He was in despair.”
“What about?”
“Nothing.”
“How do you know it was nothing?”
“He has plenty of money.”
হাসান আজিজুল হকের অনুবাদে—
জানো, গত সপ্তাহে সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল, একজন বেয়ারা বলল।
কেন?
সে মনে হয় হতাশ হয়ে পড়েছিল।
কী নিয়ে হতাশ?
কোনো কিছুই নিয়ে নয়।
তুমি জানলে কী করে?
তার অনেক টাকা।
কবীর চৌধুরীর অনুবাদে—
একজন ওয়েটার বলল, গত সপ্তাহে ও আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল।
কেন?
হতাশ হয়ে পড়েছিল।
কি নিয়ে?
কিছুই না।
তুমি কেমন করে জানো যে কিছুই না?
অনেক টাকা-পয়সা আছে ওর।
ওয়ালীউজ্জামানের অনুবাদে—
“গেল হপ্তায় বুড়ো আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল,”–ওয়েটারদের একজন বলল।
“কেন?”
“কেন আর, হতাশায়।”
“হতাশা কেন?”
“কোন কারণ-ই নেই বুড়োর হতাশ হবার মতো।”
“তুমি কিভাবে জানলে ওটা অকারণ হতাশা?”
“আরে ওর তো অঢেল টাকা-পয়সা!”
এই অংশে এসে দেখা যাচ্ছে হাসান আজিজুল হকের অনুবাদ তুলনামূলকভাবে সুখপাঠ্য হলেও যথার্থ হয়েছে মীর ওয়ালীউজ্জামানের অনুবাদ। কবীর চৌধুরীর অনুবাদও খারাপ হয়নি।
মূল গল্পে হেমিংওয়ে কয়েক জায়গায় ইংরেজির মধ্যে স্প্যানিশ শব্দ ব্যবহার করেছেন। একটি অংশে লিখেছেন—What did he fear.? It was not fear or dread. It was a nothing that he knew too well. It was all a nothing and a man was nothing too. It was only that and light was all it needed and a certain cleanness and order… Some lived in it and never felt it but he knew it all was nada y pues nada y nada y pues nada. Our nada who art in nadanada, nada be thy name thy kingdom nada thy will be nada in nada as it is in nada. Give us this nada our daily nada and nada us our nada as we nada our nadas and nada us not into nada but deliver us from nada; pues nada. Hail nothing full of nothing, nothing is with thee.
হাসান আজিজুল হকের অনুবাদে—
তোমার ভয়টা কিসের? না। এটা ভীতি বা আতঙ্কের না। সে খুব ভালোই জানে, এটা কিছুই নয়। সব মিলিয়ে এটা আসলে কিছুই নয়। আর মানুষ মাত্রই কিছুই নয়। আসলে শুধুই আলো, আসলে আলো আর খানিকটা পরিচ্ছন্নতা আর একটু সাজানো-গোছানো। কেউ কেউ এর মধ্যেই জীবন কাটায়, কিন্তু তা কোনোদিন অনুভব করে না। সে শুধু এই জানে এটা শূন্য, কিছুই না। জানে যে, যারা ‘কিছুই নয়’-এর মধ্যে আছে তারা জানে আমার ভেতরটা ‘কিছুই না’। ‘কিছুই না’ তোমার নাম, তোমার সাম্রাজ্য। ‘কিছুই না’ তোমার ইচ্ছা। তোমার ‘কিছুই না’ শূন্যতার মধ্যে শূন্যতা। শূন্যতাই তোমার রাজ্য। তুমি শূন্যতায় পরিণত হবে, শূন্যতারই ভেতরে। কারণ তার শূন্যতার মধ্যেই আছে। আমাদের এই ‘কিছুই না’ দাও। আমাদের প্রতিদিনের ‘কিছুই না’, আর আমাদের ‘কিছুই না’, যা আমাদেরকে ‘কিছুই না’ থেকে তৈরি করেছে ‘কিছুই না’। আমাদেরকে দাও ‘কিছুই না’-এর ভেতর থেকে। ‘কিছুই না’-এর ভেতর থেকে আমাদেরকে ক্রমাগত সরবরাহ করো। ‘কিছুই না’-এর জয় হোক, ‘কিছুই না’ পূর্ণতা লাভ করুক। তোমার সঙ্গে ‘কিছুই না’ থাকুক।
কবীর চৌধুরীর অনুবাদে—
কি ভয় করে সে? ভয় কিংবা আতঙ্ক না। সেটা একটা শূন্যতা সে যা খুব ভালো করে জানে না। সবকিছুই একটা শূন্যতা আর মানুষও একটা শূন্যতা। শুধু তাই, আর একটা মানুষের দরকার শুধু আলো আর কিছুটা পরিচ্ছন্নতা এবং শৃঙ্খলা। কেউ কেউ তার মধ্যেই বাস করে কিন্তু তা অনুভব করে না, কিন্তু সে জানে যে সবকিছুই নাডা, নাডা বি দাই জেম ই নাডা ই পুয়েস নাডা। আমাদের নাডা যে আছো নাডার মধ্যে, নাডা হোক তোমার নাম, তোমার রাজত্ব তোমার ইচ্ছা হোক নাডা নাডার মধ্যে যেমন তা আছে নাডায়।…
মীর ওয়ালীউজ্জামানের অনুবাদে—
সে কিসের ভয়ে ভীত? না, কোন ভয় বা ভীতির ব্যাপার সেটা নয়। এ হচ্ছে এক অর্থহীনতা কেবল—সেটা সে ভালভাবেই জেনেছে। কোন কিছুরই কোন অর্থ নেই—যেমন, একজন মানুষও শুধুই আরেক অনস্তিত্ব কেবল। এই অর্থহীনতাই সকল কথার সার—দরকার কেবল আলো আর এক ধরনের নিয়মবদ্ধতা ও পরিচ্ছন্নতা। কেউ কেউ এরকম পরিবেশে জীবনযাপন করেও এর কিছুই উপলব্ধি করতে অক্ষম। কিন্তু সে এটা ভাল করেই বুঝেছে যে, এর সব কিছুই অর্থহীন এবং আরো অর্থহীন ও আরো, আরো নঞর্থক। হে অর্থহীনতা, আমাদের দৈনন্দিন এই অর্থহীনতা থেকে মুক্তি দাও, যাতে আরো, আরো অর্থহীনতায় আমাদের অর্থহীন উত্তরণ ঘটে।
গল্পের সবচেয়ে কঠিন এই অংশের অনুবাদে আমরা তিনজনকে ভিন্নভিন্ন পথে হাটতে দেখি। হাসান আজিজুল হকের মূল থেকে একচুলও না সরে স্প্যানিশ শব্দের বাংলা করেছে। একই কাজ মীর ওয়ালীউজ্জামান করলেও তিনি কিছুটা প্যারাফ্রেজিং করেছেন। তবে অর্থের কোনো হেরফের হয়নি তাতে। স্প্যানিশ ‘নাডা’ শব্দের বাংলা সমার্থক শব্দ হিসেবে হাসান আজিজুল হক ব্যবহার করেছে ‘শূন্য’ এবং ‘কিছুই না’, মীর ওয়ালীউজ্জামান করেছে ‘অর্থহীনতা’ এবং ‘নঞর্থক’। অন্যদিকে কবীর চৌধুরী স্প্যানিশ শব্দের অনুবাদ না করে বাংলা বাক্যের ভেতর স্প্যানিশ শব্দগুলোর কেবল প্রতিবর্ণীকরণ করাতে পাঠকের জন্য অর্থ-উদ্ধার অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
আলোচ্য গদ্যে আমি সদ্যপ্রয়াত বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান গল্পকার হাসান আজিজুল হকের অনুবাদ ও তাঁর দৃষ্টিকোণকে উপজীব্য করে তাঁর প্রিয় কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ছোটোগল্পের পাঠ উন্মোচন করার চেষ্টা করলাম। হাসান আজিজুল হক শুধু লেখক ছিলেন না, তিনি তাঁর উত্তর প্রজন্মের জন্য সাহিত্যের স্কুল হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর হেমিংওয়ে চর্চা ও অনুবাদ তারই একটি উজ্জ্বল নিদর্শন।