প্রথম রোমাঞ্চ – হামিম কামাল

শেয়ার করুন


প্রথম রোমাঞ্চ: কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হককে নিয়ে লেখা স্মৃতিগদ্য

আমি আর অনার্য সেই রাতে হাসান স্যারের সঙ্গে থাকতে শুরু করলাম। স্বকৃত নোমান ভাই আমাদের হাতে তাঁকে বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন। কী বিপদ। একজন অতো বড় মানুষকে দূর থেকে দেখে সটকে পড়া যায়। সেটাই সহজ, সেটাই নিরাপদ। তার সঙ্গে বা পাশের ঘরে বুকধড়ফড় রাত কাটানো কি সহজ কথা। কখন কী দরকার হয়, কী থেকে রেগে যান। হাসান স্যার ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক। বার্কলে কিয়ের্কেগার্ড ধরতে শুরু করলে মহাবিপদ। হাসান স্যার পুরাণে পণ্ডিত। নাইটস্কুলের কুরুক্ষেত্রে দুর্যধন প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে আমরা সিঁটিয়ে থাকলাম। রাতের বেলায় নাকি ওষুধ খাওয়াতে হবে তাঁকে। সব লেখা আছে। সেই মতো করলেই হলো।
জায়গাটা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অতিথিশালায়। ঘরগুলোর জানালা শান্তিনিকেতনী শৈলীতে গরাদবিহীন। বিরাট সব জানালা। আস্ত আমি অল্প একটু ঝুঁকে পাঁচ তলা থেকে লাফিয়ে পড়তে পারি অনায়াসে। আকাশে একটা দুটো তারা। ঢাকার আকাশের ধূলোয় পৃথিবীকে মহাজগতের একমাত্র গ্রহ মনে হয়। আজ ব্যাপার পুরোপুরি তা নয়। কোথা থেকে ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে। বারান্দায় কিছু ফুলের গাছ ছিল বোধয়, বিকালে অধীর মন নিয়ে আসার পথে অতোটা খেয়াল করিনি। আমি জানালা সব খুলে দিলাম। মশা আসবে, তবে বাতাসও আসবে। স্যার বিছানার হেলানে বালিশ পেতে আধশোয়া। আমাদের দিকে যথাসম্ভব হাসিমুখে তাকানোর চেষ্টা করছেন।
“তোমরা এখানেই থাকবে?” হঠাৎ বললেন।
“ইয়ে, মানে, ওই যে নোমান ভাই বলে গেল,” বললাম আমি। অনার্য আরো খানিকটা সপ্রতীভ। ওর উত্তর সরাসরি। “জি।” মনে হলো স্যার প্রমাদ গুনলেন। কিন্তু তা মনে মনে। মুখে হাসিটা ধরে রেখেছেন। সম্পন্ন ঘরের বিটকেল কোনো ছাত্র যখন দুষ্টুমি করে তখন প্রথম প্রথম গৃহশিক্ষক যে হাসি নিয়ে তাকান, অনেকটা তেমন হাসিটা। অবশ্য দুষ্টুমির কিছুই আমরা শুরু করিনি। জানালাটা আমি একটু শব্দ করে বৃথাই বন্ধ করে আবার খুললাম। যাতে তাঁর কোনো আপত্তি থাকলে তখনই করতে পারেন। তিনি কিছু বললেন না। কিন্তু আমিই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছিলাম। দূরে পরীবাগের রাস্তায় গাড়িঘোড়ার শব্দ। বাতাসও ধুলা আর সালফাইডে ভারি। স্যার রাজশাহীর নিভৃত পরিবেশে থাকেন। সেখানে পদ্মার জলছুঁয়ে আসা বাতাস নিশ্চয়ই আরো নির্মল?
“ইয়ে, বলছি, রিমোটটা কোথায় জানো?”
স্যারের কথায় বর্ধমানের একটা টান আছে। ওনার জন্মস্থান। আমরা রিমোট খুঁজতে লেগে গেলাম। বিছানার পায়ের কাছে একটা ওয়ার্ডরোব ধরনের আসবাব। তার ওপর টেলিভিশন। রিমোট দুটো। একটা পাওয়া গেল টিভির আড়ালে, আরেকটা বিছানার শিয়রে। বিছানার চাদর দিয়ে ঢাকা। অনার্য রিমোট এগিয়ে দিলো। স্যার বললেন, “স্টার জলসাটা এখানে কত নম্বরে তা জানো?”
প্রশ্নটা আমার দিকে তাকিয়ে করা। ধাক্কা খেলাম দু’দিক থেকে। প্রথম ধাক্কা বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন হাসান আজিজুল হক প্রথমবারের মতো আমার সঙ্গে কথা বলে উঠলেন। আর দ্বিতীয় ধাক্কা তিনি স্টার জলসা খুঁজছেন। আমার হয়ে অনার্য বলল, “কই তা তো আমরা জানি না। দেন আমি খুঁইজা দেই।”
পাশাপাশি দুটো ঘর, সামনে টানা বারান্দা। সাদা পাথরের মেঝে একটা হাসপাতালসুলভ শীতলতা ছড়ালেও কোথায় যেন একটা চাপা উৎফুল্ল ভাব ছিল। এই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে তো একরকম তীর্থই বলা যায়। ধ্যানে সিদ্ধির যে আনন্দটা আছে, চারদেয়ালে যেন তারই আভাস খানিকটা ধরা। এ মুহূর্তে আমাদের সামনে আছেন আরেকজন ধ্যানী মানুষ। টেলিভিশন চালানোর কথা থাকলেও তিনি চালালেন না। রিমোটটা রেখে আমাদের দিকে ফিরলেন। মুখে সেই হাসি। বললেন, “তোমাদের নাম কী। তোমরা কি লেখালেখি করো?”
হাসান স্যারকে যে বলব, জি, আমরা লিখি, অতিবড় দুঃসাহসিক হবে সেটা। ইচ্ছে হলো সোনামুখ করে বলি, জি না। কিন্তু আরেক মন বাধা দিলো। তেমনটা বললে যে মিথ্যা বলা হবে। উপরন্তু সে বছর ঢাকা টাইমস নামে এক পত্রিকার ঈদসংখ্যায় আমার লেখা গিয়েছিল। নির্বাচিত লেখাগুলোয় নাকি হাসান স্যার চোখ বুলিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে মিছে বললে যদি ধরা পড়ি। লেখালেখি করি শুনলে কী আর করবেন। হয়ত বলবেন, নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো পড়েছ? পড়েছ কাজান জাকিস? সরাসরি না বলে দেবো। সমস্যা কী। সত্যং সর্বজিতেষু। নিজের তৈরি সংস্কৃত আওড়ালাম। অনার্য বলল, “জি স্যার। লেখালেখির হালকা চেষ্টার মতো করি।”
মিটে গেল। হাসান স্যার বললেন, “বাহ বাহ, ভালো ভালো। মহাভারত পড়েছ?”
“জি না,” বলে দিলো অনার্য। আমার মাথার ভেতর আবার কুয়াশা ঢুকে গেল। আমি তো পড়েছি। কালীপ্রসন্নের মহাভারত, প্রথম খণ্ড। কিন্তু যদি বলি পড়েছি, অমনি তো চলে যাব প্রশ্নের দ্বিতীয় ভাগে। আর সেখানে আমার মতো লোক কাদায় গড়াগড়ি যাবে। কী বলব আমি? যাহোক, মিনমিনিয়ে বললাম, “জি, ইয়ে মানে…”
স্যার বিভ্রান্ত হয়ে তাকালেন। “কোন অংশটার কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?”
হয়ত অজ্ঞাতবাসের রোমাঞ্চের কারণে আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে বিরাটপর্বের সেই ভীষণ যুদ্ধের ছবি। রক্তের বন্যায় হাড়কংকাল খুলিকশেরুকা সব ভেসে যাচ্ছে- সেই ছবিটা। ওযে বুকের ভেতর এতো বেশি দৃশ্যজাগানিয়া, কী বলব, পাশা খেলার দৃশ্যের চেয়েও সে পাকা। জানি না কোনো শব্দ উচ্চারণ করে ফেলেছিলাম কিনা নরম জিভে। হাসান স্যার দ্যুতক্রিড়া নিয়ে বলতে শুরু করলেন। আর কী যে প্রশ্ন করলেন, কোনো অগ্রপশ্চাত পেলাম না। মহাভারতের কোন অংশ থেকে প্রশ্নটা করলেন তাই ভাবছিলাম। মনে হচ্ছিল ও তো পড়িনি? বললামও তাই, “স্যার মনে করতে পারছি না।” স্যার হেসে সঙ্গত কথাটাই বললেন। “তাহলে কই, কী পড়েছ।”
এই ভয়ই পেয়েছিলাম। অনার্যের দিকে তাকালাম ভয় ভয় চোখে। অনার্য হাসছে। ইস্পাত স্নায়ুর মানুষ অনার্য। হাসান স্যার, কেন ভুলে গেছি, শিশুপাল নিয়ে অনেকটাক্ষণ বলে গেলেন। অতো কথা শিশুপাল নিয়ে আমি পড়িইনি। বোধয় নেই মহাভারতেও। অন্য কোনো পুরাণে আছে কিনা তাও বা কে জানে। হয়ত স্যার জানেন। বলতে বলতে একসময় হাসিটা অবজ্ঞার রেশরাখা শ্লেষহাস্যে পরিণত হলো। আর পাঠযাচাইপর্বের শেষ হলোএই কথার ভেতর দিয়ে, “আচ্ছা গান জানো?”
অনার্য বলল, “জি জানি।”
“বেশ। গাও।”
অনার্যর সাহস আছে। কোন ভরসায় যে ও গান জানি বলেছিল আজও আমার কাছে রহস্য। ওর কণ্ঠে সুর যেন এক টালমাটাল নদী। আর সেখানে ব্যাঙের ঝাঁক স্রোতের দখল নিতে চেষ্টা করছে। উপমিত করলে আমার এই মনে হয়। সেই গলা নিয়ে অনার্য গেয়ে গেল, “আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছ…” হায় মৌসুমী ভৌমিক। গানটার এই ভয়ানক মুখাগ্নি আপনাকে দেখতে হলো না। তবে আমি দেখলাম, হাসান আজিজুল হক একমনে শুনছেন। তিনি মুখ নত করে তাকিয়ে আছেন বিছানার দিকে। নিজ হাতের দিকে। বালিশের নকশার দিকে। তিনি সেই গানের প্রতিটি কথা যে বিমূর্ত ছবি তৈরি করছে তার বিন্দুছবির সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে নিয়েছেন। অনার্যের কণ্ঠ নয়, ওর নিরলংকার আবেগটা, ওর গাওয়া গানের কথাটা তিনি নিয়েছেন। আমার নিজেকে অত্যন্ত ছোট মানুষ বলে মনে হলো। মনে হলো, এখানে হাসান স্যার আর অনার্য থাকলেই চল। আমি বাহুল্য।
এমন সময় হাসান স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এবার তুমি গাও।”
“জি মানে…”
“পারো না গাইতে?”
পারি না আবার। আমি বাথরুমে যতো সুন্দর আজি যত তারা তব আকাশে গাই, শ্রীকান্ত আচার্য চুপ মেরে যাবে। কিন্তু এখন কি আমি পারব তেমন করে গাইতে? অনার্য তো অকপটে গেয়ে ফেলল। আমি আকাশ পাতাল ভাবছি, স্যার বললেন, “গাও না। গাও। তুমিও একটা গাও। কী গাইবে বলো।”
“দাদাভাই,” এ সম্বোধনই আমি করেছিলাম সারাটা সময় তাঁকে, “আজি যত তারা তব আকাশে।”
“ওহ, হা হা হা হা! আজি যতো তারা, এ তো আমারও ভীষণ প্রিয়। গাও গাও।”
আমি শুরু করলাম। এবং পুরো সুরটা কেঁচে দিলাম। গাইতে গাইতে আড়চোখে তাকিয়ে মনে হলো, স্যার আমাকে ঘৃণা করছেন। বেজায় ঘৃণা করছেন। এতো ঘৃণা আর কাউকে করেননি কোনোদিন। গান থামলে নিচের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বেশ তো গাইলে। বেশ বেশ।”
অনার্য বলল, “স্যার, আমি আরেকটা গাইতে পারি?”
“অ্যাঁ? আরেকটা?”

হাসান স্যারকে আমি প্রথম আপন করেছি তাঁর আত্মজা ও একটি করবী গাছ দিয়ে নয়। সবাই ওই গল্পটার কথা বেশ বলে। কিন্তু আমাকে প্রথম শিহরিত করেছে তাঁর আমৃত্যু আজীবন। ঈশ্বর, এখনো যখন মনে করি লেখাটার কথা, আমার মাথায় নীল বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে যায়। আর আমি দুহাত দিয়ে বৃষ্টি সরাই।
ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম, আমরা ও হাসান আজিজুল হক এক ঘরে। শিহরিত হচ্ছিলাম। আমি ভীষণ গুরুবাদী মানুষ। আমার এই গুরুবাদকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন নোমান ভাই। যাঁর কথা শুরুতেই বলেছি। স্বকৃত নোমান। হাসান স্যারের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। যাহোক, আমার গুরুবাদ আমাকে শিহরিত করে তুলছিল। বলছিল, ওনার হাত তোলা আশীর্বাদ তোমার চাই। আমার এতো সব চিন্তার ভেতর অনার্য দ্বিতীয় যে গানটা গেয়েছিল সেটা প্রিন্স মাহমুদের লেখা, “দশ মাস দশ দিন। জেমসের মতো করতে চেষ্টা করল কণ্ঠটা অনার্য, খানিকটা। শুধু রাতের তারা- বলে উঁচু তারে ওঠার সময়ে কণ্ঠটা একটু বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। হাসান স্যার প্রশংসা করলেন গানের। তারপর দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। কখন যেন রাত দশটা বেজে গেছে।
সেবার বাংলা একাডেমির আয়োজনে একটা সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছিল ঢাকায়। সঙ্গে একুশে বইমেলাও চলছিল। দুই বাংলার লেখকেরা ঢাকায় এক হয়েছিলেন, মেলায় তার ছাপ পড়েছিল। যতদূর মনে পড়ে পশ্চিম বাংলা থেকে বিমল গুহ, অমর মিত্র এসেছিলেন। তারকাচিহ্নিত হোটেলে ওনাদের আবাসন হয়েছিল। হাসান আজিজুল হক রাজশাহী থেকে এসে উঠেছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অতিথিশালায়। কেউ কেউ আপত্তি তুলছিলেন, তাঁকেও সেই নামী হোটেলে না রেখে কেন এখানে রাখা হচ্ছে? নিশ্চয়ই অবহেলা। কিন্তু আমাকে আর অনার্যকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আমরা বলব, হোটেলের চেয়ে এখানে অনেক বেশি ভালো ছিলেন। এখানে অনেক বেশি সহজ আর আপন একটা পরিবেশ বজায় ছিল। তাঁর কাছে আসা যাওয়ার স্বাধীনতা বাইরের কারো বিশেষ ছিল না। কিন্তু স্যারের নিজের স্বাধীনতা ছিল একটা প্রশস্ত করিডোরে, বারান্দায় পড়ার ঘরে আসা যাওয়ার, যেখানে বইপত্রে দেয়াল পড়েছে ঢাকা।
তো ঘড়িতে যখন দেখা গেল রাত বাজছে দশটা, হাসান স্যার সোজা হয়ে বসলেন। অত্যন্ত জরুরি কিছুর সময় হয়ে গেছে। রিমোটটা হাতে নিয়ে বললেন, “আমি এবার টেলিভিশন দেখব। তোমরা তবে যাও।”
আমরা যাওয়ার জন্যে গোছাতে না গোছাতেই তিনি টেলিভিশন ছেড়ে স্টার জলসা বেরও করে ফেললেন। দেখা গেল তাঁর পছন্দের সিরিয়ালটা শুরু হয়ে গেছে। সিরিয়ালটা নামটা আমার মনে নেই, শুধু মনে আছে একটা ছোট মেয়েকে ঘিরে গল্পটা। স্যার একমনে দেখতে শুরু করলেন। টেলিভিশনে ঠিক তাঁর ভাষাতেই কথা বলছে। হঠাৎ একটা কোনো হাসির দৃশ্যে স্যার খাট কাঁপিয়ে হাসতে থাকলেন। আমরা আস্তে দরজা ভিড়িয়ে বের হয়ে এলাম।
আমরা তিনদিন স্যারকে সত্যিকারের লেখা বলতে যা বোঝায় তা লিখতে দেখিনি। কিন্তু তাঁর নিজ কলমটা তাঁকে ধরতে দেখেছি। ওটা টেবিলের ওপরই থাকত। সোনালী একটা কলম। নীল কালির। একবার তিনি বিছানায় বসে আছেন, কলমটা দূরে টেবিলে। আমাকে বললেন, “কলমটা আমাকে দিতে পারো?” আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে ওটা হাতে নিতে গিয়ে একটা ধাক্কার মতো খেলাম। রামধনু যেমন রাম ছাড়া, গাণ্ডিব যেমন অর্জুন ছাড়া আর কেউ তুলতে পারে না, থরের হাতুড়িও যেমন থর ছাড়া কথা বলব না বলে গাঁট হয়ে থাকে, হাসান আজিজুল হকের কলমটিও যেন তেমনই। ঠিক ঝরনাকলম নয়, তবে তেমনই অনেকটা। সোনালি একটা চুরুট যেন। কম হলেও দু’ শ গ্রামের মতো তার ভর। আর বেশি হলে তিনশ।
সেই প্রথম রোমাঞ্চের রাতের শেষ পর্যায় তো বাকি।
নাটক দেখা শেষ। রাতের খাবার চলে এসেছিল খাওয়ার পর্বও শেষ। এবার স্যারের ওষুধ খাওয়ার পালা। ওষুধের পর্বটা একটু জটিল। স্যারের পুত্রবধু সব একটা কাগজে যত্ন করে লিখে দিয়ে গেছেন, কোন ওষুধ কখন, কিভাবে প্রভৃতি। আমরা কাগজটা হাতে নিয়ে আগাগোড়া করতে থাকলাম। বিশেষ করে আমার কাছে মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হস্তাক্ষরে হায়ারোগ্লিফিক লেখা হয়েছে। কাগজটা অনার্য হাতে তুলে নিলো। এবং কাগজ দেখে দেখে ওষুধগুলো বের করে হাতে নিতে থাকল। আমিও আনাড়ির মতো দৃষ্টি আগপিছ করতে থাকলাম।
ওষুধগুলো খাওয়ার পর হাসান স্যারের একটু সন্দেহ হলো। বললেন, “কোন কোন ওষুধ দিয়েছ তোমরা?”
আমরা হাতাহাতি করে কাগজটা মেলে ধরে আবার চিহ্নিত করলাম, কোন কোন ওষুধ দিয়েছি। জানালা দিয়ে দূরে গাড়িঘোড়ার শব্দ আসছে। রাত বেড়েছে। শব্দ কমে এসেছে ক্রমশ। ওষুধগুলোর নাম বলার পর একটা ওষুধে খটকা লাগল। হাসান আজিজুল হক একটা ওষুধের নাম করে বললেন, “কিন্তু এটা কি সকালে না?”
আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। এবং মাথার ভেতর আতশবাজি পুড়তে শুরু করল। একটা সকালের ওষুধ আমরা তাঁকে রাতে খাইয়ে দিয়েছি। ও যে ঠিক কিসের ওষুধ আমাদের মনে নেই। তবে কোনো এন্টিবায়োটিক নয়। সম্ভবত প্রেশারের ওষুধ। যাহোক, আমাদের তো গলা শুকিয়ে গেল। স্যার আবার বললেন, “বলছি, ওটা কি সকালের ওষুধ নয়?”
অনার্য বলল, “স্যার, আপনার বড় ছেলেটা জানি কোন দেশে থাকে?”
পাশের ঘরে আমরা অনেক রাত অবধি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে থাকলাম, কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় কিনা। কোনো বিপদ হলে ত্বরিৎ পদক্ষেপ নেওয়া চাই। কয়েকবারই কল্পনায় শুনতে পেলাম তিনি পানি, পানি বলে আমাদের ডেকে উঠেছেন। কান ফেলে শুনি, সব বৃথা। একবার দরজার কাছে গিয়ে কান পেতে, নাক ডাকার শব্দও শুনে এলাম। রাতভোর করে ঘুমাতে গেলাম গেলাম আমরা। এবং সকাল কাঁচা থাকতে থাকতেই তড়াক করে উঠে দেখি, তিনি মুখ হাত ধুয়ে কাপড় বদলেছেন, তাঁর চোখে মুখে সকালের স্নিগ্ধতা। আমরা হাঁফ ছাড়লাম।
এর চার বছর পর দাদাভাই যেদিন মারা গেলেন, আমি আর স্ত্রী পার্ল তখন ধানমণ্ডি থেকে বসুন্ধরায় ফিরছি। মাঝখানে গুলিস্তানে বাস বদল করতে হয়েছিল। সিটে বসে মোবাইল ইন্টারনেট অন করে পার্ল গম্ভীর হয়ে গেল। খবরটা আমাকে মুখে দিতে ও পারল না। স্ক্রিনটা এগিয়ে দিলো নিঃশব্দে। আমার পৃথিবী মুহূর্তে ভাষাশূন্য হয়ে গেল। শব্দেরা পরিণত হলো শবে। প্রথম যে কথাটা মনে পড়ল তা হলো, একসঙ্গে তিনি দিন থাকার দ্বিতীয়দিন আমি এক ফাঁকে বাসায় গিয়ে অপরাজিতার বীজমঞ্জুরি নিয়ে এসেছিলাম বেশ কটা। স্যারকে দিয়েছিলাম। এ গাছ তাঁর বাড়ি উজানে লাগানো হবে, তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমি কল্পনায় সেই অপরাজিতার লতা দেখতে পেলাম। সেই লতা তো আমায় কোনে সংকেত দিলো না? কেন? মাঝখানে তিনি একবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় এলেন। নিবিঢ় চিকিৎসা চলেছিল তাঁর। এরপর বিপদমুক্ত হয়ে তো আবার রাজশাহীতে ফিরে গেলেন। তারপর থেকে মন কেন সব ঠিক আছে এমন স্পন্দন দিলো? নিজের ওপর আমার বিশ্বাস ছিল।
ফেসবুকে কেউ একজন তাঁর সমাধির ছবি দিয়ে লিখেছে, চিরনিদ্রায় আগুনপাখি।
আগুনপাখি হাসান স্যারের অথবা দাদাভাইয়ের আরেক নাম হয়ে উঠেছিল। অগ্রজদের কাছে শুনেছি, তাঁর হাত থেকে একটা স্বস্বীকৃত উপন্যাসের জন্যে তাদের দীর্ঘদিনের অপেক্ষা জমে ছিল। অবশেষে এসেছিল আগুনপাখি। দুই বাংলার লব্ধি ললিত ভাষাশৈলীর নবীন প্রস্তরফলক যে লেখক স্থাপন করলেন, তিনি উপন্যাসের সেই শৈলীর স্বাক্ষর কেন রাখবেন না? তিনি কি কেবল ছোটগল্পের রাজপুত্র হয়েই থাকবেন? সবার ভেতর অপেক্ষা। আর স্বীকৃত উপন্যাস বলতে, উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি দেননি তো তিনি নিজের কোনো বড় লেখাকে। তরুণবয়েসে লেখা‘শামুক’ তাঁর নিজের স্বীকৃতি পায়নি। আরেকটু বেশি বয়েসের‘বৃত্তায়ন’ তাঁর স্বীকৃতি পায়নি। অবশেষে আগুনপাখিকে বললেন তিনি উপন্যাস। এবং ভূয়সী প্রশংসা পেল দেশভাগের এই অশ্রুবিন্দু। ২০০৬ এ আগুনপাখি প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার পেল। ২০০৮ সালে কলকাতা থেকে ভূষিত হলো আনন্দ সাহিত্য পুরস্কারে।
আবার সেই প্রথম রোমাঞ্চের দিনগুলোয় আসি।
স্যার হুট করে বললেন,“লেখালেখি ব্যাপারটা কেমন জানো?”
“কেমন দাদাভাই?”
“ধরো নিজ হাতে বানানো একটা কুড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ এক মহাবনের সামনে। এবার বন কেটে পথ করে এগোও। আরো বহু লেখক একইরকম বন কেটে নিজ পথ করে এগিয়েছে। তেমন পথ তুমি দেখবে অনেক কিন্তু তাদের কারো পথ তোমার পথ নয়।”
তাঁর সঙ্গে, তাঁর সেবায় কাটানোর শেষ দিন বিদায় নেওয়ার জন্যে যখন তাঁর কাছে গেলাম, তিনি তখন বন্ধু পরিবৃত হয়ে বসে আছেন। আমি সেখানে হাঁটু গেঁড়ে বসলে তিনি কোনো কথা না বলে আমার মাথায় হাত রাখলেন। আমি চোখ বন্ধ করলাম। আমি হামিম কামাল। আমার মাথার ওপর হাত রেখেছেন হাসান আজিজুল হক। আমার এক বন্ধুর বাবা মায়ের বইয়ের সংগ্রহ থেকেবারো বছর আগে একটা বই পড়তে নিয়ে রেখে দিয়েছিলাম।বইটা এতো ভালোবেসেছিলাম যে কিশোর আমার মনে অর্বাচিন দখলদারি মানসিকতার জন্ম হয়েছিল। বইটি‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’। সেই বইটির লেখক এক যুগ পর আমার মাথার ওপর হাত রাখবেন কোনদিন ভেবেছিলাম। যেন এই আশীর্বাদটুকুর জন্যে আমি অপেক্ষা করে ছিলাম সারাটাসময়। আমার যে কী ভীষণ দরকার ছিল এ আশীর্বাদ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এমন এক বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে প্রগতিশীল শিক্ষকদের লাশ পড়ে, কেউ কেউ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যান। মৌলবাদের মৌলবিবাদে অপ্রস্তুত হয়ে কিছু বিপথগামী দীর্ঘদিন ধরে এক ভয়ের আবহ তৈরি করে রেখেছিল। বিভিন্ন সময়ে তারা হাসান আজিজুল হকের প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে। হাসান আজিজুল হক সারাটাসময় প্রগতির পক্ষে সরোষকণ্ঠে নিজের অবস্থান ঘোষণা করে গেছেন।
মানুষের ভালোবাসার এক আশ্চর্যসুরক্ষাবলয় তাঁকে ঘিরে ছিল।
সেই যে তাঁর সঙ্গে প্রথম তিন দিন কাটানোর শেষ দিন, আমি আর অনার্য তাঁকে বিমানবন্দর অবধি পৌঁছে দিলাম। মাঝপথে স্যার স্বকৃত নোমান ভাইয়ের সঙ্গেই আলাপ করলেন। আমরা পেছনের সিটে বসে থাকলাম। ২০১৭’র ফেব্রুয়ারির সকাল।সূর্যের আলো কেটে তিনি ক্রমশ ছায়ার ভেতর ছায়া হয়ে ভবনের আড়ালে চলে গেলেন।
লিখতে লিখতে মনে হলো, মানুষ বোধয় জন্মের আগে ছায়ার ভেতর ছায়া হয়ে থাকে। আর মৃত্যুর পর হয় আলোর ভেতর আলো। মাঝখানে আলোছায়া স্পষ্ট কিছু ছবি রেখে যায়। সে ছবি যারা জমিয়ে রাখে, তাদের বড় কষ্ট। তাদের দৃষ্টি আমৃত্যু অশ্রুতে ঝাপসা।

শেয়ার করুন

ক্যাটেগরি বা ট্যাগে ক্লিক করে অন্যান্য লেখা পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরনো লেখা

ফলো করুন

Recent Posts

Recent Comments

আপনপাঠ গল্পসংখ্যা ২০২২