প্রতারণার বিরুদ্ধে – অনিন্দ্য রায়

শেয়ার করুন

২০১১৷ ১8ই অগাস্ট৷ ভালোপাহাড়,  কবিতার ক্যাম্প,  সারাদিন কবিতা-কবিতা-কবিতা পের হয়ে তখন রাত্রি৷ ঘড়িতে বারোটা পেরিয়েছে,  এখন ১৫ই৷ আমরা ক‘জন, সাথে বারীনদা;  আমার একপাশে প্রদীপ,  শমীক অন্যদিকে৷ সবাই মহুয়াময়, একজন বাদে, আমিই সেই একাকী৷ কবিতা পড়া হচ্ছে,  আলোচনা হচ্ছে তা নিয়ে ৷ দুবছর আগেও এই কবিতাভুবনে কাটিয়ে গেছি,  এ রকমই দুদিনরাত্রি৷ এবার একটু অন্যরকম, যেন৷ এত কথা হচ্ছে, ইন্দ্র এত সুন্দর কাউন্টার করছে বারীনদাকে,  কমলদা স্বপ্ন বিছিযে দিচ্ছেন,  রঞ্জনদা স্বভাবতই কেয়ারিৎ, তবু, যেন৷ আমি সেই একাকীই৷ একটা-দুটো কথা,  বিরুদ্ধতা,  মাথার মধ্যে তৈরি৷ কোথাও এক এক দফা ‘প্ৰতারণা’,  এক এক দফা অ্যান্টি মাথা তুলছে,  মিলিয়ে যাচ্ছে৷ আমাকে ধাক্কা দিচ্ছে,  সরিয়ে দিচ্ছে, আমাকে এই কবিতাপ্রাণ মানুষজনের থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে৷ সেই একাকী আমি,  আমাকে কি বের করে দিচ্ছে দরজা দিয়ে,  বাইরে,  একাকী৷ কিছুতেই মেলাতে পারছি না৷ বারীনদার কথাবার্তা মানতে পারছি না৷ মনে হচ্ছে,  তাঁর লেখার সাথে কথায় ফাঁক থাকছে৷ আমার কি ঘুম পাচ্ছে?  আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছি?  আমার কি রিজনিং ঠিক নেই? আমি তো একাই মহুয়াহীন,  এখানে কি কনসাসনেসের ভিন্ন নির্মিতি আছে?  যা আমাকে রিফিউজ করছে!

এইসব ভাবতে ভাবতে আনমনা,  তখনই বারীনদা বললেন,  “ অনিন্দ্য, কবিতা পড়”।

আমি শুরু করলাম৷ পড়তে৷ হ্যাঁ,  পড়তে, রিডিং পড়ার টিউনে, দ্রুত৷ যেন কেউ কিছু বুঝতে না পারে। পরপর তিনটে কবিতা পরলাম৷ কোনো রিঅ্যাকশন নেই কারু৷ নিশ্চুপ৷ শুধু ইন্দ্র কিছু কথা বলল,  একটি কবিতায় ‘স্টাডি ইন স্টারলেট’ শব্দকটি ছিল, তাই নিয়ে৷

বারীনদা কিছুই বললেন না আমার লেখাগুলি নিয়ে৷ বিরক্ত হলেন কি আমার ওপরে?

পরের সকাল, স্বাধীনতা দিবস ৷

বারান্দায় বারীনদার মুখোমুখি ৷ বললেন,  “গুড মর্নিং”।

এগিয়ে গেলাম ৷ কিছুই বলছেন না,  আমিও চুপ৷

শমীক একটু দূর থেকে আমাকে ডাকল।

আমি ওর দিকে যাওয়া শুরু করতেই বারীনদা বললেন,  “অনিন্দ্য, এরকম করিস না”।

আমি দাঁড়ালাম৷

বললেন,  “কাল তোর কবিতা শুনতে চাইছিলাম, সবাই চাইছিল৷ তুই এমনভাবে পড়লি কেউ কিছুই বুঝতে পারলাম না”।

“আমি চাইনি কোনো কমিউনিকেশন হোক” ৷ বলি,  কিন্তু কথাটা মনে রয়েছে যায় “করিস না” ৷

হ্যাঁ, আমি চাইনি ব্যক্তি বারীনদার সাথে কোনো কমিউনিকেশন হোক আমার ৷

একটা দূরত্ব চেয়েছি,  যে দূরত্ব কবির সাথে তাঁর পাঠকের,  একজন কবিতাচিন্তকের সাথে পরবর্তী প্রজন্মের৷

‘কবিতা ক্যাম্পাস’- এ তাঁর একটি গদ্যে আপত্তি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলাম ১৯৯৩-এ৷ ছাপাও হয়েছিল৷ তাঁর কবিতা বিষয়ে সব কথাই যে মেনে নিয়েছি এমন নয়৷ কিন্তু নিজের ভাবনার প্ৰতি তাঁর কনফিডেন্সকে শ্রদ্ধা করেছি৷ তিনিও স্নেহ করেছেন আমাকে৷ প্ৰশ্রয় দিয়েছেনI

লিখতে চেয়েছি ‘প্রতারণার বিরুদ্ধে ছাব্বিশ দফা’,  একটি গদ্য৷ লিথেছি,  কিন্তু প্রকাশ করিনি৷ কেউ যেন আমাকে বলেছে, “অনিন্দ্য,  এ রকম করিস না”।

কমিউনিকেশন, হ্যাঁ,  কমিউনিকেশন সম্ভব, আমি আজ বিশ্বাস করি, বারীনদা৷

প্রতারণার বিরুদ্ধে নীরবতা ছাড়াও আরও কিছু আয়ুধ রয়েছে, বিশ্বাস করি, আমাদের তার প্রয়োগকৌশল শিখে নিতে হবে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *