ঘুণমাটি – বনমালী মাল (পর্ব ১১)

শেয়ার করুন

৩১.

দূরান্ত থেকে একটা বাস এসে দাঁড়াল বাজারের মাঝে। কয়েকটা আদেশানুসারী পা ওঠানামা করে হিসেব চুকিয়ে দিল। দিন মাস তারিখের হিসেব কোনোদিন রাখে না পঞ্চু। কুশলের কথায় কয়েকদিনেই পুজো। পুজোর জন্য দেবীর প্রয়োজন। প্রায় লটকে পড়া কিংবা শুকিয়ে যাওয়া একটা লাউডগার মতন এখানকার মানুষগুলোকে ভাবতে শুরু করেছে পঞ্চু। এখানে আসা থেকেই সে নিজেকে নন্দবাবা কথিত সেই মুখ থুবড়ে পড়া ঘোড়াটির মুখের সামনে কয়েক গাছি হালি লকলকে ঘাসের সঙ্গে তুলনা করতে থাকে। যাদের উপস্থিতি রামচক বা নন্দবাবা কারো মুখ থেকে শোনেনি। অথচ হালি লকলকে ঘাম যে ছিলই, এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছে পঞ্চু, যারা ওই ঘোড়াটাকে আশা দেওয়ার জন্য আতুর হয়ে মুখিয়ে ছিল।

এখানে মালিনী থাকার কথা নয়। কুঁরগির নীল স্রোতে খেলে বেড়ানো একটাও রাজহাঁস এখানে চরে না, যারা শুধু পালকের প্রদর্শনেই মানুষের মনে একঝাঁক শ্বাস এনে জুটিয়ে দেয়। আসা থেকে পঞ্চু দেখেছে এই শহরের বিমর্ষ অসুখ। পুজো সামনে বলেই যেন শহরটা কৃত্রিম আলো আর জবরদস্তি হাসিতে ফেটে পড়ছে। কয়েকটা কুকুর অনবরত পথে পথে নিজেদের ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে বিতণ্ডা করে। অস্বস্তি এড়াতে ঢেলা কিংবা পাথর ছোঁড়ে মানুষ। খরিদ্দার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা ভিড় তৈরি করছে প্রতি দোকানে। পঞ্চুর চোখের সামনে ঘোলা জলের পাত্রটা ভেসে ওঠে, যেখানে হাত ডুবিয়ে সাময়িক একটু স্বচ্ছ করে হাতটা আবার চাকে গিয়ে পড়ে। যার নীচে থিতিয়ে পড়ছে কাদার ডালা। ওরাই ওদের আত্মজ দিয়ে ঠাকুর গড়ে। কেউ সরা বা মালসা। ঘোলায় লুকিয়ে থেকে ওদের মনের অবস্থা কেমন, তা বুঝতে পারছে না পঞ্চু। মাঝে মাঝে মনে হয়, ওই ঘোলতাই জলটাই শহর।

সন্ধ্যা গড়িয়ে গড়িয়ে গভীরে যাচ্ছে। পঞ্চু উঠে গেছে দেবীর ঘরে। একলা দেবী, প্রাণ পায়নি বলে, খালি ঘর। একটু আগে পর্যন্ত কতগুলো জট পাকানো ভাবনা এলোমেলোভাবে তাকে দুর্বল করে দিয়ে গেছে। যে ভাবনাগুলো বোঝার কোনো সূত্র নেই। শুরু নেই। শেষ নেই। আকাশ-রেখার মতন সীমাহীন একটা ল্যাদল্যাদে কেঁচো এঁকেবেঁকে নিজেকে ঘৃণ্য করে তুলছে। শুধু ভাবনার একটা সার থেকে থেকে পঞ্চুকে কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে যাচ্ছে। অথর্ব অক্ষম পঞ্চু স্থির তাকিয়ে আছে কোনো একটা কিছুর দিকে। কেবল থেকে থেকে একটা চাপা শ্বাস জানান দিয়ে যাচ্ছিল তার অস্তিত্ব। এখন দেবীর সামনে বসে আছে পঞ্চু। কতগুলো চঞ্চল প্রাণী পেটে নিয়ে স্থির গম্ভীর সমুদ্র যেন। বাইরে বাতাসের মতন করে মানুষের কোলাহল ভেসে বেড়ায়। কেউ কেউ একটা ভোগের বস্তু খুঁজে পেতে মানুষেরও অধম করছে নিজেদের। এটাই এখানে স্বাভাবিক বলে অন্যেরা কেউ তার প্রতিবাদ করছে না। কেউ দেবীর শপথ করে নিজেকে প্রমাণ করছে।

স্তিমিত হয়ে আসে পঞ্চুর চোখ। কাল রাতে জেগে থাকা আর আজ সকাল থেকে নতুন করে একটা ঘোর তাকে চনমনে শিল্পী হয়ে উঠতে দিচ্ছে না। ঘরের মধ্যেকার হলুদ আলোটা দেবীর মুখের কাছে নামানো। চোখের গর্তগুলো অসম্ভব রকমের বড়ো গভীর খাদ হয়ে আছে। ওই খাদগুলোতে একটা দায়সারা দৃষ্টি ফেলে অবাক বনে যায় পঞ্চু। স্থির কুঁরগির জল কালো হয়ে আছে। রাজহাঁসগুলোর জায়গায় এই শহরের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে দেখা মানুষজন ভাসছে। এই ভেসে থাকার সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা করার মতন অবস্থায় নেই পঞ্চু। তবুও যেন একটা কাক চিৎকার করে করে তাকে অশুভ কিছু ভাবতে সাহায্য করছে। এই ভোর সন্ধ্যায় কাক কোথায় কেন বা কাকের ডাকের সঙ্গে অশুভের সম্পর্ক—এসবই পঞ্চু শিখে আর জেনে নিয়েছে এই কদিনেই। ছল ছল জলের চোখে হাতগুলো টেনে নেয় একবার। দেবীর অসংখ্য হাত ভালো করে গুনে নিতে পারছে না। নিজের হাতের ক্ষতটা দিন দিন আরও কাঁচা হচ্ছে তার।

অনুমান আর আভাসের সঙ্গে পৃথিবীর কোনো যুক্তির সুসম্পর্ক থাকে না। যুক্তি যত প্রখর আর তীব্র হয়, অনুমান ততই হাতের রেখা থেকে খসে খসে পড়তে থাকে। কিন্তু প্রতিটা অনুমান আর আভাসের হাত ধরেই যুক্তি খোঁজার প্রেরণা পাওয়া যায়। এখনও একটা জট লেগে আছে পঞ্চুর মাথার ভেতরে। টুকরো টুকরো কিছু ছবি ভিড় করছে। ফিকে হতে হতে লোপ পাচ্ছে। কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্র বা জায়গা নয়, এক্ষেত্রে নিজের অজান্তে সবথেকে গভীর ছাপ ফেলা চরিত্র আর ঘটনাগুলোই তাকে হিম করে দিচ্ছে। দেবীর চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ তৈরি করতে গিয়ে সে আরও বেশি নির্বাক হয়ে যাচ্ছে মনের দিক থেকে। অনুমান করতে পারছে, আজ এমন কিছু একটা স্পষ্ট হতে চলেছে, যা তার এই ক্ষতকে সারিয়ে তুলতে পারে।

কয়েকদিন ধরেই কুশলের এমন গা ঢাকা দেওয়া সন্ধ্যাকে সে ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। বিনোদের মুখ চোখে কুশলের প্রতি ঘৃণা স্পষ্ট। রামচকের রাস্তায় নারী পুরুষ যতখানি সাবলীল, এখানে ততখানি নয়। বরং একটা লুকিয়ে রাখার কৃত্রিম প্রসাধন পঞ্চুর সারা মনকে বিষাক্ত করে তুলছে। আতর বাজারে হোঁচট খাওয়া পঞ্চু নিজেকে সামলে নিতে পারলেও ক্রমে আরও মুখ থুবড়ে পড়ছে। সারাদিনের শেষে সন্ধ্যা এলে যখন চোখের সামনে থেকে সব দৃশ্য লোপ পায়, ক্যানভাস আরও ছোটো হয়ে আসে, তখন কুরে কুরে একটা পোকা ক্রমশ তার গভীরে ঢুকে যায়। এখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের কোনো প্রভেদ নেই। একটা ছাঁচে ফেলে নাক মুখ চোখের ভিন্নতা স্পষ্ট করা শুধু।

যে নির্মল একটা ছবি মনে গেঁথে সে রামচক ছেড়ে বেরিয়েছিল, এই কয়েকদিনেই সেই ছবি ক্রমে ফ্যাকাসে হতে শুরু করেছে। এইসব ভাবনার স্রোত এগিয়ে চলতে চলতে তলে থিতিয়ে থাকা নুড়ি কণার মতন একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে পঞ্চুর রংতুলি। সারশূন্য একটা খাদ ভরা আছে মাটির উত্তল ছাঁচে। চোখ ফেলে চোখ আঁকার প্রক্রিয়ায় মন যে কতখানি কাজ করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

৩২.

কুশলের দোটানার জীবনে মাঝে মাঝে কিছু দিন এমন আসে, যেসব দিনে সে একইসাথে সুজাতা আর তার নিজের স্ত্রীকে ধারণ করতে পারে। তাদের দুটো ভিন্ন গন্ধ তার শরীরের ভেতর শরীর জাগিয়ে তোলে। একটা সন্ধ্যা আর একটা রাত। সন্দেহ বিহীন। দ্বিধা বিহীন। যে সন্ধ্যায় বা রাতে বোধ বা কোনো আত্মজিজ্ঞাসা নিজেকে খুঁড়ে ফেলার মতন করে কুশলকে কুরে কুরে খায় না। কাল সেই রাত ছিল। আসলে নিজের অনুচিত স্বভাবকে প্রশ্ন করার জন্য যে একটা নির্বিঘ্ন সময় দরকার, সেই সময়টাই কুশল কাল থেকে পায়নি। আজকের এই সকালেও সে নিজেকে ফুটিয়ে তুলছে একটা নিষ্পাপ কোমল ফুলের মতন।

কাল রাত থেকে একটা স্বাভাবিক দ্বিধা নিয়ে বসে আছে পঞ্চু। দেবীর চোখ আঁকা শেষ করে কত সময় স্থির তাকিয়ে ছিল দেবীর দিকে। কেমন হওয়া উচিত আর কেমন হয়েছে, এই দুইয়ের মাঝে নিজেকে ঝুলিয়ে দোলাচ্ছে সে। আজ সকালেও চাকের গায়ে হাত দিয়ে সেই এক দ্বিধা বয়ে বেড়াচ্ছে সে। ঠিক ঠিক চোখগুলো এঁকেছে তো সে! নিজেকে এমন প্রশ্নে ব্যস্ত রাখতে গিয়ে চাকের গতি কমতে কমতে কখনও থেমে যাচ্ছে। চাকের সেই ধীর গতি কিংবা থেমে যাওয়া একটা চিত্র স্পষ্ট হচ্ছে। সেই চিত্র একটা জীবন চাকের। জীবন যদি থেমে থেকে এক একবার অন্তত এই দ্বিধার মাঝেও একটা বিরামচিহ্ন এঁকে দেয়, বাকি পড়তে থাকা বয়সের কাছে, সে বড়ো একটা ক্ষতি নয়, বরং মানুষের এই দার্শনিকতাটুকুতে জল দেওয়ার একটা অবসর গড়ে ওঠে।

কুশল এসে দাঁড়ায় পঞ্চুর সামনে। এইমাত্র সে পর্দা ঘেরা দেবীর ঘর থেকে একটা দম বন্ধ করা হাঁফ নিয়ে এসেছে। অবাক দৃষ্টি তার চোখে সাঁতার কাটছে। আনাড়ি। সাথে ভয় মিশে আছে দৃষ্টির পরিধি জুড়ে। যে চোখ জোড়া সে দেখে আসছে পর্দা ঘেরা একান্তে—

সেই চোখ কখনও কোনো দেবীর চোখ হতে পারে না।
সে চোখে তেজ নেই!
করুণা নেই!
সে চোখ দ্বিধা আর বিরক্তির দৃষ্টি।
অপরাধ লুকানোর জন্য চোখগুলোর ওপর লেপের পর লেপ। অস্বচ্ছ।

পঞ্চু তখনও স্থির স্থাণু হয়ে বসে আছে।

—দেবীর চোখ কি এমন হয়!
—এই চোখে তেজ নেই! করুণা নেই!

পৃথিবীতে এমন কোনো সমস্যা নেই, যা পরিস্থিতির আড়ালে ক্ষীণ হয়ে যায় না। সমস্যা নয় বরং পরিস্থিতিই আসল। এখন এই মুহূর্তে কুশল পঞ্চুকে তবু কিছু বলবে না। কোনো গালমন্দ নয়। শুধু একটু বিরক্তির ভাব দিয়ে গোটা বিষয়টাকে হালকা করে দেওয়ার চেষ্টা করে। কারণ আজ তার সবকিছু মিলিয়ে দেওয়ার, মিলিয়ে নেওয়ার দিন। সুজাতা আর স্ত্রী নিজের নিজের জায়গায় বৃহস্পতির মতন অবস্থান করছে। কেউ কোনোভাবেই সকাল থেকে কুশলকে দোটানে ফেলছে না।

পঞ্চু এখন এই সময় কেবল চুপ করেই থাকতে পারে। তার কোনো অজুহাত নেই। সেই দগদগে ঘায়ের কোনো বিরাম নেই, বিরাম থাকতে পারে না এখানে, এই শহরে থাকতে। উপশমের কথা আর কাহিনি সে কবেই ভুলে বসে আছে নিরুপায় হয়ে। রামচক এখন তার নিজের নয়। এ শহর বাজার তার নিজের নয়। কুশল, একজন নামজাদা শিল্পীর নাম নয়, যা তার ভাবনায় আজন্ম চিটে বসেছিল। এখন নিজেই আগন্তুক হয়ে উঠেছে! নাকি এই রংচঙে শহর আর জোনাকির নিস্তব্ধ আলোবিহীন মিছিলের মধ্যে সে নিজেকে মানিয়ে একজন করে তুলতে পারছে না! এখন তার যা অবস্থা, তাতে সে কেবল খুব জোরে তার চিন্তার মতো করে চাকটাকে ঘোরাতে পারে।

প্রতি সন্ধ্যায় কুশলের এমন বেরিয়ে যাওয়া তার কাছে অমূলক কিছু নয়। হাতের চেটো দুটো আলগা ঘেরা দিয়ে হাঁড়ির পেট তৈরি করার জন্য যে আড়াল প্রয়োজন, সেইটুকু ছাড়িয়ে কুশল যখন এক কালো সন্ধ্যা আর রাত গায়ে মেখে সবাইকে অন্ধ করে নিজেকে মাতিয়ে তোলে, এটাই পঞ্চুর কাছে অশ্লীল বলে মনে হয়। লুকিয়ে লুকিয়ে নুড়ি বয়ে চলা একটা নদীও মোহনায় গিয়ে উজাড় করে দেয় নিজেকে। একটা রাজহাঁস পাখসাট তুলে আভূমি উন্মোচন করে নিজেকে। ঢেকে রাখার জন্য নিজের কাছে কোনো দায় নেই তার। রামচকে থাকতেও পঞ্চু দেখেছে, নারী পুরুষের অবাধ বিচরণ নিয়ে কিংবা একাত্মে মিলে যাওয়া নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। ঘা থেকে রস চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে অবিরাম। পঞ্চুর চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিনোদের চোখগুলো। সেই চোখে আঁকা আছে আগাগোড়া একটা অসৎ লোকের প্রতিবিম্ব।

গোপনীয়তার পালক বুনতে বুনতে আপাত সুন্দর একটা মানুষ নিজেকে কতখানি অতিরিক্ত মাংসের অধিকারী করে তোলে, তা এখন পঞ্চু বেশ বুঝতে পারছে। যে কেউ এখন পঞ্চুকে দেখলে একটা মাটির মূর্তি মনে করতে পারে। নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া কোনো বিমুখ বিরুদ্ধ শামুক। অনেক কষ্টে সন্ধেটা হামাগুড়ি দিয়ে পেরিয়ে যায় পঞ্চু। ধীর মন্দ চাকের গতি ভর করে। কুশল চলে গেলে চিটচিটে কাদা গুঁড়িতে পা ফেলে ভেতরে যায় পঞ্চু। কাদার চিট ও তার কাছে অস্বস্তির মনে হল। দেবীর চোখগুলোর দিকে আর তাকাল না। যে চোখ কাল সে নিজে এঁকেছিল, তা ভাসতে ভাসতে আজ এসে ঠেকেছে মন খারাপের কোলে।

কতগুলো খারাপ হওয়া মেঘলা মন পঞ্চুকে একসাথে আক্রমণ করেছে। অদ্ভুত বিষণ্ণতা পঞ্চুকে কুঁকড়ে দিচ্ছে। বিনিদ্র অসুখী একটা রজনী যাপন তাকে মাঝে মাঝে একটা ঘোরের মধ্যে ডুবিয়ে নিচ্ছে। এই ঘোর থেকেই কিছু সময়ের জন্য দেখা এক একটা স্বপ্ন পঞ্চুকে সাদা কালো মেশানো সেই পালক করে দিচ্ছে, যা কুঁরগির বাতাস আর তীর হয়ে এই বাজার, এই শহরে এসে থেমেছে।

তন্দ্রা…

ঘোর…

সে অবিরাম হাঁটছে আতর বাজার থেকে গোটা শহর।
কতগুলো চোখ তাকে ভাবাতে ভাবাতে মেঘে মেঘে আঁকা হয়ে যাচ্ছে। ওই মেঘ থেকে আর কোনোদিন নোনা জল ঝরবে না। কাঁটার মুখে যেটুকু সময় থাকে, সেটুকুই নিরাপদ। এখন পঞ্চু নিজে অস্বস্তি পেলেও, সে জানে এটাই নিজেকে তৈরি করে নেওয়ার সময়। এখান থেকেই সে হাঁটবে শিল্পী হওয়ার পথে। এই তো এখুনি সে দেখতে পাচ্ছে স্পষ্ট, একটা মুকুট মাথার শিল্পী দাঁড়িয়ে আছে আলো করে। তার চারপাশে অন্ধকার যাত্রার সৈনিক। অবিরাম ওই পথে হাঁটার কাজে তাকে একমাত্র বাধা দিচ্ছে ওই দগদগে ঘা টা। ঘায়ের কথাটা ভাবলেই পঞ্চু নেতিয়ে পড়ে।

সামনে দেবীর উত্তোলিত বাহু।

হলুদ আলোয় কেমন মরচে ধরা বিষণ্ণতা।

ঘায়ের কথা মনে পড়লে এই শহরের পাশাপাশি পঞ্চুর রামচকের কথা মনে পড়ে। এই শহর যে পোকার খোলসে বাস করে, শ্বাসের সাথে সাথে পোকার লালা সহ্য করতে হয়, সেটা পঞ্চু বেশ টের পায় এখন।

—রামচকের স্নিগ্ধ জোনাকির বাতাসে এই ঘা ভালো হবেই…
—কিন্তু নিরুপায়…
—শিল্পী যে হতেই হবে আমাকে
—দেবীর চোখের মতন চোখ আঁকা থেকে আমি মাত্র আর কয়েক মুহূর্ত দূরে।

এরকম ভাবনা আর জিজ্ঞাসার মাঝে প্রতিবার প্রতিদিন পঞ্চু দুর্বল হয়ে পড়ে। শেষে যে সিদ্ধান্ত নিয়ে সে ক্ষান্ত হয়,

—নিজেকে এই আস্ত ঘায়ের মতন করে তুলতে হবে।
—শিল্পী হয়ে ওঠার এটাই একমাত্র পথ।

৩৩.

ঘোড়া মাঠ থেকে যতদূর দৃষ্টি যায়, কুয়াশা ঘেরা একটা চাদর ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসে। একসময় দ্রষ্টার চোখ দুটো অধিকার করে একটা অদৃশ্য উপনিবেশ গড়ে তোলে। বেশ কয়েকদিন টানা বৃষ্টিতে আকাশ পরিষ্কার। কেউ যেন ঝুড়ি ঝুড়ি বিশ্বাস ঝুলিয়ে বেঁধে দিয়েছে রামচকের আকাশে। আজ আকাশ পরিষ্কার থাকবেই, এই বিশ্বাস আকাশকে বাধ্য করেছে মেঘের জমাট আস্তরণ সরিয়ে দিতে।

বলাই মনে মনে এখন কল্পনা করে, পঞ্চু ফিরে এসেছে। একজন বড় শিল্পী হয়ে ফিরেছে সে। শহরে শহরে নামকরা দশজনের একজন হয়ে তাদের পঞ্চু, রামচকের পঞ্চু কুঁরগির স্রোত ভেঙে এপারে আসছে। কতগুলো দিন আর মাস কেটে গেলে মানুষের জেদ কিংবা আদর্শ টাল খায়! নেশায় ভর করে যে পঞ্চু একদিন রামচক ত্যাগ করেছিল, সে ফিরে আসবে। ফিরবে শুধু রামচক ভালোবেসে। ঘোড়া মাঠে বসে এমন ভাবনা আর আকাশের হাসির সাথ দেওয়া—বলাইকে বেশ চনমনে করে তুলছে। সূর্য ওঠার আগে সে ঘর ছেড়েছে। মনের মধ্যে যে তীব্র কৌতূহল ছিল পঞ্চু নিয়ে, তা সঙ্গে নিয়ে নন্দবাবার বাড়িতে ওঠে।

—বাবা…

উৎসাহ অথচ চিন্তা ভরা দৃষ্টি বলাইয়ের চোখে যতটুকু আলোর মৃত্যু এনে দিতে পারে, তা দিয়ে বাইরের ভোরের এই আলো আরো মায়াময় হয়ে উঠছে।

—বাবা!

যেন একটা নির্ঘুম রাতের নৌকা থেকে কেউ নন্দবাবাকে টেনে নাম করিয়ে গেল এইমাত্র। চোখ জুড়ে কোনো পিচুটি নেই। আছে শুধু কোটর সর্বস্ব দুটি চোখ। কাল পর্যন্ত মানুষটার নিশ্চিন্ত স্বপ্নে কোনো কালো বিড়াল হেঁটে যায়নি। পঞ্চু যাওয়ার পর যে কালো অন্ধকার তাকে কয়েকদিনের জন্য বেড়ি দিয়ে রেখেছিল, সেই বেড়ি কবেই কেটে গেছে। এক এক ঘড়ি নিজেকে সে নিয়োজিত করেছিল স্বপ্নের রামচকের অঙ্কুরিত হতে।
কিন্তু কাল সকালে গ্রামের কেউ কেউ দেখেছে, কুঁরগি পেরিয়ে একজন আগন্তুককে রামচকে আসতে। রাতের কোনো এক সময় অন্ধকার নিয়ে সে হয়তো এসেছে। সকালে কালো ঘুচতে না ঘুচতে একজন প্রথম দেখে, তার রুদ্ধশ্বাস ছোটার পথে যাকে যাকে দেখে, তাকেই বলে ব্যাপারটা।

—সুন্দর নয়, কুৎসিত নয়!
—অদ্ভুত!
—উবু হয়ে বসে আছে!
—না না, সে রামচকের কেউ নয়…

ঝাউ শিরীষ আর উঁচু গাছগাছালির মাথা শান্ত হয়ে হঠাৎ থেমে স্থির। ভারী হয়ে যেন নেমে যাচ্ছে, নুয়ে যাচ্ছে মাটিতে। লোকটা সোজা গিয়ে দাঁড়ায় নন্দবাবার উঠানে। দূত যেন ভাঙা বার্তা নিয়ে বলার মুখ হারিয়েছে। জয় পরাজয়ের কোনো পক্ষ হয় না। যুদ্ধে উভয় পক্ষই জয় আর পরাজয়ের স্বাদ পায়। মুহূর্তবিশেষে।

ততক্ষণে সে একটু শান্ত হয়েছে। পুরনো হয়েছে অনুভূতি। মিইয়ে গেছে মুখ চোখের আবিষ্কারি তীক্ষ্মতা। কয়েকটি শিশুর মুখে একটু পরেই সকালের প্রথম নিষ্পাপ আলো এসে পড়বে। একটু থমকে যায় লোকটা। মধ্যমণি হয়ে নন্দবাবা এক মুখ প্রশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে শিশুদের চোখে। এমন অসময়ের সময়ে লোকটাকে দেখে কিংবা তার অসুখী চলন বাবাকে টেনে মাটিতে নামিয়ে আনে। যে চোখজোড়া এতক্ষণ ঘোড়ামাঠের বৃত্তান্তে মগ্ন ছিল, ক্লান্ত বিষণ্ণ পা জোড়ার দিকে তাকিয়ে মাটির মায়ায় লুটাতে লুটাতে নন্দবাবা দালান থেকে নেমে আসে।

আরও অনেক সকাল আসবে, অনেক সকাল পেরিয়ে এসেছে রামচক। লোকটার বলা এক এক কথা এখনও কানে বাজছে নন্দবাবার। একটা ক্ষণিক চিত্র আঁকতে আঁকতে ভাবনায় ডুবে যাচ্ছে সে।

—উবু হয়ে বসে আছে একজন…
—অথর্ব প্রায়!
—সারা গায়ে দগদগে ঘা
—অবিরাম চুঁইয়ে পড়ছে রস!

নন্দবাবা সেখানেই বসে পড়ে। কেমন একটা আঁত বেরিয়ে আসা আলগা বাঁধন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তার প্রশান্ত চোখ মুখ মরা কুঁরগির কল্পনায় ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। কাল রাতের নিশ্চিন্ত ঘুমের চিহ্ন লোপ পাচ্ছে। মুখের সব ভাঁজগুলো এক এক করে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করছে।

বলাই নন্দবাবার কাছে এসে কথা হারিয়ে ফেলে। প্রতি পায়ে যে ভাবনা জড়িয়ে জড়িয়ে সে নিয়ে এসেছিল, এখানে এসে তা নিমেষে উবে যায়। তার কল্পনায় প্রায় সময় একটা কচ্ছপ মৃদু গতি নিয়ে টহল দেয়। চকচকে খোলস। এখন নন্দবাবার মধ্যে সেই কচ্ছপটি দেখতে পাচ্ছে বলাই। সময় কত থেমে আছে যেন। শুধু সেই কচ্ছপের চকচকে খোলসের জায়গায় বলাইয়ের চোখের সামনে এখন ভাসছে শ্যাওলা পড়া একটা চাদর। উবু হয়ে বসে আছে। নির্ভার। ভাবনায় অচেতন।

ভাঙা ভাঙা শব্দে বলাই বুঝতে চেষ্টা করে।

একটা মৃদু হাসি খেলে যায় বলাইয়ের মুখে। কোনো সাক্ষ্য দেবে না বলে, সূর্য এইমাত্র উঁকি দিয়েছে বলাই আর নন্দবাবার মুখে। কমলা রোদ বিছিয়ে থাকা মাটির দিকে তাকিয়ে বলাই বলে—

—কেউ যদি রামচক ভালোবেসে এখানে থাকতে চায়, তাতে কারো কিছু বলার থাকতে পারে না।
—সেদিনের ঘোড়াটাও তো এসেছিল বাইরে থেকেই…
—বাবা…

সূর্য ওঠার মতন করে মুখ তুলল নন্দবাবা। চোখের তারায় জলের ছাপ স্পষ্ট। বলাই দেখতে পাচ্ছে, ঝাউবন ঘোড়া মাঠ কুঁরগির ভরা পেট স্রোত সবকিছুই চলছবির মতন এক এক করে নন্দবাবার চোখে ফুটে উঠছে।

—আমি কদিন থেকেই ভাবছি, পঞ্চু হয়তো এতদিনে মস্ত শিল্পী হয়ে উঠেছে!

বলাইয়ের দৃষ্টি আশেপাশের খুঁটিনাটির উপর তুলির মতন বুলিয়ে বুলিয়ে চলছে।

—আমাদের রামচকের কত খ্যাতি হবে!

একটা নির্বিবাদ হাসি নন্দবাবার মুখে। বলাইয়ের সামনের সাদা কয়েকটা চুল চোখে রেখে নিজের বয়স মনে পড়ছে তার। রামচককে আরও অনেক দূর যেতে হবে।

এমনভাবেই। একা। স্মৃতি বহন করে চলতে যেখানে ভালো লাগে, সেখানে স্মৃতি মধুর। কিন্তু স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে গেলে তা মেদুর হয়ে যায়। এতগুলো কথা নিজের মনে ভাবতে ভাবতে নন্দবাবার চোখ মুখে যে ছবি ফুটে ওঠে, বলাই সেই নির্দেশ কিংবা পরামর্শ মাথা নত করে মেনে নেয়।

মনে মনে খুশি হয় বলাই। নন্দবাবা এখনও ওই ঘোড়া মাঠটার মতন অবিচল পবিত্র আর আদর্শের প্রতীক হয়ে রামচকের বুকে শ্বাস নিচ্ছে। যে মধুর ভাবনা নিয়ে ভোরে সে পথ চলা শুরু করেছিল, এখন তা স্তিমিত। সেই কচ্ছপটা এখন একদম সুরক্ষিত। মুখটা ঢুকিয়ে রেখেছে খোলকের ভেতরে। পথ চলতে চলতে পুরো আলোতে স্নান করছে বলাই। ঝরঝরে একটা রোদেল সকাল তার শরীরে কোনো জড়তা রাখছে না। নিজের সাথে সাথে রামচকের প্রতিটি মানুষের দেহে মনে এমনই সুবাস আর নির্ঝরতা থাকুক। বলাই এইসব ভাবতে ভাবতে পরমার কথা ভাবে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *