|

সর্বেশ্বরদয়াল সাক্সেনা-এর কবিতা – ভাষান্তর: রূপায়ণ ঘোষ

শেয়ার করুন

কবি পরিচিতি: সর্বেশ্বরদয়াল সাক্সেনার জন্ম ১৯২৭ সালে উত্তরপ্রদেশের এক সামান্য বস্তিতে। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে, জীবিকা অর্জনের জন্য তিনি ফেরিওয়ালা থেকে শিক্ষকতা, ক্লার্ক তথা পত্রিকার সম্পাদক রূপেও কাজ করেছেন। তাঁর কবিতা এক আশ্চর্য মানবচৈতন্যের কথা বলে যেখানে ‘অহং’ (আমি) ও ‘সোহহং’ (তুমি) একই সঙ্গে যুক্ত হয়, বিমুক্ত হয়, প্রবাহিত হয়।

সর্বেশ্বরদয়াল সাক্সেনার কবিতা রুশ, জার্মান, পোলিশ প্রভৃতি ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে সোভিয়েত লেখক সঙ্ঘের আমন্ত্রণে তিনি ‘পুশকিন কাব্য সম্মেলন’-এ যোগদান করেন। ‘খুঁটিয়োঁ পে টাঙে লোক’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৮৩ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৮৩ সালেরই ২৪শে ডিসেম্বর মাত্র ৫৬ বছর বয়সে নতুন দিল্লিতে তাঁর মৃত্যু হয়।

কালো চিতা

সাঁঝের আধো-অন্ধকারে
নিজের শিকারকে লুকিয়ে রেখে
মলিন পাথুরে নদীর কাছে
জল খেতে আসে কালো চিতা।

এ নদীর কম্পিত নীরবতা
চিতাটির অতীত
তার বর্তমান
তার অনাগত ভবিষ্যৎ—

বহু যুগ ধরে
এই নদীর সাহায্যে
কালো অরণ্যের সুদীর্ঘ স্পন্দনে
বদলে যায় কালো চিতা…

রাতভর

রাতভর, হাওয়া বইতে থাকে
দৃষ্টি ধাবিত হয় আরও বাইরে
আমার নিজস্ব সত্তার কপাট
অবহেলিত জানালার মতো,
খোলে আর বন্ধ হয়…
ছাদ ও দেয়ালের মাঝে
মাথা কুঁঁটে, কেঁদে ওঠে মানুষের ছায়া।

বাতাসের বেগ আসে
দুলতে থাকে খুঁটিতে ঝোলানো একটি ছবি
ছবিরই মানুষ—তবু ছবি থেকে আলাদা একজন
মেঝের উপর রাতভর শুয়ে থাকে
সাদা এক মৌন চাদর জড়িয়ে…

কালো চিতা ২

পাথরের উপর শুয়ে আছে কালো চিতা
গোধূলির মতো এই ধূসর পাথর।

পাথরের উপর আড়মোড়া ভাঙছে চিতা
ক্রমশ বদলে যাচ্ছে প্রস্তরদেহ।

পাথরের উপর দৌড়ে চলেছে কালো চিতা
দ্যাখো ধীরে ধীরে পালটে যাচ্ছে পাথরের রং।

পাথরের উপরেই সে তছনছ করে নিচ্ছে নিজস্ব শিকার
জীবনের রক্ত গড়িয়ে পড়ছে
পাথর আর পাথরের মতো নয়
বদলে যাচ্ছে চিতার ছায়ায়।

একটি চিতা, নখরের প্রবৃত্তিকে উল্লাসে রূপান্তরিত করতে করতে
সমস্ত অরণ্যকে,
বদলে দিচ্ছে কালো চিতায়…

আয়ুপাখি

যতগুলি রঙিন পাখি ছিল আমার ভিতর
সমস্ত উড়ে গেল—
না জানি কোন্ বৃক্ষশাখা অথবা পাহাড়-পর্বতে
তারা গেল হারিয়ে!
পাখসাট স্তব্ধ হলে, সময় আমাকে ফিরে দ্যাখে
অথচ এখনও আমি শূন্য নই
পালকের ওম আর বিহঙ্গ-কলরব
শরীরী সংগীত জাগায়;
যে সত্তা একই সাথে গান ও পাখির
তার সমস্ত নিঙড়ে নিই নিজের ভিতর
আমি তাকে নাম দিই আয়ুপাখি…

জুতো

একজন বলল,
আমার জুতোর পালিশে তুমি নিজের মুখ দেখতে পারো—
আমি ছটফটিয়ে উঠে ভাবি,
ভাগ্যবান সেই মানুষগুলো
যাদের কোনো চেহারা নেই।

জুতো পড়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াই
আয়নার থেকে এত লম্বা হয়ে উঠি যে
মুখ দেখা যায় না!
আমি জুতো খুলে রাখি
ছায়া ও আমি পরস্পরকে অপলক দেখতে থাকি
মুহূর্তে খেয়াল হয়,
সুন্দর সেইসব মানুষ—যারা জুতো পড়ে না।

প্রণয়বাসা

একটি সাদা কবুতর
আসে আর চলে যায়
তার আসা ও ফেলে যাওয়া স্থানে
কোনো সংগীতচিহ্ন থাকে না।

কয়েক মুহূর্তের জন্য
এই গভীর অন্ধকারে ফাটল ধরে যায়
আবার তা অদৃশ্য হয়।
অথচ আমার আত্মার ভিতর
ক্রমশ কবুতরের প্রতীক্ষা চমকে চমকে ওঠে!

একটি সাদা কবুতর
এখনও আসে আর চলে যায়;
তার আসা-যাওয়ার স্থান জুড়ে প্রতীক্ষার ডিম পড়ে থাকে…

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *