|

বনরাজা – স্রোতরঞ্জন খীসা অনুবাদ : পদ্ম কুমারী চাকমা

শেয়ার করুন

রাত্রের মধ্যে খবরটা গোটা নান্যাচর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। প্রত্যেক বাড়িতে নানা ফিসফাস, শলাপরামর্শ চলছে। সবার মনে চিন্তা এবার কী হবে? চাকমা রাজ-সরকার আর ব্রিটিশ সরকারের হুকুম। না মানলে শাস্তি হবে, তা অবধারিত। ভেবেও কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। ভোর হলেই গ্রামে ব্রিটিশ পুলিশের আগমন ঘটবে। সঙ্গে থাকবে রাজার সেপাই। তারা প্রথমে যাবে কারবারির কাছে। গ্রামের সবাইকে ডাকা হবে। তারপর প্রত্যেক ঘর থকে একজন করে পুরুষের নাম খাতায় লেখা হবে। বাঁচবার রাস্তা খোলা নেই।

গত দু-তিন দিন আগে উজানের বড়ো গ্রাম, বুড়িঘাট, লুদিবান গ্রামে ঘটে যাওয়া খবর সবার জানা হয়ে গেছে। কু-খবর বাতাসের চেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে নাকি গ্রামে গ্রামে মহিলাদের কান্নার ধুম পড়েছে। প্রত্যেক গ্রামের প্রত্যেক ঘর থেকে একজন করে পুরুষ নিজের নাম লিখতে বাধ্য হয়েছে। শুধু ষাট বছরের বুড়ো আর ষোল বছরের কম বয়সি ছেলেরা রেহাই পেয়েছে। বাদের তালিকায় রয়েছে, মূক-বধির-অন্ধ অর্থাৎ প্রতিবন্ধীরা। আরও খবর এসেছে আপদকালীন সময়ে মহিলাদেরও নেওয়া হবে। ফলে নান্যাচর গ্রামে সময়ের ধার না ধেরে গ্রামবাসীরা যখন-তখন নিজেদের মধ্যে শুধু ফিসফাস কথা আর শলাপরামর্শ করেই চলেছে।

এই অস্থির পরিস্থিতিতে গ্রামের কয়েকজন মিলে উজান গ্রামের যুধিষ্ঠিরের শরণাপন্ন হয়। এক কথার মানুষ সে। যা করব বলে তা-ই করে। সত্যবাদী যাকে বলে। মানুষের কাছে সে ‘বলী’ বলেই অধিক পরিচিত। কিন্তু সে নিজেকে ‘বলী’ মানতে নারাজ। সে বলে–চিদুচ্যা বলী, চিন্দ্যামনি বলী আর রদংখ্যা বলী থাকতে আমি কে! খুবই অমায়িক স্বভাবের লোক। তবুও লোকে তাকে ‘বলী’ বলেই ডাকে। অনেকের কাছে ‘ঊধুবলী’ নামেও পরিচিত। তার এই ‘ঊধুবলী’ নাম হওয়ার পেছনে একটা ঘটনা রয়েছে। জুমের উৎপাদিত শস্য বিক্রির জন্য সে একদিন রাঙ্গামাটির বাজারে যায়। সে তখন পূর্ণ যুবক। বয়স কুড়ি-বাইশ হবে। হঠাৎ করে সেখানে উপস্থিত হয় বরিশালের বড়োসড়ো এক মুসলমান বলী। তার নাম করিম মাল।
‘মাল’ বলতে বলীকেই বোঝায়। তার মোটা ভুঁড়ি, খালি গা, আর পরনে হলদে রঙের লুঙ্গি। গলায় একটা ফুলের মালা। কোমরে মার্কিন কাপড় প্যাঁচানো, কাপড়টি মাটি স্পর্শ করেছে। সঙ্গে একঝাঁক রাঙ্গামাটির মুসলমান। তারা একটা ঢোল বাজিয়ে চিৎকার করে বলছে “এসো, এসো, কে আছো, কার বাপের ক্ষমতা আছে করিম মালের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করার”। অনবরত ঢোল বাজিয়ে বাজিয়ে একই কথার পুনরাবৃত্তি করছে। এমন দুর্ভাগ্য যে, সে সময় সেখানে চিদুচ্যা বলী, চিন্দ্যামনি বলী আর রদংখ্যা বলী কেউ নেই। তরতাজা যুবক যুধিষ্ঠির ভাবল এইবার চাকমাদের মান গেল। কি করা যায়! নিজেকে আর ভাবার অবকাশ না দিয়ে দৌড় দিয়ে করিম মালের কোমরে জড়ানো মাটি স্পর্শ করা মার্কিন কাপড়টির উপর পা রাখে। মুসলমান বলী করিম মাল পেছনে তাকিয়ে দেখল। যুবক যুধিষ্ঠিরকে দেখে মুখ বাঁকা করে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল ‘আ—রে, যাও–যাও, যন্ত্রণা দিও না’। তুমি হলে যুবক, চুপচাপ ফিরে যাও। এতেই তোমার মঙ্গল। যদি হাড়গোড় ভেঙে যায় মা-বাবা কাঁদবে। যুধিষ্ঠিরের আর সহ্য হয় না। লাফ দিয়ে বলে ‘আগে মল্লযুদ্ধ হোক তারপর দেখা যাবে’ কার হাড়গোড় ভাঙে। তারপর রাঙ্গামাটি বাজারের গ্যোরবান্যা মল্লযুদ্ধের ময়দানে তারা দু’জন মুখোমুখি দাঁড়াল। আরম্ভ হল মল্লযুদ্ধ। মুসলমান বলীকে উপরে তুলে পর পর তিন আছাড় দিল। শেষবারের আছাড়ে তার কোমরের হাড় ভেঙে গেল। মাগো বলে চিৎপটাং হয়ে মাটিতে পড়ে রইল। এদিকে যুধিষ্ঠিরের শক্তি ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিযোদ্ধার অবস্থা দেখে নিজেকে সামলানোর জন্য মল্লযুদ্ধের ময়দান ছেড়ে একলাফে গিয়ে পড়ল বড়োগাঙে। অনেকক্ষণ বড়োগাঙে ডুব মেরে থেকে নিজেকে শান্ত করল সে। তারপর জল থেকে উঠে এল। এদিকে করিম মালকে তার সঙ্গীরা ধরাধরি করে নিয়ে গেল। পরে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গীরা জিজ্ঞেস করে কেন সেদিন সে বড়োগাঙে ডুব দিয়েছিল। তার উত্তর, সেদিন তার শক্তির গতি এতটাই ঊর্ধ্বমুখী ছিল যে, তা থামানোর জন্যই গাঙে ডুব দিতে হয়েছে। তাই পাহাড়ি চাকমাদের কাছে সে ‘ঊধুবলী’ নামে অধিক পরিচিত। সেদিনের পর থেকে সে আর মল্লযুদ্ধে নামেনি। বন্ধু-বান্ধবরা বার বার মল্লযুদ্ধে নামানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। তার এক যুক্তি–চিদুচ্যা বলী, চিন্দ্যামনি বলী আর রদংখ্যা বলী থাকতে আমি কী বলী! সেই ‘ঊধুবলী’ যুধিষ্ঠিরের মন খুব ভালো ও সাফ ছিল। কারো সঙ্গে ঝগড়া করে না। কিন্তু সে খুব ছটফটে–এককথার মানুষ। যা করব বলে সেটা অবশ্যই করবে, আর যেটা করবে না বলে সেটা মরে গেলেও করবে না। মানুষের সাহায্য করতে তার না নেই। মানুষের বিপদে-আপদে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসে। এজন্য আজকের এই বিপদের দিনে গ্রামের কিছু মানুষ তার সঙ্গে চুপিসারে পরামর্শ করল। যুধিষ্ঠির বলল আগামীকালের কারবারির ডাকা সভাতে আমরা সাত-আটজন যাবো না। কিন্তু অবস্থা বুঝতে দির্ব্যচানকে পাঠানো হবে। কেন-না সে প্রতিবন্ধী, ঠিকভাবে হাঁটতে পারে না। তার নাম খাতায় লেখার প্রশ্নই ওঠে না। আর আমাদের কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে তারা ঠেগা, তৈজং এ জুমের কাজে গেছে। এটাই ঠিক হল।

কথা অনুযায়ী পরের দিন সকালে কারবারির বাড়িতে সভা বসল। সভাতে গ্রামের সবাই এসে জড়ো হয়েছে। আরও উপস্থিত হয়েছে ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ আর চাকমা রাজার সেপাইরা। তাদের সঙ্গে এসেছে রাজার মুখ্যপাত্র অতুলচন্দ্র দেওয়ান। সভার আরম্ভে অতুলবাবু বলল “বাপ-ভাই সবাই! তোমরা সবাই জানো ভারতের পূর্বদিকে বার্মাফ্রন্টে ব্রিটিশ সৈন্য আর জাপানি সৈন্যের তুমুল যুদ্ধ হচ্ছে। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্য করার জন্য ভারতের ছয় শ’য়ের উপর রাজা মহারাজারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা সবাই নিজের নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী বার্মাফ্রন্টে সৈন্য পাঠিয়েছে। আমাদের শ্রদ্ধেয় চাকমা রাজাও ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তোমরা তো জানো যুদ্ধক্ষেত্রটি আমাদের একেবারেই পাশে। অঞ্চলটি অত্যন্ত ঘন জঙ্গল এবং পাহাড়-পর্বতে ঘেরা। সেখানে যুদ্ধের মালপত্র, খাবার দ্রব্যাদি আর অস্ত্রশস্ত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া খুবই কষ্টকর কাজ। চাকমা রাজা আর ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে আলোচনা হয়েছে—চাকমা রাজা সৈন্যের পরিবর্তে কয়েক হাজার কুলি দেবে, যারা যুদ্ধ এলাকায় মালপত্র পৌঁছে দেওয়ার কাজ করবে। এইজন্য বাপ-ভাই সবাইকে বলছি, রাজা আদেশ করেছেন প্রত্যেক ঘর থেকে একজন করে সমর্থ পুরুষকে অবশ্যই এই কাজে যেতে হবে। কাজের ধরন দেখে ব্রিটিশ সরকার বিবেচনা করে মজুরি দেবে। অর্ধপথে অসুখে বা যুদ্ধ এলাকায় কেউ যদি বন্দুকের গুলিতে মারা যায় তাহলে মৃত ব্যক্তির পরিবারকে ব্রিটিশ সরকার ক্ষতিপূরণ হিসেবে টাকা দেবে…”।

দেওয়ানবাবু বলার পর গ্রামের কারবারি সবাইকে অনুরোধ করে কিছু কথা বলল। তারপর শুরু হল গ্রামের পুরুষদের খাতায় নাম লেখানো। দেখা গেল উজানের গ্রাম থেকে যুধিষ্ঠির সহ সাত-আটজন আলোচনা সভায় অনুপস্থিত। কারবারি তাদের খবর জিজ্ঞেস করলে উজানের গ্রামের বাসিন্দা দির্ব্যচান বলল–‘দু-তিন দিন হয়েছে তারা ঠেগা, তৈজঙ এলাকায় জুমের কাজে গেছে, ফিরতে ছ’মাস লাগবে’। কারবারি রেগে চিৎকার করে উঠে বলল জুমের কাজ-টাজ নয়। রাজা সরকারের হুকুম। ফাজলামো নয়। কালকে খবর পাঠাও—যাতে তড়িঘড়ি ফিরে আসে। সবাইকে কুলি হিসেবে যেতেই হবে। এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই”। দির্ব্যচান আচ্ছা বলে ফিরে গেল। নাম লেখানোর পর্ব শেষ করে সভাভঙ্গ হল। তারপর সবাই যে যার বাড়ি চলে যায়।

পাহাড়ের জুমঘরে চুপে চুপে যুধিষ্ঠিররা দির্ব্যচানের সঙ্গে দেখা করল। সেখানে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা চলল।

আলোচনায় ঠিক হল এই মুহূর্তে তারা সেখানে যাবে না। পালিয়ে পালিয়ে থাকবে। বেশি অসুবিধা হলে উত্তরদিকে বসত পরিবর্তন করবে। কথামতো রাতের অন্ধকারে স্ত্রী-পুত্রদের স্থানান্তর করে কাজলঙের ঘন জঙ্গলে তারা প্রবেশ করল।

এদিকে দুয়েক দিনের মধ্যে যুধিষ্ঠিরদের পালানোর খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সেই খবর রাজবাড়িতেও পৌঁছে যায়। তৎক্ষণাৎ চাকমা রাজা, যুধিষ্ঠির ও তার সঙ্গীদের রাজ্যের যেখানে পাবে সেখান থেকে ধরে আনার হুলিয়া জারি করে দিল। তারা রাজার বিচারাধীন। তাদের ধরিয়ে দিলে পুরস্কার দেওয়া হবে।

যুধিষ্ঠিররা এখন পরিবার সমেত কাজলঙের জঙ্গলে। ভয়ে রাজার সেপাইরা এই জঙ্গলে প্রবেশ করে না। এজন্য সেখানে নিশ্চিন্ত মনে আছে। কিন্তু কতদিন এবং কীভাবে এই ঘন জঙ্গলে থাকবে। দরকারি জিনিস কোথা থেকে পাবে? যাইহোক শেষে দু-একজন লোক লুকিয়ে উত্তরদিকের পদাছড়া বাজার থেকে দরকারি জিনিস কিনে নিয়ে আসে। এভাবেই পথ চলা শুরু হয়।

এদিকে গোটা দেশ জুড়ে সাংঘাতিক অরাজকতা শুরু হল। যুদ্ধ বলে কথা। বাজারে জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। মরার উপর খাঁড়ার ঘা। টাকা দিয়েও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে না। এই সুযোগে এক শ্রেণীর মানুষ এবং ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে। আর শুরু হয় চারদিকে অন্নাভাব। তারা গ্রাম আর জুমে উৎপাদিত শস্য কম দামে কিনে নেয়। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বেশি দামে বিক্রি করে। এছাড়া সহজ সরল গ্রামবাসীদের মনে বোমার ভয় ছড়িয়ে দেয়। গ্রামের শান্তি বিনষ্টির পথে। ছারখার হয়ে যাচ্ছে ঘর-সংসার। কিছু পুরুষ কুলি কাজে নিযুক্ত–আর কিছু কুলিগিরির ভয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। এর ফাঁকে ফাঁকে কিছু লোক স্বার্থের খাতিরে ধনীব্যক্তি ও ফিরিঙ্গি সেপাইদের কাছে মেয়ে পাচার করার কাজে নামে। মা-বোনের ইজ্জত নিয়ে খেলা শুরু হয়।

এমন পরিস্থিতিতে যুধিষ্ঠির বড়ো চিন্তায় পড়ে গেল। তার পরিকল্পনা ছিল এভাবে জঙ্গলে লুকিয়ে না থেকে সাজেক, বা দেওনদীর পারে বসত গড়ে তুলবে। কিন্তু প্রতিদিন দেশের এই দুর্দশা ও অরাজকতার কথা শুনে নিজের মতো পাল্টালো। সিদ্ধান্ত নিল প্রাণ থাকলে থাকবে না থাকলে নেই, কিছু একটা করতে হবে। এইবার তার আসলরূপ দেখাতে হবে। নতুন পথের পথিক হল সে। কাঁধে বন্দুক তুলে নিল, কোমরে গুঁজে নিল গুলি। ডাকাত সাজল। যুধিষ্ঠিরের ডাকাত দল–ঊধবলীর ডাকাত দল। একদিন হঠাৎ করে মোট দেড়শ জন সঙ্গী নিয়ে লোকালয়ে পা রাখল। আক্রমণ করা শুরু করল কৃপণ, অমানুষ, অন্যায়কারী ধনীব্যক্তিদের। ধান-চাল, টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা সব কেড়ে নেওয়া হল। লুণ্ঠিত জিনিস সবই গ্রামবাসীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া শুরু হল। যুধিষ্ঠিরের ডাকাত দলের ভয়ে চারদিকের বিত্তবানেরা তটস্থ। শেষে চাকমা রাজার কাছে তারা ডাকাত যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে নালিশ জানাল। যুধিষ্ঠিরকে বন্দি করার জন্য সেপাই পাঠানো হল। সুভলং, ভূষণবাগ, খবংপোচ্যা, তারাবোন্যা–এরকম কয়েকটি জায়গাতে ব্রিটিশ সেপাইদের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের ডাকাত দলের যুদ্ধ বাঁধে। গ্রামবাসীদের সহায়তায় প্রত্যেকটি যুদ্ধে যুধিষ্ঠিররা অক্ষত অবস্থায় পালাতে সক্ষম হয়। কেন-না প্রতিবারেই তারা যুধিষ্ঠিরের কাছে লুকিয়ে লুকিয়ে খবর পৌঁছে দিত।
গ্রামবাসীরা যুধিষ্ঠিরকে ভীষণ ভালোবাসে। তার পেছনে অনেক কারণ আছে। যুধিষ্ঠির সবসময় তার দলের উদ্দেশে বলত–দেখো, অজানা গ্রামবাসীদের উপর হাত তুলবে না, নারীর ইজ্জতে হাত দেবে না, তাদের সম্মান করবে, বয়স্কদের মান্য করবে আর শিশুদের আদর করবে। এসব বললেও কি আর হয়। হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না। তদ্রুপ দলের কিছু লোক সেই আদেশ অমান্য করে। এদেরকে নিয়ে বিপদে পড়তে হয়। এভাবে একদিন কাজলঙের নারদমনি কারবারি গ্রামে অঘটন ঘটে গেল। কারবারির বাড়ি লুঠ করতে গিয়ে দলের রাঙাচঘা কারবারির যুবতী মেয়ে রাঙাবীকে দেখে আর ঠিক থাকতে পারেনি। সঙ্গীদের অজান্তে সে রাঙাবীর মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কাঁধে তুলে নিয়ে যায়। কেউ টের পায়নি। কিন্তু রাঙাবীর মা আর যুধিষ্ঠিরের ছোটো ভাই কুন্দলবন ঘটনাটি দেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে ফেরত পাওয়ার জন্য যুধিষ্ঠিরের পায়ে পরে কাকুতি মিনতি করতে থাকে। কুন্দলবনও ঘটনার সত্যটা স্বীকার করে। সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠির রাঙাচঘাকে ধরে আনার হুকুম দেয়। এবং সঙ্গে রাঙাবীকেও আনতে বলে। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের আনা হল। গম্ভীর গলায় যুধিষ্ঠির বলে ওঠে এ ঘর থেকে আমরা কোনো জিনিস নেব না। সব জিনিস রেখে দেওয়ার জন্য আদেশ দেয়। অন্য গ্রাম থেকে লুণ্ঠিত রুপার ভাগ রাঙাবীকে দিতে বলে। নিজে রাঙাবীর মা’র কাছে ক্ষমা চায়। নিজ হাতে নারদমনির কোমরের বাঁধন খুলে দেয়। আর রাঙাচঘাকে হুকুম দেয়–এখন তুমি রাঙাবীকে ‘মা’ সম্বোধন করে পায়ে ধরে মাপ চাও। আরও শুনো আরেকবার এরকম দুষ্কর্ম করলে তোকে গাছে ঝুলিয়ে গুলি করা হবে। রাঙাচঘা কাঁপতে কাঁপতে রাঙাবীকে ‘মা’ ডেকে পায়ে ধরে মাপ চায়। প্রতিজ্ঞা করে জীবনে আর এরকম কাজ করবে না।

একদিন আরেক ঘটনা। দেশে দেখা দিয়েছে অন্নাভাব। ব্রিটিশ সরকারের কালেক্টরের হুকুমে কিছু সরকারী কর্মচারী পাহাড়ী এলাকায় যায়। তারা মজদুরের সাহায্যে প্রত্যেকের ঘর থেকে ধান জমা করে নৌকায় তুলে নিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে খবর যায় যুধিষ্ঠিরের কাছে। গ্রামবাসীদের কাছে নিজের লোক মারফৎ খবর পাঠাল–যাও তোমরা সব ধান লুণ্ঠন করে আনো। তোমাদের পেছনে আমার মানুষরা থাকবে। আমি জানি সরকারি কর্মচারী আর তাদের শ্রমিকদের কাছে বন্দুক নেই। তাই চিন্তার কোনো কারণ নেই। যুধিষ্ঠিরের অভয় পেয়ে তারা সব ধান লুঠ করে নিয়ে আসে।

খবর গেল রাঙ্গামটির পুলিশের মূল দপ্তরে। ফিরিঙ্গি পুলিশ দলবল নিয়ে হাজির। গ্রামবাসীদের গ্রেপ্তার করল। কোন কথা শুনতে নারাজ। সবাইকে চালান করবে। এমন সময় জঙ্গল থেকে যুধিষ্ঠির রাঙাবীকে খবর পাঠাল “যাও গ্রামের সব মেয়েরা মিলে ফিরিঙ্গি সাহেবকে ঘেরাও করো”। আর বলবে “ধান লুঠ করেছে যুধিষ্ঠিরের ডাকাত দল, আমাদের পুরুষেরা নয়। তারা ধান লুঠ করে ঘরে ঘরে বিলিয়ে দেয়। ক্ষমতা থাকলে সেই ডাকাত দলকে ধরে নিয়ে যাও, আমাদের পুরুষদের নয়। আর যদি তাদের নিয়ে যাও সঙ্গে আমাদেরকেও নিতে হবে। যাও এইকথাগুলি বলো। এতেও যদি কাজ না হয় তাহলে আমরা ফিরিঙ্গি পুলিশের উপর আক্রমণ চালাবো–তোমাদের ছাড়িয়ে আনব।”

রাঙাবী শীঘ্রই গ্রামের সব মেয়েদের জড়ো করলো আর সবাইকে নিয়ে ফিরিঙ্গি সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাঙাবী মনে সাহস সঞ্চয় করে স্পষ্ট গলায় বলল–ধান লুঠ করেছে যুধিষ্ঠিরের ডাকাত দল, আর তুমি গ্রামবাসীদের বেঁধে নিচ্ছ… এরকম নানাকথা। কথা শুনে সাহেব ঘাবড়ে গেল। তারপর অবস্থা বুঝে গ্রামবাসীদের ছেড়ে দিল।

এভাবে যুধিষ্ঠিরের ডাকাত দল গ্রামবাসীদের সহায়তায় গ্রামে গ্রামে পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে ফিরে থাকে। গত চার বছরে তার ডাকাত দলের সংখ্যা কম করেও দুইহাজার। সবাই এক জায়গায় থাকে না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। উত্তর ও দক্ষিণ দিকের নানা জায়গায় তার মানুষদের বাস। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব ছিল কুন্দলবনের উপর। কুন্দলবনের একটা বিদ্যা জানা আছে। মাটিতে কান পাতলে সেপাইদের চলাচল… কতদূরে তাদের অবস্থান এসব সে টের পায়। তার এই গুণের জন্য যুধিষ্ঠিরের ডাকাত দলকে সেপাই-পুলিশ ধরতে পারে না। গ্রামবাসীদের কাছে যুধিষ্ঠিরের নাম হয়েছে—‘বনরাজা’। বনরাজা ভালোর কাছে ভাল… মন্দের কাছে বজ্রাঘাত।

একদিন যুদ্ধ শেষ হল। দেশের অরাজকতা অনেকটা কমে গেল। কিন্তু দেশে বড়ো বিপদ দেখা দিল। ভাগ হবে হিন্দুস্থান আর পাকিস্তান। রেডক্লিপ সাহেব চাকমা রাজ্যকে পাকিস্তানের সীমানায় যাবে বলে মত দেয়। চাকমা রাজাও সেটা মেনে নিল। কিন্তু না মানার দলে ছাত্র আর নেতারা। তারা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেয়। ডাক পেল বনরাজা যুধিষ্ঠিরও। ডাক পেল রাঙাবী ও তার মেয়ে সঙ্গীরা। মেয়েদের জড়ো করার দায়িত্ব পড়ল তাদের উপর। সবাই আন্দোলনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু কয়েকজন নেতার ভুলে আর সৈন্যদের অমানবিক নির্যাতনে কয়েকমাসের মধ্যে আন্দোলন ভেঙে পড়ল।

ঠিক হল নেতারা দেশ থেকে বেরিয়ে বিদেশের সাহায্য নেবে। কিন্তু যেতে হবে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, লুকিয়ে। এইজন্য ডাক পড়ল যুধিষ্ঠিরের। সুযোগ বুঝে নেতাদেরকে দেশের সীমানা পার করে দিতে হবে। তখনই বনরাজা যুধিষ্ঠির তার ছোটো ভাই কুন্দলবনকে হুকুম দিল—তাড়াতাড়ি যাও, দেশের ভেতরে ও বিশেষ করে উত্তরদিকের আমার সব সাগরেদদের বলো দেশের নেতারা যাতে ভালোভাবে দেশের সীমানা পার হতে পারে। দরকার পড়লে থানা-পুলিশ-সেপাইদেরকে সরাবার জন্য কিছু ঝামেলা সৃষ্টি করতে হবে। এসব কথা সবাইকে ভালো করে বুঝিয়ে বলবে। এদিকে আমি অস্ত্রশস্ত্র ও শক্তপোক্ত চল্লিশজন সঙ্গী সমেত নেতাদেরকে পথ দেখিয়ে অগ্রসর হবো। যাও, এখনই যাও। চারদিনের মাথায় আমরা রওনা দেবো। এরমধ্যে সবাইকে এই খবরটি দাও।

চারদিন পর খবর এল যুধিষ্ঠির তার চল্লিশজন সঙ্গী সমেত নেতাদেরকে নিয়ে রওনা দিয়েছে। দুইদিনে তারা সীমানায় পৌঁছল। পৌঁছানোর পর নেতাদের উদ্দেশে হাত জোড় করে যুধিষ্ঠির বলল–নেতারা, তোমরা আর চিন্তা করো না। ওই পারে আমার লোক থাকবে। তারা তোমাদের দেখবে।

তারপর কিছুসংখ্যক নেতা বিদেশে আর কিছুসংখ্যক নেতা রইল দেশের জেলখানায়। আর বনরাজা যুধিষ্ঠিরের ঠিকানা গভীর জঙ্গল। শোনা গেছে–দেশ ছেড়ে একদিন সে উত্তরদিকে চলে যায়। যাবার সময় রাঙাবী তার সঙ্গী হয়েছে।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *