মরণলেখ ১ – গৌতম বসু
আকাশের কাছে আমাদের সাহায্য প্রার্থনা
মনের পথে-পথে যারা হেঁটেছি
মন, খরোস্বী লিপির চিরশয্যা, মন দাবানল
দাবানলের পথে যারা হেঁটেছি
দূরের দেশ, নিজেকে তুমি কোথায় ফেলে এসেছো ভাবো
ভাবো, রক্ষাকবচ ভেসে গেছে কোন কূলে থেকে অকূলে
মনের পথে-পথে যারা হেঁটেছি
রক্ষাকবচ ভেসে গেছে যাদের
শতাব্দীর মতো একনিষ্ঠ যারা
সৃষ্টির মতো, লয়ের মতো একা
মনের পথে-পথে যারা হেঁটেছি
বাতাস এখনো শোকগাথা, শোকগাথার বাতাসে এসে দাঁড়ালাম
দেহকার্য এখনো সম্পন্ন হয় নাই
মানুষ যুদ্ধের ন্যায় পুড়ছে এখনো
যুদ্ধস্রোত মানবতার ন্যায় পুড়ছে
নিদাঘ হে, এখনো করুণা কহে নাই
নিদাঘ হে, এখনো করুণা থামে নাই
থামে নাই কালচক্র, ফুটে আছে কালপুষ্পরাশি
জন্মলগ্ন, মৃত্যুরেখার পাশ দিয়ে বিরামহীন
বহে চলে কুলশ্রেষ্ঠের অর্ধদগ্ধ মন্ত্রোচ্চারণ
তোমার তীরে নিরাশা, কৃষ্ণকায় ফল পড়ে আছে
দুই হাতে রাশি-রাশি সেই ফল কুড়িয়ে এনেছি
প্রান্তর তখন শতাব্দীর মতো একা, একনিষ্ঠ
একা পর্যটন, একা মৃত্তিকা, একা অবলোকন
বিপুল তরঙ্গ তোমার, নিরাশা
আমাদের খালি পায়ের পাশে বালির খালি পা
প্রদোষকালের জনহীন তীরে বালি ও নক্ষত্র
পাশাপাশি হাঁটছে মনে-মনে, মৃত্তিকার মনের
সন্ধান তারা পেয়েছে কী, নিজের মনের সন্ধান,
দেখি, শরীরের ’পরে কৃষ্ণকায় ফল পড়ে আছে
বিপুল সম্ভার তোমার, নিরাশা
ধীরে পায়ে মৃত্তিকার মনে আজ প্রবেশ করেছি
প্রাণমন, আলো জ্বালাও, বুক অন্ধকারে, জ্বালাও
উন্মত্তের কণ্ঠস্বরে বলি, জ্বালাও, দু’চোখ ভ’রে
তারে দেখি, মৃত্তিকার কোমল মন, তোমায় দেখি;
একটি বাদুড় মাথার ’পরে সভয়ে উড়ে গেল
ওই নীরব অন্ধকারে কেউ দাঁড়িয়ে আছেন কী?
অন্তরে কেউ, মৃত্তিকার মনের আল্পনার ধারে?
আসুন আমরা ধীর পায়ে হাঁটি, এই গুহাচিত্র
আনন্দঘন এই জাতক কাহিনি যেভাবে হাঁটে
এক জীবন থেকে অন্য জীবনে, যেভাবে হাঁটছে
নদীতীরে প’ড়ে থাকা সেই কৃষ্ণকায় ফলগুলি
যেভাবে হাঁটছে ছায়াসমূহ, উদাস দিবালোক
অনাহার, ফলাহার, স্নান, আমরা সব হাঁটছি
আমাদের বিনাশ আমাদের পাশে-পাশে হাঁটছে
আমাদের সমূহ বিনাশ, মন বলে
পথের ধারে-ধারে সুন্দর ফুটে আছে
আমি যারে দেখি নাই
কেন দেখি নাই রক্তের কোমল ফুল
পথের ধার, কেন তোমারে দেখি নাই
এসো হে, রক্তরাঙা ঘোর বসন্তবেলা
আমি যারে দেখি নাই
বৃষ্টির দিনে যে সমস্ত একলা পথ
আরো একা হয়ে যায়, যে সমস্ত মেঘ
ব্যাথার মতো গগনপথে ফুলে ওঠে
আমি যারে দেখি নাই
পায়ে পড়ি পথের ধার, আমার রক্ত
যেন এমন কোমল এক ফুল হয়
আমি যারে দেখি নাই
আমি তারে দেখি নাই, অশান্ত মনের প্রভা
অবিরল, পরমদুঃখী আমার দুই বাহু
তোমার ঘনহরিত বর্ণ খনন করেছি,
তোমার পরিহাস, দেখেছি, ঝরে পড়ে ধীরে,
অতিধীরে মিশে যায় নিদারুণ ক্ষতচিহ্নে
হা আত্মকথা, হা সরল, কোন পথে গড়িয়ে
চলেছে, বলো, রূপবতী শ্রাবণ মাসগুলি;
চাতালে পরমান্ন ফেলে ছড়িয়ে কারা যায়
দূরদেশে, কাদের মুখশ্রী আজ ভিক্ষাপাত্র,
এ-সমস্ত গণনা করি খননের সময়ে
নারীদের শ্বেতবস্ত্র সতত গণনা করি
আমি গণনা করি মর্মস্থলের নীরবতা
অসম্ভব, আপনাকে গণনা করি সভয়ে
সম্যক বুঝি নাই, আমি এক, না শূন্য, না সহস্র
তাম্রবর্ণ অস্তাচলের মরণলেখ কথা বলে
বলে, রক্তধারার নিয়ম শৃঙ্খল বেজে উঠেছে
ফিরে আসছে সব, যুদ্ধসাজ ফিরে আসছে রথে
রথের কেতন ফিরে যাচ্ছে আবার, আকাশ ছিঁড়ে
এগিয়ে চলেছে অন্তরের অগাধ রাত্রির পানে,
কান পেতে ওই শুনি আকাশের যুদ্ধযাত্রা
আমার অশেষ যুদ্ধের ঘনছায়া, আকাশ,
যদি এবার তোমার গমনপথের মাঝে
এসে দাঁড়ায়, মরণের কোল যদি এমন,
ছিন্ন দেহে, আমি তবে সম্মুখে এসে লুকাই
সে উদাস বাতাসটিতে, যে আমারে কাঁপায়,
কাঁপায় পথের ধারে ফুটে থাকা সারি-সারি
রক্তের কোমল ফুল, কাঁপায় এ-হস্তাক্ষর,
আকাশ আমার কম্পিত হস্তাক্ষর দেখেছে
আমায় দেখে নাই,আমার ক্রোধ দেখে নাই ;
আমার ভিন্ন দেহ সম্পূর্ণ গোপন এখনো
প্রাচীনতম আলোর গন্ধ আমার গুহায়,
গুহাচিত্র বেয়ে অবিরাম জল ঝ’রে পড়ে
আমি সযত্নে পরেছি সেই জলের তিলক
গুহাচিত্রের মাঠের উপর দিয়ে হাঁটছি।
মহাবাহু
অষ্টম সংখ্যা, বর্ষা ১৪১৭