পাইস হোটেল – উপল মুখোপাধ্যায়
ঠান্ডা থেকে গরমের দিকে যাওয়ার মতো খিদে পায় যখন, স্মৃতিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে যখন বাঁচতে ইচ্ছে করে, যখন এই আজকের মতোই কালও বাঁচব বলে ভাবতে থাকি, তখন আমি পাইস হোটেলের দিকে হাঁটা দিলাম—সঙ্গে বান্টি। বান্টিকে সঙ্গে নেওয়া মানে কি স্মৃতিদের নেওয়া নয়? বহুদিন আগে ওকে বিয়ে করেছিলাম। তারপর কোনো কেলো হয়নি এমনটা নয় তবু বান্টিকে নেওয়া মানে স্মৃতিদের নিয়েও তার দিকে না তাকানো। বান্টিকে বললাম, “চল্।”
—কোথায়?
—চল্ পাইস হোটেলে।
—পাইস হোটেল?
—কলকাতার সবচেয়ে পুরোনো পাইস হোটেল।
—পুরোনো? কতদিনের?
—বহু পুরোনো। একশো বছর আগের।
—একশো?
—তার থেকেও বেশি। তবে কত বেশি জানি না।
—কিন্তু আমরা তো কলকাতায় থাকি না।
—হ্যাঁ, আমরা বহুদূর থাকি।
—তবে কলকাতায় যাব কেন?
—কলকাতায় যাব না তো।
—তবে কোথায় যাব?
—পাইস হোটেলে। বহু পুরোনো পাইস হোটেল। প্রাচীন হোটেল। প্রাচীন কলকাতায় যাব।
—চলো।
বান্টি এত সহজে রাজি হবে ভাবিনি। ও আজকাল ছেলের পড়াশোনার তদারকি করতে বেশি বেশি সময় কাটায়। যত পড়া বাড়ে তত ওকে সময় দিতে হবে। কত পড়া বাড়বে তার কোনো শেষ নেই তাই সময় দিতে দিতে বান্টির আর কোনো সময় থাকছে না। ওই জন্য সে শিখে গেছে স্মৃতিদের সঙ্গে কীভাবে থাকতে হয় অথচ তাদের দিকে তাকাতে নেই। এইভাবে না তাকাতে তাকাতে আজকাল বান্টির চোখ আরও ঝলমলে হয়ে উঠেছে কারণ স্মৃতিরা খুবই ঘন একটা কিছু, কুয়াশা হয়ে তারা যখন ছেয়ে আসছে তার দিকে তাকালে স্মৃতি ছায়া ছায়া হয়ে যাবে। এইভাবে বান্টি ঝলমলে চোখে তাকাল আমার দিকে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই নিশ্চয়ই খুশি হচ্ছিস?”
—কেন?
—এই যে আমরা যাচ্ছি?
—কোথায়?
—পাইস হোটেলে।
—কলকাতায়?
—না পাইস হোটেলে। প্রাচীন হোটেলে।
—সে কলকাতাতেই।
—হ্যাঁ, সে এক প্রাচীন কলকাতা।
—কলকাতা যেতে আমার ভালো লাগে না। ট্রেনের ভিড়।
—যদি আমরা অন্য ভাবে যাই?
বান্টি আর কিছু বলল না। আমার দিকে তাকালও না। সে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যেন কোনো কথাই হয়নি এমন ভাবে আমার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। আমি ভাবতে লাগলাম কীভাবে অন্য ভাবে কলকাতা যাওয়া যায়।
অন্য ভাবে কলকাতা যেতে খুব যে ঝামেলা পোহাতে হয়েছে এমনটা নয়। এখন বয়স বেড়ে গেছে। আত্মজৈবনিক হতে খুব ইচ্ছে করে কিন্তু কিছুতেই হতে পারি না। খালি টুকরোটাকরা কথা মনে পড়ে। স্মৃতিরা কথা মনে পড়ায় আর ঘটনা যেন ঘটতে ঘটতে বর্তমানে ঘটছে—অন্য ভাবে যাওয়ার কথা মনে পড়ে গিয়ে সেসব দেখা যাচ্ছে। আমি আর বাপ্পা রাঁচির মোরাবাদি হিলসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাপ্পা দেখাল মোরাবাদি হিলসের ঠাকুর পরিবারের বাড়ি, মধুবালার বাড়ি—সব পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। আমরা ওই পাহাড়ে উঠলাম একদম অন্য ভাবে। যে রাস্তায় সবাই হেঁটে হেঁটে সহজে ওঠে তেমন ভাবে নয়। বড়ো পাথরের খাঁজ দিয়ে ঘষটে ঘষটে, ফাঁক গলে পৌঁছলাম যখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে সূর্য আমাদের আলাদা রকম করে পাহাড়ে ওঠা দেখতে না ডুবে অপেক্ষা করে আছে। পাহাড়ে উঠতেই সূর্য ডুবতে শুরু করল। বাপ্পা আর আমি প্রথম দিককার নিষিদ্ধ সিগারেট দুটোতে টান দিতে দিতে দেখছিলাম অনেক ওপর থেকে রাস্তায় ছোটো ছোটো যান চলাচল করছে, ছোট্ট ছোট্ট লোকজন, আরও সামনের দিকে তাকালে বহুদূরে অনেক উঁচু থেকে দেখা যাচ্ছে মোরাবাদি ময়দান। বাপ্পা বলেছিল ওখানে জেপির মিটিং হয়েছিল—জয়প্রকাশ নারায়ণ, অনেক লোক। আমি বললাম, “হুম, মেসোমশাই তো জেপিকে খুব সাপোর্ট করে।” বাপ্পা তার বাবার কথা শুনে বলল, “বলিস না—সবসময় ওই এক কথা।” অন্যরকম করে কলকাতা যেতে যেতে অনেকদিন আগেকার এ সব নিয়ে ভেবেছি। তারপর দেখলাম কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন পাইস হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর বান্টি। আর স্মৃতিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে আমরা খাবার খেতে ঢুকলাম সঠিক রাস্তা দিয়ে হেঁটে একদম অন্য ভাবে।
গিয়ে দেখি পাইস হোটেল ঠিক একশো বছর আগের মতোই আছে শুধু তাতে রং করা হয়েছে। সে রঙে আলো পড়ে চকচক করছে। আবার একটু ওপরে রাখা আছে কিছু জিনিসপত্র অনেকটা আগোছালো ভাবে, যেন কেউ তাদের সরিয়ে নিতে ভুলে গেছে। অনেকটা তাকের মতো—টুকিটাকি সব জিনিসপত্র, তার মধ্যে একটা পুরোনো গ্রামোফোন দেখলাম। সেই গ্রামোফোনটার চোঙ ধুলো মেখে রয়েছে। দেয়াল জুড়ে রং করে করে ঠিকঠাক রাখা হচ্ছে বছর বছর। আর তাক একই রকম ধুলো নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। আমি বান্টিকে গ্রামোফোনের দিকে তাকাতে বললাম। প্রথমে বান্টি তাকাচ্ছিল না, সে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব কিছু দেখছিল। স্মৃতিদের দূরে সরিয়ে রাখায় তার ঝকঝকে চোখ দিয়ে বান্টি সব কিছু বেশি বেশি দেখছিল। দেখলাম তাকে দেখে সবাই বেশ নড়েচড়ে উঠল। পুরোনো চেয়ার আর টেবিল নিয়ে বসেছিল যে ম্যানেজার সে বেশ গুরুত্ব দিয়ে বান্টিকে বলল, “পাবদা মাছ খান ম্যাডাম। পোস্তর বড়া। চচ্চড়ি। শুক্তোও নিতে পারেন। খাসির মাংস–মাটনও আছে। চাটনি আছে।” আমি বললাম, “কীসের চাটনি?” ম্যানেজার বলল, “আমের।”
—আমের?
—হ্যাঁ।
—শীতকালে আম?
—হ্যাঁ, আগেও পাওয়া যেত।
—বলেন কী! সারা বছর আম!
—আগেকার কলকাতায় পাওয়া যেত।
—আর এখন?
—এখানে তো আমরা আগেকার কলকাতার মতোই চলি।
—কী করে?
—কারণ এখনও, এই শীতেও, আম পাওয়া যায়।
—যায়?
—শুধু একটু খুঁজতে হয়।
—খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসেন।
—খুঁজে খুঁজে।
বান্টিকে বললাম, “কী কী খাবি?” ও বলল, “বলো।” আমরা অনেক কিছু খেলাম। যখন খাচ্ছিলাম পাইস হোটেল একদম ফাঁকা ছিল। তারপর সময় যায়, পাইস হোটেল ভরে যেতে লাগে। দেয়ালের রং আরও চকচকে লাগল। সেখানে আলো পড়ে ঝলমল করল। পাবদা মাছ খেতে গিয়ে দেখলাম অতি স্বচ্ছ সেই মাছের ঝোল। এমন যে তলা অবধি দেখা যাচ্ছে। মাছটি আড় হয়ে সেখানে ছিল। বহু বছর ধরে রান্না করতে করতে তবেই এই রকম ঝোল রাঁধা সম্ভব। আমি ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলাম, “বড়ি দিয়ে পাবদা মাছ রেঁধেছেন তো?” ম্যানেজার অদ্ভুত ভাবে হাসল, “ভুল করছেন। আমি কিন্তু কর্ণধার নই। মালিক নই। ম্যানেজার-ট্যানেজার বলতে পারেন।” আমি বললাম, “বড়ি দিয়ে পাবদা মাছ রেঁধেছেন কি?” ম্যানেজার তখনও হাসছিল, বলল, “দেখুন, খেয়েই দেখুন না।” আমি কোথাও বড়ি খুঁজে পেলাম না। তারপর দেখলাম এক অপূর্ব মাংস রান্না করা হয়। সেখানে মশলা আছে অথচ নেই, এমন সব ঝোল যা আস্তে আস্তে খেতে হয়। বান্টিও দেখলাম খুবই আস্তে আস্তে খাচ্ছে। আমাকে দেখে বলল, “খুব আস্তে আস্তে খাও সব বুঝতে পারবে। তোমার সবটাতে তাড়াহুড়ো।” আজ আমরা একদম অন্য ভাবে কলকাতা এসেছি। সেখানে কোনো তাড়া ছিল না। ভিড় ছিল না অথচ পাইস হোটেলটি ক্রমে ভিড়ে ভরে উঠেছে। এত ভিড় হল কোথা থেকে এই অসময়? দিন নয়, রাত নয়, এমন একটা সময় দেখে এখানে পৌঁছেও শান্তি নেই। কেবল ভিড়ে গমগমিয়ে উঠছে হোটেল। তার দেয়াল রং করে করে রাখা ছিল আর তার ওপরের তাকে টুকিটাকি ময়লা পড়া জিনিসপত্র, একধারে গ্রামোফোন। ভিড় বেড়ে যেতে সেই গ্রামোফোন বেজে উঠছে। সেখানে এক প্রাচীন গান শোনা যাচ্ছে। সেই গান শুনতে শুনতে সবাই গুনগুন করে গাইছে। মাথা নাড়ছে আর খাওয়া দাওয়া করছে। আমি খেতে খেতে সুন্দর গন্ধ উপভোগ করছিলাম আর গান বেজে উঠতে চমকে তাকিয়ে উঠেছি। বান্টিকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই গান শুনতে পাচ্ছিস?” বান্টি বলল, “এটা অনেক দিন ধরে বাজানো হচ্ছে।”
—অনেক দিন ধরে?
—হ্যাঁ, অনেক দিন ধরে।
—তুই কী করে বুঝলি?
—কী করে আবার! আমি আগেও এসেছিলাম।
—কবে?
—অনেক দিন আগে।
—কত দিন আগে?
—সে অনেক দিন হল।
—কত দিন?
—অত মনে পড়ছে না।
—তবে গান মনে পড়ছে কী করে?
—সে বলতে পারব না।
—এসেছিলি সে কথা মনে আছে?
—আছে।
—কার সঙ্গে এসেছিলি?
—কেন? তোমার সঙ্গে।
—সে কী!
—মনে করে দেখো।
—কী?
—মনে করার চেষ্টা করো।
—করব?
—করো।
আমি স্মৃতি নিয়ে ঘর করি না। ঠান্ডা নিয়ে ঘর করি। সেই ঠান্ডা যখন গরমের দিকে যাওয়ার মতো হয় তখন একটা ট্রাক্টর মিছিল দেখা যাবে আর পাবে খিদে। মিছিল কথাটা বলা যাবে কি যাবে না, লেখা যাবে কি যাবে না এ সব কিছু ধর্তব্যের মধ্যে না এনে খিদের কথা বলে ফেললাম আর স্মৃতিদের একপাশে সরিয়ে রেখে পাইস হোটেলের কথা লিখতে বসেছি। দেখছি বান্টির চোখ আর ঝলমলে নেই। তার মধ্যে দিয়ে স্মৃতিরা ঘুরতে ঘুরতে যেতে যেতে কুয়াশার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে রয়েছে। তার চোখ দুটো হয়ে গেছে আবার ম্লান মতো একটা কিছু। ও আস্তে আস্তে খাচ্ছে, পাবদা মাছের স্বচ্ছ টলটলে ঝোল যেখানে বড়ি জেগে থাকে, অপূর্ব হাল্কা করে রান্না করা খাসির মাংস যাকে মাটন বলে আর অসময়ের আমের চাটনি যা পুরোনো কলকাতার প্রাচীন গাছের আম দিয়ে তৈরি। তার মনে পড়ে যাচ্ছে পুরোনো গ্রামোফোন ও গানের কথা। পাইস হোটেলের কথা। ম্লান হয়ে আসছে চোখ। মনে করার চেষ্টা করছে আমি সত্যিই ওর সঙ্গে এখানে এসেছিলাম কি? কবে যেন?