শঙ্খ ঘোষ: আমাদের প্রত্যয়ে – কিন্নর রায়

শেয়ার করুন

শঙ্খ ঘোষ প্রয়াত হয়েছেন তাঁর বাড়িতে, নব্বই বছর বয়সে। এই সূত্র সবই সংবাদমাধ্যম থেকে পাওয়া, এখন কথা হল যে, কবি হিসেবে, গদ্যকার হিসেবে, চিন্তক হিসাবে, ছোটোদের লেখক হিসেবে তাঁর কথা নানাভাবে বলা যায়। আমার সঙ্গে তাঁর যে খুব হৃদ্যতা ছিল তেমন নয়, কোনো সভায় বা সমাবেশে দেখা হলে উনি যতটা ঘাড় হেলাতেন আমিও ঠিক ততটাই ঘাড় হেলাতাম। আমি ওনার বাড়িতে গেছি দু-বার। মানিকতলার ফ্ল্যাটে একবার তাঁর ছোটোমেয়ে টিয়া, সেমন্তী যার নাম, সে মাধ্যমিকে সম্ভবত সেকেন্ড হয়েছিল। তার একটা ইন্টারভিউ নিতে গেছিলাম ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’ পত্রিকার পক্ষ থেকে। সেদিন শঙ্খ ঘোষ বাড়িতে ছিলেন না। প্রতিমাদি ছিলেন, তাঁর স্ত্রী, অসামান্য যত্ন করে (যেমন সকলকেই করেন, ওঁদের এই যত্ন অত্যন্ত সমুচিত) আমাকে প্রচুর পরিমাণে খাবার খাইয়েছিলেন এবং আমি টিয়ার ইন্টারভিউ নিয়ে চলে এসেছিলাম। পরে শঙ্খ ঘোষের বড়োমেয়ে মিঠি এবং জামাই সোমেশ্বর ভৌমিক, ছোটোমেয়ে টিয়া, এদের সঙ্গে অনেকবার দেখা হয়েছে। বিশেষ করে মিঠি এবং সোমেশ্বরের সঙ্গে ‘প্রতিক্ষণ’-এর আড্ডায় কথা হয়েছে। সোমেশ্বরকে নানাভাবেই জেনেছি—একজন চিত্রসমালোচক হিসেবে, সুভদ্র, সুজন মানুষ হিসেবে।

শঙ্খ বাবুর ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’, ’মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘বাবরের প্রার্থনা’ এসব কবিতার বইগুলি বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেতাব। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’-এর মতোই শঙ্খ ঘোষের ‘পেটের কাছে উঁচিয়ে আছে ছুরি/এখন আমি ইচ্ছে মতো ঘুরি’ কিংবা ‘বাবরের প্রার্থনার’ “আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক” বা “যমুনাবতী সরস্বতী” ইত্যাদি লাইন জরুরি অবস্থার সময় কবিতাপাঠকদের মুখে মুখে ঘুরেছে। শঙ্খবাবুর ছোটোদের জন্য দুটি লেখা আমার অত্যন্ত প্রিয়, ‘সকালবেলার আলো’ এবং ‘সুপুরিবনের সারি’। ‘সকালবেলার আলো’-তে তিনি অখণ্ড বঙ্গের যে ফেলে আসা স্মৃতিকথা লিখেছেন, তা পড়তে পড়তে মন ভারাক্রান্ত এবং স্মৃতিমেদুর হয়ে ওঠে। বইদুটির মলাট এঁকেছিলেন পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়, আমাদের দুলুদা। ‘সকালবেলার আলো’-তে বাসুদি বলে একটি চরিত্র আছে, অত্যন্ত চমৎকার। সেখানে একটি জায়গায় সম্ভবত উজ্জ্বল বাটা মাছের স্তূপের বর্ণনা আছে, যা পড়তে পড়তে মানিকবাবুর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’-র রুপোলি ইলিশের চোখের বর্ণনা মনে পড়ে যায়।

শঙ্খ ঘোষ শুধুমাত্র কবি বা গদ্যকার ছিলেন না, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তাঁর ভাবনা-চিন্তা ছিল বিস্তৃত। আমার মনে পড়ছে, পশ্চিমবাংলায় তখন বামফ্রন্টের শাসনকাল, বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধানতম কবি শামসুর রহমান প্রয়াত হবার পর, তাঁর প্রায় দীর্ঘ একটি বক্তৃতা তিনি পেশ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমির বাইরের খোলা মঞ্চে। সেই বক্তব্য এবং ভাষার ব্যবহার শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। তাঁর সঙ্গে কথা যে খুব হয়েছে এমন নয়, আমার একটি বই ‘যে লেখার সিরিয়াল হয় না’, তাতে তাঁর একটি কবিতা ব্যবহারের জন্য ফোন করেছিলাম। আমি বললাম, “কবিতায় যদি গল্প লুকোনো থাকে/ টপ করে তাকে গিলে নেবে সিরিয়াল!” এটা আমি ব্যবহার করব। উনি স্তব্ধ হয়ে ছিলেন, উনি হ্যাঁ–না কিছু বলছেন না দেখে আমি সম্মতি ধরে নিলাম। তারপর কবিতাটি আমি ব্যবহার করলাম এবং বইটির একদম শুরুতে কবিতাটি আছে। উত্তরবঙ্গ থেকে অমিত দাসরা ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকা বের করত। ‘এক্ষণ’ এর সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য মারা যাবার পর তারা একটি সাহিত্য সমাবেশ করে। কলকাতা থেকে আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম—শঙ্খ ঘোষ এবং দেবেশ রায়ও ছিলেন। আমি বন্দিমুক্তির সভায় বা অন্যান্য সভায় দেখেছি শঙ্খ ঘোষ সাধারণত বক্তব্য পেশ করতে উঠতেন না। কিন্তু সেখানে তিনি উদ্যোক্তা অমিত দাস এবং তরুণ লেখকদের আহ্বানে স্টেজে উঠে লিটল ম্যাগাজিনের আন্দোলন কী হতে পারে এবং কলকাতা কেন্দ্র থেকে সরে গিয়ে তথাকথিত মফঃস্বল যে ক্রমশ নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে, এই পুরো ব্যাপারটা নিয়ে এত সুন্দর একটি অসামান্য বক্তৃতা দিলেন, তা শোনার মতো। ওনার কণ্ঠস্বর ছিল অপূর্ব। উনি যদি শুধুমাত্র একজন আবৃত্তিকার হতেন তাহলেও সেই কণ্ঠ আমাদের মুগ্ধ করত, যেমন শম্ভু মিত্রের কণ্ঠ আমাদের মুগ্ধ করে। একবার তাঁর একটি ঘরোয়া সভায় আমন্ত্রিত ছিলাম, সেখানে তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতাপাঠ শুনেছি।

বিভিন্ন সময় অন্যায় এবং নানা সামাজিক অসঙ্গতির প্রতিবাদে তিনি সোচ্চার হয়েছেন। সবসময় তাঁর সাথে একমত হয়েছি এমন না, অনেকসময় তিনি কী বলতে চেয়েছেন বুঝতেও পারিনি। নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরের সময় তিনি প্রতিবাদী হয়েছিলেন বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে। আবার কামদুনির সময় যখন শিপ্রা ঘোষ নামে একটি ছাত্রীকে শাসকদলের আশ্রিত সমাজবিরোধীরা ধর্ষণ করে হত্যা করে তখন তিনি কলকাতায় একটি মিছিল ডেকেছিলেন। রাজ্যে তখন তৃণমূল রাজত্ব চলছে, আমিও সেই মিছিলে ছিলাম। তাঁর শরীর খারাপ থাকা সত্বেও মিছিলটিতে আগাগোড়া হেঁটেছিলেন এবং কোথাও বিরতি নেননি, অন্যরা হাত ধরতে এলে আপত্তি করেছিলেন। এছাড়াও বাংলাদেশে একটা ভয়ংকর ঝড় হবার পর মূলত চট্টগ্রামের মানুষরা খুব ক্ষতিগ্রস্ত হন, তখন এ রাজ্যের এক অতি দক্ষিণপন্থী শক্তি যারা ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছে তারা প্রচার করতে শুরু করে যে ইসলাম ধর্মের মানুষদের পাপের ফলেই এই দুর্যোগ হয়েছে। বাংলাদেশের ওই দুর্গত মানুষদের সমর্থনে টাকা তোলার জন্য একটি দীর্ঘ মিছিল হয়, সেই মিছিলের ব্যানারটি আমার হাতে ছিল। তীব্র বর্ষণের মধ্যে ভিজতে ভিজতে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে শঙ্খ ঘোষ মিছিলে হেঁটেছিলেন। এবং সেই টাকা তুলে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। গুজরাট দাঙ্গায় যেভাবে ইসলাম ধর্মের মানুষদের নাৎসি কায়দায় খুন করা হয়, (সেই খুনিরা আজকে কেন্দ্রে ক্ষমতার অলিন্দে রয়েছে) সেই শক্তির বিরুদ্ধে নানাভাবে যাঁরা সোচ্চার হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শঙ্খ ঘোষ অন্যতম। সবসময় তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে এমন নয়, কিংবা সবসময় তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য সমর্থন করতে পেরেছি এমন নয়, কিন্তু আমার মনে হয়েছে, ‘শুধুমাত্র আমি কবিতা লিখি’, ‘শুধুমাত্র আমি গল্প লিখি’—এরকম জায়গায় নিজেকে সীমাবদ্ধ না করে তিনি সামাজিকতার মধ্যেও নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। যেকোনো বড়ো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কিন্তু দেশের বিপাকে ঘরে বসে থাকেন না। আমি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তুলনা করছি না। রবীন্দ্রনাথ কক্ষনো বসে থাকেননি, তিনি যখন বুঝেছেন তাঁর মতো করে প্রতিবাদ করেছেন এবং রবীন্দ্রনাথ নিজে যেটা ভালো বুঝেছেন সবসময় সেটা করেছেন। কোনো গড্ডালিকা প্রবাহে তিনি গা ভাসাননি। সেটা আমাদের দেশে আজকের দিনে খুব বিরল। যারা লেখালিখি করেন (তাদের সাহিত্যিক বলা যায় কিনা জানি না) তারা অনেকেই এখন স্তব্ধ। দাঁড়িয়ে আছেন নিজের প্রাসাদ, পুরস্কার, কোন্ কাগজ থেকে তার ধারাবাহিক বেরোলো, কোথায় কোন্ বড়ো প্রকাশক তার লেখা ছাপলো— এইসব চিত্র বিচিত্রের মধ্যে। সমাজের যে নানারকম অসঙ্গতি, অন্যায়, তার বিরুদ্ধে তারা কথা তো বলেনই না, বরং এড়িয়ে যান, ‘আমি ঠিক রাজনীতি বুঝি না’, এইসব বলে। আবার কখনও কখনও দাবি করেন—আমিই তো প্রথম অমুককে নিয়ে উপন্যাস লিখেছি কিংবা বড়োগল্প লিখেছি, অমুকের অত্যাচারের জন্যই অমুক সরকার আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিল, এসব কথাও তারা বলেন বাজার গরম করার জন্য। কিন্তু শিরদাঁড়া সোজা রেখে নিজের মন্তব্য, যেটা আমি ভালো বুঝি বা মন্দ বুঝি, সেটা বলার লোক ক্রমশ কমে আসছে। শঙ্খ ঘোষ অন্তত বহুক্ষেত্রে তাঁর নিজের জায়গা থেকে এই প্রতিবাদটুকু জানিয়েছেন।

‘প্রতিক্ষণ’-এ তিনি মাঝে মাঝে আসতেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে। খুব চাপা রসিকতা করতেন কখনও কখনও। সেই চাপা রসিকতাও শোনার মতো ছিল। আমি তাঁর বাড়ির আড্ডায় কখনও যাইনি। শুধু একবার ওঁর মেয়ের ইন্টারভিউ নিতে, আর একবার ‘যে লেখার সিরিয়াল হয় না’ বইটি প্রকাশ হবার পর ওঁকে দিতে যাওয়া ছাড়া। বইটি দিতে যাওয়ার দিন উনি বাড়িতে ছিলেন, এবং উনি আর ওনার স্ত্রী, প্রতিমাদেবী অসম্ভব যত্ন করে আমাকে খাইয়েছিলেন। সেদিন ওনার বাড়িতে ওনার কাকা ছিলেন, একটা বড়ো সাহিত্যের পার্লামেন্ট বসে সেদিন ওনার বাড়িতে। এধরনের পার্লামেন্ট আমি সবসময় এড়িয়ে যাই, কারণ আমার খুব অসুবিধা হয়, নিজেকে odd man মনে হয়। একটা হাফ শীতের দিন, ওনার কাকা গায়ে একটা এন্ডির চাদর দিয়ে প্রুফ দেখছিলেন। শঙ্খবাবু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দু-একটা কথা বললেন, বসতেও বললেন। তাঁর ওই সৌজন্য ও ভদ্রতা আমি সত্যজিৎ রায়, অশোক মিত্র ছাড়া ওই মাপের অন্য কারোর মধ্যে দেখিনি। সত্যজিৎ রায় নিজে এসে লিফটের দরজা খুলে দিতেন। অশোক মিত্র নিজে এসে লিফটের দরজা খুলে দিতেন এবং দাঁড়িয়ে থাকতেন। শঙ্খবাবু এবং মহাশ্বেতাদিও তাই করতেন।

শঙ্খবাবু যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন, সেই সম্পর্কিত প্রবন্ধ থেকে আমাদের অনেক শিক্ষা নেওয়ার আছে। তিনি তাঁর স্কুলের কথা বলতে বলতে একটা অদ্ভুত স্কুল জীবনের গল্প একেবারে ছোটোদের মতো করে বলেছেন, যা বড়োরা পড়েও আনন্দ পাবেন, এরকম একটি গ্রন্থ তিনি নির্মাণ করেছিলেন—‘ছোট্ট একটা স্কুল’। এছাড়াও তাঁর বহু সমালোচনামূলক লেখা এবং বিশেষ করে তাঁর বক্তৃতা এবং কথা বলা, বাঙালি আভিজাত্যের সঙ্গে সঙ্গে এক আন্তর্জাতিক মানও হয়তো স্পর্শ করেছিল। এই ধরনের মুহূর্তের মধ্যে বলে ফেলার লোক খুব কম আছেন। আমি শুনেছি, যারা তাঁর খুব স্নেহধন্য কবি বা গদ্যকার তাদের পাণ্ডুলিপি তিনি যতদিন পেরেছেন নির্দ্বিধায় বসে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কারেকশন করেছেন এবং প্রুফ দেখে দিয়েছেন। রোববার তাঁর বাড়িতে যে সাহিত্যের সংসদ বসত, সেখানে আড়াইটে–তিনটে পর্যন্ত অত্যন্ত ধৈর্য নিয়ে বসে থেকেছেন এবং কথা শুনেছেন নবীন কবি ও গদ্যকারদের। ফলে সব মিলিয়ে একটা মানুষ চলে গেলেন, এটা একটা শোকাবহ ঘটনা তো বটেই।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *