আহা যদি অহর্নিশি দাঙ্গা হত – পরম ভট্টাচার্য (পুনর্পাঠ)

শেয়ার করুন

ক.

অপু এ শহরে অভ্যস্ত, পরিচিত। প্রতিটি বাড়িঘর, মানুষজন, গলি, তস্যগলির আলাভোলা পাগল যত, সবেতেই অপু প্রাচীন। কোথায় ভয়, কোথায় স্বস্তি, কোথায় আনন্দ-বেদনা জানে অপু। ছোট্ট এই রেল শহরের রেলকর্মীর ছোটোছেলে। মধ্যবিত্ত পরিবার। অপুর দাদা ব্যাঙ্ককর্মী। দিদি এম এস সি করছে। অপুর বাবার চাকরির মেয়াদ আর দুবছর। সাধারণ গ্র্যাজুয়েট হয়েছে অপু গেল বছর। অপু বুঝেছিল একটা গভীর কোনো পরিবর্তন এসেছে মনে। ‘ছুটি’ গল্পের ফটিকের জন্য যে কাঁদত, গফুর মিঞার মহেশের জন্য যে ব্যাকুল হয়ে উঠত, গুলতি মেরে, মারবেল খেলে, ফুটবল মাঠে কাদায় মাখামাখি হয়ে, ঘুড়ির সঙ্গে আকাশে উড়ে বেড়াত যে, বয়ঃসন্ধিতে সমবয়সি নিন্নির বুক ভেদ করে সহসা উঠে আসা দুই ঢেউ অবাক বিস্ময়ে দেখত যে এই অপু একসময় দ্বিজ হল। ব্রাহ্মণত্বে দীক্ষিত হল। গায়ত্রী মন্ত্রের মহিমা সম্বন্ধে মন্ত্রদাতা প্রদত্ত ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকল। কোনো দল নয়, কোনো সংঘ নয়, আর পাঁচজন সাধারণ ভারতীয় হিন্দু বা মুসলমান অভিভাবকদের মতো অপুর বাবা একটু বেশি রকম হিন্দু কাতর ছিলেন। বসার ঘরে বা খেতে বসে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে তিনি ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানরা কতটা ক্ষতিকর, দেশটাকে কত উচ্ছন্নে নিয়ে যাচ্ছে তারা, কেমন হারে বংশ বৃদ্ধি ঘটছে সেসব বলতেন। উত্তেজিত হতেন। ‘পিতাহি পরমং তপ’ ত্বত্তে বিশ্বাসী অপুর মনে সেসব কথা ধীরে ধীরে একটা স্থায়ী আস্তানা গেড়ে বসেছিল। ধন্দে পড়ে অপুর কখনও মনে হত গফুর মিঞা কিংবা বিদ্রোহী স্রষ্টা নজরুল ইসলাম গোছের মানুষগুলো ব্যতিক্রম, প্রায় হিন্দু। প্রথম যৌবনের শরীরি উচ্ছলতা, অবাধ্য করুণ যন্ত্রণা, নিন্নির ব্যাকুল প্রত্যাশার কাছাকাছি গিয়েও দ্বিজদ্বন্দ্বে দীন হয়ে ফিরে আসে। নিন্নির সেই ব্যর্থ নিষ্ঠুর তাচ্ছিল্যের হাসি সময় সময় এখনও তাকে তাড়া করে। প্রথমা নিন্নিকে কতদিন যে সে কলোনির শনির থালায় প্রার্থনা করেছে।

পড়াশুনোয় অপু কনোদিনই মনোযোগী নয়। সব সময়ই তার অন্য ব্যস্ততা। খেলার মাঠ, স্কাউট, স্বেচ্ছাসেবক সাফাই বাহিনী, আড্ডা দেওয়া, হাসপাতাল, দরিদ্র নারায়ণ সেবা। সুযোগ পেলে বরং স্বামী বিবেকানন্দ পড়া। ‘জীবে প্রেম’ অপুর প্রায় নেশায় দাঁড়িয়েছিল। কাজেই পরীক্ষার পড়া, স্কুলের পড়া হত খুব কম। অথচ বাড়িতে দাদা-দিদি খুব মনোযোগী। ভালো ছাত্র। পরীক্ষা এলেই অপুর উৎকণ্ঠা বেড়ে যেত। প্রস্তুতি প্রায় নেই। একটা বিশ্বাস ছিল, ভালো কাজ করে, দুর্গত মানুষের জন্য কাজ করে, জীবে যথা সম্ভব প্রেম যখব সে করে, ঠাকুর একটা বন্দোবস্ত নিশ্চয় করবেন। থানে-মন্দিরে-ঠাকুরকে এইসব কথা মনে করিয়ে দিয়ে সে উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। বাবা মাঝে-মধ্যে বলতেন, তোমাকে কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে, চর্চা করতে হবে—ঈশ্বর ফাঁকিবাজদের সহায় হন না। অপুর তখন মনে হত, সবই যদি নিজে করি তবে ঈশ্বরের মহিমা কোথায়? বাবার এই বিশ্লেষণ তার মনঃপূত হত না।

খ.

সমাজবিরোধী যাদের বলা হয় অপু তাদের মতো নয়। সে কোনও ধর্ম সঙ্ঘও করে না। এই সমাজেরই এক সদস্য হিসেবে মনের গভীরে তার হিন্দুবোধ, রাষ্ট্রবিরোধ, মুসলমান বিরোধিতা ইত্যাদি একটা শক্তপোক্ত ভিত রচনা করেছে। কথা বলে দেখেছে, নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য পরিসরে লেখাপড়া জানা মানুষগুলোর অনেকেই তার মতো করেই ভাবে। তবে শুধু ভাবে। ভেতরে উদ্যোগ গ্রহণের সেই আগুন নেই, তেজ নেই। তার ভেতরে কিন্তু দাউ দাউ বিদ্বেষের আগুন জ্বলত। কী করা যায়, কীভাবে সুযোগটা পাওয়া যায় তার অন্বেষণে থাকত অপু।অবশেষে একদিন সে সুযোগটা এসে গেল। সে নিজেও এতটা ভাবতে পারেনি যে গতবছরের দাঙ্গায় সে হিন্দুদের পক্ষে এত বড়ো ভূমিকা গ্রহণ করবে।

গতবছরের সেই দিনটি অপুর আকাশে ধ্রুবতারা। খাপ্পা ঘোড়ার মতো টগবগে উত্তেজনা। বুকে রক্ত লাল জিঘাংসা। জেদোন্মত্ত খুনোখুনি মেজাজ। স্বধর্ম আর স্বজাতি রক্ষার আদিমতম স্পেসিস প্রিজারভেশন ইন্সটিংক্ট। গত বছরের সেই দিনটি। আঃ, মায়েদের আর বোনেদের সেই কাতর অনুরোধকে তুড়ি মেরে তুচ্ছ করে ধর্মযুদ্ধে বেড়িয়ে পড়া, নপুংসক গা বাঁচানো জাতভাইদের উদোম করে তুলোধুনো করা, বামপন্থী, উদারপন্থী বিভীষণের চোখের সামনে বুক চিতিয়ে হেঁটে, দৌড়ে ছুটে দাঙ্গার আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া—আঃ, কী দুর্দান্ত গতবছরের সেই দিনটি! লাঠি নয়তো হকিস্টিক কিংবা থান ইট এক অভূতপূর্ব অসংগঠিত শৃঙ্খলায়, অকল্পনীয় তৎপরতায় জমা হয়ে যায় যথাস্থানে। তারপর সেই বহু প্রত্যাশিত ধর্মযুদ্ধ। নাম জিজ্ঞেস করে অথবা পোশাকে চোখ রেখে রেখে অ্যাকশন। হতচকিত, বিস্মিত পথিকেরা শংকিত পথিকেরা—পথ হারাইল! কারও বুকে-পিঠে কয়েকটি মানুষের সোল্লাস লম্ফঝম্ফ, কারও মাথায় বাঁশের চাটি, কারও মুখে কপালে উপর্যুপরি থান ইটের বলিষ্ঠ চুম্বন, ঊরুদেশে ক্রমাগত হকিস্টিক কিংবা থার্ড ডিগ্রি মেজাজে নাভিমূলে বুলেটের শীতল মোচড়। গত বছরের সেই দিনটি! আঃ, অসহায় মানুষের আর্ত চিৎকারে এত আনন্দ হয়! না-না! সে তো মানুষের নয়! বিধর্মীর! আঃ, কী দারুণ সেই অনুভব! প্রার্থিত রক্তের সাগরে ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে সপ্তডিঙা ভেসেছে যেন! কত বৈচিত্র্য নিয়ে যে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা যায়, কত মনোরম বীভৎসতা নিয়ে যে স্বধর্মের অধিকারকে মুখর করে তোলা যায় সেই দিনটির আগে তা তো জানত না অপু। কারও সাথে কারও কথা তো হয়নি! কিন্তু অপ্রত্যাশিত স্বতঃস্ফূর্ততায় সবাই সেদিন নানাবিধ নমুনা প্রদর্শনের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। প্রতিটি আক্রমণ ছিল স্বরচিত শিল্প-সুষমায় পরিপূর্ণ। স্বাভিমান—স্বকপোলকল্পিত একটি চোর বা পকেটমার ধরা পড়লে সাধারণ পথচারীদের সমাজসংস্কারক অ্যাকশনে যে স্বমহিমা প্রত্যক্ষ করা যায় তার চেয়েও সৃষ্টিশীল ছিল গতবছরের সেই অ্যাকশনের দিনটি। অপু ভাবলেই পাগলা হয়ে যায়। সেই দিনটিকে কেন্দ্র করেই তো তার স্বপ্ন-ফসল পর্বের শুরুয়াত। সে ভাবেওনি যে ওই দিনটি ‘একটি দিন’ হিসেবে এত দ্রুত পিছিয়ে পড়বে। পুরোনো হয়ে আসবে! আহা রে, গত বছরের সেই অবিস্মরণীয় দিনটি!
আহা, যদি অহর্নিশি…।

গ.

সেদিনটার পর থেকেই দিনগুলো সব একে একে অন্যরকম খারাপ। অপুর মাথা খারাপ হয়ে গেল যখন দেখল হুলিয়ার ভয় ওর ভেতরকার বিদ্বেষী হিংস্র মানুষটিকেই জবাই করে ফেলেছে। প্রায় সবকটা অ্যাকশন-পুঙ্গবকেই প্রাণভয়, পুলিশের ভয় একেবারে খতম করে ফেলেছে। মাথাখারাপ হয়ে অপুর খিস্তি উগরে উগরে বেরুতে চায়। সে সুদ্ধ সবকটায় আজ শালা নপুংসক।

দাঙ্গার পর নিয়মমাফিক প্রশাসনিক হুলিয়া আর রাজনৈতিক গ্রেফতারের কোপে পড়তে হয় হিন্দু-মুসলিম কিছু দাঙ্গাবাজকে। দাঙ্গা ঘটে যাওয়ার পর পুলিশ আর সি আর পি-র যে ত্রাস গোটা শহরতলিকে গ্রাস করে তার অর্ধেক ত্রাস ও শক্তি প্রদর্শনেই দাঙ্গাটাই কিন্তু রুখে ফেলা যেত। সে বিশ্বাস দাঙ্গাবাজদেরও। অপুরও তাই মনে হয়েছে। তাহলে সরকার প্রশাসন কী চায়? ধন্দে পড়ে যায় অপু।

হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাবাজরা হুলিয়ার কোপে পড়ে গ্রেফতার হয়। লকআপে ইন্টারোগেটেড হওয়ার মুহূর্তগুলোতে হঠাৎ করেই রাজনৈতিক দাঙ্গাবাজেরা যেন আবিষ্কার করে আর ঠান্ডা মাথায় খুব সহজেই ধরে নিতে পারে ‘মানুষ’ কখন পুলিশ হয়। দাঙ্গার সময় আক্রমণকারী হিসেবে অসহায়, নিরস্ত্রদের জন্য তারা মাত্র কয়েকটি ঘণ্টা আগেও যে এহেন ‘পুলিশ’ হয়ে উঠেছিল সেটা জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে যায়। লকআপে আতঙ্কে নিপীড়নে “মানুষ” হয়ে দাঙ্গাবাজেরা যেন অনুভব করে দাঙ্গার সময় শুধু তাদের উর্দি ছিল না—কিন্তু আগাগোড়া এইরকমই ছিল। যন্ত্রণায় নিপীড়নে প্রাণী হয়েছে আর পাশাপাশি প্রবল আক্রোশে পুলিশ হয়ে উঠেছে।

পুলিশ বিষয়ক আরও কিছু প্রবাদ তখন ছড়ায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে পুলিশের হিন্দু-মুসলমান জাত হয়। সেই সূত্র ধরেই বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক হাওয়া প্রবাহিত হতে থাকলে নাকি সময় সময় পুলিশকেও স্বধর্মীয় মানুষ হতে কোনও সৌভাগ্যবানরা দেখেছে। সবার ভাগ্যে এটা জোটে না। সে নাকি এক দারুণ ব্যাপার! স্বধর্মীদের কোনও কোনও পুলিশ ফাঁকতালে পালাবার সুযোগ করে দেয়। নিপীড়নের মাত্রা কম করে দেয় আর দেখার মতো ব্যাপার হল সেই মাপের আন্তরিকতায় ওরা পাশাপাশি বিধর্মী কয়েদিদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালায়। আর তার চেয়েও চমকদার ব্যাপার হল যে স্বধর্মীরা, স্বধর্মী পুলিশ ভাইয়ের কৃপায় নিরাপদ বাঁচা আর বিধর্মীর নিগ্রহের কথাটাও ততোধিক আন্তরিকতার সঙ্গে সাপোর্ট করে। অপু গ্রেফতার হয়েছিল। পুলিশের কায়দা দেখে অনেকের মতো হাউ-হাউ করে কেঁদে না ফেললেও নির্যাতনের গভীরতা ঠোঁট কামড়ে রক্ত বের করে টের পেয়েছিল। একটা ক্ষীণ গ্লানি আর অপরাধবোধ ওকে শীতল দমকা হাওয়ার মতো ছুঁয়ে যায়। নিজের মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো ভয় পেয়েছিল অপু। সে কারণেই না সে কয়েকবার ভেবেছিল থানার ওসি, এ এস আই কেউ যদি তেমন হয়? স্বধর্মী মানুষ? পুলিশ না হয়ে, বিধর্মী না হয়ে?

ঘ.

বিপদের মধ্যে ফেলে পালানো কি ঠিক হবে? এদিকে লকআপে তো পেনিস থেঁতলে পুঁজ রক্তের ধারা বইয়ে দিছে শোনা যায়। অপুকে কি বিল্লা ছেড়ে দেবে? পালানোটা তো এখন যুদ্ধকালীন রিট্রিট। এটা তো একটা ট্যাক্টিস। সবাই থেঁতলে গেলে চলবে কী করে? কাউকে তো বেঁচে থাকতে হবে। এ নিরন্তর যুদ্ধের কাণ্ডারি হবে কে? হবে কারা? তপন, অবিনাশ, বিমল, তনু সবাই তো…। পালানো দরকার। না-না। এত আত্মরক্ষার বৌদ্ধিক ব্যারিকেড তৈরি করছে অপু। কিন্তু ভয় যে আছেই।থেকেই যাচ্ছে একটা ধস নামা ভয়। অপু তো হিরো, দাঙ্গা বাহিনীর পুরোভাগে ছিল সে। ধর্মযুদ্ধে এমন বীরত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা! সব আছে, বহুজন, জনগণ, হিন্দু অগুণতি ভাইরা আছে, সব আছে কিন্তু যেন নাই নাই শূন্যতার ঝিঁঝি ডাক।

তুলির কাছ থেকে একান্ত নিভৃত অভিসারে বীরোচিত ভূমিকার জন্য মৌসুমি প্রশস্তি স্বাদটাই আলাদা। তেত্রিশ ইঞ্চি বুকটাও যেন তখন স্ফিতিতে বেয়াল্লিশ হয়ে যেতে উদ্যত হয়। তাছাড়া তুলির বাবা-মাও একটু বাড়তি সম্ভ্রম অন্তত দেখাবেন এমন একটা ভূমিকা নেবার জন্য। কারণ, আজকাল আর আদর্শবান, ধর্মপ্রাণ, সাহসী ছেলে দেখা যায় না—সবাই কেন্নোর মতো অনৈতিক এক জীবনে অভ্যস্ত। অপু যে তেমনটি নয় প্রমাণিত হয়ে গেল। অপু এখন শুধু এক পাতি গ্র্যাজুয়েট নয়। অপু এক দুর্দান্ত ধর্মসেনা।

কার্ফু ঘোষণার পর কলোনির একেবারে শেষ প্রান্তে দীনুদের বাড়ি শেল্টার নিতে হয়েছে দুদিন আগের সেই ক্রান্তীয় দিনটির পর থেকেই। তুলির সাথে দেখা হয়নি। অথচ গর্ব আর ভীতির যে সন্ধিস্থলে অপু এখন হাবুডুবু খাচ্ছে সেই দ্বন্দ্ব নিয়ে বিম্বিত হওয়ার টলটলে জল তো শুধুই তুলি! তুলি কী! কই তেমন দেহাতি পুকুর! বন্ধু কই! আদর্শই তো হওয়া উচিত সর্বোতকৃষ্ট প্রতিবিম্বস্থল। কিন্তু সে যে এক মহাসামুদ্রিক অতলান্তিক বিমূর্ত গাম্ভীর্য। নেমে পড়া মানে ডুবে যাওয়া আর ঢেউয়ে ঢেউয়ে অনির্দিষ্ট ভেসে যাওয়া, তীর কোথাও নাই, বর্ণ নীল, নোনা স্বাদ। অপু তুলিকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যায়।

দীনুর বাড়ির পেছনের বেড়া টপকে, ঘোষবাবুদের রান্নাঘরের ধার দিয়ে পাপড়িদের বাড়ির জমাদার পথ দিয়ে, হুইসেলের পাঁজরভেদী প্রতাপ শুনে, কলোনির এলোমেলো শর্টকাট পথ দিয়ে অবশেষে অপু তুলিদের পেছনের গেটে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে ঘাম মোছে। রুমাল ভিজে জল। তুলিদের পেছনের দরজা খোলাই ছিল। রান্নাঘরে টুংটুং আওয়াজ। আর খুব চেনা একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের কলি। তুলিই বোধহয় আপনমনে টেনে চলেছে। এক অনাস্বাদিত অপার আনন্দে অপুর বুকটা ভরে যায়। একান্ত মৌসুমি প্রশস্তি পাওয়ার মুহূর্তটি সমাগত। এত অনিশ্চয়তা, এত কষ্টের মধ্যেও এক অন্য পাওয়ার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তুলি! আমার প্রাণভোমরা তুলিমণি! অপু দরজা দিয়ে ঢোকে। রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে দেখে মাসিমা কাপপ্লেট ধুচ্ছে। ও কিছু বলার আগেই ওর পায়ের শব্দে ওকে দেখে স্থির হয়ে যান তিনি কেমন একটা ভীতিবিহ্বল চোখে চেয়ে থাকেন। অস্বস্তিতে পড়ে যায় অপু। মাসিমা অমন করছেন কেন!

—মাসিমা আপনার শরীর ভালো তো?
—শরীর খারাপ হবে কেন, তুমি কি পেছনের দিক দিয়ে এলে? কেউ দেখে নেয়নি তো?
নীচু স্বরে কাটা কাটা জবাব মাসিমার। অপুর মেজাজ বিগড়ে যায়।
—কেউ দেখেনি। আপনার মুখটা দেখে ভাবলাম শরীর ধরেছে, আসলে তো আপনার অন্য টেনশন। তুলি আছে তো…
মাসিমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে অপু ভেতরে ঢোকে। ধুনোর গন্ধ। তুলি বোধহয় ঠাকুর ঘরে। অপু সোজা বসার ঘরে ঢোকে। মেসো কাগজ পড়ছেন। পায়ের শব্দে চোখ তুলে অপুকে দেখে কিছুক্ষণ নিষ্পলক চেয়েই থাকেন। হাত থেকে কাগজটা তার নিজেরই আসন করা পায়ে পড়ে যায়। পড়ে যেতেই যেন সম্বিত ফিরে পান তিনি। তুমি কী করে এলে? তোমার সঙ্গে আমরাও রেহাই পাব না, কেন এলে বলো তো? অপু মনে মনে নিজেকে তুলোধুনো করে। সে এত দেরিতে বুঝলো অনেকের কাছে রায়টের সময়কার বীরোচিত ভূমিকার চাইতে পুলিশ, সি আর পি-র ভয় অনেক বেশি। নিজের বাড়ি থেকে পালিয়েও দীনুদের বাড়িতে গিয়েও কিন্তু সে স্বস্তিতে ছিল। হাঁপ ছেড়েছিল। মাসি-মেসোদের আচরণ সময়োচিতই তো বলতে হবে। মেজাজটা বিগড়েই চলেছে। অথচ তুলি যে অপুর নিজের মনেরই অন্য নাম।

তুলির বাবার প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তর থাকতে পারে না। অপু টের পায় মেজাজটা চড়েই যাচ্ছে ক্রমশ। আশ্চর্য, ব্যাপারটা ওর হাতের বা হিসেবের বাইরেই ঘটে চলেছে। কান গরম হয়ে উঠেছে। যুক্তি দিয়ে বুঝেও সে ঘামছে। তুলির বাবা আরও কীসব বিড়বিড় করছেন। সবই লজিক। তুলি কলেজে যখন যায় তখন বাজে ছেলেরা টন্ট করলে অপুর শরণাপন্ন হয়েছেন এই বাব-মারাই। কেরোসিন পাওয়া যাচ্ছে না—অপু। রেশনে ভালো বিতরণ ব্যবস্থা নেই, বাজার থেকে দামি চাল কিনতে হচ্ছে—অপু। ছোটো ছেলেটার এডমিশন—অপু। ভালো ফুলের চারাগাছ—অপু। ভ্রমণে যাবে, ট্রেনে বড়ো ভিআইপি সহ তুলে দেবে—তাও অপু। সবেতেই অপু—কীসে নেই! আর কী বাহবা, কী প্রশস্তি! তুমি বাবা আমাদের চোখের মণি।নিজের মানুষও এতটা করে না। অপুর তখন সে কী সুখ! পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে বা বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে তুলি তখন একটা অদ্ভুত ঠোঁট টেপা হাসি হাসে। বুকটা তখন অপুর পাহাড় হয়ে যায়। বাবা-মার প্রশস্তি শুনে তুলি অপুর জন্য গর্বিত হচ্ছে। আসলে তীব্র আতঙ্ক, প্রশস্তি-ভালোবাসা-স্নেহ সবকিছুকেই হারিয়ে দিয়েছে।
‘আমি কী গান গাব যে ভেবে না পাই’—গানের কলিটা ভাঁজতে ভাঁজতে তুলি বসার ঘরের পর্দা সরায়। হাতে ধুনোর বাসন। ধোঁয়া উঠছে তাতে নীল নীল। গান ভঙ্গ হয়ে যায়। তুলি বুঝতেই পারেনি অপু এসেছে। অপু বসেনি। বাবা বসতে বলেওনি। ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবছিল সব। তুলি ডানহাতে পর্দাটা ধরে আছে। বাঁ হাতে ধুনুচি। চোখে মুখে কাতর অসহায় ভয়ার্ত ভাব। সহসা পাংশু হয়ে যায় তুলি। ওর খোপাটা খসে পড়ে। তুলি ভেবে পায় না কী করবে! ওকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে বারবার—অপুদা ওদের বাড়িতে বিপদ ডেকে আনতে পারে। পুলিশ, সি আর পি ছেলেমেয়ে বাছবিচার করে না‌। অপুদা বাড়ির ছোটো ছেলে। তুলি বড়ো। খোকন সবে হায়ার সেকেন্ডারি ফার্স্ট ইয়ারে। অপু একেবারে ভেঙে পড়ে বুঝতে পারে তার সর্বশেষ নীড়টিও কালবোশেখির কবলে পড়েছে। নিভৃত অভিসারে মৌসুমি প্রশস্তির জন্য অবশিষ্ট প্রাণটুকু আতঙ্কের বুলডোজারে গুঁড়িয়ে গেছে। এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে এই তীব্র গ্লানি আর ব্যথাকে সঙ্গী করে চোরের মতো ঘুরপথে, জমাদার পথে একটা অব্যক্ত দমক দেওয়া কান্নাকে বুকে করে নিজের বাড়িতে চলে আসে অপু। একটুখানি শান্তি চাই তার। মা আছে তো। বেশি সময় অবশ্য থাকা যাবে না।

তখন রাত সাড়ে সাতটা। বাড়ির বসার ঘরে অপুর দাদার ছোটোবেলা থেকে সবচাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেবায়ন আর অপুর দিদি তাপসীর মধ্যে কথা হচ্ছে। অপুর বাড়ির সদস্যরা মিশ্র-সাম্প্রদায়িক চেতনায় আক্রান্ত। মানসিক ও রাজনৈতিক ভাবে বাবার পরেই অপু। অপুর মা শুধু এটাই বোঝেন যে পাকিস্তানেও মুসলমানদের অত্যাচার সহ্য করে ভিটে ছেড়েছেন। এখানেও ওদের যে রেটে বংশবৃদ্ধি, শেষমেশ বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য করবে, মেয়েছেলের ইজ্জত থাকবে না। তাই মাথা সোজা করে দাঁড়াবার আগেই ঝামেলা সাফ করে রাখা ভালো। তাপসী আর রূপক হিন্দুদের ক্ষোভের কারণ বোঝে কিন্তু নৃশংসতা বা বা মূর্খ ভণ্ড গোয়ার্তুমিকে ওরা ঘৃণা করে। দেবায়নকে অপুর মা ভারী স্নেহ করেন। দেবায়ন আর রূপক ছোটোবেলা থেকে বিকম অবধি সহপাঠী। চাকরিতে একই বছরে একজন ব্যাঙ্কে, অন্যজন হাইস্কুলে। তাপসী- দেবায়ন প্রামোপাখ্যান দশ বছরের ইতিহাস। অপুর বাবা আর অপুর সাথে দেবায়নের কথা মানেই সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক বিতর্ক ও তিক্ততা। অপুর বাবা দেবায়নকে মোটেই পছন্দ করেন না। তপসী-দেবায়ন সম্পর্কটিকেও ঘৃণা করেন। অপুর অবশ্য এ নিয়ে কোনও আপত্তি নেই। অপুর মা যত তাড়াতাড়ি এই সম্পর্কটা বাস্তবায়িত হয় ততই খুশি হন। রূপক জানে দেবায়নের মতো ছেলে হয় না। সে নিজে প্রেমের ব্যাপারে রক্ষণশীল হলেও দেবায়ন ভালো আর প্রিয়বন্ধু বলেই তাপসীর জন্য ভরসা করতে পারে। দেবায়নের সাথে ওর রোজ দেখা হওয়া চাই। ওরা দুজনে রাজনৈতিক তর্ক করতে পারে না। কারণ এতে ওরা দুজনেই আহত ব্যথিত হয়। দেবায়ন, মাসিমণি, রূপক আর তাপসীর জন্যই এই বাড়িতে আসে। অপুকে নিজের ছোট্ট ভাইটির মতো ভালোবাসে। অপু তা বোঝেও। কিন্তু যত বড়ো হয়েছে অপু, একটা অদৃশ্য দেয়াল মাঝখানে শুধুই বড়ো হয়েছে।

কথা হচ্ছিল অপুকে নিয়ে। এই দাঙ্গা হাঙ্গামা নিয়ে। হিন্দু-মুসলিমের পারস্পরিক ভেদাভেদ আর আক্রোশ নিয়ে। তাপসী আর দেবায়নের।

—দ্যাখো এসব রক্তপাত আমারও ভালো লাগে না। অপুটা দিনকে দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। কথাই কম বলে—কিন্তু তোমার কথার সুরে সবসময় হিন্দুদের দোষারোপ করার একটা টেন্ডেন্সি—এটাও খুব গোঁড়া মনে হয় আমার…। আজ ক্ষোভ চাপা দেয় না তাপসী। মনটা খুব খারাপ।
—হিন্দু ঘরে যখন জন্মেছি, তখন হিন্দু নিয়ে বেশি বলাটি বোধহয় আমার এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে, অধিকারের মধ্যেও পড়ে। অপুর মধ্যে যে দুঃসাহস ও আগুন এটা আমাদের কারও মধ্যে নেই। আমার দুঃখ হয়, অপুর মতো একটা ছেলে অর্থহীন অন্ধ ধংসলীলায় মত্ত তখন…!
—এই অন্ধ ধ্বংসলীলায় কই মুসলমানেরা নেই?
—খুব আছে, ষোলো আনা আছে, অত্যন্ত বীভৎস নোংরা ভাবেই আছে—যারা যেখানে সংখ্যালঘু, নিরাপত্তার যুক্তিতে তাদের মধ্যে কিছু কূপমন্ডুকতা থাকে। সংকীর্ণতা থাকে।
—আচ্ছা, তুমি কি সত্যিই মনে করো হিন্দুদের ক্ষোভের কোনো ভিত্তিই নেই?
—ভিত্তি? হ্যাঁ নানা কারণে ক্ষোভের নানা রকমের ভিত্তি হয়। আমি সব বলতে পারব না। যুক্তি দিলেই সবসময় কাউকে কনভিন্স করা যায় না। যুক্তিতে হেরে যাওয়া যেতে পারে কিংবা নিজের যুক্তি খুঁজে পাওয়া না যেতে পারে। ভিত্তি আছে বলেই ইম্পোজিশনটা সহজে চলতে পারে—এই ভিত্তিটা উপড়ে ফেলা যায় কীভাবে সে আমি জানি না, আমি কনফিউজড কিন্তু হিন্দু ক্ষোভকে তোল্লা দিয়ে আর সংখ্যালঘুদের তোষণ করে সমাধান সম্ভব নয়, সেটা নিশ্চিত জানি…।

দেবায়নের শেষের কথাগুলো বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে অপুর কানে আসে। অপু ভেতরের ঘরে না গিয়ে তাই সটান বসার ঘরেই ঢুকে পড়ে। ভেতরের তরল কান্না গরম লাভায় রূপান্তরিত।

—কী ব্যাপার দেবুদা, দূ্র্বল জায়গা বুঝে খুব লেকচার ঝেড়ে চলেছেন দেখছি–

দেবায়ন, তাপসী দুজনই অপুকে দেখে অবাক। ফ্যালফ্যাল করে দুজনে অপুর দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বাড়িতে অপুর জন্যই থমথমে অবস্থা। অপুর মা তাঁর স্বামীর ওপর কামান দেগে চলেছেন, কচি ছেলেগুলোর মাথা খেয়ে বুড়োগুলো সব দিব্যি আছেন। আমার অপুর কিছু হলে তোমাদের অফিসে গিয়ে চ্যাঁচাব আমি বলে দিচ্ছি। সারাদিন বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছেন আর বলেছেন, যাও না ছেলেকে খুঁজে বের করো। থানায় টাকা পয়সা যা হোক দিয়ে ব্যবস্থা করো। অপুর বাবা নিশ্চল, নির্বাক সারাদিন। রান্নাঘরে তাপসী। অপুর চিন্তাটা ভোলার চেষ্টায় তাপসী দেবায়নের সঙ্গে কথা বাড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। হঠাৎ মূর্তিমান অপু এসে হাজির‌।

—ভাই! তুই? বাড়িতে! …ইস্ কী হবে এখন? তাপসী ভেঙে পড়ে।
—কোনও বিপদ হবে না, আমি ঠিক চলে যাব… একটু আস্তে কথা বল মা শুনবে। তাপসীর মাথায় হাত দিয়ে বলে অপু।
—কিন্তু অপু কলোনির সর্বত্র পুলিশ, সি আর পি…
—তা হোক না দেবুদা, আপনার কী? আমাদের দাঙ্গাবাজদের নিয়ে এত ভাবনাচিন্তা কীসের? আপনার আদর্শ অনুযায়ী তো ধরিয়ে দেওয়াই উচিত আমাকে…পারছেন না কেন? এই বাড়ির ছেলে বলে? না না, আদর্শের সাথে বেইমানি ঠিক নয়—যান যান, পুলিশে আমার শেল্টারের খবরটা দিন গিয়ে, যান। সত্যি, আপনাদের মতো দুর্বল চিত্তের লোকেরা কোনও কাজের নয়…

দেবায়নের ভাসা ভাসা চোখ দুটো ব্যথাদীর্ণ হাসিতে ভরে ওঠে। কিছুই বলে না সে। তাপসীর বুক ব্যথা বেড়ে যায়। —দেবায়নদা, দাঙ্গাবাজদের থামাতে মাঠে নামলে আর ওয়ারেন্ট বেরুলে তোমার জন্যে এই প্রেমিকটিও থাকত না। জোর বেঁচে গেছ। দাঙ্গা করে কী কী পেলাম জানি না, তবে তুলিকে হারালাম এটা এত বেশি স্পষ্ট যে শালা তোমায় দেখে হিংসে হচ্ছে।

—কী হল দেবুদা, চুপ করে আছেন যে…!?
—তাড়াতাড়ি দীনুদের বাড়ি দিয়ে আসি তোমাকে…। চলো অপু।
—দরকার নেই, আপনার সঙ্গে যাওয়ার কোনও দরকার নেই, আমি একাই পারব। আপনাকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে গেলেও আমার সম্মানহানি ঘটবে। আপনারা বিভীষণ। অকর্মণ্য। কোনও ক্ষমতাই নেই। শুধু আড্ডা আর চায়ের দোকানে বসে বসে প্রগতিশীল চর্চা করা ছাড়া। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাটক, গান, কবিতা, গল্প, পত্রিকা এসব করে করে এতদিন কী হয়েছে? কী করতে পেরেছেন আপনাদের মতো প্রগতিশীলেরা? কী হয়েছে মিছিল, মিটিং আর প্রগতিপন্থী সংগঠন করে করে? একটাও দাঙ্গা রুখতে পেরেছেন? একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দুকেও, একটা মুসলিমকেও অসাম্প্রদায়িক লিবারেল করে তুলতে পেরেছেন? পারেননি? কেন পারেননি? কারণ, মানুষের ভেতরের জিনিসকে উপর থেকে ফেলা বস্তু আর শিল্প দিয়ে বদলে ফেলা যায় না। ভীতি আর শৌখিনতার ঠাট-টা বজায় রেখে দাঙ্গা রোখা যায় না—এসব গাদা গুচ্ছের বই না পড়েও বঝা যায়। মুসলমানের জন্য আইন আলাদা, ওরা হাজারটা বিয়ে করবে, ১০০ কোটিকে হুহু করে দশ বছরে দেড়শো কোটিতে পৌঁছে দেবে—স্যাটেনিক ভার্সেস না পড়েই বন্ধ হয়ে যাবে। চূড়ান্ত ফ্যানাটিক মোল্লাদের অগ্নিদৃষ্টির কোপে পড়ে শাহাবাণু মামলার সুপ্রিম কোর্টের রায়টাই নস্যাৎ হয়ে যাবে আর বলা হবে রামমন্দিরের বেলায় আদালত মানো এটা কি মগের মুলুক? ভোটের রাজিনীতি আমরা বুঝি না, সব ওই বামেরা বোঝে? রামমন্দির বিজেপি-র ট্রাম্পকার্ড! আর আপামর হিন্দুরা জলভাত, দুধভাত। কিছু বোঝে না। ভোটের জন্য মুসবছরের সেই দিনটি অপুকে আগুন নিয়ে খেলার একটা অভিজ্ঞতা দিয়েছে। আদর্শগত ভাবে জেদ বাড়িয়েছে। ভয় জাগিয়েছে। নৃশংসতম ঘটনা ঘটিয়েও মুসলিমরাও কোথাও কংগ্রেস, কোথাও কমিউনিস্ট, এসব আমরা বুঝি না। কিছু করার মুরোদ নেই। শুধু বুঝি, বুঝি আর সব বুঝির কেরামতি। সত্যি কত বুদ্ধি আপনাদের!

অপু সেদিন যাওয়ার পথে গ্রেফতার হয়। গেল ন’রাতে একা দীনুদের বাড়ি যে অনুতাপ আর আশেপাশের আহ্লাদিপনায় ভুগতে হয় না সেটা সে বুঝতে পেরেছে। আদর্শের দিকে কনফিডেন্স যেমন বেড়েছে সাহসের দিকে কমেছে কিছুটা। কারণ, পুলিশ। কিন্তু বিধর্মীদের ঘড়বাড়ি-রক্ত-শরীর-চামড়া-মাংস সমস্ত কিছুই ধ্বংস হয়ে যাক, পুড়ে-কেটে সাফ হয়ে যাক, কিংবা ধর্ষিতা হোক কোনও বিধর্মী কিংবা কোপে কোপে ফালা ফালা হয়ে যাক কোনও বিধর্মী চাচা অথবা বিধর্মী পিতার শরীর।

আহা, দাঙ্গা হোক, দাঙ্গা হোক অহর্নিশ। গেল বছরের সেই দিনটি প্রতিনিয়ত, প্রতিদিন, প্রতি ক্ষণে ক্ষণে নেমে আসুক আপন ধর্ম-ভুবন জুড়ে। অপু পুলিশ লকআপে নির্যাতনের ক্ষতস্থানে বাঁ হাতের আঙুল বোলাতে বোলাতে আদর্শের শতমুখী এইসব কথা ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়ে।

ঙ.

বাজার কলোনি বস্তি কোয়ার্টার সর্বত্র আগুনে আগুন। গৈরিক সন্ন্যাসীর মতো সে আগুনের রং।

উল্লাসের সমবেত চীৎকার আর আর্ত চিৎকার। কিন্তু কোনও কিছুর আর ধর্ম বোঝা যাচ্ছে না। কতকগুলো কষাই চেহারার প্রেতছায়া মূর্তি বেরিয়ে আসছে আগুনের দীর্ঘ আভরণ ভেদ করে। এ কোন্ ধর্ম? অপু দিশেহারা। কে কার? মা কোথায়? বাবা? কসাইরা অপুর কাছে এসে ওকে ঘিরে ফেলে। কারা ওকে কুচি কুচি করে কাটছে? ওর দিদিকে কোথায় যেন টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে। আর ওই যে, ওই কি তুলি? বিবস্ত্রা পড়ে আছে রাস্তার ধারে? কলোনির শূকরগুলোর ছুঁচলো নাক আরও সক্রিয় করে শিথিল গা-ছাড়া শিকার ঘিরে নৃত্য দিয়ে চলেছে।

দাঙ্গান্মোত্ত ভিড় ঠেলে সরিয়ে কাছের কোনও মানুষের কাছে যেতে পারছিল না অপু। পিছলে পিছলে পিছিয়ে যাচ্ছিল। বারবারই কাছের জনেরা দূরে আরও দূরে সরে সরে যাচ্ছিল। হঠাৎ দাঙ্গামিত্র নিলয় হাঁপাতে হাঁপাতে অপুর কাছে এসে দাঁড়ায়। হাতে কাটারি, মুখে রক্ত, দৃষ্টি বীভৎস। বাবা কড়া ভাষায় বিধর্মীর কথা বললে মুখটা যেমন দেখায়, আয়নায় অপু নিজেকে সেবক হিসেবে যেভাবে দেখতে পায়, ঠিক সেরকম বীভৎস নিলয় মুসলিম পাড়ার কোতল ও উচ্ছেদ অভিযানের অনুপুংখ বিবরণ দিতে থাকে সোল্লাসে। তারপর হাঁপিয়ে বলে, আহা! আহারে…

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *