শ্রাবণের জীবন গোঙায় – রঘু জাগুলিয়া

শেয়ার করুন

(উৎসর্গ—শিল্পী ভাস্কর প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)

বিরামহীন ঘর

উঠোনের চারপাশে ঝরাপাতা, এলোমেলো, উন্মত্ত। বাতাস এইসব বিচিত্র রঙে একটার পর একটা ছবি বানায়, মুহূর্তে কেড়ে নেয় নিকট অস্তিত্ব। বিকেলের এই মনোভূমি তন্দ্রাচ্ছন্ন পাগলের আশ্রয়। আরও কিছুকাল এখানে সে পড়ে থাকতে চায়। ওদিকে ভেজা স্যাঁতসেঁতে পাঁচিল দিয়ে পিঁপড়ের মিছিল। খাবার নিয়ে বাড়ি ফিরছে। ভাঙা জানলার পাশে তেঁতুলগাছে মাটির কলসিতে মা-শালিক, একটা ঘাস মুখে একবার ঢোকে তারপর উড়ে গিয়ে চারপাশ শিস দিয়ে বিহ্বল করে তোলে। এই বাড়ি বহুদিনের ধ্বংসস্তূপ, ভূস্বামীহীন, এখানে রাস্তাঘাট উঁচু-উঁচু ঘাসে বিপর্যস্ত। শৈশবে, এরকম নির্জনতায় আমরা বৃষ্টিতে পোকামাকড়ের ভেসে যাওয়া দেখতাম। দুপুরের মেঘ তাড়া খাওয়া মোষের মতন ফোঁশ-ফোঁশ করে ছুটে আসত মাঠের কিনার থেকে। কাদায়-কাদায় এমনি অচল, পথও বেশি দূর যেতে দিত না। তারপর ছোটো গাছগুলো নাড়িয়ে দেওয়া। তাজা ফুলের প্রকাশে প্রজাপতি যেভাবে নেচে নেচে চলে সেরকম পাগলামো।

শিল্পী: ভাস্কর প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

সে শুধু আছে, এই একাগ্রতা নিয়ে
পাগলের হাত-পা ছোঁড়ার আনন্দে দেখেছি রৌদ্র ওঠে
ম্রিয়মাণ তাঁর হাসি, গাছের আড়ালে চলেছে

স্মরণ করি তাই তাঁর ছায়া
যাকে সে সত্য ভেবে দৌড়ে গেল ওইদিকে

তেমনি কোনো দিনে, হঠাৎ বরিষনে
মেঘে মেঘে ক্রমবিপর্যয়ে
আসন্ন সন্ধ্যার উপকূলে দেখি সে ছায়া
ঘুমিয়েছে প্রায়, অলোকরঞ্জনে।

নিয়তিনিশীথ

সন্ধের দূরবর্তী পাড়া আলেয়ার মতন। কী বিপুল অন্ধকার আর ভেজা নিশ্বাসের চলাফেরা। ছেঁড়া ত্রিপলের তাপ্পি-মারা চাল, মাঝে মাঝে আমনের চাটি খড় গোঁজা। ভাঙা ডিসের মধ্যে সারারাত টপ-টপ জলের শব্দ। সকালে ঘরের ভিতর যখন আলোর প্রবেশ—থালা, বাটি, গামলা অবিশ্রান্ত। জলমগ্ন সংসার। বারান্দায় গাছের পাতা আর বৃষ্টিছাঁটের অভিনবত্ব যেন নতুন ঘর বাঁধার ঈঙ্গিত। ঘুঁটের মাচা, রান্নার কাঠ, জলভর্তি আঁচ, ছাদহীন মুরগিঘর, আর গৃহস্বামীর দিকে মুখ করে থাকা অবলা জন্তুরা, দু’মুঠো খাবারের অপেক্ষায়। অনেকক্ষণ খেতে না পেলে গরু-বাছুর যেরকম মুখ করে চেয়ে থাকে, সেরকম পথ-ঘাট-পুকুর-নিরালা। এই সব প্রাণ নিরীহ, প্রাণবন্ত, জল-কাদায় সম্পৃক্ত। ভোরের আলো ফুটতেই ছোট্ট ছোট্ট কাজ কত দ্রুত সেরে ফেলবে গৃহিণীরা, সেসব চট করে ধরা যায় না। গোবর জলের ছিটে, ছই দেওয়া, ছাইগাদায় বাসি বাসন-কাসন, গর্তে গোবর ছোঁড়া। তারপর সারাদিন চাষের কাজ, মাটির কাজ, জঙ্গল করা, মাছ ধরা বিবিধ কাজ শুধু কাজ নয় এখন আর আমার কাছে। যেকোনো প্রিয় বই পড়ার পর যেরকম ইন্দ্রিয়াতীত আনন্দ হয় এইসব তেমনি। তবুও মানুষ ভুলে যায়, ওদের দু’টো হাত, আঙুলের আলোকদ্যুতি।

সে ভুলে গেছে ফুল, ফুলের সমস্ত অতীত—

জোছনায় যেরকম ঘুমন্ত পাতারা হেসে ফ্যালে
সেরকম অভিব্যক্তি নিয়ে ধুলোয় গড়াগড়ি খায়—

বহুদূর থেকে ভেসে আসা কোনো সংকেত
যেন ঘূর্ণায়মান লাট্টুকে ধরেছে খুব চেপে
ওই তার জ্ঞান, স্থিতি নেই কোথাও

বাতাসের মতো হাহাকার করে, মাথা ঠোকে পাথরে

শিল্পী: ভাস্কর প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

সুন্দরীবৃক্ষ এবং সহস্রফণা

নীল অন্ধকারে ডুবে যাওয়া মাঠ। মাঠে শস্যের চঞ্চলতা। দূরে শ্যামলিমা। এইসবের মাঝে তিনি কোন্ বৃক্ষতলে বাঁশি ফেলে চলে গেছেন নীলাচলে। ভাবি এখন, কে বাজায় আজ তাঁর বাঁশি, কোন্ দিকে তাঁর প্রিয়তমার কুঁড়েঘর। এইসব বিস্মৃতপ্রায়। মানবমনের গোপনগুহায় আজ হয়তো তিনি নেই, নেই তাঁর ছায়া। তবুও দেখি দশমিক প্রথা, অঙ্কের জটিল আঁধার, ক্রমে আকাশে নক্ষত্রের সীমাহীন বোঝাপড়া। তমিস্রাবনে আলো। আমাদের গণিত বিদ্যালয়। আছে বর্ণশ্রেষ্ঠ, বিড়ালের মতন থাবা উঁচিয়ে, কালো। যার কাছে দৃশ্য লুকোচুরি খেলে এবং জলের ভিতর মাছেদের ক্রীড়া। ওই ছবি, যেন আমাদের আত্মপ্রতিকৃতি।

জলের মতন জগতের সকলেই ছবি আঁকে
শুধু ছবি আঁকে না কবিতাও লেখে
অগোছালো পড়ে আছে সব। জগৎ কি মৃত?
মনে হয় পাগলও জানে জগৎ জীবন্ত—
তাই তো সে স্বপ্নে হাসে,

অনন্তে রঙিন ডানা
ভ্রমণ পেয়েছে আজ

বাতাস যেরকম তুলোর মতো স্পর্শ করে
যেভাবে আলোর প্রস্তুতি—প্রান্তরের আড়ালে…

দূর বলতে যেরকম

যতদূর মন ছোটে ততদূর নদী—
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে জেনে রাত্রি জাগল
তখন কি কিছু ভাবি আমি
ঘুমের ভিতর উঠে বসে থাকি
দেখি নিমফুল ঝরছে, সীমান্তের বায়ুসৈন্যরা
ফসলের খেত হয়ে চুপিচুপি চলেছে—

তরীখানি দূরে, তার পাশে পড়ে আছে চাঁদ
গাছের আড়ালে তিনি
রাতের পোশাক খুলে
পরে ফেলছেন দিনের পোশাক

শিল্পী: ভাস্কর প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

অন্ধকার এইখান জুড়ে

অন্ধকার সেই প্রাচীন সমুদ্র
যার ঢেউ ভবিষ্যত অন্ধকারে ধাক্কা খাচ্ছে

মাটির কলসি ভেঙে ছড়িয়ে আছে। লাল-কমলা বিষাদ। বিকেলবেলা আকাশ নিজঝুম নয় অতটা, যতখানি সদ্য উড়তে শেখা পাখিটা স্নায়ুশীতল, নীরব। ঝরা পালকে পালকে রক্তের ছিটে। বোধশূন্য বর্ষাকাল।

এখানে আকাশ অনেক নীচু। বাজার থেকে লোক আসছে দেখি, পা দেবে যাচ্ছে এক-একজনের কাদায়।
—কী কিনলা গো বড়দাদা?
—পুঁইশাক আর দু’শো (গ্রাম) ভুসিচিংড়ি—বাজার এখন আগুন, কোনো কিছু হাত দেবার জো নি।
—আর ও পাড়ার খবরটা শুনিছ?
—হ রে। মাইনষের শরীর বলে তো কিছস্যু নি এখন। টাকা পাখি—পাখি টাকা।
—তা তোমার পার্টি যে বলছে ঘর দেবে!
—পার্টি কি আর এখন মাইনষের কথা ভাবে! এক বাঁদর বলছিল না, মানুষের মাথা গুনি ভোট হয়। অধ্যাপকের মাথা যা আর বিজ্ঞানীর মাথা তা… সংখ্যা… সব সংখ্যা

বড়দাদা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। উঠোনের নিমগাছ থেকে কোনো এক বিচিত্র পাখি শিস দিচ্ছে। তার শিস শুনে মনে হচ্ছে হয়তো সব দোষ ঐ আকাশের। তাই সে আকাশকে শোনায়। ব্যাঙের চিৎকারে রাত্রির পর্দা ছিঁড়ে যায় এক একসময়। ঝিঁঝির মুখরতা এই অন্ধকারকে আরও দুর্গম করে তোলে। প্রদীপের আলো নিভে গেছে সেই কোন্ সন্ধেবেলায়। আর এই অন্ধকারে আমাদের কালো মেনিটা, খাট থেকে লাফ মেরে জানলার পাশে দাঁড়ায়।

অন্তর্জলি

এখন বাতাস একটু শান্ত। তার আর আগের মতন গলাবাজি নেই। সে এখন প্রেমিকার মতন চুম্বন করে, জড়িয়ে ধরে বুকের খোল। সারাদিন পেঁজা তুলোর মতন মেঘ উড়ছে। আকাশে শরৎচন্দ্র। পুজোর ঢাক শোনা যাচ্ছে দূরের মণ্ডপে। ঘাটে নৌকা বাঁধা, মা ফিরবেন। অথচ সামনের কোটালে এই বনভূমি সংলগ্ন অঞ্চলে বাঘের মতন হিংস্র থাবা নিয়ে শাসন করবে ঢেউ। ছিটেবেড়ার বাড়িঘর, ধানের গোলা, এই উঠোন, উঠোনের পাশে তেঁতুলগাছ, আম, পেয়ারা, অর্জুন— হয়তো আগেভাগে বুঝতে পেরে এরা ঝুঁকে পড়ছে সব মাটির দিকে। ফ্লাডসেন্টারে বেশ কিছু মাস আধপেটা খেয়ে পড়ে থাকবে অগণিত ছোটোবড়ো ধড়। প্ল্যাস্টিক বোতলের মতন জলে কিছুদিন ভেসে থাকবে গৃহপালিত জীবদেহগুলি। চাষজমিনের উপর খয়েরি-কালো আস্তরণ—সূর্যের শৌখিনতা। প্রকৃত প্রস্তাবে আগামী কয়েক বছর শুধু আকাশ দেখবে সবাই। আর তার রঙচঙে বিষণ্ণতা।

ঋণ—শাশ্বতী সরকার, অতনু চট্টোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *