রায় বাঘিনী ওরফে পুরুষ ইন্ডিয়ার রিরংসা – এণাক্ষী রায়

শেয়ার করুন

প্রতিনিয়ত মেয়েদের নিয়ে মৌখিক নিপীড়ন দেখতে দেখতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে এই লেখা।

সম্প্রতি বম্বে হাইকোর্টের পরপর তিনটি রায় ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়ে গেল। ১)কোনও নাবালিকা মেয়ের হাত ধরে টানা এবং একই সঙ্গে সেই সময় প্রকাশ্যে প্যান্টের চেন খুলে যৌনাঙ্গ প্রদর্শন, যৌন নির্যাতন হিসাবে গণ্য হবে না। তার চার দিনের মাথায় রায় দিলেন, ২) ১২ বছরের কোনও শিশুর জামাকাপড় খুলে বা জামাকাপড়ের ভিতরে হাত গলিয়ে বুক বা গোপনাঙ্গ স্পর্শ না করা হলে, তা শিশুদের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ (পকসো) আইনের আওতায় পড়বে না। ৩) নাবালিকার সম্মতিতে যৌন সংসর্গ করলে সেটা ধর্ষণ নয়।

উল্লেখ্য প্রথম দুটি মামলার বিচারপতি ছিলেন পুষ্পা গনেড়িওয়ালা। বিচারপতি মহিলা না হয়ে পুরুষ হলেও এই রায়ে কোনো সান্ত্বনার কথা ছিল না যদিও। আমাদের দেশে খুব কম মেয়ে আছে, যাদের রাস্তাঘাটে বা ভিড়ের মধ্যে এই রকম অবাঞ্ছিত স্পর্শের সম্মুখীন হতে হয়নি। কেউ কেউ এই রায়ে অসন্তুষ্ট হয়ে বলছেন, রায়-টায় যাই হোক, এই রকম কিছু হলে মেয়েরাই ধরে কেলাও। হ্যাঁ মেয়েরা কেলাবে, কেলায়ও। অন্তত চিৎকার করে ভয় পাইয়েও দিতে পারে। কিন্তু প্রশ্নটা যখন শিশু নিগ্রহের, তখন নিগৃহীত শিশুর সেই বোধ এবং সাহস থাকা সম্ভব নয়। তার মানে, অনেকগুলো নিগ্রহের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তাকে নিজেকেই জবাব দেওয়ার মতো সাহস সঞ্চয় করতে বলা হচ্ছে। আর এই মধ্যবর্তী সময়টুকুর মধ্যে কিছু পুরুষের লালসার শিকার হওয়াটা তার ভবিতব্য বলে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না।

ক্রমশ জীবনের সবক্ষেত্রে মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া ঠেকাতে পরিকল্পিত ভাবে নানান নিগ্রহ করা হচ্ছে মেয়েদের। এ ব্যাপারে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ডিজিটাল মিডিয়াগুলো। বড় বড় হাউসের ডিজিটাল মিডিয়াগুলোর চরিত্রগত পরিবর্তন হয়েছে সোসাল নেটওয়ার্কে এসে। এদের কাজ, সারাদিন ওৎ পেতে বসে বিভিন্ন সেলিব্রিটির ইন্সট্রাগ্রাম ফলো করা। কে কার সঙ্গে ছবি দিল, সেগুলো বিনা অনুমতিতে মিডিয়ায় ভাইরাল করে মুখরোচক হেডলাইন দিয়ে ছেপে দেওয়া। বাংলা বানানের গুষ্টির তুষ্টি করার কথা না হয় বাদই দিলাম। গত দু-মাসে শ্রাবন্তীর চতুর্থ বিয়ে কার সঙ্গে, দেখুন হেডলাইনে অন্তত সাত আট জনের সঙ্গে অভিনেত্রী শ্রাবন্তী চ্যাটার্জির ছবি দিয়ে, ভেতরে নিরীহ খবর পরিবেশন করা হয়েছে। সৃজিত -মিথিলার বিয়ে ভাঙছে, হেডলাইন দিয়ে খবর। এবং সব ক্ষেত্রেই মহিলার সঙ্গে অন্য পুরুষের ছবি। কাজের সূত্রে যেন কোনো মহিলার কোনো পুরুষের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করার অধিকার নেই। তারা সেলিব্রেটি, তাদের বিয়ে বা ডিভোর্সের ঘটনা হয়তো খবর হতে পারে। কিন্তু রোজই কোনো না কোনো পুরুষের ছবির সঙ্গে জুড়ে দিয়ে এইরকম হেডলাইন আর তাতে নোংরা কমেন্টের বন্যা টেনে আনাটা সুস্থতার লক্ষণ নয়। এগুলো কী সাইবার ক্রাইমের আওতায় পড়ে না! আমি শ্রাবন্তী চ্যাটার্জিকে চিনি না। সৃজিত বা মিথিলাকেও চেনার কোনো সম্ভাবনা নেই। এখানে প্রশ্ন শ্রাবন্তীর বিয়ে নিয়েও নয়। তার জীবন, সে ঠিক করবে সেই জীবনে কী করবে। কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ভদ্রমহিলাকে খিস্তি করার জন্য এইসব গণমাধ্যমের দরজা খুলে দেওয়াটা পীড়াদায়ক। একেকটা কমেন্ট সেকশনে শ্রাবন্তী বা মিথিলাকে নয়, সমস্ত নারী জাতিকে নিয়ে যে সব কমেন্ট আসে, তাতে পরিষ্কার যে এরা কোনো নারীকেই স্বাধীনচেতা দেখতে চায় না। এবং আশ্চর্যভাবে সেই সব কমেন্টে নারীদের পক্ষ নিয়ে সাওয়াল করা লোকজনও অপর পক্ষকে গালাগাল দেবার সময় ব্যবহার করে তাদের মা-বোন-স্ত্রীদের জড়িয়ে নোংরা ভাষা। অদ্ভুতভাবে তাদের গালাগালগুলো এসে ঠেকে, সেই চুদির ভাই বা খানকির ছেলেতে। ধর্ষকের মা-বোন-স্ত্রীকে পালটা ধর্ষণের হুমকিও বাদ যায় না। সব দিকেই লক্ষ্য সেই মেয়েরাই।

সম্প্রতি কোনো এক টিভি চ্যানেলে নিজেদের মতামত দিতে গিয়ে আক্রান্ত হলেন দুই অভিনেত্রী। শেষ পর্যন্ত তাদেরও সেই চরিত্র নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য, রেপের হুমকি থেকে খুনের হুমকি পর্যন্ত শুনতে হয়েছে। কোনো মেয়ে, পুরুষের থেকে উঁচু গলায় কথা বললেই তার বিপক্ষে একটাই অস্ত্র – ধর্ষণ । আদালতের এই রায় সেই ধর্ষণের দিকে এককদম এগিয়ে দিল সুযোগসন্ধানী পুরুষদের। স্কিন টাচ না করে কী করে কী করে ধর্ষণ করা যায় তার রিসার্চ এতক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে নিশ্চয় কোনো গোপন সেলে।

অযাচিত উপদেশ এবং অনুযোগগুলো মেয়েদের ওপরই এসে পড়ে। প্রায়ই শুনতে হয় তাদের পোশাক-আশাকের জন্যই এই বিপদ ঘনিয়ে আসে এবং এই অভিযোগে সামিল হন কিছু মহিলারাও। সবকিছুর পরেও মহিলাদের নির্যাতনের পেছনে মহিলাদের প্রতিই অভিযোগ থেকে যায়, তাদের পোশাক নিয়ে। দশ মাসের বাচ্চা থেকে আশি বছরের বৃদ্ধারও যেখানে ধর্ষিত হওয়ার থেকে ছাড় নেই, সেখানেও পোশাক বিতর্ক এসে যায় অবধারিত। কেন শুধু মেয়েদেরই পোশাক-আশাক নিয়ে এত কথা! কারণ মেয়েদের স্তন। যে-স্তন পান করে এই পুরুষেরা পুরুষত্ব দেখানোর মতো ক্ষমতা অর্জন করেছে। আগে হিন্দি সিনেমায় একটা ডায়লগ প্রায়ই শোনা যেত – ‘হ্যায় কই মাই কা লাল! অগর মা কা দুধ পিয়া তো সামনে আ’। মায়ের দুধ পান করলে আর বীরত্বের অভাব থাকা কথা না। সেই মায়ের দুধ পান করে কিছু পুরুষ এতটাই পুরুষ হয়ে ওঠে যে মেয়েদের স্তন দেখলেই (সে পোশাকের ওপর দিয়ে হলেও) টেপার জন্য হাত-নিশপিশ করে। তাদের সেই অপরাধকে সিলমোহর দিয়ে আদালত এটাই প্রমাণ করল, এই অসম্মানজনক ব্যবহার সহ্য করাটা শারীরিক নিগ্রহর মধ্যেও পড়ে না। যৌন নিগ্রহর সংজ্ঞা ইচ্ছাকৃত ভাবে বদলে দিয়ে কাদের সুবিধা করছে আদালত?

পদে পদে অভিযোগ আজকালকার মেয়েরা খুব নির্লজ্জ। এরা পিঠ খোলা ব্লাউজ পরে। ওড়না ছাড়া কামিজ পরে। জিন্স টিশার্ট পরে। ঘোমটা তো কবেই উঠে গেছে। তাহলে কী আমরা প্রাচীন ঐতিহ্যে আবার ফিরে যাব! এই কিছুদিন আগেই পূর্ব, দক্ষিণ আর পশ্চিম ভারতে সেলাই করা পোশকের চল ছিল না। সায়া ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি কোনো রকমে পেঁচিয়ে রাখা হতো শরীরে। উচ্চবর্ণের ছেলেরা ধুতি পরত। কখনো ওপরে আরেক খণ্ড কাপড়ের উত্তরীয়। সাধারণ পুরুষরা পরত হাঁটুর ওপর পর্যন্ত ধুতি। বাঙলায় মুসলমানরা আসার আগে অব্দি সেলাই করা কাপড় পরার চল ছিল না। সেই যুগে ফিরে যাওয়াটাই তো উচিত! তাই না? তাহলে এসব সেলাই করা জামাকাপড় না-পরে, এক বস্ত্রে দরজা বন্ধ করে বসে থাকা উচিত। সূর্যের আলোও যেন স্পর্শ করতে না পারে। সেই যুগের দিকে আরেকবার মেয়েদের নিয়ে যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সমাজ। আদালত থেকে বিশেষ মৌলবাদী রাজনৈতিক দল, কেউই বাদ নেই এ তালিকায়।
রামরাজ্যে সূপর্ণখাদের প্রেমের প্রস্তাবের জবাবে নাক কাটা যায়। উর্মিলাদের কেটে যায় রাজপ্রাসাদে স্বামীহীন বন্দি জীবন। আর সীতার অগ্নিপরীক্ষা, পাতাল প্রবেশ ইত্যাদি ইত্যাদি। সে দিকে আরেকবার ঘুরে যাচ্ছে দেশ। তাই স্বাধীনচেতা, স্বাবলম্বী মহিলাদের দিকে ধেয়ে আসছে ধর্ষণের হুমকি থেকে বুলেটের গুলি পর্যন্ত। গৌরী লঙ্কেশদের খুনে রাঙা হচ্ছে ডিজিটাল ইণ্ডিয়ার মাটি। তারপরেও রায়, রায় আর রায়। মেয়েদের, মহিলাদের, নারীদের, মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার রায়। আর কত রক্ত কত খুন চাও, হে পুরুষ ইন্ডিয়া?

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *