মেয়েলি প্রতিবাদ এবং কিছু অতিকথন – সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী
মেয়েলি প্রতিবাদ বলতেই আজও আমাদের কাছে যে ছবিটা ভেসে আসে তা হল কিছু ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি অথবা ওরকম কিছু একটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু এসব প্রতিবাদের মধ্যে যে দৃশ্যপটগুলো চোখে পড়ে তা হল সবটাই ব্যক্তি নারীত্ব, তার শরীর অথবা সেইরকম কিছুর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ। হ্যাঁ, এর মধ্যে অবশ্য কিছু গার্হস্থ্য হিংসা অথবা দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থাকে। সেসবের বাইরে যে প্রতিবাদটুকু চোখে পড়ে তা হল কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের কম বেতনে খাটিয়ে নেওয়া, হেনস্থা বা ওইরকম কিছু। কিন্তু খুব সাদা চোখে দেখে এই প্রতিবাদের মধ্যে যেটা সাধারণত চোখে পড়ে তা হল মেয়েদের একটা নিজস্ব জগৎ আছে এবং সেই জগতের মধ্যে কিছু বদল ঘটলেই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ওঠে মেয়েরা এবং যেহেতু মেয়েরা একটু বেশিই কিচিরমিচির করে তাই প্রতিবাদ ব্যাপারটা তাদেরকে মানায়ও বেশ ভালো। ফলত আমরা খুব একটি দৃষ্টিনন্দনযোগ্য প্রতিবাদে শামিল হই। কিন্তু এর প্রেক্ষিত বিচার করলে আমরা দেখি সাধারণত এই প্রতিটি প্রতিবাদের পিছনে রয়েছে একটি সুচারু পুরুষের আবেদন। খুব নবীন রক্ষণবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও আমরা যদি মাথা গুনতে বসে যাই তবে নেতৃত্বের জায়গায় মেয়েদের খুঁজতে দূরবীন না হলেও অণুবীক্ষণ যন্ত্র তো লাগেই লাগে। যে কয়েকজন নেত্রীস্থানীয় ব্যক্তিত্বের প্রকাশ দেখতে পাই খোঁজ নিলে জানতে পারা যায় সে কোনো না কোনো রাজনৈতিক পুরুষের সঙ্গে আত্মীয়তায় সম্পৃক্ত। এই সম্পৃক্ততাতে দোষের কিছু নেই, কিন্তু যদি তা ছায়াতল হয়ে যায় তবেই তাতে বড়ো বেশি সমস্যা হয়ে যায়। আর মেয়েদের প্রতিবাদ নিয়ে লিখতে গেলে এ কথাগুলো বাধ্য হয়েই লিখতে হয়। আসলে মানুষে-মানুষে বিভাজনের রাজনীতি শুরু হওয়ার প্রথম সোপানটাই ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক অথবা লিঙ্গকেন্দ্রিক রাজনীতি। এখানে দুজন মানুষের মধ্যে বিভাজন করার কায়দাটা খুব সহজ আর সস্তা। ছোটোবেলায় মনে পড়ে ডাংগুলি খেলার খুব একটা চল ছিল। যারা ডাংগুলি খেলেছেন তারা জানেন, যারা খেলেননি তাদের সহজ করে দেওয়ার জন্য আরেকটু বলি। ক্রিকেট খেলার ব্যাট বলের মতো ব্যাপারখানা। একপক্ষ ব্যাট করবে আর অন্যপক্ষ ছুঁড়ে দেওয়া বল ধরার চেষ্টা করবে। ডাংগুলি খেলার গুলি ধরায় বেশ সুনাম ছিল এই প্রতিবেদকের। এমনই একদিন এক প্রবল পক্ষ ড্যাং ধরেছে, অপরপক্ষে গুলি ধরতে মরিয়া হাত, ড্যাংওয়ালারা বলল, কিচ্ছু না ‘বাঁটে মার’, লজ্জায় গুলি ধরার সাধ জন্মের মতো বেরিয়ে যাবে। সেদিন বুঝলাম গরুর মতো মেয়েদেরও ‘বাঁট’ হয়, আর তাতে আঘাত করে খেলার মাঠ থেকে বেরও করে দেওয়া যায়। বয়স তখন মোটে সাত। সামান্য একটা ইজের পরেই বাড়ির পাশের খোলা জায়গাটায় খেলতে বেরিয়ে যেতাম নিঝুম দুপুরে। ভাগ্গিস এটা বিগত শতাব্দীর ঘটনা তাই ওটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল, নাহলে তো শৈশবে ধর্ষণের অভিজ্ঞতা লিখতে হত। অর্থাৎ একটি মেয়েকে অপমান করার সবচাইতে বড়ো জায়গা হল তার নারীত্বের অপমান এটা মোটামুটি ভাবে সমাজস্বীকৃত। তার কাজ নয়, তার মেধা, মনন, রুচি, ভাবনা কিচ্ছু নয়, একমাত্র তার নারীত্ব — সেখানেই তাকে অপমান করা যায় সবচাইতে বেশি।প্রতিবাদের ক্ষেত্রে তাই একই দৃশ্য দেখতে পাই। মূল্যবৃদ্ধি বা কোনো সামাজিক প্রতিবাদের ক্ষেত্রে আমরা সেই মানবতার মুখ ঠিক কবে দেখতে পাবো যেদিন কিনা প্রতিবাদের মধ্যে কোনো লিঙ্গ বিভাজনের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না।