গ্রন্থ সমালোচনা: ক্ষত্রবধূ – মহাশ্বেতা চ্যাটার্জি

শেয়ার করুন

বাণী বসুর লেখা ‘ক্ষত্রবধূ’ উপন্যাসটি ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় দে’জ পাবলিশিং থেকে। ক্ষত্রিয় কুলের তিন বধূকে নিয়েই এই উপন্যাসের কাহিনিবৃত্ত রচিত হয়েছে। প্রথমেই গান্ধারীর কথা উল্লেখ করেছেন ঔপন্যাসিক। এক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের উত্থাপনের মধ্য দিয়ে উপন্যাসটি শুরু হয়েছে। যেখানে গোটা মহাভারত পাঠ করলে একবারও কুরুকুলের জ্যেষ্ঠ বধূর নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি।

“পণ্যের কি সেভাবে কোনও নাম থাকে? থাকে হয়তো জাতিনাম; গান্ধারী, কুন্তি, মাদ্রী। কিন্তু তার বেশি কী এমন ব্যক্তি যে শুধু তাকেই বোঝায় এমন একটা ‘নাম’ তাকে দিতে হবে! সে তো ক্ষত্রবধূ, তার কি আলাদা ব্যক্তিত্ব আছে? আছে আলাদা কোনও বক্তব্য?”

ভীষ্ম, জন্মান্ধ পাত্র অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্রের জন্য পাত্রী খুঁজতে গিয়েছিলেন গান্ধার রাজ্যে; যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে।গান্ধার রাজকন্যা গান্ধারী, পিতার মুখে কুরুকুলের কথা শুনে বিবাহে সম্মতি জানান।

“—ভেবেছি। আর তো কোনও উপায় নেই পিতা। ক্ষত্রিয়কন্যা তার স্বদেশকে বাঁচাতে, স্বার্থত্যাগ ও সুখত্যাগ করতে ভয় পায় না পিতা।”

রূপে, গুণে অনন্যা পাহাড়ী মেয়ে গান্ধারী। শ্বশুর গৃহে প্রবেশ করলেন তার অতুলনীয় চোখ দুটি কাপড়ে বেঁধে। পণ করেছিলেন অন্ধ স্বামীকে কোনোদিন অতিক্রম করবেন না। প্রতিজ্ঞা থেকে কোনোদিন সরে আসবেন না, স্পষ্ট জানিয়ে দেন গান্ধারী।

বীরপুরুষ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে নিজেকে কিছুতেই সমর্পিত করতে পারছিলেন না গান্ধারী। ভুলতে পারছিলেন না এই সম্পর্কের মূলে রয়েছে ভয়। পরে সংযুক্ত হয় ঘৃণা।একজোড়া সুনয়ন স্বামীর জন্য উৎসর্গ করেছেন – একথা তার মনে অহমিকা সৃষ্টি করে। সকলে তাকে ‘মহাসতী’ সম্মানে ভূষিত করেন। ‘মহাসতী’ হয়ে থাকবার লোভ সংবরণ করতে পারেননি গান্ধারী। অন্ধ বরের তুলনায় তিনি বেশ উঁচুতে অবস্থান করছেন, একথা মনে বাসা গেঁড়ে বসেছিল তার।

তবে ধীরে ধীরে গান্ধারী বুঝতে পারেন ধৃতরাষ্ট্র একজন ভীত, লোভী, অসহায় মানুষ। ধৃতরাষ্ট্রকে, গান্ধারী স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণই করতে পারলেন না।

রাজার একমাত্র কন্যা গান্ধারী আদরে মানুষ হয়েছেন। ছোটো থেকেই তিনি ভেবেছেন, তার স্বপ্নের পুরুষ বিশাল, মহানুভব, বিরাট হৃদয়ের অধিকারী হবেন। কিন্তু যাকে স্বামী হিসেবে পেলেন তিনি ছিলেন বাইরে এবং ভিতরে সম্পূর্ণ অন্ধ।

গান্ধারী, এক স্বেচ্ছা-আরোপিত ছদ্মজীবন যাপন করেছেন। নিজের সন্তান হিসেবে যাদের গ্রহণ করেছেন, তাদের জীবনে তার কোনো প্রভাবই নেই। স্বামীর সঙ্গে বিবাহের প্রথম দিন থেকেই ছিল পাহাড় প্রমাণ দূরত্ব। সংসারের দিকে কোনোদিন তাকিয়ে দেখেননি তিনি।
বাণী বসু মহাভারতের গান্ধারী চরিত্রটিকে বাস্তবের মাটিতে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁকে মহানুভব করে গড়ে তোলার কোনো বাসনাই ঔপন্যাসিকের ছিল না। সুনয়নী, পরমাসুন্দরী গান্ধারী অল্প বয়সে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে চূড়ান্ত খেদ থেকেই প্রতিবাদী হয়েছিলেন। নিজের দৃশ্যজগতের মধ্যেই তিনি এক শক্ত প্রাচীর তুলে দিয়েছিলেন। সেই জেদের বশে সৃষ্ট আড়াল তার জীবনটাকে নিষ্প্রাণ করে দিয়েছিল।

ভোজরাজার কন্যা কুন্তী। বাল্যকাল থেকে পৃথার উপর অন্দর পরিচালনার ভার ন্যস্ত হয়েছিল। তাই বয়সের তুলনায় তিনি খুব বেশি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন।পৃথার স্বয়ংবর সভায় বিধি অনুযায়ী নিমন্ত্রিত হন রাজা পাণ্ডু। কন্যা স্বেচ্ছায় মালা পরিয়ে দেন রাজাকে। ধুমধাম করে বিবাহসভা অনুষ্ঠিত হয়। রাজা পাণ্ডুকে কুন্তী ভালোবেসে ফেলেন। রাজার পাণ্ডুরতাকে জন্মগত ত্রুটি ভেবে নিজেকে প্রাণপণে বুঝিয়েছিলেন পৃথা।

একদিন হঠাৎ কুন্তী জানতে পারলেন ভীষ্ম, পাণ্ডুর আরেকটি বিবাহ দেবেন। তিনি মর্মাহত হন। কেন তার কিছুদিন মাত্র বিবাহের পরই সপত্নী আনা হচ্ছে – এই প্রশ্ন তিনি সত্যবতীর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেন। হয়তো এখানেই ক্ষত্রবধূদের অসহায়ত্বগুলি খুব বেশি চোখে পড়ে। কখনও তাদের স্বামীদের অর্থাৎ রাজাদের রাজনৈতিক বন্ধুত্ব বাড়াতে বিবাহ করতেই হয়, এই যুক্তি শুনিয়েই শান্ত রাখা হয়।

“এখানে খালি বীরত্ব, প্রতিজ্ঞা, সতীত্ব, উর্বরতা – এই সব গুণের দাম। মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধি, কাণ্ডজ্ঞান, হৃদয়বৃত্তি ও আবেগের কোনও দাম নেই।”

রাজা পাণ্ডুকে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে কুন্তী বলেছেন তিনি তাকে পত্নী হিসেবে গ্রহণ করেননি। এই কথা কোনও ভদ্ররমণী নিজের মুখে বলতে পারেন? কেন তার দ্বিতীয় বিবাহের প্রয়োজন পড়ছে? এই সমস্ত প্রশ্নবাণের সামনে যেন বোবা হয়ে যান পাণ্ডুরাজ। কুরু প্রাসাদেই রাজা পাণ্ডুর সঙ্গে বিবাহ হয়ে যায় মদ্র রাজকুমারীর। মাদ্রী ও রাজা পাণ্ডুর জন্য পৃথক মহলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়।

কিছুদিনের মধ্যেই পাণ্ডু রাজা দুই স্ত্রীকে নিয়ে বনবাসে চলে যান। সহবাসে অক্ষম স্বামী; পাণ্ডুর সঙ্গে একরকম বৈধব্য জীবন যাপন করছিলেন দুইজন স্ত্রী-ই।

“ভীষ্ম, বেদব্যাস এমন কি তাঁর ভাসুর ধৃতরাষ্ট্রও জানতেন, পাণ্ডুর বিবাহ অনুচিত। তাঁর স্ত্রী গ্রহণ করা নিষ্ফল হবে। এসব জেনেও তাঁরা পাণ্ডুকে কুন্তীর স্বয়ংবর সভায় যেতে নিষেধ করেননি। উপরন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য শল্য-ভগ্নী মাদ্রীরও ক্ষতি করেছিলেন।”

বিদুরকে, রাজা পাণ্ডু আহ্বান করেন কুন্তীর সঙ্গে মিলিত হয়ে সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য। তাদের মিলনের ফলেই জন্ম হয় যুধিষ্ঠিরের। কিন্তু বারংবার বিদুরকে সন্তানাকাঙ্খায় ডেকে নিয়ে আসার কথায় সাই দেননি কুন্তী।

কুন্তীর জীবন, সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ধাবমান। দূর্বাসা ঋষিকে সম্পূর্ণ সেবাপ্রদান করতে গিয়ে কর্ণকে গর্ভে ধারণ করা, তাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখে ভাসিয়ে দেওয়া। বিবাহের পরই জানতে পারলেন স্বামী পৌরুষহীন। মাদ্রীর সঙ্গে স্বামীকে ভাগ করে নেওয়া। স্বামী পাণ্ডু ও মাদ্রীর দেহাবশেষ ও পুত্রদের নিয়ে হস্তিনাপুরে, বনবাস কাটিয়ে ফিরে এসে অনিশ্চয়তার দিকে পা বাড়ানোর সাহস দেখিয়েছেন কুন্তী। জীবনের কোনো অবস্থাতেই হার মেনে পিছ-পা হননি তিনি।

গান্ধারী, কুন্তী, মাদ্রী — এই তিন ক্ষত্রবধূ-ই নিজেদের অবস্থানে অবিচল থেকে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধেই মোকাবিলা করেছেন। বাণী বসুর কলম যেন ভিন্ন আয়নায় প্রতিফলিত তিন ক্ষত্রবধূর চরিত্রকে নব দৃষ্টিতে দেখার ভাবনা প্রদান করেছে। এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে মহাকাব্যে বর্ণিত নারীর চরিত্রদের অন্তরের বয়ানগুলির বিনির্মাণকেই দেখিয়েছেন ঔপন্যাসিক বাণী বসু এই ‘ক্ষত্রবধূ’ উপন্যাসে। উপন্যাস পাঠকদের কাছে এই উপন্যাস এক ভিন্ন ধরনের পাঠ হয়ে উঠতেই পারে।

ক্ষত্রবধূ- বাণী বসু
দে’জ পাবলিশিং
কলকাতা।
প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি, ২০১৭।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *