কৃষ্ণচন্দ্র দে, সঙ্গীত মহীরূহ – সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় (শেষ অংশ)

শেয়ার করুন

কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে গান শিখে বা তাঁর পরিচালনায় কাজ করে যেসব শিল্পী বিভিন্নভাবে উপকৃত হ’য়েছেন তাঁদের মধ্যে শচীন দেববর্মণ, আঙুরবালা, ইন্দুবালা, রাধারাণী, তারকবালা, কমল দাশগুপ্ত প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই সমস্ত গুণী মানুষদের কাছে তিনি ছিলেন শিক্ষক স্বরূপ। আকাশবানীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এই মানুষটির সংস্পর্শে এসে উপকৃত হননি এমন কোনও শিল্পীকেই খুঁজে পাওয়া ভার। এই সব ছাত্রছাত্রীরা যেদিন পরিণত হয়েছেন, সেদিন তাঁদের পরিচালনায় বহু ক্ষেত্রে কৃষ্ণচন্দ্র অবলীলায় কাজ করেছেন, কোথাও কোনও ব্যক্তিত্বের সংঘাত বাধেনি। একটা ঘটনা বলি। ১৯৫৩ বা ৫৪ সালে দেবকী বসুর পরিচালনায় ‘শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ ছবির কাজ চলছে,সংগীত পরিচালক কমল দাশগুপ্ত। কৃষ্ণচন্দ্রের অভিনয় ছিল এক চণ্ডালের রোলে, সে গান গায়। ছবির গান টেক হচ্ছে আর কৃষ্ণচন্দ্র বার বার করে কমলবাবুকে বলছেন যে কমল ঠিক মতো হচ্ছে তো? দেখ, ঠিক না হলে বলো, আমি আবার গাইব। এই ব্যবহারে কমলবাবু নিজেই খুব সঙ্কুচিত হচ্ছিলেন, কিন্তু কোনও অহমিকা বা অভিমান ব্যাতিরেকেই নিজের কাজকে নিখুঁত করে তুলতে ক্লান্তি আসেনি কৃষ্ণচন্দ্রের।

এই প্রসঙ্গে আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ শ্রীরামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শোনা একটি ঘটনা বলি। বেশ আয়েশ করে বলেছিলেন রামকৃষ্ণঠাকুর ও তাঁর গুরুদেব তোতাপুরির গল্পের মুখ দিয়ে। রোজ লোটা মাজতেন তোতাপুরি, বলতেন পেতলের ঘটি, মাজলে তবেই ঝকঝক করে, না মাজলে আর সে জেল্লা থাকেনা, ঠিক যেন মানুষের মন। সিধে থাকতে চায়না, তাই অবিরত বিচার বোধ রাখতে হয়। এই শুনে রামকৃষ্ণদেব শুধিয়ে ছিলেন আর যদি ঘটিটা পেতলের না হয়ে সোনার হয়? তোতাপুরির মুখে কথা সরেনি। এই গল্পের শেষে বলেছিলেন “কেষ্টদা-র গলা, গায়কী এসবের পেছনে যত না অধ্যবসায় ছিল, আমার বার বার মনে হয়েছে ঈশ্বরদত্ত আশীর্বাদ আরও বেশী ছিল, ওই সোনার ঘটির মতো”। কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে ওনার প্রথম পরিচয় হয় কমলা গার্লস্ স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে। তখান রামকুমার বাবু তবলিয়া হিসেবে খুবই পরিচিত। কৃষ্ণচন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতে হাজির আগে ভাগে। কিন্তু হল কি তবলা বাজাবার কথা যার ছিল সে এত নার্ভাস হয়ে পরে যে গানের আমেজ বারবার কেটে যেতে থাকে। বিরক্ত হয়ে তবলিয়াকে তিনি বলেন যে ভাই আমি তাল বলে দিচ্ছি, তুমি সেই মতোই বাজাও, শুধু ঠেকা হলেই চলবে… কিন্তু তাতেও বিপদ কাটে না। তখন উদ্যোক্তাদের একজনের অনুরোধে রামকুমারবাবু বসেন বাজাতে এবং আসর খুব জমে ওঠে। ‘সখা, এ মিনতি মনে রেখ’ গানটি ভীষণ জমে সেদিন। সে গান শেষ হলে কৃষ্ণচন্দ্র বলেন, “কে বাজালে হে? বেশ বাজালে তো?” এইখান থেকেই দুজনের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ওনার বাড়িতে গানবাজনায় নিয়মিত হাজিরা শুরু হয় রামকুমারবাবুর। কৃষ্ণচন্দ্রের অভ্রান্ত অনুমান শক্তির একটি গল্পও আমি রামদাদুর কাছে শুনেছিলাম। সেটিও বলি।

বিডন স্ট্রীটের মিত্তির বাড়ির জলসায় গাইছেন কৃষ্ণচন্দ্র দে, হারমোনিয়ামে আছেন জ্ঞান গোঁসাই। বেশ কয়েকটি গান হবার পর কী যেন খেয়াল হওয়ায় তিনি গোঁসাইজীকে বললেন আমি তো গাইলুম। এবার তুমি গাও, আর হারমোনিয়ামটা আমি ধরি, কি বল? গান ধরলেন জ্ঞান গোঁসাই, ‘আমায় ব’লো না ভুলিতে ব’লো না’। যেমন কথা তেমন সুর, যেমন গান তেমনি হারমোনিয়াম বাদন, এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়। শেষ লাইনে এসে খুব খেলিয়ে গোঁসাইজী শূন্যে হাতটা ঘুরিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের দিকে তাক করে শেষ করলেন ‘ওগো সখী’ বলে। সাথে সাথে তিনি বললেন, জ্ঞান সবই তো ঠিক ছিল, কিন্তু ওগো সখী বলে লাইনটা আমার দিকে হাত দেখিয়ে শেষ করলে, ওটা কি হল? আমি কি তোমার সখী? – এই ছিল ওনার অনুভবের শক্তি। বাতাসের মধ্যে হাত খেলিয়ে কোনদিকে ঘুরে গেল সে হাত, তাও তিনি অনুভব করে বলে দিয়েছিলেন। সামনে কে কেমন করে বসে গাইছে, কণ্ঠের আওয়াজে বুঝতে পারতেন। বলতেন, ওহে অমন হাঁটুমুড়ে বসে গান গেও না, সোজা হয়ে বসো।

আরও একটি ঘটনার কথা বলি, এটিও রামদাদুর কাছে শোনা। কৃষ্ণচন্দ্র দের প্রবল আত্মবিশ্বাসের প্রসঙ্গে এটি বলেছিলেন। একবার বিডন স্ট্রীটের মিনোর্ভা থিয়েটারে গানের জলসা বসেছে। সব নামী দামী গায়ক গায়িকারা এসেছেন গাইতে। সঙ্গতকারী হিসেবে ছিলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। আঙুরবালা খুব উঁচু স্কেল ডি সার্পে গেয়ে হাততালির ঝড় নিয়ে উঠে গেলেন। এসে বসলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। গান ধরলেন তারও ওপরের স্কেল এফ সার্পে! এই স্কেলে গলা ধরে রাখাই অসম্ভব। কিন্তু তিনি শুধু গাইলেন তা নয়, দাপটের সাথে হেসে খেলে যে সব কাজ করে দেখালেন তাতে মনেই হল না যে এমন একটা স্কেলে তিনি গাইছেন। চারিদিকে ধন্যি ধন্যি পড়ে গেল, শ্রোতারা ভাবে ভেসে গেলেন। গান শেষে রামকুমারবাবু ওনাকে শুধোলেন যে এমন অসম্ভব একটা স্কেলে আপনি কেন গাইলেন? জবাবে উনি বলেছিলেন যে দেখ, আঙুরবালা হাততালি নিয়ে বেরিয়েছে ওই ডি সার্পে গেয়ে, এখন আমি যদি তারও ওপরের স্কেলে না ধরি আমার গানটা মার খাবে। এখন ওই চড়ায় গাইতে গিয়ে যদি আমার লাংস্ টা বেরিয়েও আসত মুখ দিয়ে আমি গাইতাম, তবেই তো লোকে বলবে হ্যাঁ, এই হচ্ছে কেষ্ট দে!

এমন আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা অথচ বিনয়ী ও প্রচার বিমুখ মানুষটির কথা লিখে শেষ করা যায় না। প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের শত অনুরোধেও তিনি নিজের জীবনী লিখতে সম্মত হননি। একবার একটি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের কর্তা এসে তাঁর মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে আর্থিক অসঙ্গতি প্রকাশ করে সাহায্য চাইলে শিশিরবাবুর পরিচালনায় তিনি চন্দ্রগুপ্ত নাটক মঞ্চস্থ করান এবং মূল গায়ক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। কৃষ্ণচন্দ্রের নামে তখন সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায় এবং অনুষ্ঠান শেষে দায়গ্রস্ত বাবার হাতে তিনি দশ হাজার টাকা তুলে দেন; শুধু তাই নয়, বিয়ের দিন নিজে উপস্থিত থেকে শুভ কাজ সম্পন্ন করান। কতখানি মহৎ হৃদয় থাকলে মানুষ এমনভাবে পাশে দাঁড়াতে পারে তার উদাহরণ কৃষ্ণচন্দ্র দে নিজে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে এই মানুষটি কিন্তু কোনও দিন সরকার কর্তৃক কোনও সন্মানেই ভূষিত হননি! আকাশবানীতে কেবলমাত্র তাঁর নামের আগে ‘সঙ্গীতাচার্য’ এই বিশেষণটি ব্যবহার করা হ’তো, ব্যাস, এইটুকুই!

শেষ জীবনে একের পর এক মানসিক আঘাতে তিনি নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছিলেন। গ্রামোফোন কোম্পানীর ওই আঘাত তো ছিলই, সঙ্গে ছিল ব্যক্তিগত জীবনের হতাশা বিষাদ। রেডিও ও নাট্যমঞ্চে কাজের সূত্রে স্নেহের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সে কালের গায়িকা নায়িকা শ্রীমতী তারকবালা বা মিস্ লাইটের সঙ্গে, যা ক্রমে ভালোবাসায় পরিণত হয়। সেই ঘনিষ্ঠতার সূত্রেই জন্ম নেয় তাঁর পুত্র সন্তান। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সেই ছেলেটির অকালমৃত্যু তাঁর মনকে গুঁড়িয়ে দেয় চিরতরে! অন্তরের দুঃখ নানাভাবে নানান গানের কথায় তিনি প্রকাশ করতেন, তার মধ্যে অন্যতম একটি হ’লো –

‘আমার নিয়েছ নয়ন তারা // দিলে তার দুটি কিনারায়, বাদল বরিষা ধারা।’

অথবা ‘ওমা তারা দুখহরা আঁখির দৃষ্টি হরণ ক’রে // করলি আঁধার বসুন্ধরা॥’

শেষ অনুভুতিটি তাঁর ছিল এই রকম, “শ্যামা মায়ের চরণ তলে সব করেছি সমর্পণ, আমার হাসি, আমার ব্যথা, আমার সাধের দুই নয়ন”।

১৯৬২ সালের ২৮শে নভেম্বর কলকাতার মদন ঘোষ লেনের বাড়িতেই তিনি পরলোকগমন করেন।

সদালাপী, মিষ্টভাষী, দীর্ঘদেহী, সুপুরুষ মেধাবী ও প্রখর স্মৃতিসম্পন্ন এই মানুষটির জনপ্রিয়তার অসাধারণ একটি কাহিনি দিয়ে এই লেখা শেষ করব। একবার তিনি গাইতে যাচ্ছিলেন পাঞ্জাবে। ট্রেন যখন পাটনা স্টেশনে আসে তখন লোকে লোকারণ্য। পাটনায় সে ট্রেন আর ছাড়তে দেওয়া হয় না, সকলের একটাই দাবী গান শোনাতে হবে! উপায়ান্তর না দেখে কৃষ্ণচন্দ্র গান ধরেন সকলের দাবী মেনে। গান শেষ হলে পর সেই যুগে জনপ্রতি দশ টাকা চাঁদা তুলে তাঁর সম্মান দক্ষিণা হিসাবে দিয়ে তবে ট্রেন ছাড়তে দেন পাটনাবাসী। সাধারণ মানুষের মনের কোন মণীকোঠায় তাঁর স্থান ছিল তা বোঝা যায় এই একটি ঘটনা থেকেই। শ্রদ্ধা, সন্মান, ভালোবাসা এবং অনুরাগের আসনে বাঙালি মননে আজও তাঁর আসন অটুট।

সূত্র: সঙ্গীত বিশারদ কৃষ্ণচন্দ্র দে – কৃষ্ণকিশোর দাস

সুরের সূর্য কৃষ্ণচন্দ্র  – মান্না দে

আমার দেখা বাংলা গানের জগৎ – রাজ্যেশ্বর মিত্র, ২৮ বর্ষ, ১৫ সংখ্যা, ১৯৮৮

অতিতের সুরে –  গীতা সেন

জলসাঘর – রামকুমার চট্টোপাধ্যায়

বিমানে বিমানে আলোকের গানে – সিতাংশুশেখর ঘোষ

সমাপ্ত

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *