সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ : পঞ্চাশ বছর পর আবার অরণ্যে – মানবেন্দ্রনাথ সাহা

শেয়ার করুন



 “রায়ের অন্য ছবির মতো অরণ্যের দিনরাত্রিও সমবেদনার ছবি। ব্যাপারটা বেশ কঠিন — কিন্তু জরুরি।  এটা আবার অন্য,  ক্ষমতা ও শ্রেণির ব্যাপারও। পশ্চিমি পোশাক পরা এ ছবির তরুণরা সকলেই উচ্চবর্ণের, চারজনের তিনজনই চাকরি করে তবু খুশি নয়, কেউ কেউ হয়ত মার্কসিস্টও — গরিবকে ঠকায়। এমন কি কলকাতার মেয়েটিও নিজের সম্বন্ধে খুব সতর্ক — পাঁচ টাকার নোটের ওপর ফোন নম্বর লেখে, কেননা আর কাগজ নেই।  শেষ পর্যন্ত কেয়ারটেকারের অসুস্থ স্ত্রী ও তার ছেলেমেয়েরাই ছবিতে বলি হয়। ওদের জীর্ণ  ঘরের জানালা দিয়ে বাইরের পৃথিবী তখন চোখের ওপর ভেসে উঠে। “[ চিত্রকল্প দিনরাত্রি / জন রাসেল / ঘরোয়া / ১৯৭২]
     সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি  উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে শারদীয় ‘জলসা’ পত্রিকায়।  বিনোদন পত্রিকা হিসাবে  ‘জলসা’ জনপ্রিয় ছিল। সিনেমার আলোচনা,  খবর ও ছবি এই পত্রিকায় বেশি থাকত। সুনীলের স্বীকারোক্তি, অর্থের তাগিদে তিনি এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন। নিছক পয়সার জন্য লিখলেও উপন্যাস হিসাবে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ জীবন দর্শনের দিক থেকে সম্ভাবনাময় ছিল।  নানা চিত্রকল্প ও জীবন জিজ্ঞাসা নিয়ে এর চলচ্চিত্রে রূপান্তরের সম্ভাবনাও ছিল অনেকখানি। সেই  সব মাথায় রেখে আর আখ্যানের  জটিল বিন্যাসের তাগিদ না রেখে সত্যজিৎ  উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করেন।  ১৯৭০ সালে কলকাতার প্রিয়া, বসুশ্রী প্রভৃতি হলে ছবিটি মুক্তি পায়। 
মুক্তির সঙ্গে  সঙ্গে ছবিটি বিতর্কের পরিসর তৈরি করে। প্রথম আপত্তি আসে লেখকের তরফ থেকেই। সত্যজিৎ রায়ও বয়ান দিয়েছেন এই ছবির কাহিনিকারের চলচ্চিত্রটি ভালো লাগেনি ।  মূল আপত্তি উপন্যাসের প্রধান চার চরিত্র শহুরে লড়াকু যুবকের বদলে চাকরিতে প্রতিষ্ঠিত সোফিস্টিকেটেড হয়ে গেছে।  সত্যজিৎ সুনীলের উপন্যাসের চার চরিত্রের মেজাজটাই ধরতে পারেননি।সত্যজিতের রূপান্তর বা সংযোজনে সুনীল নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন। আনন্দলোক পত্রিকার সত্যজিৎ সংখ্যায় (মে,১৯৯২)  স্মৃতিচারণায় সুনীল বলেছেন : “নির্লিপ্তভাবে  এ ছবি দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।  আমি নিজে এবং আমার কয়েকজন বন্ধু এই উপন্যাসের আসল চরিত্র।”

সুনীল  চলচ্চিত্রের পরিবর্তন  মেনেছেন, কিন্তু যে জীবন চর্যার সঙ্গে,  যে মেজাজে তিনি ও তাঁর  কৃত্তিবাসের বন্ধুরা জীবন যাপন বা না-যাপন করেছেন তার সঙ্গে সিনেমার চরিত্রগুলির একেবারে মেলে না। 
নগরের যাপিত জীবনে ক্লান্ত চারজন যুবক।  নানা টানাপোড়েনে বিধ্বস্তও কেউ বা।  তারা ঠিক করে  কলকাতা থেকে বিহারের পালামৌ অঞ্চলের নিবিড় অরণ্যে কয়েকদিন  পালিয়ে বাঁচবে।  নিছক অস্তিত্বের সংকটে নয়,  তাদের জীবনবোধ  আরো গভীরে শিকড় সন্ধানে রত থাকতে চায়। তথাকথিত সভ্য নাগরিক সভ্যতার প্রতি তাদের তীব্র ক্ষোভ।  সংবাদপত্র  পুড়িয়ে নাগরিক জীবনের সঙ্গে সংযোগকে ছিন্ন করতে চায়।  আবার অরণ্যে এসে নাগরিক সুখভোগের চাহিদা ও অতৃপ্তিও কম নয়। ওদের উদ্দাম কামনা,  আদিবাসীদের সরল জীবনে মিশে যাবার উদগ্র বাসনা আছে।  আইডেন্টিটি ভুলে মাতাল হয়ে উল্লাসে স্নান বা নৃত্য সবই একটা কেন্দ্রবিন্দুতে পৌছেছে।  
চিত্রনাট্য থেকে একটা বিশেষ অংশ তুলে নিলে ছবির মেজাজটা লেখায় পাওয়া যেতে পারে : 
হাজারিবাগ   অরণ্য প্রান্তরে একটি সরকারি বাংলোয় বিশেষ ধরনের কুয়ো থেকে জল তুলে  খোলা আকাশের নীচে স্নান করছে শেখর। গুন গুন করে গান করছে আর গায়ে জল ঢালছে। শেখর : তোমার দেখা পাইনে তো মা৷     কাট্ বাংলোর বারান্দায় এলিয়ে মেজাজে বসে সিগারেট টানছে সঞ্জয় আর অসীম          কাট্বাংলোর ঘরে হরি ক্লান্ত হয়ে জামা-প্যান্ট পরেই ঘুমোচ্ছে কাট্ অসীম : শেখরটাকে সঙ্গে না আনলে ঠিক জমে না?  সঞ্জয়   : মনে আছে সেবার দীঘায় কী করেছিল? অসীম  :   কাল আমি যখন ফোন করলাম,  ও কি বলল,  জানিস তো?  ‘তুই এত লেটে খবর দিচ্ছিস,  লাস্ট মোমেন্টে ছুটি কেমন করে পাই? ‘ শেষকালে দেখলাম ওর চাকরিই নেই। … সঞ্জয় ও অসীম বাংলোর বারান্দায় বসে সিগারেট খাচ্ছে। অরণ্যে অচেনা নানা শব্দ শোনা যায়। অসীম  : সঞ্জীব চাটুজ্জের মতে এই শব্দটার মধ্যে একটা বিষণ্ণ – ভাব আছে। সঞ্জয় : সত্যি এইসব জায়গায় এলে আয়ু বেড়ে যায়। অসীম : হুঁ!  আয়ুটা আদৌ বাড়ানোর প্রয়োজন আছে কিনা সেটা ভাবা দরকার। সঞ্জয় :কেন,  তোর এখন অ্যাসেনডিকা!  যত বাঁচবি তত উঠবি!  অসীম   : হুঁ,  যত উঠব তত নামব। সঞ্জয় : (হাতে সিগারেট) আমাদের সেই    ত্রৈমাসিকটার কথা মনে পড়ে তোর?  অসীম : হ্যাঁ একটু আগেই ভাবছিলাম। সঞ্জয় : কী খাটাই খাটতাম বলত?  ভাবা যায় না!  দিনে ষোল ঘন্টা। … তবে একটা কথা বলতে হবে কখনও কোনো বাজে লেখা ঢোকাইনি। স্নান করে বারান্দা দিয়ে শেখর আসছে,  মুখে স্মিত হাসি। অসীম  : কীরে তোর স্নান হল?  শেখর : ফার্স্ট ক্লাস।  একটা ড্রামাটিক ব্যাপার করব দেখবি?  অসীম : তোর যা খুশি তাই কর। শেখর একটা ইংরেজি খবরের কাগজ পুড়িয়ে দেয়। শেখর :  সভ্যতার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ। পোড়া কাগজের ক্লোজ-আপ  । কাগজটা পুড়ছে। আবহ সংগীতে মাদল বাজার শব্দ। ওরা চারজন জঙ্গল দেখতে বেরিয়ে পড়েছে।[চিত্রনাট্য  :অরণ্যের দিনরাত্রি ]    ছোটনাগপুরের জঙ্গলে কলকাতা থেকে উদ্দেশ্যহীনভাবে পালিয়ে যাওয়া  চারজন যুবকের কয়েকদিনের ছুটি উপভোগের কাহিনি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’।  কিন্তু নির্ভেজাল জঙ্গল উপভোগের   কাহিনিতে বদ্ধ না থেকে  আখ্যানের মধ্যে ঢুকে পড়েছে নাগরিক জটিলতা।  এই জটিলতা বহন তারা করেছে দৈনন্দিন নাগরিক জীবনে।  হরি, সঞ্জয়, শেখর,  অসীম।  এদের মধ্যে অসীম উচ্চপ্রতিষ্ঠিত।  একটা অতৃপ্তি সকলের নাগরিক অর্জন।  অরণ্যে এসে তাই বন্য হতে চেয়েছে তারা চারজনই। সভ্য সমাজের সঙ্গে সমস্ত  সংসর্গ ত্যাগ করতে চেয়েছে। কিন্তু নাগরিক সুবিধাভোগ বা দুর্নীতি এমনকি রিরংসাকেও তারা ভুলতে পারেনি।  বাংলোতে অন্যায়ভাবে থাকা, কেয়ারটেকারকে ঘুস দেওয়া কিম্বা মদ্যপান ও আদিবাসী নারীর সঙ্গে যৌনতা সর্বত্র সেই  নাগরিক চিহ্ন।হরি প্রত্যাখ্যাত শহুরে একটি মেয়ের দ্বারা।  সেই আঘাত রিরংসায় প্রকাশ পেয়েছে দুলির সঙ্গে বন্য যৌনতায়। ত্রিপাঠি পরিবারের সঙ্গে তাদের সখ্য ছবির   আখ্যানে এক অনাবিল আনন্দ ও জটিলতা বহন করে   এনেছে।   ছবির বাকি অংশের আখ্যান অনেকটা এরকম : 

অরণ্যের দিনরাত্রি ছবির পোস্টার

 “পরের দিন সকালে প্রথম ঘুম ভাঙল  শেখরের। শেখর দেখতে পেল তাদের বাংলোর সামনের রাস্তা দিয়ে দুজন ভদ্রমহিলা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে। সে তৎক্ষণাৎ অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে অসীম ও সঞ্জয়কে খবরটা দিল। তারপর সকলের ঘুম ভাঙলে, চা খেয়ে সবাই বাজারে গেল প্রাতরাশের জন্য। এই সময় শেখর দেখতে পেল যে দুলি ও তার বান্ধবীরা বাজারে গোল হয়ে বসে আছে, কাজের অপেক্ষায়। দুলি শেখর আর হরিকে দেখে চিনতে পারল আর জিজ্ঞাসা করল তাদের সন্ধানে কোনো কাজ আছে কিনা। তখন শেখর দুলিকে বলল পরে বাংলোয় দেখা করতে। প্রাতরাশ করার সময় শেখর কায়দা করে লখার কাছ থেকে সেই দুই ভদ্রমহিলার বাসস্থান জেনে নিল।

এই দুই ভদ্রমহিলা সম্পর্কে বৌদি ও ননদ। বৌদিটির একটি ছেলে  আছে। এরা সকলে, পরিবারের কর্তা, প্রবীণ ব্যক্তি, সদাশিব ত্রিপাঠির সঙ্গে বেড়াতে এসেছে। টুরিস্ট বাংলো থেকে হাঁটা দূরত্বে সদাশিব ত্রিপাঠির একটি বাড়ি আছে যেখানে ত্রিপাঠি পরিবারের সকলে বছরে অন্তত একবার বেড়াতে আসে। শেখররা বাজার থেকে সেই বাড়ির সামনে এল ওই ভদ্রমহিলাদের সঙ্গে আলাপ করবে বলে। ঠিক তখনই সদাশিব ত্রিপাঠি প্রাতভ্রমণ শেষ করে প্রত্যাবর্তন করছিলেন এবং শেখরদের দেখে এবং তাদের কথা শুনে আনন্দের সঙ্গে তাঁর গৃহে আমন্ত্রণ করেন। পরিচিতি পর্ব শেষ হবার পর সঞ্জয়, শেখর, হরি এবং বৌদি ব্যাডমিন্টন খেলতে শুরু করে।

অন্যদিকে অসীম ননদটির প্রতি আকৃষ্ট হয়। সে কৌশলে ব্যাডমিন্টন খেলা এড়িয়ে গিয়ে ননদটিকে নিয়ে, পাশেই একটি ওয়াচ টাওয়ার ছিল, সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ নিরালায় আলাপচারিতা করে। অসীম জানতে পারে মেয়েটির নাম অপর্ণা, তার এক দাদা ছিল, কয়েকবছর হল সে আত্মহত্যা করেছে।  অপর্ণার মাও গত হয়েছেন এবং অপর্ণারা সকলে প্রতি বছর অন্তত একবার এইখানে বেড়াতে আসে, কারণ জায়গাটা সদাশিববাবুর খুব পছন্দের  জায়গা।  এই আলাপচারিতায় অপর্ণাও  জানতে পারে যে অসীমরা জোর করে টুরিস্ট বাংলোটা দখল করেছে।

এর মধ্যেই লখা এসে খবর দেয় যে বাংলোয় টুরিস্ট রেঞ্জার সাহেব এসেছেন এবং তিনি এই চার বন্ধুর দর্শনপ্রার্থী। তখন অসীমরা ত্রিপাঠি পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেয় ও পরেরদিন সকালে প্রাতরাশের জন্য আমন্ত্রিত হয়। অসীমরা বাংলোয় ফিরে এলে রেঞ্জার সাহেব জানান যে বড়সাহেব, অর্থাৎ ডি. এফ. ও, ডালটনগঞ্জ খুব শিগগির বাংলো পরিদর্শনে আসতে পারেন। ফলে বিনা অনুমতিতে বাংলোয় থাকার জন্য অসীমদের বিতাড়িত হবার সম্ভাবনা আছে ও চৌকিদারেরও চাকরি খোয়ানোর সম্ভাবনা আছে। এই শুনে চার বন্ধু বেশ মুষড়ে পড়ে। একটু পরে দুলি এবং তার দুই বান্ধবী বাংলোয় আসে কাজ করার জন্য এবং শেখর ওদেরকে অগ্রিম পারিশ্রমিক দিয়ে ঘর-দোর পরিষ্কারের কাজেও লাগায়। কিন্তু চৌকিদারের আপত্তিতে তারা সরে পড়তে বাধ্য হয়। এই সময় হরির খেয়াল হয় যে তার টাকার ব্যাগ হারিয়ে গেছে এবং সে তৎক্ষণাৎ  লখাকে সন্দেহ করে ও তাকে প্রহার করতে শুরু করে। এই ঝামেলা যাতে আর না বাড়ে তার জন্য অসীম লখাকে তার পাওনা টাকা মিটিয়ে দিয়ে তাড়িয়ে দেয়।

তারপর অসীম, সঞ্জয় ও শেখর বাংলোর লাগোয়া কুয়োর পাড়ে স্নান করতে আসে। তারা যখন খালি গায়ে সাবান মেখে স্নান করছে, সেই সময়ে হঠাৎ গাড়ি করে অপর্ণা এবং বৌদির আবির্ভাব হয়। সেই দেখে সঞ্জয় বুদ্ধি করে কুয়োর পাড়ে নিজেকে আড়াল করে সটান শুয়ে পরে, অসীম কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, একমাত্র শেখরই সপ্রতিভ ভাবে দুই মহিলাকে প্রীতি সম্ভাষণ করে। তখন বৌদি হরির টাকার ব্যাগটি ফেরত দেন, যেটি হরির অজান্তে ব্যাডমিন্টন কোর্টে খেলার সময় পড়ে গিয়েছিল। গাড়ি চলে যাবার পর আনন্দিত সঞ্জয় কুয়োর পেছন থেকে বেরিয়ে আসে, অসীম নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে এবং শেখর এই বলে ওদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে যে এটা কোনো ব্যাপারই নয়।

সেইদিন সন্ধ্যেবেলা ওরা যথারীতি হাড়িয়া পান করতে যায়। রাতে মদ্যপ অবস্থায় বাংলোয় ফেরার সময় ওরা রাস্তায় একটি গাড়ির সামনে পড়ে। গাড়ির হেড লাইট এবং হর্নের আওয়াজে বিরক্ত হয়ে অসীম অপ্রকৃতস্থের মত আচরণ করে। কিন্তু তারা দেখতে পায়না যে গাড়ির মধ্যে অপর্ণা ও বৌদি বসে ছিলেন।

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে যথেষ্ট দেরি হয়। শেখর ঘুম থেকে উঠেই বুঝতে পারে যে ত্রিপাঠীদের বাসভবনে গিয়ে প্রাতরাশের নিমন্ত্রণ রক্ষা করার সময় চলে গেছে। সে অসীম ও সঞ্জয়কে তিরস্কার করে এবং বাইরে গিয়ে দেখতে পায় বৌদি ওদের জন্য কিছু খাদ্যসামগ্রী একটা টিফিন কৌটোয় পাঠিয়ে দিয়েছেন, একটি চিঠি সমেত। অতপর ওরা চারজনে আবার ত্রিপাঠীদের বাসভবনে যায়, সকালে না আসার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, হরির টাকার ব্যাগ ফেরত দেবার জন্য ধন্যবাদ জানায় এবং দুপুর বেলায় বৌদি ও অপর্ণাকে বাংলোয় আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে আসে।

অসীমরা বাংলোয় ফিরে আসার পরে ডি. এফ. ও সাহেব বাংলো পরিদর্শনে আসেন ও তিনি তাঁর কর্তৃত্ববলে অসীমদের বাংলো থেকে চলে যাবার নির্দেশ দেন। ঠিক এই সময় অপর্ণা ও বৌদি বাংলোয় আসেন। দেখা যায় যে ডি. এফ. ও সাহেব ত্রিপাঠী পরিবারের পূর্বপরিচিত এবং অপর্ণা অসীমদের নিজের বন্ধু বলে পরিচয় দেওয়ায় অসীমরা সে যাত্রায় বিতাড়িত হবার থেকে রক্ষা পায়। তারপর দুই ভদ্রমহিলা ও চার বন্ধু মিলে বাংলোর বাগানে আলাপচারিতার মধ্যমে এবং মেমরি গেম খেলে একটা সুন্দর অপরাহ্ন   অতিবাহিত করে।

অরণ্যের দিনরাত্রি ছবিতে মেমোরি গেম খেলার দৃশ্য

বিকেলের দিকে ওরা একসঙ্গে একটা স্থানীয় মেলায় যায়। সেখানে অসীম অপর্ণার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে এবং যখন জানতে পারে যে অপর্ণারা আগামীকাল সকালেই কলকাতায় ফিরে যাবে, তখন সে অপর্ণাকে মনের কথা খুলে বলে ও কলকাতায় অপর্ণার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চায়। অপর্ণা  অসীমকে নিরাশ করে না। শেখর মেলায় গিয়ে জুয়া খেলে বেশ কিছু টাকা হারায়। এদিকে হরি মেলায় দুলি কে দেখতে পেয়ে তাকে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কিছু সময় অতিবাহিত করে। কিন্তু হরি দেখতে পায়না যে লখা হরিকে নজরে রেখেছে। হরি দুলির সঙ্গে জঙ্গলে কিছু সময় কাটাবার পর যখন বাংলোয় ফিরে আসছে, তখন লখা প্রতিশোধ নেবার জন্য হরিকে প্রহার করে ও হরির টাকার ব্যাগ নিয়ে চলে যায়। হরি কিছুক্ষণ অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থেকে, ধুঁকতে ধুঁকতে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বাংলোয় ফেরার চেষ্টা করে। তখন শেখর ওকে দেখতে পেয়ে হরিকে বাংলোয় নিয়ে যায়।

মেলা থেকে কিছু কেনাকাটার পর সঞ্জয় বৌদিকে তাদের বাড়ি পৌছিয়ে দিতে আসে। বৌদি সঞ্জয়কে কফি পান করার আমন্ত্রণ জানালে সঞ্জয় সানন্দে তা গ্রহণ করে। কিছুক্ষণ পর বৌদি সদ্য কেনা সাঁওতালি গহনা পরে সঞ্জয় কে দেখাতে আসেন এবং সঞ্জয় বেশ অপ্রস্তুত বোধ করে। সঞ্জয়ের তরফ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে বৌদি তাঁর ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন। সঞ্জয়ও বাংলো থেকে ফিরে আসে। 

পরের দিন সকালে চারবন্ধু কলকাতা ফেরার প্রস্তুতি নেয়।শেখরের শুশ্রূষায় হরি অনেকটা বেটার ফিল করে। অসীম চৌকিদারকে তার প্রাপ্য টাকা দিয়ে বলে যে তার চাকরি খোয়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। চৌকিদার তখন এক টিফিনবাক্স খাবার তাদের হাতে দিয়ে বলে  যে বৌদি পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারা আনন্দের সঙ্গে তা গ্রহণ করে। শেখর দেখে তার ভিতরে ডিম সিদ্ধ। হাতে নিয়ে বলে,  ডিম মাইরি!  মুখটা খুশিতে ভরে যায়। এবার তাদের অ্যাম্বাসাডার   কলকাতার অভিমুখে রওনা দেয়। গাড়ির পিছন পিছন গেট লাগাতে নিজস্ব ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে চৌকিদার।

[কাহিনি সংক্ষেপ : উইকিপিডিয়া] 

‘অরণ্যের দিনরাত্রি’  ছবির অজস্র সিকোয়েন্স এছবির প্রধান সম্পদ। এর মধ্যে প্রধান মেমরি গেমের সেই পৃথিবী বিখ্যাত দৃশ্যটি।  একটি চরিত্র একজন  বিখ্যাত সেলেবের নাম বলছে আর অন্যজন সেই নাম বলে নতুন একটা নাম যোগ করছে। এটা মেমরিতে রেখে খেলা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া জয়া, সঞ্জয়, অপর্ণা, শেখর, হরি, অসীম  এই ক্রমে নাম  বলতে থাকে।  যেমন,  জয়া -রবীন্দ্রনাথ,  সঞ্জয়- কার্ল  মার্ক্স, অপর্ণা – ক্লিওপেট্রা, শেখর- অতুল্য ঘোষ, হরি – হেলেন অব ট্রয়, অসীম – শেক্সপিয়ার।  ক্যামেরা প্যান করে ক্লোজ-আপে মুখের অভিব্যক্তি ধরছে। চমৎকার।  শেখর চরিত্রে রবি ঘোষ যখন অতুল্য ঘোষ বলার সময় অপর্ণার কালো সানগ্লাস পরে নেয় তখন সেটা অপূর্ব শ্লেষাত্মক হয়ে ওঠে। আদিবাসী গয়না পরে জয়া যখন অবদমিত কামনায় সঞ্জয়ের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে চায়, তার হাত রাখে বুকে —  সেই দৃশ্যটিও স্বাভাবিক ও সুন্দর। হরির প্রেমিকা হরিকে অপমান করলে হরি তার চুল ধরলে ফলস চুল ও খোঁপা পড়ে যায়। হরিকে সপাটে চড় মারে।  আর দুলির সঙ্গে যৌনমত্ত অবস্থায় হরি যখন তাকে চুল কিনে দেবার কথা বলে তখন তা এক আয়রনিতে পরিণত হয়ে যায়।  অভিনয়, সংলাপ ও সম্পাদনা  এই তিনের মধ্য দিয়ে সত্যজিৎ   মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সমস্ত সম্ভাবনাকে তিনি ব্যবহার করে নিয়েছেন। ‘উপরিতলে তেমন কিছু ঘটে না,  কিন্তু তলায় আবেগের আলোড়ন চলতেই থাকে’, বলেছেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক অ্যান্ড্রু রবিনসন।   

অভিনয়ে সকলেই  প্রবলভাবে তাদের শক্তি জানান দিয়েছেন।  সঞ্জয় চরিত্রে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়,  অসীম চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়,  জয়া চরিত্রে কাবেরী বসু, অপর্ণা চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুর,  দুলি চরিত্রে সিমি গেরওয়াল অনবদ্য। আদিবাসীদের খাঁটি ফিলিং তাঁর অভিনয়ে ধরা পড়েছে। হরি চরিত্রে শমিত ভঞ্জ খেলোয়াড় সুলভ মেজাজে জীবন্ত। তবে রবি ঘোষের শেখর বোধহয় সেরা অভিনয়ে মাতিয়ে রেখেছে গোটা ছবি।  হরি যখন আদিবাসী  মেয়ে দুলিকে টাকা দিচ্ছে, বেকার যুবক শেখর তখন বলে, ‘তিরিশ টাকা দিচ্ছে। হি ইজ গোয়িং টু পে থার্টি চিপস্’, তার এই কথা সরসতায় ভরপুর। অসহায়তা চাপা দিতেই বোধহয় শেখর সবসময় উচ্ছ্বল।  পাহাড়ী সান্যাল ছোট চরিত্রে নিজের প্রতিভা চিনিয়েছেন। তাঁর কণ্ঠে অতুলপ্রসাদের  গানের প্রয়োগ অতুলনীয়।

সৌমেন্দু রায়ের ক্যামেরার কাজ অরণ্যের গভীরতাকে চরিত্রে এনে দাঁড় করিয়েছে। সেই সঙ্গে বাঙালি দর্শক তার ভিতর পাচ্ছে ‘পালামৌ ‘ পাঠের নস্টালজিয়া।  অরণ্যের এক নিজস্ব আদিম নৈঃশব্দ আছে। সত্যজিৎ সংগীত যোজনায় তাকেই আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। 

সত্যজিৎ রায় পরিচালিত “অরণ্যের দিনরাত্রি” ছবি পঞ্চাশেও  সুবর্ণময়। প্রতিবার ছবিটা দেখলেই তার ভিতরে পাই নবীন যৌবন। তারুণ্য আর জীবন রসে ভরপুর এই ছবি সত্যজিৎ রায়ের এক গুরুত্বপূর্ণ ছবি। সুনীলের মতো করে নাগরিক তরুণদের উপস্থাপন করতে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও  এই ছবির শিল্পরস তাতে ক্ষুণ্ণ হয়নি। “অনেকে অপু ট্রিলজি বা চারুলতাকে তাঁর শ্রেষ্ঠ শিল্প কর্ম বলে মনে করলেও অরণ্যের দিনরাত্রি সেকথা আমাকে বিশ্বাস করতে দেয় না”, বলেছেন চলচ্চিত্র সমালোচক  জন রাসেল। সিরিও কমেডি গোত্রের এই ছবি কোনো বিশেষ বক্তব্যকে বহন করে না। চরিত্রগুলোর সঙ্গে এক হতে হতে তাদের জীবন অভিজ্ঞতার শরিক হতে ভালো লাগে।  তাই পঞ্চাশ বছর পরেও আবার অরণ্যে ফেরা যায়।  ফেরা যায় সেই তরুণবেলার গভীর নস্টালজিয়া নিয়ে।       

গ্রন্থ ঋণ
১. সাহিত্য ও চলচ্চিত্র  : সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র : মানবেন্দ্রনাথ সাহা
২. চিত্রনাট্য সাহিত্যের নতুন ভুবন  : মানবেন্দ্রনাথ সাহা 

পত্রিকা
 ১. ঘরোয়া : সত্যজিৎ রায় সংখ্যা,  ১৯৭২, কলকাতা।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *