‘ভরসা যেন পড়ায় এবং ভরসা যেন পড়তে আসে’ – অম্লান চক্রবর্ত্তী

শেয়ার করুন

অবশেষে আমাদের রাজ্যে বিদ্যালয়গুলিতে পুনরায় ক্লাস নেওয়া শুরু হল। দীর্ঘ ১১ মাস ব্যাপী বন্ধ বেঞ্চ-ব্ল্যাকবোর্ডে জমে থাকা অবসন্নতার ধুলো ঝেড়ে এবার শুরু নতুন উদ্যমে স্বাভাবিক জীবনের। প্রত্যেকেরই মনে থাকার কথা গত বাইশে মার্চ, ২০২০ সালে সারা দেশে লকডাউন ঘোষিত হবার পর থেকেই ক্লাস বন্ধ হয়ে যায় স্কুলগুলিতে। শুরু হয় অনলাইন ক্লাসের। কিন্তু ভারতের মতো আর্থসামাজিক পরিকাঠামোয় তা কতখানি বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব? নামীদামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলিতে হয়তো প্রত্যেক অভিভাবক পারবেন তাঁর সন্তানের হাতে স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট তুলে দিতে, কেরলের মতো শিক্ষিত রাজ্যেও হয়তো তা সম্ভব। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সম্ভব? উত্তর, নতমুখে দীর্ঘশ্বাস। 


স্কুল খোলার খবরে যে বসন্তের টাটকা বাতাস মনের মধ্যে এসেছিল তা মিলিয়ে গেল, যখন জানতে পারলাম, সরকার বাহাদুর শুধুমাত্র নির্দেশিকা জারি করেছেন, স্কুল খোলার দিনক্ষণ। কিন্তু নিউ নরমাল দিনে কোভিড প্রটোকল মেনে চলা এবং সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেননি। এমনকি স্কুল খোলার চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই “ধিতাং ধিতাং বোলে” আগুয়ান বিধানসভা ভোটের কাজের জন্য স্কুলগুলি নিয়ে নেওয়া হবে। মনের মধ্যে বহু প্রশ্ন ভিড় করে আসছিল। 

খোঁজ নিতে গেলাম একটি সরকারি স্কুলে—সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল। কলেজ স্ট্রিটের এই স্কুল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, বিষ্ণু দের ঐতিহ্য বহন করে। কিন্তু বর্তমানে সরকারি স্কুলগুলিতে যে আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে ছাত্রছাত্রীরা আসছেন সেখানে স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট দুষ্কর। বহু ছাত্র আজও যৌথপরিবারে থাকেন যেখানে কবীর সুমনের ভাষায় “ঘেঁষাঘেঁষি আর ঠেসাঠেসি করে গায়ে গায়ে শুধু কুটকুট”। বহু পরিবার থেকে ছাত্রের দল আসছেন যাঁরা প্রথম প্রজন্মের স্কুলযাত্রী। 

এমতাবস্থায় ভরসা শুধু স্কুল কর্তৃপক্ষের চওড়া কাঁধ। সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলের মাননীয় প্রধান শিক্ষক মহাশয় শ্রী দেবব্রত মুখোপাধ্যায় গত ডিসেম্বর মাসে আরও কিছু স্কুলের প্রধান শিক্ষক/শিক্ষিকার সাথে কথা বলে কিছু প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন স্কুলের বর্ষীয়ান শিক্ষক শ্রী অমিত কুমার দাস মহাশয়—যিনি সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে পঁচিশ বছরের বেশি সময় ধরে আছেন এবং স্কুলের প্রত্যেকটি স্নায়ু-তন্তুকে চেনেন হাতের তালুর মতো। এঁরা বসলেন আলোচনায়। গঠন করলেন কোভিড প্রোটোকল। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রতিবেশী হেয়ার স্কুলে কোনও প্রধান শিক্ষক না থাকায়, কোভিড প্রোটোকল গাইডলাইন এবং তাপমাত্রা পরীক্ষার যন্ত্র উপহার দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল। 



স্কুল খোলার আগে প্রধান শিক্ষক মহাশয় ১০ই ফেব্রুয়ারি নিজ উদ্যোগে একবার অভিভাবক-শিক্ষক মিটিংয়ের ব্যবস্থা করলেন। 
মিটিংয়ে কথা ছিল ৪:১ অনুপাতে অভিভাবকগণ আসবেন যাতে ভিড় এড়ানো যায়, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল বহু অভিভাবক চলে এসেছেন। তাঁদের স্যানিটাইস করে বসানো হল হলঘরে। শিক্ষকদের তরফে শ্রী অমিত কুমার দাস মহাশয় কোভিড প্রোটোকল, করণীয় এবং বর্জনীয় অভ্যাস এবং স্কুল কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সে বিষয়ে অভিভাবকদের অবগত করলেন। 


অভিভাবকগণও নিজেদের মতামত জানালেন স্কুল কর্তৃপক্ষকে। 


পরিশেষে, প্রধান শিক্ষক মহাশয় স্কুল খোলার পক্ষে ও বিপক্ষে অভিভাবকদের মতামত জানতে চাইলেন। স্কুল কর্তৃপক্ষের ভরসায়, হাত তুলে সম্মতি জানালেন সকল অভিভাবক। 


অবশেষে এল ১২ই ফেব্রুয়ারি। ক্লাসরুমের বন্ধ তালা খুললেন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা শ্রী নীলু থান্দার। 


প্রধান শিক্ষক মহাশয় দেবব্রতবাবুর নিখুঁত পরিকল্পনায় আগে থেকেই স্কুলের ক্লাসরুম পরিষ্কার করা ছিল। উনি নিজে হাতে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইটের দ্রবণ প্রস্তুত করলেন। 


সেই দ্রবণ দিয়ে প্রত্যেকটি ক্লাস পুনরায় পরিষ্কার করা হল। প্রধান শিক্ষক নিজে সেই ঘটনার তদারকি করলেন। 


ছাত্রদের আসা শুরু হল। ভয়, সংশয়, উত্তেজনা, আনন্দ প্রত্যেকের চোখেমুখে। বিষয়টি বুঝতে পেরে প্রধান শিক্ষক মহাশয় নিউ নরম্যাল দিনের নিয়মাবলী সম্পর্কে ছাত্রদের অবগত করলেন। 


পুরোনো অভ্যাস অনুযায়ী, বিদ্যাসাগরের মূর্তিতে প্রণাম করে ছেলেরা স্কুলের ভিতর প্রবেশ করল। 


প্রত্যেকটি ছাত্র স্কুলে উপস্থিত হওয়া মাত্র প্রথমে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করে, স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে নিল। তারপর তাঁদের শরীরের তাপমাত্রা মেপে নিলেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। 


ছাত্রদের স্কুলের ব্যাগও পরিষ্কার হল। 


এরপর নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাসে গিয়ে বসল ছাত্ররা। 


ক্লাসে পৌঁছেই চেনা ছবি দেখা গেল। এত দিন পর বন্ধুদের কাছে পাবার আনন্দ সব কিছুকেই ছাপিয়ে যাবে তাই তো স্বাভাবিক। অভিজ্ঞ শিক্ষকরা হয়তো অনুমান করতে পেরেছিলেন এমনটাই। তাই তৎক্ষণাৎ ক্লাসে পৌঁছে শুরু করলেন পঠনপাঠন। 


সময় কম, সিলেবাস শেষ হয়নি। দুজন ছাত্রকে দেখলাম একটি বিষয়ের পড়া বুঝতে এগিয়ে এল শিক্ষক শ্রী অরুণাভ আদকের কাছে। মাস্টারমশাইও যত্ন নিয়ে ছাত্রদের একটি ঘরে ডেকে নিয়ে বিষয়টি বুঝিয়ে দিলেন। 

 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক শ্রী রঞ্জন কুমার দাস ক্লাস নিলেন একটি অভিনব উপায়ে। বদ্ধ ক্লাসরুমের পরিবর্তে বেছে নিলেন খোলা করিডোর। নির্দিষ্ট দূরত্বে ছাত্রদের দাঁড় করিয়ে ক্লাস নিলেন তিনি। এও এক “নিউ নর্ম্যালসি”। 


দুই দিনের মধ্যেই প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এল সব। বিদ্যালয়ের স্বাভাবিকত্ব ফিরে এল। 


কিন্তু একটি অভাব বোধ হচ্ছিল। কোথায় গেল সেই দুষ্টুমির ছবি? সেই গলাগলি, দলাদলি, অকারণে হেসে ওঠা? অল্পস্বল্প খুনসুটি? ধ্বস্তাধ্বস্তি? তবে কি অতিমারী কেড়ে নিল স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যগুলি? দুটি ক্লাসের মাঝে হঠাৎ চোখে পড়ল সেই চিরাচরিত দৃশ্য। 


তবে সব শেষে দেখলাম, একটি ছাত্র তার বন্ধুর হাতে স্যানিটাইজার দিচ্ছে। বন্ধুর হাত পরিষ্কার করার জন্য। অতিমারী, আতঙ্ক সব ছাপিয়ে অবশেষে জয় বন্ধুতার। জয়ী ভরসা। শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-ছাত্র-অভিভাবক সকলের সকলের প্রতি ভরসা। 

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *