ভেসে আসে সুগন্ধ – অতনু চট্টোপাধ্যায়
(১)
সৌরভচন্দ্র ওরফে সৌরভ মুখোপাধ্যায়কে আমি বাপ্পামামা বলে চিনতাম। ও একবার সপ্তমীর সকালে মন্দিরের চাতালে কী এক নিজের আবিষ্কার করা খেলার টুর্নামেন্ট চালাচ্ছিল। এরকম হামেশাই করত। দিনটা খেয়াল আছে, কারণ—কলাবউয়ের চান দেখেছিলাম সংলগ্ন পুকুরে প্রথমবার। তখন আমার বয়স নিশ্চিত পাঁচ পেরোয়নি। সৌরভ সম্পর্কে এই আমার প্রথম স্মৃতি।
মামার বাড়ির পেছনের মাঠে আমরা নিয়মিত ফুটবল, ক্রিকেট খেলতাম। সন্ধ্যায় মন্দিরে আড্ডা দিতাম। ওর স্কুলের প্রায় প্রত্যেক শিক্ষক, ছাত্রকে বিলক্ষণ চিনতাম, যেহেতু সান্ধ্য আড্ডার মূল ও পার্শ্ব চরিত্রে আসল কুশীলব ছিলেন এঁরাই। এমনকি পাশের গার্লস স্কুলের ভেতর অবধি দেখতে পেতাম চোখ বুজে। ফলত বছর দুই আগে যখন আসল পি. কে. সি. স্যারকে চাক্ষুষ কোনো এক অনুষ্ঠানে দেখি, রীতিমতো আশাহত হই। কে না জানে কল্পনায় মানুষ বেঁচে থাকে, বাস্তব তার দুর্বল ছায়ামাত্র।
মনে পড়ছে, মাধ্যমিকের আগেআগে বিকেলশেষে টুক করে সাইকেল নিয়ে চলে যেতাম মামার বাড়ির নীচের ঘরে। কথা হত না, মেজদাদু সেতারে, সঙ্গতে ও। ঘণ্টাখানেক চুপ করে বসে থেকে ফিরে আসতাম। মেজদাদু অর্থাৎ প্রকাশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় আর দাদু বিকাশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় দু’জনেই কবিতা লিখত৷ ওদের আমরা লি-ভূপতি জুটি বলে ডাকতাম।
বাপ্পা নাটকে ওভারঅ্যাক্টিং করেছিল, প্রথম কবিতা প্রতিযোগিতা করেছিল, পত্রিকার গুরুগম্ভীর মিটিংয়ে দাবি করে বসেছিল ক্যারামবোর্ড। কোনো এক বান্ধবীকে কথা দিয়েছিল বলে, সিগারেট ছোঁয়নি। শিবপুজো করত। বাপ্পা ঢপ-ও দিত বিস্তর। রবিবারের অসম আড্ডায় আমি আর ও মিলে দাদুর কবিতা কাটাছেঁড়া করতাম। বেলা পড়ে গেলে ওর মা সিঁড়ির নিচ থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দিত। আমাদের ছিল অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিন, প্রচুর চেনা-অচেনা কবি। যেদিন দাদু মারা যায়, শ্মশানে নামল পুলিশভ্যান থেকে। সেজদিদা মারা যাওয়ার দিন, ও তন্দ্রাচ্ছন্ন, জানতে পারেনি। সৌরভ সেজদাদুকে নিয়ে একটা কবিতায় লিখেছিল,
একেকদিন রাত্তিরে, অনেক রাত্তিরে বাড়ি ফেরার সময় জানি এই গাছ আর আমার বাবা ছাড়া কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করবে না।
রাত করে সাইকেলে বাড়ি ফেরার সময় পিঠে থাকত সেই পরিচিত ব্যাগ। পুজোর ভাসানে ওর বিখ্যাত নাগিন ড্যান্স ছিল সর্বজনবিদিত। একবার রাতবিরেতে অঙ্ক করানোর নাম করে ছাদে বসে শুধুই তর্ক… “গণিত কেবলই ল্যাঙ্গুয়েজ, গণিত আদতে কবিতা”—ভোরের গঙ্গাদর্শনেও তার মীমাংসা হল না সেবার।
কালকেই পুরোনো কবিতা ঘাঁটতে গিয়ে ওর একখানা কবিতাকে অবিকল নিজের লেখা বলে মনে হল, পরে অবশ্য ভুল ভাঙে। শেষবার সবাই মিলে বসেছিলাম ঘরোয়া মদ্যপানের আসরে। দোসরা মে নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা চলছিল। মাঝেমাঝে ওকে খোঁচাচ্ছিলাম বিয়ে নিয়ে। দশপেগের পর উঠে যায়। বাড়ি গিয়ে বমি করে।
এরপর আকড়া স্টেশনে ওকে দূর থেকে দেখি শেষবার, পবিত্রদাকে দাহ করে ফিরছিল। সেদিন আর কথা বলিনি, কেন যে বলিনি, কে জানে!
(২)
আমি, সাদিক, সৌরভ, অনাদি কবিতা লিখতাম। পত্রিকা বার করতাম একসাথে। আমাদের প্রতিহিংসা ছিল কুকুরের মতো। রাতবিরেতে আমাদের কামড়াকামড়ির আওয়াজ শোনা যেত শুনশান রাস্তায়। আমাদের হাতেখড়ি লেখক শিল্পী সঙ্ঘে। প্রতিমাসে অন্তত ডজনখানেক কবিতা প্রসব করতাম সেসময়। পাড়ার কুকুরেরা আমাদের দেখে লজ্জা পেত। কারণ একটুকরো হাড় চিবিয়ে খুশি থাকতে শিখিনি তখনও।
আমাদের ছিল ‘ভূমা’, ‘ফুলকারি’ নামে বিভিন্ন সংগঠন। বাম, অতিবাম থেকে সদ্য তৃণমূল সবার তখন হাতেহাতে কবিতা, সবার তখন মাথায় জ্বলে উঠছে কুপি। আমাদের মধ্যে বাপ্পা ছিল অসংবাদিত নেতা, ফলে বরাবর বিতর্কিত।
কিছুদিন আগে এক ফেসবুক পোস্টে সৌরভ লিখেছিল, “সাদিক আর আমি একই এলাকায় থাকি, একই পথ দিয়ে হাঁটি, একই ট্রেন ধরি এবং একই চায়ের দোকানে বসে চা খাই, তবু সাদিকের দেখার চোখ একেবারে আলাদা। ও না বলে দিলে আমার এই ভুবনের মধ্যে থাকা আরেকটি ভুবনের সন্ধান আমি পেতাম না। তাই ওর লেখা শুধু পড়ি না, দেখারও চেষ্টা করি।” …জীবনে এই প্রথমবার বাপ্পামামাকে স্বপ্নে দেখি, ওর মৃত্যুর তিনদিন আগে, কী দেখেছিলাম মনে নেই। ঘুম থেকে উঠে মুখ তেতো হয়ে যায়।
যখন রোদের জোরালো আঠায় মাকড়সা বুনে নিত জাল, যখন এলোমেলো হাওয়ায় সেই জাল দুলেদুলে উঠত, যখন কালবৈশাখীর আগে লাল হয়ে থাকত সুপুরিগাছের মাথা, সেই বয়সে ও ‘রূপরেখা’-কে বলে ফেলতে পেরেছিল, “শুধু প্রোনাউনসেশান দিয়ে কিস্যু হয় না।” আর যায় কোথায়! গমগম করে উঠল হাততালি।
“মাঝেমাঝে দেখা যাচ্ছে খণ্ডিত আকাশ/তাও বা ইচ্ছে হলে হাওয়ার, সরে গেলে ওড়না।” সুতরাং ও যে মাংসের বালিশ মাথায় নিয়ে লেকের ধারে শুয়ে আছে, তাতে আর সন্দেহ রইল না। ওর প্রতিটা অক্ষর ছিল যেন-বা গরমের হলকা, রগরগে অথচ স্মার্ট।
ভারতীয় গণতন্ত্রে যেমন উদ্দেশ্য, বিধেয় খুঁজতে নেই, এই লেখার ভবিতব্যও তাই। দূরে সমুদ্রের নোনতা হাওয়া, হলদে হ্যাজাকের চারিদিকে ঝুলে আছে সারিসারি পমফ্রেট, ভেটকি, শংকর, চিংড়ি, কাঁকড়া আরো কত কী। রূপ মনে আছে, স্বাদ ভুলে মেরে দিয়েছি বেমালুম। এরকমই ঝাপসা হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে মহব্বত ডাক্তারের ‘সৃজনী’ পত্রিকা, শীতলদার ঠেলাগাড়ি। রেলগেট নেমে আসছে। ট্রেন ছেড়ে দিলে ফের উঠে যাচ্ছে। হুল্লোড়ের মধ্যে থেকে ছাতুর বিজ্ঞাপন পিঠে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে পক্ষীরাজ অটো। বাপ্পা উঠছে। নেমে যাচ্ছে। ভিড়ের ভিতর মিশে যাচ্ছে ভিড় হয়ে। হ্যাজাকের হলুদ আলোয় আবার কখনও জটলা পাকিয়ে চামড়ার ব্যাগ খুলে বিক্রি করছে পাহাড়ি বিছের তেল।
(৩)
আমি রাজীব বলছি—“আপনার কবিতা বেশ ভালো, আরো ভালো করতে হবে।” এই নষ্টামোর জুড়ি মেলা ভার। প্রযত্নে সৌরভচন্দ্র। আসলে এর মধ্যে গঙ্গা দিয়ে বহু জল বয়ে গেছে। বাম জমানার ইতি টেনে তৃণমূল ক্ষমতায় এসে গেছে বেশ কিছুদিন। আমি প্রায় চার বছর পাঞ্জাবে কাটিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে। এদিকে সৌরভ তৃণমূলের সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী। এর মাঝে অনেক ওঠাপড়ার ইতিহাস, প্রায় সবটুকুই আমার জানা। তবে অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা মুলতুবি থাক। যা প্রাসঙ্গিক, তা হল, রাজীব তখনও আমার অপরিচিত। তাই সুযোগের সদ্ব্যবহার।
“আরো ভালো করতে হবে”, বলুন কার না গা জ্বলে! সেসময় আমার দ্বিতীয় বই সবেমাত্র প্রকাশিত। হাতফেরতা তা গিয়ে পৌঁছায় মামাবাবুর কাছে। এবং ইহাই পুড়কির প্রকৃত কারণ।
মধ্যবর্তী দীর্ঘ সময় সৌরভ ছিল লেখালেখির বাইরে। যোগাযোগ বলতে পারিবারিক অনুষ্ঠানে দেখা এবং মেপে বাক্যবিনিময়। ব্যক্তিগত আলাপে এবার কিন্তু ওকে সপ্রতিভ লাগল আগের মতো। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে আবার। নানা পত্রপত্রিকায় লেখা চোখে পড়ত।
ক্রমশ লক্ষ করলাম, ওর সাংগঠনিক তৎপরতা আর জনসংযোগ বর্ষাকালের পদ্মার মতো ছড়িয়ে চলেছে। এপার ওপার দেখা যায় না। হঠাৎ হঠাৎ কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে ডাক পাই, সে এক বিপুল কর্মযজ্ঞ। সভাসদ পরিবৃত এই রূপ সংগঠকের, কবির হতে পারে না। এ-ও হয়তো আমাদের সংস্কার। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে একে আগাপাশতলা জুতো দিয়ে পিটতে আমি সৌরভকে বহুবার দেখেছি।
বিষাদের দিনে ইয়ার্কির রুমাল ওড়ানো
বিষাদের দিনে ইয়ার্কি
কিছু সহজ ব্যাপার নয়।
রঙিন দিনগুলিকে মুছতেমুছতে
সাদা পাথরে মিশিয়ে দেওয়া
কিছু সহজ ব্যাপার নয়।
সাদা পাথর ধীরেধীরে
ভারী হয় আসে শয়তানের হাসির মতন।
শয়তানের চটুল হাসির মতোই অনায়াস ছিল ওর ভঙ্গি। কিন্তু যদি ধরে নিই শিল্প সেই “বিমূঢ় অনাসৃষ্টি আলিঙ্গন”, তবে শুধু দাপুটে পুরুষের পেশিপ্রদর্শনে খেলা তো জমবে না। খেলা হবে তখন, যখন তার দোসর পুরুষকে পার্কের বেঞ্চি অথবা খালের ধারে পথ চেয়ে বসে থাকতে দেখা যাবে। এবং খেলা হয়েওছিল, কারণ এই দ্বিতীয় পুরুষটি অনিবার্যভাবে ‘বিপন্ন সংশয়’। দেখুন তার শিরদাঁড়ার হাড়, ঈষৎ বক্র—গোলাপি লিপস্টিক লেপটে আছে ঠোঁটে। কাজলপরিহিতা সে, একেবারে পুরুষের নাকছাবিটির মতো প্রবল দাম্ভিক।
ভাবি কাম্যুকে দেখতে পাব শহরের রাস্তায়
কাম্যু
হাজার হাজার ইঁদুর
হৃদস্পন্দন কেড়ে নেয় আমার
কাম্যুর মৃতদেহ কি
কাকদ্বীপ থেকে ভেসে ভেসে এসেছিল?
আমার পেচ্ছাপে কি কাম্যুর রক্ত!
পাঠককে অনুরোধ, লক্ষ্য করুন এই ‘কাকদ্বীপ’ শব্দটির অমোঘ ব্যবহার, কোনো প্রাচীন হরতালের স্মৃতি কি উঁকি দিয়ে ফিরে গেল?
কিন্তু কাহিনিটি যেহেতু দ্বিচারী এবং বহুগামীতার, ফলত অনূঢ়া নারীর মতো নির্জন, অতি ব্যক্তিগত জমি নদীর কোনো এক পাড়ে থাকতেই হবে। শুধু ষাঁড়াষাঁড়ির বান দেখব বলে তো এতদূর আসিনি আমরা। দেখব আমরা, voyeur-এর মতো বাথরুমের ফুটোয় চোখ লাগিয়ে গোপন অঙ্গবিলাস।
এত রগরগে ভূমিকা দিয়ে আমি যা বলব, তা নিশ্চিত নির্জন ও ব্যক্তিগত অথচ একই সাথে পারিবারিক৷ ফলে আপনাদের বিরক্তি অন্যায্য নয়। এটি একটি পিতাপুত্র সংলাপ।
টলটলে বাবা পাথর ভেঙে ভেঙে ঢোকে ব্যাঙ্কে
বাবার শেষ পেনশন
ঝাপসা চোখে আর কাঁপা হাতে সই করে মৃত্যুর স্লিপে
“আর কতক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হবে রে?”
আমি ধরি তার হাত
নদী মিশে যায় সমুদ্রে
অবশেষে সময় আসে বাবার
চোদ্দহাজার পাঁচশোটা গর্জন হয় বাবার শরীরে
বাবা তখন আমার চেয়েও যুবক, পূর্ণমাত্রায় যুবক
টগবগ করে ছুটে পৌঁছতে চায়
যুবতী নদীর পাড় ধরে ছাত্রভর্তি ক্লাসরুমে।
বাবা তখন ধুতি পাঞ্জাবিতে সাদা ঘোড়া
কল্পতরু এক বনেদী জমিদার।
শেষ পেনশন থেকে আমার হাতে দুশো টাকা গুঁজে দিয়ে
আর মায়ের জন্য একবাক্স সন্দেশ নিয়ে
হঠাৎ করেই বাবা মৃত্যু-রিকশায় উঠে পড়েন
আমি জানি অনেকটা পথ এখন বাবাকে
একাই যেতে হবে
আর জ্বলন্ত পাটকাঠি হাতে মন্ত্র পড়া ছাড়া
আমার আর কিছুই করার নেই।
এই কবিতা কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা দাবি করে। কিন্তু আমরা তো বাৎস্যায়নের বংশধর, ন্যায়শাস্ত্রের বিচক্ষণতা আমাদের নাইবা থাকুক। আজ আমরা দেখবই, কারণ, ভুলবেন না, আমাদের চোখ লেগে আছে সেই বাথরুমের ফুটোয়। সামনে যে নগ্নদেহ, তার নিস্পৃহতা দেখুন। দেখুন কনুইয়ের ভাঁজ।
মৃত্যুর কয়েকদিন আগে বাবা কেবল যেতে চাইতেন
দেখি
তিনপুরুষ পুরনো ঠাকুরদালানে
একেবারে শেষ হয়ে যাওয়ার আগে
পূর্বপুরুষের স্মৃতিগুলোকে শেষবার দেখা আরকী
দেখি, আমরা এভাবেই দেখি
ঠাকুরকে দেখি বিসর্জনের সময়
বাবা-মাকে দেখি মৃত্যুর সময়
আর প্রেমকে দেখি বিচ্ছেদের সময়
‘ভেসে আসে সুগন্ধ’। সেই কবে থেকেই তো ভেসে আসছে, ফিরে ফিরে যাচ্ছে আবার ভাঙা বাড়িটার খিলানে, ঘুলঘুলিতে। এ কেবলই পিতৃপুরুষ দর্শন নয়। সৌরভ আমাদের ঠকায়নি। আমরা খেয়াল করে উঠতে পারিনি, এই যা।
(৪)
মনা বলে আমাদের এক বন্ধুকে বর্ষায় ফুটবল মাঠে সাপে কেটেছিল। সত্ত্বর তাকে লোকাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসায় ও সুস্থ হয়ে ওঠে। ঘটনাটা ঘটেছিল ঠিক এর ছ’মাস পর। হঠাৎ বোঝা গেল ওর দুটো কিডনিই অকেজো হয়ে গেছে। পরবর্তী দীর্ঘ রোগভোগের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে মনা মৃত্যুর দিকে হেঁটে যায়। এই বিয়োগবেদনা গাম্ভীর্য দাবি করে, প্রস্তুতির সময় পাওয়া যায়, যেন বৃদ্ধ সোভিয়েতের পতন দেখছি। পাশাপাশি ভাবুন তো একবার কারো লুঙ্গির ভেতর ছুঁচোবাজি ঢুকে গেছে। অস্থির হুল্লোড়, হাস্যরোলের মধ্যে কেউ পুড়ে যাচ্ছে, শুনেছেন কখনও মৃত্যুর এই লঘু স্বর? দেওয়ালে দেওয়ালে ‘টুম্পা সোনা’, ‘খেলা হবে’, পরিযায়ী শ্রমিকদের একপাটি চটি পড়ে আছে রেলের পাটরিতে। অথচ আপনার আশ্রয় ‘ঈশ্বর দর্শন যাত্রার গল্প’। ফলত আপনি ভাগ্যবান, কিন্তু সত্যিই যদি লুঙ্গির ভেতর ছুঁচোবাজি ঢুকে যায়—
আগুন জ্বলে ওঠে মাথায়, নেশা হয় খুব। তোমরা যে মঞ্চের উপরে নেত্য করছো তার নীচে শুয়ে আছে একটি শুয়োরের বাচ্চা। ভুস করে মঞ্চ ফুঁড়ে জেগে উঠবে সে, মঞ্চের উপর ঝিকমিক, ঝিকমিক — আকাশে কতো তারা, অন্ধকার।
একটি অসমাপ্ত প্রেমের কবিতা
ভুস করে জেগে উঠবে সে, গুলি করে নামাবে আকাশের তারাদের। চাঁদ নিয়ে খেলবে, তোমাদের কবিতাকে ফেলে দেবে নর্দমার জলে। কোন শালা আছিস রে এখানে — আয় যুদ্ধ করি, রাক্ষসদের ধরে ধর্ষিত গুহার ভেতর জোরসে দিই ঢুকিয়ে।
সন্তানের রক্ত হাতে পিতাদের চিৎকার শেষ হলে মাঝরাতে জেগে ওঠে মৃত্যুর বেদনা, কান্নার বাতাস। দূর দিয়ে বয়ে যায় আগেকার হাওয়া।
আমাদের লিঙ্গ ছিন্ন করো হে সন্ত্রাস — হে শুয়োরের বাচ্চারা — হেসে ওঠো, হেসে ওঠো শেষবার।
সৌরভ জায়গায় জায়গায় বেশ উচ্চকিত, ওর অভিন্নহৃদয় সঙ্গী মইদুলদা, শীতলদা সকলেই এরমই ছিল। কিন্তু কী নির্বিঘ্নে দূর দিয়ে বয়ে যাওয়া ‘আগেকার হাওয়া’ সৌরভ টের পায়, তা লক্ষ করবার মতো বিষয়। সৌরভের লেখার শেষ পর্যায়ে, যেভাবে শুয়োরের খোঁয়াড়ে দিনপাতের নিখুঁত বর্ণনা বারবার উঠে এসেছে, এরকমটা আমি অন্তত আর কারো লেখায় দেখিনি। আহা ট্যাক্সি, ওহো ট্যাক্সি, টসটসে পুঁজের মতো ট্যাক্সির হলুদ রং যে চেয়েচেয়ে দেখবার মতো নয়, সেকথা স্বাভাবিক। কিন্তু ঘটনাচক্রে এটাই আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতা। আত্মায় ফুটে থাকা সেফটিপিন।
নিজের কথা নিজেকে চিৎকার করে বলতে পারি না
আহা ট্যাক্সি
হাওয়ার ভেতর আসে উন্মাদ ট্যাক্সি
আহা ট্যাক্সি, ওহো ট্যাক্সি
প্রতিরাতে আমাকে চুম্বন করে যায়
না-দাঁড়ানো ডোরাকাটা ট্যাক্সি
আমার গোপন ইচ্ছা জানে বলে
ডাকলেও কাছে আসে না
সামনে দিয়ে চলে যায় হাসতে হাসতে
এই ট্যাক্সির ভেতর একদিন
গতজন্মের পরাজিত শরীর ফেলে
তোমাকে উদ্দাম চুমু খেয়েছিলাম
আহা ট্যাক্সি, ওহো ট্যাক্সি
ওহো আমার না-দাঁড়ানো আশ্রয়
তোমার গতিবেগ বাড়িয়ে দাও
আমাকে ডেকো না কাছে
এই মোহময়ী চৌষট্টি কলার ভেতর
আমরা নিজেদের হারিয়ে ফেলব
আহা ট্যাক্সি, ওহো ট্যাক্সি…
সৌরভের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ, যার অনেকগুলোর সঙ্গে আমারও মতান্তর নেই। অথচ কেউ কলকাতার রাস্তায় ট্যাক্সির শরীর জুড়ে বাঘের ডোরাকাটা দাগ দেখে ফেললে, তাকে সমীহ না করে উপায় থাকে না। কেউ যদি একান্তই ইট তুলতে চান, তবে আমার বিনীত অনুরোধ এটুকুই, ইটটি তিনিই তুলবেন, এই কুরুক্ষেত্রের পরেও যার হাতে কোনো পাপ লেগে নেই।
পাতাল শহরের হাঁ-করা জানোয়ারগুলো একা পেয়ে
মহাভারতের মাঠ
কুত্তার মতো আমাকে তাড়া করেছে
আজ আমি সোনাদানা, মদ, রুটি যাই দিই না কেন
এই নির্জন রাতে একজায়গায় দাঁড়িয়ে না থেকে
ওরা ঠিক বুক চিরে আমার রক্ত নেবে
একদিন আমিই তো শান দেওয়া ছুরি গলায় ঠেকিয়ে
ছায়া গুলোকে বাধ্য করেছিলাম গণিকার মতো হাসতে
উন্মত্ত ঋতুর হাত থেকে পালাতে পারিনি কেউ
বদলা নিতে শালারা আজ আমায় তাড়া করেছে
আমি যে শুধু অন্ধকার ধরি আর সারারাত নর্দমায় শুয়ে থাকি
খুন হতে হতে এরা কি সেটাও ভুলে গেল?
‘মার’ ক্ষমতা থাকলে ঠিকঠাক অস্ত্র দিয়ে আমাকে মার
আকাশবাণী হয়েছে আজ তোরাও মরবি আর আমিও মরব
সাদা ফুল নিয়ে পড়ে থাকবে শুধু মহাভারতের মাঠ
এই লেখা যখন শেষ করছি, আস্তে আস্তে ভোর হচ্ছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সৌরভ উঠে দাঁড়াচ্ছে, ওর একটা পা ওদের ভাঙা বড়োবাড়ির চিলেকোঠায়, আরেক পা গিয়ে পড়েছে পুরোনো মন্দিরের মাথায়। মাথা নড়তে নড়তে এই তো পার করল রবিয়েলদের বাড়ি, জালখুরা ক্লাব, বাটা মিলনসঙ্ঘ। আর ওর পিঠের ব্যাগ নন্দনচত্বরের ওপর দিয়ে, কবিতা আকাদেমির ওপর দিয়ে, আমাদের জেলখানার অনেকটা ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে, দূরে, বহু দূরে।