তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল! – সুমন চক্রবর্তী

শেয়ার করুন

“যুদ্ধ” শব্দটা যেখানে যখনই উচ্চারিত হয় তখনই বিভীষিকাময় কিছু চিত্রকল্প এবং তার সাথে সম্পর্কিত কিছু শব্দের অনুষঙ্গ আমাদের প্রাত্যহিকতা সর্বস্ব বেঁচে থাকাকে যেন শিহরিত করে। তখন যুদ্ধ আর সেই চিত্রকল্প বা তার সাথে সম্পর্কিত শব্দের অনুষঙ্গগুলির মধ্যে কোন প্রভেদ থাকে না, তারা হয়ে ওঠে একই সমান্তরাল রেখায় অবস্থানকারী দুটি বিন্দুর মত অভিন্ন, হয়ে ওঠে একে অপরের সহোদর। তখন যুদ্ধ মানে – উষর রাস্তার ধুলো উড়িয়ে সাঁজোয়া গাড়ির চলে যাওয়া।যুদ্ধ মানে তখন – রণতরীদের গতিবিধির রোমহর্ষক ধারাভাষ্য। যুদ্ধ হয়ে ওঠে – বোমারু বিমানের উদ্দেশ্যহীন আনাগোনার নামান্তর মাত্র। যুদ্ধ বলতে তখন আমরা বুঝি – ব্ল্যাক-আউটের অন্তহীন রাত। যুদ্ধ বললেই মনে পড়ে যায় – সংবাদ পত্রের প্রথম পাতায় দৈত্যকায় অক্ষরে ছাপা দানবীয় ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান। যুদ্ধ মানে – কোন এক অখ্যাত সাইডিং শেডে টিমটিমে আলোর নীচে অপেক্ষারত জলপাই উর্দিতে কতগুলি বলিপ্রদত্ত জীবের সারি। যুদ্ধ মানে – গণ কৃষ্টির প্রচ্ছদপম বিবরণ।যুদ্ধ মানে – রাতের নি্র্ভেদ্য নৈঃশব্দকে ছিন্নভিন্ন করা শহীদের মা’র আর্তনাদ। যুদ্ধ মানে – কোন এক আয়লান কুর্দির অচেনা সৈকতে পড়ে থাকা নিথর, প্রাণহীন দেহ। ‘যুদ্ধ’ বললে যেন মনে হয় এক সদ্য পঙ্গুত্বপ্রাপ্ত রাস্ট্রের ক্রাচে ভর করে পথ চলা।
যুদ্ধ নিঃসন্দেহে মানুষের আদিমতম প্রবৃত্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। মানবেতিহাসের প্রথম যুগ থেকে আজ পর্যন্ত, একদিনের জন্যও যুদ্ধ থামেনি – বলা ভালো থামতে দেওয়া হয়নি।আগ্রাসী মনোভাবের বশবর্তী হয়ে মানুষ কখনও নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে কিংবা অপরের শ্রেষ্ঠত্বকে খর্ব করতে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে, কিন্তু মজার বিষয়টা হল সব ক্ষেত্রেই বিপর্যস্ত হতে হয়েছে সেই সমস্ত আম মানুষজনদের যাঁদের যুদ্ধর সূচনা বা বিরতি ঘোষনার প্রশ্নে সে অর্থে কোন নির্ণায়ক ভূমিকাই থাকার কথা নয়। আগ্রাসী মনোভাবের উত্তরাধিকার যা কি না মানুষ আবহমানকাল নির্বিশেযে বহন করে এসেছে, তার মাশুল ক্রমশ অবহ হয়ে উঠছে না-তো উত্তর প্রজন্মের জন্য? প্রত্যেকটা দিন সাক্ষী হচ্ছে কোন-না-কোন ভয়াবহ হিংসা-মৃত্যুর প্রেতলীলার … হিংসার বারুদের লেলিহান শিখায় অঙ্কুরেই বিপন্নতার সম্মুখীন হচ্ছে কোন-না-কোন সভ্যতার সাকার হওয়ার স্বপ্ন … রক্তাক্ত হচ্ছে নগর-বন্দর। নৃশংসতার মাধুকরীকে পাথেয় করেই হয়ত লেখা হচ্ছে উষর সময়ের দলিল। সেই দলিলে লেখা হচ্ছে না তো – যুদ্ধ, হানাহানির কারণে নেমে আসা সেই উর্মিল রাত্রিটা অনেকটা লিবিয়ার দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মতো যেখানে জন্তুগুলো আনুপূর্ব অতিবৈতনিক, বস্তুর কাপড় পরে কেবলমাত্র লজ্জাবশত?
প্রবহমান কালের সাথে পাল্লা দিয়ে পাল্টেছে যুদ্ধের প্রকৃতি বা চরিত্র। একটা সময় ছিল যখন নিছক ব্যক্তিক পারঙ্গমই বিবাদমান দুটি পক্ষের মধ্যে ফারাক গড়ে দিত। একটা এ্যাকাইলেস্ বা একটা নেলসন বা একটা আফজল খানের শুধুমাত্র ব্যক্তিক নৈপুন্যেই নির্ধারিত হত বহু যুদ্ধের জয়-পরাজয়। যাবতীয় নৈর্ব্যক্তিকতার প্রতি দায়বদ্ধতাকে বিসর্জন দিয়ে ইতিহাসবিদের দল আপন মনের মাধুরী মিশায়ে এমনই ইতিহাস রচনা করতে শুরু করলেন যা কি না প্রায় বীর-গাথার সমতুল। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁরা যুদ্ধ নামক প্রতিষ্ঠানটিকেই মহিমান্বিত করে বসলেন – বলা ভালো রোমান্টিসইজ করা হল যুদ্ধকে এবং যুদ্ধ কর্ত্তৃক আনিত ধ্বংসবাদকে বা নিহিলিজমকে। সেই ইতিহাস হয়ে উঠল রিচার্ড আল্ডিংটন, এডমাণ্ড ব্লাণ্ডেন, রুপার্ট ব্রুকেদের রচিত কবিতার পাঠান্তর মাত্র। এর কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিস্রুত হল যুদ্ধ সম্বন্ধীয় সমস্ত ত্রেতা যুগীয় ভ্রান্ত এবং বিপথগামী ধ্যান-ধারণা।
যুদ্ধের প্রকৃতিগত বা চরিত্রগত পরিবর্তনটা প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয় ক্রিমিয়ার যুদ্ধে (১৮৫৩ – ১৮৫৬) এবং একথা নিতান্ত দ্ব্যার্থহীনভাবে বলা যায় যে ক্রিমিয়ার যুদ্ধই ছিল যুদ্ধকে একটা ব্যক্তি-পারঙ্গম নিরেপেক্ষ বিষয় করে তোলার প্রশ্নে সততই এক কালচিহ্ন। পৃথিবী প্রথম বারের জন্য সাক্ষী হল Minié ball বা Minni ball ব্যবহারের। সেই সময়ের নিরিখে Minié ball ছিল এক অত্যাধুনিক আবিস্কার, এবং এটিকে ছোড়ার জন্য সাহায্য নেওয়া হল Minié Rifle নামক এক বিশেষ ধরণের আগ্নেয়াস্ত্রের। মানুষ মেতে উঠল এক নতুন ধ্বংসাশ্রয়ী খেলায়। যার ফল স্বরূপ – ক্রমেই বীক্ষনাগারগুলো পরিণত হল রণনীতি নির্ধারণের প্রাণকেন্দ্রে। দুনিয়া জুড়ে গবেষণা শুরু হল নরমেধ যজ্ঞকে সুসংহত করার লক্ষ্যে, আর সেই যজ্ঞে যাজ্ঞিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেল বহু প্রথিতযশা বিজ্ঞান সাধকদের। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পারস্পরিক সহচার্যে যুদ্ধের বিভৎসতা পেল এক নবতম মাত্রা। যুদ্ধের ব্যাপ্তিকাল সংক্ষিপ্ত করার এক অভূতপূর্ব প্রতিযোগিতায় মাতলো তামাম বিশ্বের যুদ্ধবাজেরা। কি বলব জানিনা – যুদ্ধ ধরলো প্রযুক্তির হাত, নাকি প্রযুক্তিই হাত বাড়ালো যুদ্ধের দিকে ধ্বংসলীলাকে আরো ‘সুষ্ঠ’, ‘সুসংহত’ করতে?
ঐ কথাগুলো বলার মানে এই নয় যে আমি যুদ্ধ এবং যুদ্ধ কর্ত্তৃক আনিত বিভৎসতার যাবতীয় দায়ভার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগমনের ওপর চাপিয়ে, স্বাভাবিক মনুষ্য প্রবৃত্তিগুলিকে বস্তুত ক্লিন-চিট দিয়ে বসলাম। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমোন্নয়নকে যদি কেউ অপব্যবহার করে থাকে, সেটা করেছে মানুষ তার আদিমতম প্রবৃত্তিগুলোর দ্বারা তাড়িত হয়ে। মানুষ তার যুক্তিবোধ ও শুভ চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে, তরবারি তুলে নিয়েছিল কখনও শুধুমাত্র উগ্র জাতীয়তাবাদের দাসত্ব করতে, কখনও ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দিতে, আবার কখনও নিতান্ত বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধির কথা মাথায় রেখে। বিখ্যাত প্রাবন্ধিক জ্যাকব ব্রনোয়স্কি লিখছেন তাঁর Science and War প্রবন্ধে লিখছেন –“ … the sense of doom in us today is not a fear of science; it is a fear of war. And the causes of war were not created by science. No, science has not invented war; but it has turned into a very different thing. Science has enlarged the mechanism of war, and it has distorted it.” জ্যাকব ব্রনোয়স্কিরই ভাষায় grapeshots বা TNT অথবা gas chamber – এর কেউই কিন্তু যুদ্ধ নামক ভয়াল প্রতিষ্ঠানটিকে “outlaw” হিসেবে ঘোষনার প্রশ্নে চুড়ান্ত রকমের অসফল। একথা সত্য যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমোন্নয়ন আমাদের স্বল্পসময়ে, সংগোপনে বেশি নৃশংসভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষকে মারার যে কৌশল, তা রপ্ত করতে শিখিয়েছে। এখন প্রশ্নটা হল – প্রথিতযশা ঐ বিজ্ঞান সাধকেরদল কি স্বতপ্রবৃত্ত হয়েই যুদ্ধ্ নামক নরমেধ যজ্ঞে শরিক হলেন, না কি রাস্ট্রযন্ত্রের চাপের মুখে নতি স্বীকার করে? যদি রাস্ট্রযন্ত্রের চাপের কাছে নতি স্বীকারের বিষয়টাই সত্য হয়, তাহলে আগামীতে মানুষকে পারমানবিক পেশি শক্তির আস্ফালন দেখার জন্য আরও বেশি করে প্রস্তুত থাকতে হবে। পক্ষান্তরে এটাও সত্য যে রাস্ট্রে – রাস্ট্রে হানাহানির কারণও কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি। সাম্প্রতিক অতীতে এমন উদাহরণও আছে যে একটি অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দুর্বল রাস্ট্রের খনিজ সম্পদের প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে পার্শ্ববর্তী অপর একটি রাস্ট্র আক্রমণ করে বসল শুধুমাত্র তার নিজস্ব প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান চেতনাকে ব্যবহার করে খনিজ সম্পদ নির্ভর শিল্পের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য। আসল সমস্যাটা হয়েছে অন্য জায়গায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগমন প্রা্ত্যহিকতাময় মনুষ্য জীবনকে প্রতিনিয়ত সহজতর করে তোলার কাজটা করে চলেছে। প্রযুক্তির সাহায্যে সময় সাধ্য বহু কাজই হয়ে যাচ্ছে স্বল্পসময়ে, এর কারণেই আজ মানুষের হাতে প্রভূত উদ্বৃত্ত সময় এবং উদ্বৃত্ত উদ্যম, যা সঠিক অভিমুখ না পাওয়ার কারণে অব্যবহৃত অবস্থাতেই থেকে গেছে। আর ঐ উদ্বৃত্ত সময় এবং অফুরান উদ্যমটারই বড় একটা অংশ যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হল এমন কিছু নঞর্থক অনুশীলনে যার পরিণাম স্বরূপ উজ্জ্বলতর হল ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতার নিশ্চিহ্ন হওয়ার যাবতীয় সম্ভাবনা। কিন্তু এমনটাই কি হওয়ার কথা ছিল? বোধহয় না! কথা ছিল কথা ছিল রক্ত-প্লাবনের পর মুক্ত হবে শস্য-শ্যামল তেপান্তর… কথা ছিল রাখালিয়া বাঁশিতে স্পন্দিত হবে মননের নির্বেদ চরাচর… কথা ছিল আমাদের ধর্ম হবে ফসলের সুষম বন্টন… আমাদের তীর্থভূমি হবে শস্যেঠাসা মাঠ… কথা ছিল পাহাড় আর সমুদ্দুরের আদিগন্ত উপকূল হবে যুদ্ধের ত্রাসমুক্ত … রক্তস্নাত বদ্ধভূম খুঁজে পাবে প্রকৃত সীমানা তার।
পূর্ববর্তী একটি অনুচ্ছেদের শুরুতেই লিখেছিলাম – মানবেতিহাসের প্রথম যুগ থেকে আজ পর্যন্ত, একদিনের জন্য ও যুদ্ধ থামেনি – বলা ভালো থামতে দেওয়া হয়নি। সেই সূত্র ধরেই বলি শুধুমাত্র অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে গোটা পৃথিবী জুড়ে দেড় শো’রও বেশি যুদ্ধ বা আন্তর্দেশীয় সংঘর্শের খবর জানা যায়। এই যুদ্ধ বা আন্তর্দেশীয় সংঘর্ষগুলির কারণে তিল তিল করে গড়ে তোলা তিলোত্তমা সভ্যতাকে যে ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল, পার্থিব ও মানবিক অর্থে, তাকে এক কথায় প্রকাণ্ডই। নির্মোহ দৃষ্টিতে যদি এই যুদ্ধ বা আন্তর্দেশীয় সংঘর্ষগুলির দিকে তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে নির্বিচারে বলি হয়েছে কখনও মানুষ অথবা মানবসৃষ্ট কোন এক বা একাধিক কালজয়ী সৃষ্টি। কিন্তু এই হিংসা, এই হানাহানি থেকে মানব সভ্যতা ঠিক কতখানি উপকৃত হয়েছে, বা কতটা ঋদ্ধ হয়েছে মানব সভ্যতা তার হদিস কি কেউ আমাদের দিতে পারেন?
এরপর বিশ শতকে সাক্ষী হয়েছিল দুটি রক্তক্ষয়ী বিশ্বযুদ্ধের। কেবলমাত্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই বলি হন কমবেশি এক কোটি কুড়ি লক্ষ মানুষ এবং আশঙ্কাজনক অবস্থায় আহত হয়ে পঙ্গুত্বপ্রাপ্ত প্রাপ্ত হন আরও দু’কোটি মানুষ। যদিও সংখ্যাগুলো নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক রয়েই গেছে। একদল গবেষক আজও মনে করেন আরও অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ বলি হয়েছিলেন। যুদ্ধ বিশেষজ্ঞদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মানব সম্পদের নিরিখে সর্বাধিক ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল রাশা এবং জার্মানিকে। ইতালি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে ১৯১৫ সালের মাঝামাঝি করলেও, ১৯১৭ সালে বিপুল সংখ্যক ইতালীয় সৈন্য ঐ রক্তক্ষয়ী বিশ্বযুদ্ধের বলি হন । এরপর কি হয়েছিল কমবেশি সকলেরই জানা। ভার্সাই-এর চুক্তি স্বাক্ষরিত হল ২৮ জুন, ১৯১৯ এবং তার শর্তাবলি বলবৎ হল ১০ জানুয়ারী, ১৯২০। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তৈরী হল লিগ অব্ নেশনস্ বিশ্বে সুখ-শান্তি বজায় রাখার লক্ষ্যে, কিন্তু বছর কুড়ি কাটতে না-কাটতেই দামামা বেজে উঠল আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের। পয়লা সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ হিটলার পোল্যাণ্ড আক্রমণ করে বসলেন। এই বিশ্বযুদ্ধ লাগর প্রশ্নে হিটলার ও তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত ace-race তত্ত্বের ভূমিকা ঠিক কতটা তা লিখে লেখাটিকে দীর্ঘায়িত করার ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু একথা সত্য যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কর্ত্তৃক আনিত ক্ষয়ক্ষতির পরিমান, পার্থিব এবং মানবিক অর্থে, কয়েক গুন প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের তুলনায়। সবচেয়ে সাংঘাতিক বিষয় ছিল অবশ্যই পারমানবিক পেশি শক্তির অনভিপ্রেত প্রয়োগ। মানবসভ্যতাকে অবর্নণীয় ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়েছিল দু’টি পারমানবিক বিষ্ফোরণের কারণে। একটি বহুল প্রচারিত মার্কিন দৈনিকে উত্তর সম্পাদকীয়তে একরকম বিজয়োল্লাসের ঢঙে লেখা হয়েছিল, “Now the scores stand settled. In fact, our boys have scored outrageously ahead of their Japanese counterparts who ventured to launch a lethal attack on Pearl Harbour. The Little Boy and the Fat Man have turned the two Japanese isles, Hiroshima and Nagasaki, into necropolises. The isles have literally ceased to exist.” কিন্তু প্রায় চমকে উঠতে হয় যখন আন্তর্জাতিক রেড ক্রস সোসাইটির প্রতিনিধিদলের কোন এক সদস্যের প্রশ্নের জবাবে প্যাসিফিক অঞ্চল সমূহের সামগ্রিকভাবে দায়িত্বে থাকা মার্কিন জেনারেল ম্যাক আর্থারকে বলে উঠতে শুনি –“The supreme value of human life is forgotten, and human dignity too… Force is not a solution for man’s problems. Force on its own is nothing. It never has the last word. Perhaps you find it strange that I, a professional soldier, should say that to you.”
এর থেকেও শিক্ষা নিয়ে উঠতে পারিনি আমরা। এরপরও যুদ্ধ দেখেছি ভিয়েতনামে, উপসাগরীয় অঞ্চলে, কঙোতে, বসনিয়া, সিরিয়া প্রভৃতি অঞ্চলগুলোতে। সাম্প্রতিকতম সংযোজন বোধহয় গাজা ভূখণ্ডে সংঘটিত হওয়া একান্ন দিনের যুদ্ধ। জুলাই ৮, ২০১৪ তারিখে অতর্কিত ইজরায়েলি বিমান হানায় প্রাণ হারান শিশু ও মহিলা সহ দু’হাজার সাধারণ মানুষ। রাস্ট্র সংঘের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী দশ হাজার বাসস্থল ভূলুণ্ঠিত হয় এবং তিন লক্ষাধিক গাজা ভূখণ্ডে বসবাসকারী মানুষ গৃহহীন হয়ে পরেন অতর্কিত বিমান হামলায়। কঙোতে, বসনিয়া, সিরিয়া, বা গাজার রাস্তার মোড়ে-মোড়ে মৃত্যুর মরিয়া হানা… ঘাড়ের কাছে ঘাতকের বিষাক্ত নিঃশ্বাস… ফুটপাথ রক্তাপ্লুত লাশ, সবই সদয় প্রভুর নামে…স্কুলে বাজারে…..মঠ মন্দির গির্জা মসজিদে……বিহার প্যাগোডা অথবা সিনাগগে…..গুলি বোমা আগুন ভাঙচুর…ছড়িয়ে ছিটকে পড়ে…..ছিন্নভিন্ন শিশু বালিকা বৃদ্ধ প্রৌঢ়ার দেহ…..নারী পুরুষের টুকরো-টুকরো হওয়া নিথর, প্রাণহীন মানবদেহের সারি ….পোড়া চামড়ার গন্ধ, …মানবতা মৃত্যুতে মন্ত্রপূত ইটে গাঁথা হয়েছে স্মারক স্তম্ভ, স্বদেশ আজ রক্তাক্ত – অনেকটা যীশুর ক্রুশবিদ্ধ ঋজু শরীরের মত…..সবই শান্তি ও ধর্মের নামে। এই জাতীয় খবর যখন পত্র পত্রিকায় পড়ি তখনই মনে পড়ে যায় ম্যাথ্যু আর্নল্ডের Dover Beach কবিতার শেষ তিনটি লাইন –

“And we are here as on a darkling plain
Swept with confused alarms of struggle and flight,
Where ignorant armies clash by night.”

এই হৃদয় বিদারক তথ্যসমূহ কখনও আবার মনে করিয়ে দেয় গ্রীসীয় ইতিহাসবিদ, থুসিডাইডেস্ বর্ণিত নৈশ-কালীন পেলোপনেসীয় যুদ্ধের কথা। সেই যুদ্ধে নিশুতি রাতে সহোদর সহোদরের রক্তাপ্লুত লাশের পাশে দাঁড়িয়ে পাশবিক আনন্দে তরবারি উচিয়ে দুনিয়ার কাছে চেয়েছিলেন তাঁর সামরিক পারঙ্গমের একমাত্র স্বীকৃতি। আজ যেটা হচ্ছে সেটাও বোধহয় পেলোপনেসীয় যুদ্ধের একবিংশ শতকের সংস্করণ। আমরাই আজ উদ্যত আমাদেরই হাতে তিল তিল করে গড়ে তোলা সহোদর প্রতিম তিলোত্তমা সভ্যতাকে বিনষ্ট করতে। এটাও কি সহোদরের হাতে সহোদরের মৃত্যু নয়?

শেষ একটা যুদ্ধ ঘোষনার সময় এসেছে আজ। যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনার। পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক… এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্য … আমাদের, আমাদের মত করে ভালো থাকার জন্য… গড়ব এমন একটা অচলায়তনমুক্ত পৃথিবী যেখানে যক্ষরাজেরা শুভ চেতনার পক্ষীরাজে সওয়ার হয়ে চাইবেন রঞ্জন, ঈশানীপাড়ার নন্দিনদের বন্ধুতা – ছুড়ে দেবেন ত্রাসমুক্ত, শোষন বর্জিত দুনিয়া গড়ার অমোঘ আহ্ববান… অথবা হল্লার রাজা মন্ত্রী আর তার দোসর বরফিকে ছুটিতে পাঠিয়ে গেয়ে উঠবেন – ও রে হল্লা রাজার সেনা! তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল!

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *