স্তব্ধ রেখার পাশে – পার্থজিৎ চন্দ (৮ম পর্ব)
অষ্টম পর্ব
Art does not reproduce the visible, rather it makes visible. A tendency towards the abstract is inherent in linear expression: graphic imagery being confined to outlines has fairytale quality and at the same time can achieve great precision. (Creative Confession- 1920/ Paul Klee)
মাত্র কয়েক পাতার গদ্য, তিনটি। বারবার তাদের কাছে ফিরে আসি; শিল্পের মৌলিক কিছু দর্শন ও ‘দেখা’র প্রশ্নে অসাধারণ তিনটি গদ্য। ১৯২০ সালের ‘ক্রিয়েটিভ কনফেসন’-এ পল ক্লি লিখছেন, ‘শিল্প যা দেখা যায় তার পুনর্নিমাণ নয়, বরং তা ‘অদৃশ্য’কে দৃশ্যমান্ করে তোলে।’
শুধু তাই নয়, যাবতীয় বিমূর্তের বীজ লুকিয়ে রয়েছে ‘লিনিয়ার’ প্রকাশের মধ্যে। কিছুটা পরে ক্লি আরও মারাত্মক উক্তি করছেন, ‘For space, too, is a temporal concept.’
কেন তিনি এ কথা বলেছিলেন? তাঁর এ কথা বলার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে গভীর দর্শন। কোনও ছবিই শুধুমাত্র ব্রাশিং দিয়ে তৈরি হতে পারে না, তার ভেতর আমাদের কিছুটা অগোচরে রয়ে যায় আরও অনেকগুলি বিষয়। ক্লি তার দিকে নজর দিতে বাধ্য করেছেন আমাদের, তিনি লিখছেন, ‘When a dot begins to move and becomes a line, this requires time. Likewise, when a moving line produces a plane, and when moving planes produces spaces. Does a pictorial work come inoto being at one stroke? No, it is constructed bit by bit, just like a house’.
শিল্পের যে ‘নির্মিত’ রূপ্ প্রত্যক্ষ করেন একজন দর্শক, সে নির্মিতির ভেতর ঘটে যায় কত কত বিষয়। পল ক্লি’র ছবির অদ্ভুত জগতে প্রবেশ করবার আগে সে পদ্ধতির দিকে নজর দেওয়া বিশেষ প্রয়োজন।
শুধু তাঁর ছবি বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রেই নয়, শিল্পের নির্মাণ পদ্ধতির সময়ে ঘটে যাওয়া বিষয় কতটা বহুস্তরীয় ও বহুমাত্রিক হতে পারে তার বেশ কয়েকটি উদাহরণ তিনি দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি উদাহরণ, যার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে রয়েছে ‘মুভমেন্ট’, ‘গতি’ ইত্যাদি বিষয়, উল্লেখ করা যেতে পারে। ক্লি বিষয়টিকে বোঝাতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন একজন আধুনিক মানুষের কথা; ধরা যাক সে একটি বোটের ডেকে হেঁটে বেড়াচ্ছে। এবার তার গতির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে
১। তার নিজের গতি
২। বোটের গতি (যা কিনা আবার তার গতির বিপরীত দিকেও হতে পারে)
৩। জলস্রোতের গতিবেগ ও দিক
৪।পৃথিবীর নিজস্ব ঘূর্ণন।
এ সমস্ত কিছুই কিন্তু ডেকের ঊপর হেঁটে বেড়ানো মানুষটির গতি-কে প্রভাবিত করছে, অথচ মানুষটি সে সম্পর্কে সচেতন থাকছে না সব সময়ে।
শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে যুক্ত হবে
৫।পৃথিবীর কক্ষপথ, এবং
৬। পৃথিবীর থেকে অকল্পনীয় দূরত্বে অবস্থান করা গ্রহ ও নক্ষত্রের কক্ষপথ।
ক্লি আরও বলছেন, প্রায় জেন-সাধকদের কথার কাছাকাছি এসে প্রজাপতির মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্লি’র কথাগুলি – ‘ফলেফুলে ভরা একটি আপেলগাছ। শিকড় নেমে গেছে গভীর, রস শুষে নিয়ে সে পাঠাচ্ছে পাতায় পাতায়। গাছের গুঁড়িটিকে কাটলে দেখা যাবে প্রতিবছর একটি একটি করে রিং তৈরি হয়েছে। আপেলফুলে পরাগ-সংযোগ ঘটেছে, আপেলের এটাই যৌনতা। এ গাছের বেড়ে ওঠা, আকৃতি, যৌনতা, ফল ও ফলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বীজ- এ সব নিয়েই সামগ্রিক ‘বৃদ্ধি’। পরিপূর্ণতা।’
এখান পর্যন্ত পড়ে অনেকেই হয়তো ক্লি’র ছবি নিয়ে কয়েকটি কথা বলার মধ্যে ‘জেন’ শব্দটি দেখে সন্দেহ করতে শুরু করবেন। সন্দেহ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে ওঠার ফলে তারা এই লেখাটিকে বাতিল করেও দিতে পারেন। কিন্তু আমার এ সময়ে দাঁড়িয়ে, জেন-এর সঙ্গে দীর্ঘ দীর্ঘ দিন কাটাতে কাটাতে মনে হয় শিল্প ও শিল্পীর মধ্যে সম্পর্কের নিহিত সমীকরণের সঙ্গে জেনের অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। ক্লি তাঁর এই সিরিজের ‘ওয়েজ অফ নেচার স্টাডিজ’ (১৯২৩)-এ বলছেন, ‘I and you, the artist and his object, sought to establish optical-physical relations across the invisible barrier between the ‘I’ and the ‘you’. … The artist of today is more than an improved camera, he is more complex, richer, and wider. He is a creature within the whole, that is to say, a creature on a star among stars.’
‘তুমি’ এবং ‘আমি’র মধ্যে যে অদৃশ্য সীমারেখা সেটিকে অতিক্রম করে সম্পর্ক স্থাপন করাই শিল্পীর উদ্দেশ্য। ক্লি কি ‘তুমি’র ‘আমি’ হয়ে ওঠা এবং ‘আমি’র ‘তুমি’ হয়ে ওঠার দিকে ইঙ্গিত করলেন? ঠিক একই বিষয় বলা হয়ে থাকে জেনের পথ ধরে চা-পান পদ্ধতির ক্ষেত্রে। ‘হোস্ট’ এবং ‘গেস্ট’ ধীরে ধীরে তাঁদের স্থান পরিবর্তন করতে থাকেন। গেস্টের হোস্ট হয়ে ওঠা এবং হোস্টের গেস্ট হয়ে ওঠার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে জেন-দর্শনের মূল-সুর এবং শিল্প-শিল্পীর মধ্যে সম্পর্ক বহুদূর পর্যন্ত হয়তো এই এবং এই-ই।
২
A & B have been arguing long, aver a bottle
Of wine, about their diametrically opposed
Points of view. But asw they approach
That stage where drink moves the heart.
Each one is moved to such fiery speech
That A suddenly finds himself drawn
To point A, and A, to point B. Faces a-glow
They reach out, their hands meet in bewildered clasp.’
শিল্প দৃশ্যমানের পুনরুৎপাদনের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে না, ক্লি’র ‘সেনিসিও’ ছবিটির মধ্যে সে কথা আরেকবার অতি-স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ছবিটির মধ্যে কিউবিজমের ধারা স্পষ্ট। ক্যানভাসটিকে জটিল জ্যামিতিক নানা আকারে ভেঙে নিয়েছিন শিল্পী। ছবিটির নামকরণের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে senile শব্দটি।
(Senecio)
হলুদ, লাল ও কমলা রঙের গাঢ় ব্রাশ-স্ট্রোক ক্যানভাসটিকে করে তুলেছে ঈষৎ বিষণ্ণ। কীভাবে একজন ব্যক্তিমানুষের মাথার ভেতর ক্রমশ ঢুকে পড়তে থাকে মেঘ… কীভাবে ধূসর ও আবছা হয়ে আসে তার চারপাশ- এ ছবিটির কাছে এসে তাকে যেন ছোঁয়া যায়। হলুদ-কমলা ছোপের মাঝখানে জেগে রয়েছে বৃত্তাকার একটি ‘মুখ’, তার বাম-দিকের ভ্রু কিছুটা উপরে উঠে রয়েছে। ক্রমশ অস্পষ্ট ও জটিল হয়ে আসা ‘জীবনের’ দিকে কি সে ভ্রু কুঞ্চন করে তাকিয়ে রয়েছে? লক্ষ করার, ক্লি চোখ ও ঠোঁট দুটিকে সরলরেখায় স্থাপন করেননি। ছবির মানুষটির গ্রীবায় যেন ভর করে রয়েছে উটের গ্রীবার নিস্তব্ধতা।
এবং ছবিটি দেখতে শুরু করলে, বারবার দেখলে মনে হওয়া স্বাভাবিক, যেন দুটি মানুষ তাকিয়ে রয়েছে দু’জনের দিকে। কারণ ছবিটি দ্বিপার্শ্বীয়ভাবে প্রতিসম।
এখানে আরেকটি গূঢ় প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে স্তম্ভিত হয়ে যেতে পারেন যে কেউ। তা হলে কি মাথার ভেতর ধূসর মেঘের ভার নিয়ে এক ব্যক্তির সত্তা বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে দু’টি অংশে এবং একটি অংশ আরেকটি অংশ’কে চিহ্নিত করতে পারছে না? না কি একই সত্তার ভেতর লুকিয়ে থাকা, মগ্ন পাহাড়চূড়ার মতো লুকিয়ে থাকা দুটি অংশ এ মুহূর্তে আবিষ্কার করছে তাদের ‘অভিন্নতা’? ‘You’ এবং ‘I’-এর মধ্যে ঘনিয়ে থাকা যে চিরায়ত দ্বন্দ্ব ও প্রশ্ন দর্শন-কে তাড়িয়ে ফিরেছে এ ছবি যেন তার মূর্ত প্রকাশ।
‘ছবি’ ও ‘টেক্সট’-এর মধ্যে শুয়ে থাকা, ঘনীভূত হয়ে থাকা দেওয়ালটাকে সারাজীবন একটু একটু করে ভেঙে দিতে চেয়ছিলেন ক্লি। তাঁর কবিতায় যেমন ‘ছবি’র উপস্থিতি, ঠিক তেমনই তাঁর ছবির ভেতর কবিতার উপস্থিতি স্পষ্ট হয়ে ফুটে থাকে।
‘ফ্লক অফ বার্ডস’ ছবিটির কাছে আসার আগে ক্লি-র সেই ‘ক্রিয়েটিভ কনফেশন’-এর কাছে আরেকবার ফিরে যাওয়া জরুরি। ক্লি লিখছেন, ‘Let us develop this idea, let us take a little trip into the land of deeper insight, following a topographic plan. The dead centre being the point, our first dynamic act will be the line. After a short time, we shall stop to catch our breath (the broken line, or the line articulated by several stops). I look back to see how far we have come (counter-movement). Ponder the distances thus travelled (sheaf of lines). A river may obstruct our progress: we use a boat (wavy line). Further on there might be a bridge (series of curves).
On the other bank we encounter someone who, like us, wishes to deepen his insight. At first we joyfully travel together (convergence), but gradually difference arise (two lines drawn independently of each other). Each party shows some excitement (expression, dynamism, emotional quality of the line)….
Lines of the most various kinds, spots, dabs, smooth planes, dotted planes, obstructed and articulated movement, counter-movement, paintings, weavings, bricklike elements, scale-like elements, simple and polyphonic motifs, lines that fade and lines that gain strength (dynamism).’
(Flock of Birds)
যে গতির কথা বারবার ফিরে আসে ক্লি’র লেখায় ও ভাবনায় ‘ফ্লক অফ বার্ডস’ তার সার্থক উদাহরণ। ক্লি ক্যানভাসে ব্যবহার করেছিলেন আকাশি, হালকা-হলুদ, হালকা-বাদামি রঙ। তাদের বিভিন্ন শেডস। এবার পাখিগুলির দিকে তাকানো যাক, ক্লি যা বিশ্বাস করতেন যা যেন উজাড় করে দিয়েছিলেন ছবিটিতে। প্রতিটি লাইন গতি সঞ্চয় করছে, প্রতিটি রেখা তাদের গতি নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ক্যানভাসে। স্থিতিশক্তি রূপান্তরিত হয়ে চলেছে গতিশক্তি’তে। কেন্ ক্যানভাসে তারা-চিহ্নের পাশেই ফুলে রয়েছে ফলিয়েজ, কেন অদ্ভুত সব জ্যামিতিক আকৃতি ছড়িয়ে রয়েছে আর কেনই বা তীক্ষ্ণ-চঞ্চু পাখি নেমে আসছে মাটির দিকে তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। ক্যানভাসের ডান ও বামদিকে মুখ করে কয়েকটি পাখি হেঁটে বেড়াচ্ছে। নিবিড় পরাবাস্তবতা থেকে জেগে ওঠা কিছু কিছু পাখি। তারা পৃথিবীর পাখির মতই, অথচ তার ‘ঠিক’ পৃথিবীর পাখি নয়- রয়েছে অনুচ্চ পাহাড়ের ইশারাও। জীবনের এসব ‘বাধা’ কি অতিক্রম করে চলে যেতে চেয়েছে পাখিগুলি? না কি বাস্তবতার বহু স্তরের মধ্যে আমরা প্রত্যক্ষ করছি শুধুমাত্র একটিকেই? ছবিটির সব থেকে বড় আকর্ষণ, তার অবিশ্বাস্য ‘সিমপ্লিসিটি’… যেন এইমাত্র ঘুম থেকে উঠে কেউ এঁকে রাখছে তাঁর স্বপ্নে পাওয়া একটি চিত্র।
তুলনায় ‘ক্যাসল এন্ড সান’ ছবিটি ‘জটিলতর’।
(Castle and Sun)
সারা ছবি জুড়ে রঙের সন্ত্রাস, ত্রিভুজ-চতুর্ভুজ-কিউব আকৃতির ভেতর রঙ পুরে দিয়েছেন ক্লি। টাওয়ারের মতো উঠে গেছে তারা। সব দুর্গের উপর আজ এসে পড়েছে সূর্যের আলো।
ক্যানভাসের ভিতর গতি ফুটিয়ে তোলার অকল্পনীয় দক্ষতা ছিল পল ক্লি’র। এ ছবিটিতে যেভাবে গতির সঞ্চার হয়েছে তা কল্পনাতীত। ক্যানভাসের নিচের দিক থেকে শুরু হয়েছে ত্রিভুজের ব্যবহার। মাঝ-বরাবর গিয়ে ত্রিভুজের সংখ্যা সব থেকে বেশি হয়েছে। ফলে গতির সঞ্চার হয়েছে তীব্র।
ছবিটির দিকে তাকিয়ে, এ রঙের সন্ত্রাসের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে অদ্ভুত ভয়’ও গ্রাস করে। এই যে অনতিক্রম্য প্রাচীর, এই যে দুর্গের সার… কী ঘটে চলেছে তার পিছনে? মানুষের তৈরি এ দুর্গের সার, এই রঙ মহাকালের নিচে দাঁড়িয়ে তিরতির করে কাঁপছে। ক্ষণকালের কম্পন… ক্ষণকালের রঙ। হয়তো মুছে যাবার জন্যই তার সৃষ্টি।
(Puppet Theatre)
ক্লি’র ছবির মধ্যে লুকিয়ে থাকা শিশুর সারল্যই কি তার সব থেকে বড় সম্পদ? ‘পাপেট থিয়েটার’, ‘দ্য গোল্ডফিস’, ‘ডেথ এন্ড ফায়ার’ ছবিগুলির দিকে তাকিয়ে সে ধারণা পুষ্টতা পায়।
ক্যানভাসের নিচের দিকে, একদম মাঝখানে একটি পাত্র উলটে রয়েছে। একটি পড়ে থাকা পুতুল, ক্যানভাস থেকে বেরিয়ে যেতে চাওয়া এক চতুস্পদ, বাদামি রঙের মাটি, যেন কতকাল সূর্যের আলো পড়েনি তার বুকে। ক্যানভাসটি বাম ও ডানদিকের সমতা রক্ষা করেছে দু-দিকে উঠে যাওয়া সিঁড়ি। পর্দা সরে গিয়ে বাম-দিকের সিঁড়িটি আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। সূর্য রয়েছে বামদিকে, তবে সে সূর্য বাচ্চাদের ছবিতে ফুটে ওঠা খেলার সূর্য। জীবনের রঙ্গমঞ্চে ওই পুতুল-অবস্থানের থেকে বেশি কোনও ভূমিকা নেই আমাদের।
(Death and Fire)
ক্লি’র সব থেকে বেশি চর্চিত ছবিগুলির মধ্যে ‘ফ্লাওয়ার মিথ’ অন্যতম। এ ছবিটিতেও উপাদানের বাহুল্য নেই, প্রায় গোটা ক্যানভাসটিকেই
ক্লি গাঢ় লাল রঙে ভরিয়ে দিয়েছেন। উপরের দিকে যথাক্রমে বাম ও ডানদিকে রয়েছে একফালি চাঁদ ও সূর্যের ইশারা। তাদের নিচে একটি চারা গাছ বেড়ে উঠছে, ঠিক যেন দু-হাত দু-দিকে প্রসারিত করে আনন্দে উদ্বেল হয়ে থাকা শিশুর উচ্ছ্বাস ছেয়ে রয়েছে তাকে। তার চারদিকে আরও ছোট ছোট গাছ।
ক্লি গাছের মূলটিকেও চিত্রিত করে গেছেন, দেখাতে চেয়েছেন মাটির ভেতর ঘটে যাওয়া খেলা।
এখান পর্যন্ত ছবিটি একটি মাত্রায় অবস্থান করছে, কিন্তু ক্লি তাঁর সিমপ্লিসিটির মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন অসামান্য কিছু ইশারা।
(Flower Myth)
এবার ছবিটির দিকে আরেকবার তাকানো যাক, দেখা যাবে ছবিটির নিচের দিকে মাঝখানে, উপরের দিকে মাঝখানে এবং দু-পাশের মাঝখানে ত্রিভুজাকৃতি চারটি চিহ্ন ব্যবহার করেছেন। হঠাৎ মনে হতে শুরু করবে নিচের ত্রিভুজটি যোনিদেশ, উপরের ত্রিভুজটি স্তন-বিভাজিকা এবং দু-পাশের দুটি ত্রিভুজাকৃতি কোনও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী নারীর কটতট-কে নির্দেশ করছে।
শুয়ে আছে এক পরিপূর্ণ নারী, তাঁর নাভি থেকে বেড়ে উঠছে গাছ। তাঁর সারা শরীর জুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে চাঁদ-সূর্য।
এ ব্রহ্মাণ্ড আসলে এক নারী-শরীর, যাকে আশ্রয় করে বয়ে চলেছে প্রাণের বিচিত্র ধারা।
শিল্প উপাদানের ‘বাহুল্যে’ নয়, উপাদানের প্রয়োগের অমোঘতায় সার্থক হয়ে ওঠে। ক্লি’র ‘টুইটারিং মেশিন’ এ কথাটিকে বারবার প্রমাণ করে চলেছে। জলরঙ আর কালি’তে কাগজের উপর ফুটে ওঠা এ ছবিটির মধ্যে রয়েছে কাঁটাতার। তার উপর বসে থাকা চারটি পাখি তাদের চিৎকার ছড়িয়ে দিচ্ছে শূন্যে। হয়তো কেউ শুনবে না কোনও দিন, তবু এ চিৎকার তাদের ছড়িয়ে দিতেই হবে। এটাই তাদের নিয়তি।
(Twittering Machine)
ক্লি পাখির থেকে শুষে নিয়েছেন তাদের গান, সেখানে প্রতিস্থাপন করেছেন চিৎকার। শিল্প ও শিল্পী কি আসলে এই নিয়তিই বহন করে চলে? বরফের প্রান্তরের দিকে চিৎকার ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া হয়তো আর কোনও ভবিতব্য নেই তার।
ক্লি তাঁর ‘মাই স্টার’ কবিতায় লিখেছিলেন,
‘My star
Rose deep
Below
My feet
Where does my fox
Go in the winter?
Where does my serpent
Sleep?’
-একজন কবি ও শিল্পীর সঙ্গে বারবার দেখা হয়ে যায় ঈশ্বর ও শয়তানের। হয়তো ঈশ্বরের থেকেও বেশি শয়তানের। তাঁর পায়ের নিচে খেলা করে তারা, কিন্তু তিনি ছাড়া কে বরফের দিনে সন্ধান করবেন ‘ব্যক্তিগত’ শৃগাল ও সর্পের? শিল্পের সঙ্গে ‘সুন্দর’ ও ‘সন্ত্রাসের’ এই অদ্ভুত সম্পর্ক আবহমানের। ক্লি’র ছবি ও কবিতার কাছাকাছি এলে সেটি আরও বেশি করে অনুভব করা যায়।