শনিবার আসে – বনমালী মাল
এখন একটু বেলা করেই ঘুম থেকে ওঠেন তিনি। কিংবা শীত যেকোনো কালেই। সকাল কিছুটা গড়িয়ে গেলে ধীরে ধীরে দুয়ারে এসে বসেন। কোনো তাড়া নেই। নিশ্চিন্ত মানুষের মতন মুখ। জমাট ঘুমের ফোলা ফোলা চোখে আলো এসে পড়ে। বুকের মাঝখানে কাঁচা পাকা লোমের ভেতর আঙুল বোলাতে বোলাতে রয়ে-বসে হাই তোলেন। আড়মোড়া ভাঙেন। প্রতি সকালে উঠে অন্য মানুষের মতো তাঁর এখন কোনো তাড়া থাকে না। সূত্র সমাধান মেলানোর জন্য বিশুর মতো তাড়াতাড়ি ঘুম ছাড়াতে হয় না। তারপর চপ্পল পায়ে গলিয়ে বাইরে যাওয়া—বাড়ির সকলের মুখ দেখা আর তাদের—তাহাদের আরও অনেক অনেক কিছু, তিনি এগুলো কিছুই করেন না। অসিত আর কানাইয়ের মতো যারা এখনও দূরের দৃষ্টিতে দুর্বল, তারা পাড়া আর পড়শিদের খবর নেওয়ার জন্য হাঁক দেয়। নিরীহ মানুষের মতন কান পাতে। ঘর আর বাইরের লোকের কাছ থেকে জানকারি নেওয়ার মতো বাকি আছে শুধু রাতের ঘুম আর ঘুমের স্বপ্ন জানতে। তারা চিন্তিত হয়ে সেসব শোনে, ভাবে।
কিন্তু তিনি এগুলোর কোনোটাই করেন না। শুধু তাই নয়, এগুলোকে তিনি এক জ্যান্ত মূর্খামি বলে মনে করেন। মানুষের কাছ থেকে নতুন খবর জানতে চাওয়াই তো বৃথা! আসলে মরে মরে স্থির পাথর হয়ে যাওয়া কয়েকটা দিন পাঁজির হিসাবে এদিক-সেদিক করে আসে। তারা সবাই আদতে এক। কিচ্ছুটি নতুন নেই। সব আগের মতো। শীতল কিংবা ছাঁচে ফেলা।
এতকিছু দেখেশুনে মানুষ যদি শেষ পর্যন্ত মানুষই থেকে যায়, তবে লাভ কী! জানতে চাওয়ার পেছনেও যে একটা হিসেব আছে! সেই হিসেবের শেষও আছে! দুটো বা তিনটে মুখ হয় মুখোমুখি হবে নয়তো একে অপরের পেছন করে দাঁড়িয়ে থাকবে। এই সোজা হিসেবটা একটা সময়ে এসে মিলে যেতে বাধ্য। তিনি বুঝে গেছেন। বছর খানেক আগে থেকেই তাঁর এই ধারণা হয়েছে, আগের দিন আর তারও আগের যে দিন, ঘটনা আর ভাবনাগুলো একসঙ্গে করে একটা জপমালা রাখার মতো থলিতে পুরে দাও, নাড়িয়ে নাড়িয়ে ফেলে দাও মেঝেতে, তোমার তৃতীয় দিনের ভালো আর মন্দ থাকাগুলো বেরিয়ে আসবে। হয়তো একটু অগোছালো হবে কিন্তু মিলে যাবে টো টো!
সবাই জানে, সেই দিনটি ছিল সপ্তাহের সবথেকে পয়া কিংবা অপয়া দিন। শনিবার দিনটায় মাঠ থেকে দূরে থাকা উচিত বলে সাময়িক বিরামে পাড়ার সব পুরুষ-স্ত্রী পার্টি পঞ্চায়েত আর আসন্ন বিবাহের দিনগুলো নিয়ে কথাবার্তা চালাচ্ছিল। সরকার এবার ধান চাষের জন্য ভর্তুকি দেবে কিনা সেই বিষয়ে একজন প্রৌঢ় কথা তুললে একজন জোয়ান মতো পুরুষ তার ফাটা ফাটা তলি পা মেলে দিয়ে বলল, “আগের বিধানসভা থিকে ইসব শুনে শুনে আসিঠি…”
সেই দিন, সেই শনিবার তাঁর মাথায় চিন্তাটা খেলে যায়। দু’হাতে মেলে ধরা পেপারের কাগজে তাঁর চোখ থাকেলও আবছা কতগুলো শব্দ আর মানুষের এলোমেলো মুখ জলপোকার মতো অস্থির ঘোরাঘুরি করে এক জায়গায় এসে বসছে! এক এক মানুষ! একই ঘটনা! একই শব্দ!
প্রতিদিন সকালে উঠে তিনি খবরের কাগজের উপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েন। বিয়াল্লিশ বছর বয়সে এসে বাকি জীবনটা কাটানোর জন্য মানুষকে অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করতে হয় যে! অনেক সমঝে চলতে হয়। আবহাওয়া থেকে কখন কোন্ খবর আসছে, ধানের দামের বাজার কোন্ মুখী—সব। অথচ পেপারের প্রথম পাতার বড়ো কালো অক্ষরে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে যে খবরটা, সেটা তো তিনি কয়েকদিন আগেই অন্য কোনো একটা পাতায় পড়েছিলেন! তাঁর বেশ মনে আছে!
দুটো হাত কাছাকাছি এনে তিনি পেপারটা বন্ধ করলেন। চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করলেন, সীমান্তে তিন জঙ্গি নিকেশ! বড়োসড়ো সাফল্য সেনার! শিরোনামের নীচে দেওয়া ছবিটা পর্যন্ত আবছা আবছা তাঁর চোখে ভাসছে! ইনসেটে দেওয়া ছিল আরও একটা ছবি! উল্লাসে আত্মহারা নগরবাসীর!
সকালের জুড়িয়ে যাওয়া চা তাঁর কাছে সংসার আর মানুষকে বাসি করে দিচ্ছে! কোন্ এক নতুন জগৎ আবিষ্কার করতে চলেছেন তিনি!
সেদিন তাঁর মাঠে যাওয়ার কথা ছিল না অথচ পেকে যাওয়া ধানের দুশ্চিন্তা ছিল! বউয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে বাজার আনার দিন ছিল! বেলা বয়ে যাওয়া রোদ আরও তীব্র হয়ে সেঁধিয়ে থাকা তাঁকে উদ্ধারের জন্য এসেছিল। অথচ সবাইকে—সবকিছুকে মন্ত্রবলে স্থানু করে দিলেন তিনি! তাঁর স্ত্রী ডাকছে না! তিন মাসের পোয়াতি ধানগাছগুলোর নুয়ে পড়া আটকে গেল! একা তিনি কেবল একটা নতুন আবিষ্কৃত জগৎ নিয়ে আঙুলের ডগায় ঘোরাতে লাগলেন! এতদিন ধরে মানুষকে ফাঁকি দেওয়ার এমন একটা পন্থা তাঁকে কিন্তু ফাঁকি দিতে পারেনি!
সেদিনটা শনিবার ছিল। এত এত বছরের প্রতিদিনের অভ্যাসকে তিনি পাশে সরিয়ে রাখলেন। এইসব দিনগুলোতে যে বাতাসকে মানুষ ভয় পায়, সেই বাতাসে পেপারের পাতাগুলোকে উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়তে দেখলেন তিনি। স্থির যেন বিপন্ন, উজ্জ্বল যেন সুখী। শনিবারের মুখর পাড়ার ঠিক মাঝামাঝি একটা ঘরের দুয়ারে তিনি আর তাঁর আবিষ্কারক স্মৃতি। একের পর এক খবর আওড়ে যাচ্ছেন! কাগজে যা যা খবর আছে, থাকা উচিত সব চোখ বন্ধ করে ঠক ঠক বলে যাচ্ছেন!
বুকের ভেতর একটা স্পষ্ট ওঠানামা অনুভব করলেন তিনি!
পেয়েছেন! এখন শুধু মিলিয়ে নেওয়ার পালা। কিন্তু কাউকে কাছে রেখে মেলাতে পারলে ভালো হয়! অন্তত স্ত্রীকে তো রাখা যায়! এমন একটা মুহূর্তের সাক্ষী করে রাখার জন্য! এখনও আনন্দে তাঁর গলা কাঁপছে। ডাক দিলেন তিনি!
এত বছর ধরে সখের বশে পেপার পড়া আর বাঁচার বশে চাষ যেন তাঁকে কতটা পথ পার করে দিয়েছে! কত কিছু শিখিয়ে গেল! কাঠা প্রতি দেড় মন কিংবা পাঁচশ আশি টাকা মন ধানের বাজারের হিসাব যে মানুষটাকে সারাজীবন মাতিয়ে রেখেছিল, সেই হিসাব আজ তাঁর এমন কাজে আসতে পারল!
তাঁর স্ত্রী এলেন হাতের কাজ ফেলে। চা ভর্তি কাপ দেখে কিছু একটা বলতে যাবেন এমন সময় তিনি এক অঘটন ঘটানোর তাগাদায় তাঁকে থামিয়ে দিলেন। হাতে তুলে দিলেন মেঝেতে পড়ে যাওয়া পেপারটা।
সেইদিন থেকে, সেই শনিবার থেকে আজ পর্যন্ত তিনি প্রতিদিন পেপারের কাগজ নেন। অথচ পড়েন না। না পড়েই বলে দিতে পারেন কোন্ কোন্ পাতায় কী কীভাবে খবর আছে! কখনও দৈবাৎ শিরোনামে সামান্য চুক হলেও মূল বিষয় আর চরিত্রে কোনো ভেদ হয় না। সামনে একজনকে রাখেন। তার হাতে ধরিয়ে দেন কাগজটা। তিনি বলে বলে যান, সামনের জন থ মেরে তাকিয়ে তাকিয়ে নির্বাক বনে যায়। এমনই হয়ে আসছে।
এ এক নিবিড় আনন্দ! তাঁর মতো একজন মানুষ বিয়াল্লিশ বছর বয়সে এসে এমন কিছু একটা করতে পারছেন! মানুষকে সামনে দাঁড় করিয়ে বোবা বানিয়ে দেওয়ার মধ্যে এত সুখ! প্রথম প্রথম একটু আধটু ভুল হত। অমিল হলেই চোখ দুটো বন্ধ করে নিজেকে একা করে নিতেন। বিড়বিড় করে কী যেন হিসেব করে নিতেন! তারপর সব ঠিক ঠিক।
চল তবে আমরা একটা গান গাই
কী গান গাইবি!
যেকোনো একটা গান!
হ্যাঁ হ্যাঁ যে কোনো একটা গান গাইলেই হল…
কানে কানে একজন ফিসফিস করে একটা গানের নাম বলল, অমনি চিৎকার আর বেসুরে মেতে গেল তারা। হেসে হেসে ঢলে পড়ল পাড়ার মেয়েরা। উদ্দাম তারা, নাচ আর গান শেষে একজন আরেকজনের চুলের সঙ্গে একটা করে গিঁট বেঁধে নিল! কোনো একজন দুর্ভাবনায় পড়ে যেন অন্যমনস্ক না হয়, তাই এমন। গোল হয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তারা। যেন কোনো একটা মধ্যবর্তী জিনিসের উপর তাদের চকচকে চোখ স্থির হয়ে আছে! এক একজন শুধু চোখ বন্ধ করে শুনিয়ে যায় গত রাতের দেখা স্বপ্নের মনে থাকা অংশটা—
“একটা দুরন্ত ঘোড়া তার ঘাড় আর লেজের লোমগুলো ফুলিয়ে এমনভাবে দৌড়ে যাচ্ছে, যেন সে দিন দিন মাটি ছেড়ে যাওয়ার ক্রম অভ্যাস করছে!”
ঠিক এমন একটা স্বপ্ন কেউ একজন দেখতে পারলেই সে নতুন কয়েকটা আগামী দিন পাবে। জড়ো হয়ে ঝুঁকে পড়া লোকগুলো কেউ সত্যিকারের এমন স্বপ্ন দেখে। আবার কেউ এমনকি একটা মাটির ঘোড়াও কোনোদিন দেখেনি, অথচ নতুন দিনের আশায় এমন একটা স্বপ্ন নিখুঁত আবৃত্তি করে! দৈবাৎ যদি আসে! নতুন কয়েকটা দিন! চমক নিয়ে!
এখন গরমের ঘাম তাঁকে অন্যমনস্ক করে দেয়, বিশেষ করে শীতকালে তিনি তাঁর চামড়ার ফেটে যাওয়া চিড় স্পষ্ট অনুভব করতে পারেন। যে বিদ্যা তাঁকে একদিন আবিষ্কারের আনন্দ দিয়েছিল, কয়েকদিন পর সেই আবিষ্কারই তাঁকে নতুন করে বুঝিয়ে দেয় মুখ তুলে হেঁটে বেড়ানো নির্বোধ মানুষগুলোর নিয়তি! তেমনই একটা সকাল, তেমনই একটা শনিবারে তিনি খুঁজে পেলেন মানুষের এই নিয়তির চক্র। মাটি জল আর ধানগাছের তিন-চারমাসের ব্যবধানে তারা সময়ের রোপণ আর ছেদ বুঝেছে শুধু কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতিটা সকাল আর সন্ধ্যা যে আদতে এক, তারা বুঝতে শেখেনি। যে অসার সুখ শরীরে আর মনে নিয়ে প্রতিটা মানুষ খবর শোনে আর রাষ্ট্রের দিকে ওৎ পেতে তাকিয়ে থাকে, যারা এখনও সহজ একটা সত্যি বুঝে উঠতে পারেনি, তাদেরকে দেখিয়ে-শুনিয়ে কিছু একটা করা যায়! যত দিন যাচ্ছে আর সকালের পর সকাল তাঁর কাছে খবরগুলো নিখুঁতভাবে মিলে যাচ্ছে, ভয়ে-ভাবনায় তিনি সেঁধিয়ে যাচ্ছেন! চোখ খুলতে পারছেন না! উন্মুখ হয়ে অনেক অনেকগুলো পায়ের শব্দ শোনার চেষ্টা করছেন। হয়তো সবাই বুঝেছে! হতে পারে, সবাই মিলে আজ তাঁর সঙ্গে বসে একসঙ্গে খবর মুখস্থ বলবে!
নিছক খেলার মতো করে তিনি যা শুরু করেছিলেন, যা নির্ভুলভাবে করতে পারার পর তিন চার রাত্রি তিনি ভালো করে ঘুমোতে পারেননি অথচ একটু গাঢ় ঘুম এলেই তিনি হয়তো এই বিষয়ে আরও কিছু নিখুঁত প্রক্রিয়া আবিষ্কার করতে পারতেন! পারলেন না। দিনের পর দিন রোগা হতে লাগলেন, আর তাঁর স্ত্রী তাঁকে সময়ে সময়ে মনে করিয়ে দিলেন, বাস্তবটা না ভুলে যেতে!
“তুমি একটা রাত অন্তত ভালো করে ঘুমাও, ভগবানের দোহাই। অনেকদিন স্বপ্নে ঘোড়া না দেখার জন্যই দিন দিন তুমি এমন হয়ে যাচ্ছ!”
স্ত্রীর এমন সমাধানে ভেতরে ভেতরে ফেটে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে তাঁর! ইচ্ছে হচ্ছে, প্রতি শনিবারের ওই গোল হয়ে থাকা মানুষের বৃত্তে গিয়ে স্বপ্নের ঘোড়াটাকে খুন করতে! গুমরে কান্না আসে তাঁর।
এক একদিন হাতের কাছে কেবল তিনি বিষ্ণুকে পান। বছর তিরিশের ছেলেটা প্রতিদিন খোঁড়া একটা পা নিয়ে এই রাস্তা ধরে হাসপাতালে যায় কিংবা অঞ্চল অফিসে ছোটে। এতদিনেও সে একটা প্রতিবন্ধীর কার্ড জুটিয়ে উঠতে পারেনি। বিষ্ণু বয়সে ছোটো বলে নয়, আসলে আগামী দিনে তাদের জন্য সরকারের চিন্তাভাবনা কী, জেনে নিতেই তাঁর কাছে এসে বসে। বিষ্ণু জানে, প্রতিদিন তাকে শুধু ওই পেপারের খবরগুলো মিলিয়েই যেতে হচ্ছে। তবু সে উপেক্ষা করতে পারে না। আসে। আর এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় যে, তড়িঘড়ি রাস্তাটা পেরিয়ে যেতে পারলে, তাকে আর এখানে আটকে পড়তে হত না।
এমন একটা ফাঁকির কথা সবাইকে বোঝানোর জন্য তিনি কম চেষ্টা করেননি! প্রতিদিন কাউকে না কাউকে ডেকে এনে সামনে বসান। অথচ পাড়া আর গ্রাম, গ্রামের লোকেরা নিজেদের মধ্যে রটিয়ে নিল,
“প্রথম দিনটা যেহেতু শনিবার ছিল, তাই আমাদের মনে হয়, এটা স্রেফ মা শীতলার কৃপা ছাড়া আর কিছুই নয়।”
এতদিনে তিনি নিজের অজান্তেই কেমন দক্ষ হয়ে উঠেছেন। ঈশ্বরের দক্ষতা মানবশরীর নির্মাণে কিন্তু তিনি! তিনি তো গোটা হাতের মাখা মাখা প্রলেপে মানুষের ভাবনা আর চিন্তাকে গড়ে তুলছেন! এমনকি ঈশ্বরও! এখন হাসি কিংবা দুঃখের ছবি সামনে এলে নিজের মতো করে গম্ভীর হয়ে পড়েন তিনি। স্ত্রী-ঘর-পাড়া সবকিছু দেখতে দেখতে বুঝতে বুঝতে তিনি দৃষ্টি স্থির করে ফেলেন। ক্রমশ একা। যিনি রাষ্ট্রের সব খুঁটিনাটি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারেন, তাঁর কাছে অজানা আর কী আছে! এদিকে দিন দিন যত নির্ভুলভাবে তিনি খবরগুলো মিলিয়ে দিতে পারছেন, তত মানুষের কাছ থেকে সরে সরে যাচ্ছেন!
একদিন এমন একটা শনিবার এসেছিল, যেদিন সকালে তিনি সত্যিই কাউকে পেলেন না! এমনকি বিষ্ণুকেও দেখতে পেলেন না! কতগুলো খবর ঠোঁটে নিয়ে উসখুস করছেন। রাস্তায় লোক চলাচল খাঁ খাঁ! শুনেছেন, কাল সন্ধ্যার আগে গ্রামে কে যেন একজন মারা গেছে।
সে হোক না! মৃত্যু তো কোনো নতুন ঘটনা নয়! নতুনের লোভ নিয়ে এত এত মানুষ শেষে কি মৃত্যুকে নতুন বলে ধরে নিল! যেখানে জীবনের কোনো নতুনত্ব নেই, মৃত্যু কি পারে মানুষকে নতুনের জালে বাঁধতে!
সকালের বাঁকা রোদ থেকে খবরের কাগজটা ছায়ায় সরিয়ে রেখে তিনি পা বাড়ালেন। রাস্তার ধারে কানাইয়ের গরুর গায়ে একটা কেঁট লাল টকটকে হয়ে ঝুলে আছে। হাঁটতে হাঁটতে তিনি চলে গেলেন কতগুলো লোকের গুঞ্জনের ভেতর। উঠানের সামনে একা একটা মড়া। সামনে বসে কেঁদে ক্লান্ত হয়েছে কেউ। একটা আধটা নয়, গোটা পাঁচ ছয়েক ঘটনা তাঁর মাথায় এল। যে খবরগুলো জড়িয়ে আছে এমন একটা মৃত্যুর সঙ্গে। এমন একটা কান্না আর এমন কিছু গুঞ্জনের সঙ্গে।
শোনা গেল, শ্মশান নিয়ে গণ্ডগোল। বছরখানেক আগেও এমন পরিস্থিতি ছিল না। যে বছর থেকে নিয়ম হল, সরকারি শ্মশান ছাড়া ব্যক্তিগত জায়গায় মড়া পোড়ানো যাবে না, তারপর থেকে প্রতিটি মড়াকে মৃত্যুর আগে কষ্ট করে হলেও দলের নাম বলে যেতে হত। অথচ কাল যে মারা গেল, তার কাছের জন তখন ক্লান্ত হয়েও অন্যদের সঙ্গে জড়াজড়ি করে ঘোড়ার স্বপ্ন শুনছিল।
সন্ধ্যা এল। অন্ধকারও। মায়াবী হয়ে উঠল শুধু একটাই গুঞ্জন—
“কুন্ দল? মিছিলেউ যায়নি কুনুদিন!”
একের-দুয়ের মুখ থেকে চোখ থেকে উত্তর শুনে সবাই দায়িত্বহীন লোকটার মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে আগুন ঝরিয়ে দিল।
চার-পাঁচজন জমে যাওয়া লোকের কাছে গেলেন তিনি। শোক নেই বরং তখন থেকে কী একটা হিসাব নিয়ে তিনি ব্যস্ত।
—কুনাইয়ের বেলাতেউ এরকম হইছিলনি! শ্মশান পাওয়া গেছলনি!
তাঁর কথায় কেউ অতীতে ফিরে গেল না। অবাক হল না। এমনকি চুপ করে থেকে তাঁকে আমলও দিল না। বরং একজন হঠাৎ তার গোটা শরীরটা দক্ষিণ দিকে ঘুরিয়ে বলল,
—এই ত, দখিনা বাতাসের বাই উঠে গেল!
দু-একজন ধেপে পড়া বাঁশ ঝাড়ের দিকে চেয়ে মনে মনে বলেই ফেলল,
—অ, আজ শনিবার ত!
এই মুহূর্তে কারো কারো ইচ্ছা হচ্ছিল এখুনি জোট বেঁধে যে যার ঘোড়ার স্বপ্নটা আওড়ে নেবে। শুধু ভেতরে ভেতরে ইচ্ছেটা একজোট হওয়ার অপেক্ষায়।
ততক্ষণে কত বাঁশপাতা ফলার মতন ঘুরতে ঘুরতে বাতাসে উড়ে গেছে। দু-একটা বাচ্চা পড়ন্ত পাতাগুলোর দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে। কিছু সময় উসখুস করে তিনি বলেই ফেললেন,
—আজকে আমিও তমাদের সঙ্গে…
—কাল সকালের খবরের হিসাব!
“হয়ে গেছে। দেখবি, কালকে এই দখিনা বাতাসের খবরটা থাকবেই।”
উপস্থিত সবাই একচোট হেসে নিয়ে তাঁর কাঁধে হাত দিয়ে গোল হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর স্বপ্নটা শোনার জন্য সবাই অধীর।