|

নান্দনিক পঙক্তিমালায় লুকোনো বিষণ্ণতা – মুহিম মনির

শেয়ার করুন
‘Poetry is the affair of sanity’ বলেই হয়তো কবির কলমে লেখা হয়–
‘জলের রং নেই, কান্না আছে থৈথৈ এসব অবৈজ্ঞানিক ভাবনাই আমার জৈবনিক সদাইপাতি– জীবনে রোদকে বৃষ্টি ভেবেছি, বৃষ্টিকে প্রেমিকা আর প্রেমিকাকে শিল্প; এও জীবনের আধুনিক ভুল স্মৃতির দুর্মর অশ্ব যখন আস্তাবলে ঘুমায় তখন আমি সাহিত্যের ক্লাসে রবীন্দ্রনাথের অধরা মানসীর গল্প শুনিয়ে নিজেরই কথা বলে যাই…’ – আল মাকসুদ  (অনাধুনিক জীবন, এবং তার জন্য এপঙক্তি মালা)
কবি আল মাকসুদ তাঁর ‘এবং তার জন্য এ পঙক্তিমালা’ কাব্যে এমনই একেক পর এক কবিতার সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। কবিতার ভাষায় বলে গেছেন হৃদয়ের যত সব সুপ্তকথা। মেলাতে চেয়েছেন পাঠকের অনানুভূত অনুভূতির সঙ্গে নিজের চেনা-অচেনা অনুভব। ফলতঃ তাঁর কবিতায় কবিতায় অবিরলধারায় উৎসারিত হয়েছে নান্দনিক সৌন্দর্যবোধ, বিশুদ্ধ আনন্দচেতনা আর অন্তঃকোঠরে লুকোনো বিষণ্ণতা। এবং যা প্রতিভাত হয়েছে এমন অসংখ্য পঙক্তিতে–
‘ঋতুর মিথ আমি মানিনা, তবু জানি ঋতু আসে পাখির পালকে ভর করে পুষ্পকে/ ভালোবেসে আমাদের বিকেলের আড্ডায়; রতি আর জিঘাংসা ভুলে গেলে যেমন/ করে ফিরে আসে ভালোবাসা, প্রেম নয় কভু… পুড়ে যাচ্ছে আগুন, আগুনের মতো/ কিছু… ফসল শূন্য বিরানমাঠে ব্যর্থ কৃষক অধরা আকাশকে তবু বলে কানে কানে–/ চলো ফিরে যাই: এপথের নেইশেষ, অলৌকিক পাথর, বৃক্ষ, নদীমেখলাস্বদেশ–/ এবং তার জন্য এ পঙক্তিমালা….’ (এবং তার জন্য এ পঙক্তিমালা; প্রাগুক্ত)
নিজস্ব কাব্যভাষা অর্জনে সচেষ্টতা আর আবহমান বাংলার মধুরতা যেন একাত্মতা ঘোষণা করেছে মাকসুদের কবিতায়। মোট সাতচল্লিশটি কবিতা আছে আলোচ্য বইটিতে। যেগুলোর অন্তর্হিত সুরধ্বনি মন্ত্রমুগ্ধ করে পাঠককে। তাদের মনোজগতে তোলে অপার্থিব আলোড়ন। আর নিয়ে যায় মেঘ পাহাড়ের দেশে। সেখানে, যেখানে ফলবতী বৃক্ষের পদতলে ঘুমায় খেয়ানৌকা; নতুন ঘাসে চকচক করে শিশির; ধূতরার ধূসর রঙে নদী হয়ে যায় মানসী। আর ‘অনুভবের পলেস্তারা খসে গেলে পড়ে থাকে বিকেলের আহ্লাদ…ফসল কাটা মাঠে/ জোছ্নার দুধ ঝরে পড়ে।’ কবিতা শেষ পর্যন্ত ভাষারই খেলা হলেও কবিতা নিয়ে আলোচনা করা কিছুটা বিড়ম্বনারই ব্যাপার। কেননা কবিতার শরীরে সন্নিবেশিত একেকটা শব্দ যেন একেকটা প্রতীক। একেকজনের কাছে বহন করে একেক অর্থ। একই শিল্পোত্তীর্ণ কবিতাতে ভিন্ন ভিন্ন পাঠকে পান ভিন্ন ভিন্ন রত্নসম্ভারের সন্ধান। আবার পুনঃঅবগাহনে একই পাঠকের প্রাপ্তি ঘটে হরেকরকমের। গ্রীষ্মে পড়া কবিতার মানে পালটে যায় বর্ষায়। শরতে ধারণ করে ভিন্ন অবয়ব। আনন্দময়ী কবিতার নরম শরীরেও ধরতে পারে ফাটল। বিষাদ আস্বাদিত হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। তারপরও বলতে হয়—এই যে অনুভূতির রদবদল, অর্থের লুকোচুরি, সৌন্দর্যের আপেক্ষিকতা, এসবেই বুঝি অন্তর্হিত থাকে একটি মহৎশিল্পের সার্থকতা। এমন সার্থক সৃষ্টির জন্যই স্রষ্টাকে খুঁজতে হয় যথার্থ শব্দ। উগলে দিতে হয় হৃদয়ানুভব। কখনো কখনো রাতের পর রাত কাটতে হয় নির্ঘুমে। আর সেই অনিদ্রাপ্রসূত শব্দবিন্যাসে বিমুগ্ধ হয়ে ওঠে পাঠক। আর যিনি কবিতাযাপন করেন, তিনি? তাঁর বিমুগ্ধতা বেশ বিরল। চিরায়ত অতৃপ্তিতে তাঁকে লিখতে হয়–
book cover
‘আমার কবিতা নিরাভরণ পদাবলি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি অবিনাশী গীতিকা …… ……. ……. বৃক্ষের বৈধব্য, প্রকৃতির সঙ্গম, ব্যর্থতার মহত্ত্ব নিরাবেগ নিসর্গের দ্বার খুলে গেলে আমি শুধু দেখি ঘাসের উঠোনে পড়ে আছে একটি প্রিয় কবিতার বিমুগ্ধ পঙক্তিমালা….’ (নিরাভরণ পদাবলি; প্রাগুক্ত)
কিন্তু কবি হয়তো জানেননা, তাঁর কুড়িয়ে পাওয়া পঙক্তিমালার সজীব পত্রপুষ্পের স্নিগ্ধসৌন্দর্যে পুনরায় বিমোহিত হয়েওঠে পাঠকের মন। আর এখানে এসে একথা মেনে নিতে কোনো দ্বিধা থাকেনা যে, ‘এবং তার জন্য এ পঙক্তিমালা’ কবিতাগ্রন্থটি এমন সব কবিতার সংকলন, যা মগ্ন পাঠকের সামনে উন্মোচন করে কবির নির্লিপ্ত নিবিড়তা, শব্দশৈলীতে সুনিপুণতা আর আজন্ম কবিতালগ্নতা। কবি আল মাকসুদের ‘বর্ষামেঘের গাঙচিল’ আমাদেরকে ডাকছে। চলুন প্রিয় পাঠক, আমরা তার ডাকে সাড়া দেই–
‘বর্ষাদিঘল নদী, মাছরাঙা বিলের জলের খলবল, মেঘের স্তনে জমে বৃষ্টির দুধ/ ভিজে যায় প্রিয়ার চিবুক চিকুর নিতম্বউড়াল…ফুলের পাপড়িতে ভরকরে মেঘের/ গাঙচিল, নীলনীল অক্ষরে বিষ্টিবিলাসী মন লিখে যায় কবিতা অমর…’

কবিতাগ্রন্থ: এবং তার জন্য এ পঙক্তিমালা কবি: আলমাকসুদ প্রকাশকাল: একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭ প্রকাশক: চর্চাগ্রন্থপ্রকাশ প্রচ্ছদ: আমজাদ আকাশ মুদ্রিতমূল্য: ১৩৫টাকা।

১লাআশ্বিন, ১৪২৫ এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *