মঙ্গল-মানবী ও একটা লোক – নীহারুল ইসলাম
খবরের কাগজটা সকালে একবার এক ঝলক উলটেপালটে দেখেছে। তখন খবরটা চোখে পড়েনি। এখন আচমকাই চোখে পড়ল। আশ্চর্য একটা ছবি! খবরটা আরও আশ্চর্যের। ‘লালগ্রহে মাঙ্গলিক নারীর ছায়ায় চাঞ্চল্য’। নাসার মার্স এক্সপ্লোরার ভেহিকল স্পিরিটের পাঠানো একগুচ্ছ ছবির মধ্যে ছিল নাকি ছবিখানি! পৃথিবীতে সেই ছবি নিয়ে উৎসাহের পারদ এখন তুঙ্গে। মহাকাশপ্রেমী থেকে নভশ্চর – সকলের কৌতূহল বাড়ছে।
কৌতূহল যে বাড়ছে, তার প্রমাণ দিচ্ছে লোকটার নিজের কৌতূহল। ছবিটাকে সে বারবার দেখছে। ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখছে। আর ভাবছে, সত্যিই কি মঙ্গল-মানবী? লালগ্রহে যার বাস! নাকি অপটিক্যাল ইলিউশন?
লালগ্রহ কোথায় সে জানে না। লালগ্রহ নিয়ে তার কোনও আগ্রহও নেই। কিন্তু নারীকে সে জানে। নারীর সব রূপ, সব রঙ, সব ঢং, সে চেনে। তবু নারী যেন তার কাছে কেমন অচেনা! নারী নিয়ে তাই তার এত আগ্রহ। মঙ্গল-মানবীর অবয়ব সেই কারণেই হয়ত তাকে ভাবাচ্ছে।
সারাদিনের কাজকর্ম সেরে লোকটা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছে। স্ত্রী তার জন্য চা আনতে গেছে। সেই ফাঁকে সে খবরের কাগজটার পাতা ওলটাচ্ছিল। তখনই খবর নয়, ছবিটাতে তার চোখ আটকে গেল। ছবির নীচে ক্যাপশান, ‘মঙ্গল-মানবী’।
ছবিটা দেখে সে চঞ্চল হয়ে উঠল। যদিও সোফায় অদ্ভূত এলায়িত ভঙ্গি তার। সেই ভঙ্গিতেই লোকটা ছবিটা দেখছে। মায়ের কথা মনে পড়ছে। শৈশবের সঙ্গিনীর কথা মনে পড়ছে। কৈশোরের প্রেমিকার কথাও মনে পড়ছে। এমনকি স্ত্রীর কথাও! তখনই স্ত্রী চা, সঙ্গে লঙ্কা-পেঁয়াজ মাখানো মুড়ি নিয়ে হাজির।
– কী ভাবতে বসলে আবার? স্ত্রী খোঁচা মারল।
লোকটা কোনও উত্তর করল না। কাগজটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে মুড়ি সহযোগে চা খেতে মন দিল। খুব খিদে পেয়েছে তার। স্ত্রী ততক্ষণে স্বামীর সরিয়ে রাখা কাগজটা তুলে নিয়েছে নিজের হাতে। স্বামী এত মনোযোগ সহকারে কী পড়ছিল, দেখবে। এটা স্ত্রীর সন্দেহ-প্রবণতা। লোকটা মুড়ি খেতে খেতে ভাবল। ভুল ভাবল না অবশ্য। স্ত্রী মাত্রই তাই। তার অভিজ্ঞতা সে-কথাই বলে।
লোকটা ধীরে সুস্থে মুড়ি খাওয়া শেষ করে। তারপর চায়ের কাপটা হাতে নেয়। আর কী জানি কেন, স্ত্রীকে নিয়ে মজা করতে ইচ্ছে হয় তার। কিন্তু কীভাবে মজা করবে? কতদিন যে স্ত্রীর সঙ্গে মজা করেনি! ব্যাপারটা ভুলেই গেছিল। তাহলে আজ হঠাৎ মজা করতে ইচ্ছে করছে কেন?
নিজের খেয়ালে নিজেই অবাক হয় লোকটা। যদিও নিজের খেয়ালকে সে অস্বীকার করতে পারে না। স্ত্রীর হাতে তখনও খবরের কাগজটা। সে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, কাগজে কী খুঁজছো অমন করে?
তোমার মাথা!
স্ত্রী যে এমন কথা বলবে, তাতে আশ্চর্য কী? লোকটা আশ্চর্য হয় না। বরং ঘুরিয়ে রসিকতা করে, আমার মাথা খবরের কাগজে থাকবে কেন? আমার মাথা ওই তো তোমার ধড়ের ওপর। দেখতে পাচ্ছো না বুঝি?
স্বামীর রসিকতা স্ত্রী বুঝতে পারে না। বোঝার চেষ্টাও করে না। সরাসরি জিজ্ঞেস করে, সত্যি করে বলতো- খবরের কাগজে অত মনোযোগ দিয়ে কী পড়ছিলে?
লোকটা বলল, বিশ্বাস কর সোনা- খবরের কাগজে আমি তোমাকেই পড়ছিলাম।
লোকটা এমন সিরিয়াস হয়ে বলল যে, তার কথায় স্ত্রী রেগে গেল। রেগে গিয়ে বলল, আমি কি কিছুই বুঝি না ভাবছো? আমি নিশ্চিত তোমার জীবনে নিশ্চয় কোনও নতুন মেয়ে এসেছে।
– হ্যাঁ সোনা, সত্যিই এসেছে। আমার জীবনে না এলেও তোমার মনে এসেছে। এবং এটাও সত্যি আমি তাকে খুব ভালোবাসি।
– কে সেই মেয়ে?
– তুমি তাকে চেনো না।
– আমি তাকে চিনতে চাই।
– চেনালেও চিনবে না তুমি। ভুল বুঝবে।
– আমি ভুল বুঝবো না। ঠিক চিনব। তুমি বলো।
– চেনার চোখ নেই তোমার সোনা।
– কেন? আমি অন্ধ নাকি!
– সেরকমই ধরতে পারো।
– তোমার কারণে আমি আত্মহত্যা করবো একদিন। দেখে নিও।
– আত্মহত্যা করলে তুমি তোমার পৃথিবী হারাবে। পৃথিবী কিছুই হারাবে না।
– তুমি এত নিষ্ঠুরের মতো কথা বল কেন?
– আমি নিষ্ঠুর তাই।
– সেবলে তুমি আমাকে কষ্ট দেবে?
– আমি কষ্ট দিচ্ছি কই? কষ্ট তো তুমি নিজেই পাচ্ছো।
– কেন কষ্ট পাচ্ছি আমি?
– তোমার অশিক্ষার কারণে।
– কী? আমি অশিক্ষিত!
– অবশ্যই।
– ঠিক আছে, আমি অশিক্ষিত। এবারে সত্যি করে বলতো কোনও শিক্ষিত নারীর সঙ্গে তোমার সম্পর্ক হয়েছে কিনা?
– বলছি তো, হয়েছে।
– কার সঙ্গে?
– এক মাঙ্গলিক নারীর সঙ্গে।
– কী সম্পর্ক?
– বন্ধুত্বের।
– আমি বিশ্বাস করি না।
– জোর করে আমি কাউকে বিশ্বাস করাতেও চাই না।
– কেন?
– আমি ভগবান নই, তাই।
– ভগবান জোর করে বিশ্বাস করায়?
– তা নয় তো কী।
– তুমি আমাকে ঠকাচ্ছো কিন্তু।
– হবে হয়ত!
আর কিছু বলে না স্ত্রী। প্রচন্ড রাগে খবরের কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। লোকটা কিছু বলে না। সে জানে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে স্ত্রী এবারে বাড়ির পেছনের বাগানে যাবে। সেখানে তার প্রিয় কোনও ফুল গাছের গোড়ায় দুই হাত ছড়িয়ে বসবে। ঠিক খবরের কাগজের ওই মঙ্গল-মানবীর ছবির মতো। তারপর কিছু ভাববে। হয়ত একটু কাঁদবে। কিংবা কাঁদবে না। আক্রোশে ফুঁসবে। শেষপর্যন্ত আত্মহত্যার কথা ভাববে। কিন্তু সাহসে কুলোবে না। তখন তার সব ভাবনা, সব দুঃখ, সব কান্না, সব আক্রোশ আজড়ে দেবে তার সেই প্রিয় ফুলগাছটির গোঁড়ায়। লোকটা ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখবে এইসব। তার আনন্দ হবে।
কারণ, লোকটা জানে পরের দিন তার ঘুম ভাঙবে তার স্ত্রীর প্রিয় ফুলগাছে ফুটে ওঠা অজস্র ফুলের সৌরভে। লোকটা নতুন দিনে নতুন ভাবে বাঁচবে আবার…
One Comment