কৃষক আন্দোলন ও নারী – প্রতিভা সরকার
পাঞ্জাব-হরিয়ানার একটি চলতি প্রবাদ, আউরত কি অক্ল উসকি চোটি মে হোতি হ্যায় — মেয়েদের মগজ বলে কিছু নেই, থাকলেও তা বিনুনিতে লুকিয়ে।
কৃষক আন্দোলন ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মেয়েদের বিরাট সংখ্যায় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বে উঠে আসা কিন্তু একেবারেই অন্য কথা বলে। নাহলে কী আর মোদি সরকার মেয়েদের ওপর এমনি এমনি এত খাপ্পা! নির্বিচারে চালান করে দিচ্ছে জেলে, কারও কারও জন্য বরাদ্দ বন্দুকের গুলি। হতে পারে এর কারণ সর্বত্র মেয়েরা সব অত্যাচার তুচ্ছ করে প্রতিরোধ গড়ছে বলে, হতে পারে মনুবাদী অনুশাসনের তোয়াক্কা করছে না বলে। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই এই ঘোরতর নিও-লিবেরাল জমানায় এবং পোস্ট ট্রুথের জগতে, যেখানে কামারাদারি ব্যাপারটাই আরও উবে গেছে অতিমারির কল্যাণে, মেয়েরা উঠে আসছে প্রতিবাদীদের একেবারে সামনের সারিতে। এই মেয়েরা কেউ শহরের, কেউ গ্রামের, অর্থনৈতিক অবস্থাও তাদের ভিন্ন ভিন্ন, শিক্ষা স্ট্যাটাস সুবিধা কোনোকিছুতেই তারা সমসত্ত্ব নয়। একটি জায়গায় কেবল তারা এক, সেটা হল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অকুতোভয় প্রতিবাদ। সেখানে কারখানা থেকে ছাঁটাই দলিতকন্যা নওদীপ কউর আর জামিয়া মিলিয়ার এমফিল ছাত্রী সারফুরা জারগারের মধ্যে কোনো তফাত নেই। বিভেদ নেই ব্যাঙ্গালোরের পরিবেশকর্মী দিশা রবি এবং ইউএপিএ-তে আটক কাশ্মীরি সাংবাদিক মাসরাত জাহারার মধ্যে। এইখানে আমি পার্ক সার্কাস আন্দোলনের সংগঠক সদ্যপ্রয়াত আসমত জামিলের কথা ও শাহিনবাগের দাদির কথাও স্মরণ করতে চাই। পাওনা কৃতিত্ব দিতে চাই সেই কৃষাণীদের যারা মাসের পর মাস দিল্লি বর্ডারের অবরোধে মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে। পালা করে করে খেতি বাড়ি সামলাচ্ছে একদল, আর একদল তখন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে নারা দিচ্ছে।
২০২০ এর সেপ্টেম্বরে তিন কৃষি আইন পাস হয়। নভেম্বর মাস থেকেই শুরু হয়ে যায় বিদ্রোহ। আজ চার মাস বাদে, অনেক চোখ রাঙানি ও নিপীড়ন সত্ত্বেও তাতে ভাটা পড়েনি। যোগদানকারী মেয়েদের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। কারণ মেয়েরা নিজেদের যুগ যুগ ব্যাপী লাঞ্ছনা বৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে দেখছে এই কালা কানুনকে। তারা জানে ভাতে টান পড়লে সবচেয়ে আগে খিদের জ্বালায় জ্বলবে কে। কার পড়াশুনোয় বাগড়া দেওয়া হবে, কার স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি খর্ব হবে। সংসারের বাজেট ছাঁটাইয়ের প্রথম কোপটাই পড়ে রান্নাঘরে। প্রিয়জনের কষ্টও তো সয় না মেয়েদের। তাই তারা কৃষি আইনের বিরোধী। যারা দিল্লি বর্ডারে যেতে পারেনি তারা একা হাতে তুলে নিয়েছে খেতিবাড়ি দেখভাল করা ও শস্য বপন কর্তনের দায়িত্ব। পাঞ্জাব-হরিয়ানায় এখন ঘরে ঘরে এমন মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। রাকেশ টিকাইত কৃষকদের আহ্বান জানিয়েছেন আন্দোলনের খাতিরে এই বছরের শস্যলাভের আশা বিসর্জন দিতে। হয়তো শস্যের সবটুকুই জলে যাবে না। এই নাছোড় মেয়েদের কল্যাণেই যেটুকু গোলায় ওঠার, তা উঠবে। এমন মেয়েও আছে যারা সকালে আন্দোলনস্থলে এসে সারাদিন ধর্নায় থেকে, শিশু এবং গৃহপালিত পশুর দেখভালের জন্য রোজ সন্ধেয় ঘরে ফিরে যাচ্ছে। যদি কোনো আন্দোলনের সাফল্য মাপার একক হয় দৈহিক শ্রম, তাহলে এই আন্দোলনের সাফল্যের বেশিটাই হবে নারীর পাওনা।
বয়স, স্ট্যাটাস ইত্যাদিকে এই মেয়েরা ধর্তব্যের মধ্যেই আনছে না। আন্দোলনে আশি থেকে আট সবাইকে দেখা যাচ্ছে। বিকেইউ নেত্রী হরিন্দার বিন্দুর নেতৃত্বে মালওয়া রিজিয়নের (সাংগ্রুর, ভাতিন্ডা, মানসা, বার্ণালা, লুধিয়ানা), যেখানে গোটা পাঞ্জাবের কৃষক আত্মহত্যার ৯৭% ঘটেছে, সেখানকার কিষাণীরা আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। আবার ট্রাক্টর চালিয়ে দিল্লিতে এসেছে এরকম কলেজছাত্রীর ছবি আমরা কাগজে আকছার দেখছি।
কৃষকের আত্মহত্যার মূল কারণ হচ্ছে দেনার দায়। আর এক নেত্রী হরপ্রিত কউর মিডিয়াকে বলেন, গম, ধান এবং আলুতে সবচেয়ে বেশি মার খাচ্ছে কৃষকেরা। এই প্রধান শস্যগুলির উৎপাদনই যদি কৃষকের কাছে লাভজনক না হয়ে দেনাবৃদ্ধির কারণ হয়, তাহলে অন্য শস্যের বেলায় কী ঘটতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। প্রিয়জনকে আর অসময়ে হারাতে চায় না বলেও কিষাণীরা আজ পথে।
এমন নয় যে ঢেঁকি যেহেতু স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, টিকরি বা সিঙ্ঘু বর্ডারে মেয়েরা খালি লঙ্গরের দায়িত্বে আছে। তারা রাঁধছে, মিটিং সংগঠিত করছে, বক্তৃতা দিচ্ছে, প্রেস সামলাচ্ছে। নারীর অংশগ্রহণ আর পরম্পরা অনুমোদিত নয়, এখানে তা স্বতঃস্ফূর্ত এবং দক্ষতা নির্ভর। নওদীপ কউরের মতো মেয়েরা আন্দোলনের স্বার্থে জেলে অব্দি যেতে প্রস্তুত। নওদীপ নিজে শ্রমিক, কাজের ফাঁকে শ্রমিককে সংগঠিত করবার দায়িত্ব সে স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে শ্রমিকদের একত্র করা এই রাষ্ট্র অপরাধ হিসেবে দেখে। তাই নওদীপকে ধর্নাস্থল থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ও কিছুদিন তার কোনো খোঁজ থাকে না। সরকার বাহাদুর হয়তো ভেবে থাকবে একে দলিত, তায় শ্রমিক, নওদীপের খোঁজ আর কে করবে! কিন্তু মনদীপ পুনিয়াদের মতো স্বাধীন সাংবাদিকদের অক্লান্ত চেষ্টায় এই কেসটি সামনে আসে এবং নওদীপের সমর্থনে জনমত গড়ে উঠতে থাকে। যদিও একটি মামলায় তার জামিন মিলেছে, কিন্তু অন্য মামলায় এখনও তাকে জেলের ভেতরেই শাসক আটকে রেখেছে।
তবুও মেয়েরা ভয় পেল কই? এক নওদীপ জেলে গেল তো কৃষি আন্দোলনের স্বপক্ষে এগিয়ে এল আর এক দিশা রবি। আর এক নিকিতা জ্যাকব। এদের বিরুদ্ধে জেলে পাঠিয়ে, দেশদ্রোহের চার্জ এনে সরকার নিজের ভয়-পাওয়া লুকোতে চাইছে বলে মনে করছেন অনেকে। এই মেয়েদেরকে সবাই ভয় পাচ্ছে বলেই, মনদীপ পুনিয়ার ভিডিওতে শুনি, সিঙ্ঘুর আন্দোলনস্থলে মেয়েদের শিবির লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়েছিল মলোটেভ ককটেল। ভাগ্য ভালো যে তা ফাটেনি। এখন তো মূল মিডিয়া দ্বারা বয়কট করা হয়েছে বলে কৃষক আন্দোলনের কথা উঠেই আসছে আরও কম। জানি না, সেখানে মেয়েরা আরও কত কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন গুজরান করছে।
কেন এইরকম নিপীড়ন নামিয়ে আনা হচ্ছে নারীপুরুষ নির্বিশেষে ?
প্রথম কারণটি অবশ্যই বশ্যতার বিরুদ্ধে নারীর জেহাদ ঘোষণা। মেয়েদের হতেই হবে অনুগত, বাধ্য এবং শালীন। পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি, এমনকি রাষ্ট্রের প্রতি। সেই জায়গায় এই মেয়েরা সমালোচনামুখর ও আন্দোলনে বিশ্বাসী। মোদি-শাহের সার্বিক আধিপত্যকামী জমানায় এই দুঃসাহস অমার্জনীয়। ফ্যাসিবাদের চিরকালের বৈরী হল স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তাধারা। এই কারণেই জেএনইউ এবং যাদবপুর ছোটো-বড়ো সব ফ্যাসিস্টের চক্ষুশূল। বিজেপির শত্রুতালিকায় এরপর জায়গা নেবে ধর্মীয় বহুত্ব, জাত এবং লিঙ্গের সাম্য, স্বচ্ছতা এবং পরিবেশসচেতনতা। অতএব যে মেয়েরা এতসবে জড়িত তাদের সামনের সারিকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে জেলখানায়। আদর্শবাদী এবং নিঃস্বার্থ মুক্তমনা আধুনিক নারীর জন্য এই ভারতবর্ষে ওই একটি জায়গাই বরাদ্দ আছে।
তা না করে উপায়ই বা কী, অন্য দলের এমএলএ, এমপিদের মতো কৃষক নেত্রী বা অন্যান্য আন্দোলনমুখর মেয়েদের টাকা ছড়িয়ে কেনা যায় না যে! ফলে কেনাবেচাযোগ্য ঘোড়াগুলির থেকে ধান্দাবাজরা এদের অনেক বেশি ডরায়।
সেই ভয়মুক্ত হতেই শাসক উলটো চাল চালে। প্রথম সারিকে ঘানি টানতে দেখলে অন্যান্যরা ভয় পাবে। তাদের অভিভাবকরা রাশ টেনে ধরতে চাইবে। মেয়েদের পক্ষে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। সুরক্ষার দোহাই দিয়েই নওদীপদের ঘরে রাখবার চেষ্টা হবে। ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হবে যোগী আদিত্যনাথকথিত প্রতিবেশ যেখানে মনে করা হয় মেয়েরা স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার যোগ্য কোনোদিন ছিল না, ভবিষ্যতেও কোনোদিন তা হবে না।
কৃষক বিদ্রোহে জড়িত মেয়েদের এই ব্যাপক হারে আন্দোলনমুখিনতার সবচাইতে চমকপ্রদ দিকটির কথা না বললেই নয়। সেটি হচ্ছে খাপের রাহুমুক্তি যা আশা করা যায় আংশিক থেকে পূর্ণতার দিকে অবশ্যম্ভাবী এগোবে। গোবলয়ের খাপ হচ্ছে চূড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতায় তৈরি এক ভয়াবহ সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যার ফতোয়া গ্রামীণ জনতা শুনতে বাধ্য। এখানে গাঁয়ের ক্ষমতাবান, ধনী, জোতদার গোছের পাঁচ-ছ’জন ‘বুজুর্গ’ জমি, বিয়ে, পারিবারিক কোন্দল, সমস্তরকম সমস্যা নিয়ে যা রায় দেবে তাই-ই চূড়ান্ত। তা অগ্রাহ্য করলে গ্রামে ধোপা নাপিত বন্ধ হতে পারে, এমনকি প্রাণটাও চলে যেতে পারে। এই খাপ সময়ে সময়ে চূড়ান্ত নারীবিদ্বেষ ছড়িয়েছে। গোত্র এক হলে নারী-পুরুষ ভাইবোন, তাদের মধ্যে বিয়ে-শাদি চলবে না এই ফতোয়ায় বহু দম্পতির প্রাণ গেছে। মনোজ-বাবলি হত্যার নৃশংসতা আজও ভোলা যায় না। অনার কিলিং, লাভ জিহাদের একনিষ্ঠ সমর্থক এই খাপগুলি মেয়েদের কেবল অবরোধবাসিনী হিসেবে দেখতে চায়। তাই কোথাও কোথাও মেয়েদের ওপর মোবাইল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। এই খাপ সদস্যরা বেশির ভাগ ছিল বিজেপির একনিষ্ঠ সমর্থক, তাদের প্রভাবে অনেক গ্রামবাসীরাও।
কৃষক বিদ্রোহ শুরু হবার পর, বিশেষ করে ২৬শে জানুয়ারির পর মহাপঞ্চায়েত ডেকে এই খাপগুলি আন্দোলনের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা জানিয়ে দেয়। ফলে পাঞ্জাবে পুরসভার ভোটে বিজেপি সাফ হয়ে যায়, হরিয়ানাতেও কেবল সময়ের অপেক্ষা। এই আন্দোলনের পুরোভাগে মেয়েদের উপস্থিতি নিয়ে কোনো আপত্তি তারা তুলতে পারেনি। মেয়েরা বুজুর্গদের সামনেই ট্রাক্টর চালাচ্ছে, রান্না ছাড়াও পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অন্য সমস্ত কাজকর্ম করছে। মোবাইল তো ছাড়, মেয়েরা শিবিরে কম্পিউটারও ব্যবহার করছে। নারীবিদ্বেষী কোনো মন্তব্য, কোনো পদক্ষেপের খবর নেই। সুপ্রিম কোর্টের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলিয়ে কেউ আন্দোলনস্থল থেকে সুরক্ষার খাতিরে মেয়েদের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে চায়নি। এটা ঠিক যে, রাতারাতি কিছু উলটে যাবে না। খাপ পুরোপুরি নারীবান্ধব হয়ে উঠবে, এমনটা কখনও হবে কিনা কেউ জানে না। কিন্তু একটা চরম হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক মৌলবাদ থেকে একটা চূড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক ও সামন্ততান্ত্রিক শক্তিকে যে সাময়িকভাবেও আলাদা করা গেছে এর কৃতিত্ব কিন্তু ঐ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মেয়েদেরই, যারা জীবন পণ করেছেন তিন কালা কানুন বাতিলের ডাকে।