কড়িবরগার ঘর – অতনু চট্টোপাধ্যায়

শেয়ার করুন

১.


অন্ধকারে সাদা সাদা ফুল ফুটে উঠল। উদ্ভিন্ন হাওয়ায় সুগন্ধ ঘোরাফেরা করে গলিমুখে। ধরতে গেলে পালিয়ে যায়, পাজি! তবু তার পদচিহ্ন আমরা টের পাই অন্ধকারে হাঁটতে বেরোলে। যদিও গলিমুখে হাঁটাহাঁটি এখন বাহুল্য বলা চলে, পুরাতন ছাদেই এই বিলাসিতার অবসান। গৃহবন্দি দশা হবিষ্যির চেয়েও বিস্বাদ, এর শুরু ভুলে গেছি, শেষ দেখতে পাই না। একদলা অস্বস্তি গলায় আটকে আছে, বুঝতে পারি। তাছাড়া পুরাতন ছাদ আছে বলে বৃষ্টি নামে, আকাশজোড়া বিদ্যুৎরেখায় ছড়িয়ে পড়ে চিন্তাজাল। দূরে সুপুরিগাছের মাথা দুলে ওঠে। নারকেলসারি আলখাল্লা উড়িয়ে দেয় হাওয়ায়।
বাসার এই অংশটুকু পরিত্যক্ত, শতাধিকবর্ষ প্রাচীন। সিঁড়িতে আলো নেই, কাঠের রেলিং খুলে এসেছে, কড়িবরগা চেয়ে আছে হাঁ করে। চামচিকে উড়ে বেড়ায়। সাবধানে নড়বড়ে সিঁড়ি পার হলে আজও অন্ধকার আকাশে একে একে তারা ফুটে ওঠে। বিগত বহুজন্মের তারারা তোমার দিকে চেয়ে থাকে একদৃষ্টে। পরিত্যক্ত বলেই প্রাকৃতিক এক সার্বজনীনতা পেয়ে বসে বাড়িটাকে। যেন সেরে উঠবার কোনো তাগিদ নেই, জ্বর হয়েছে, মাথা ভার, জলপট্টির বন্দোবস্ত নেই। মোমবাতি নিভে গেছে কখন… মুখ তেতো, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা, কিন্তু তা জাতকের স্মৃতির মতোই কোনো এক রহস্যময় কারণে সুদূরে নিবদ্ধ। ঠিক এইখানে এসে আমার ভাস্করদার এক আত্মপ্রতিকৃতির কথা মনে পড়ে। পিছনের দেওয়াল স্যাঁতস্যাঁতে, জায়গায় জায়গায় রং খসে পড়েছে। তা মুখ, এমনকি শরীর থেকেও। আলো অতি ক্ষীণ, সান্ধ্য আকাশের মতো ক্রমে তা আরও ক্ষীণতর হয়ে ওঠে। এই বুঝি অন্ধকার এসে নিয়ে যাবে সবটুকু! মনোবিকলনের লণ্ডভণ্ড ছাপ সর্বত্র প্রকট। পরনে ঢলাগেঞ্জি, বুকের অনেকখানি নীচ অবধি ছবিটাতে ধরা। অনানুষ্ঠানিক এই পরিবেশ এমনই, যেন আচমকা ঢুকে পড়েছি অন্যের ঘরে। কী করণীয় ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, ফিরে গেলে ভালো হয়। অথচ অবিকল অর্থোডক্স সিরীয় গির্জার ঈশার আদলে তার দৃষ্টি তোমাতে আচ্ছন্ন। গালে হালকা দাড়ি, ঢেউখেলানো পরিপাটি চুলে প্রাচীন তৈলচিত্রের ফাটল। মাথার পিছনে সামান্য হলুদাভা সুস্পষ্ট।

শিল্পী — ভাস্করপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

ভাবো, ঈশা ফিরে এসেছেন গ্রামে। দূর দিকচক্রবালে গরম বালি উড়ছে। খচ্চর থেকে নেমে ঘরে ঘরে গিয়ে তিনি সংগ্রহ করছেন সুসংবাদ। অবিকল ধর্মবীর, হাতে যেন ন্যায়দণ্ডটিও ধরা। তুমিও প্রস্তুত। খাটিয়ায় উদগ্রীব বসে আছো, ভেজানো দরজা খুলল। তোমার চোখে পড়ল সবকিছু বাদ দিয়ে তার আলখাল্লা ভেদ করে বুকের ডানপাশের ক্ষতের সুড়ঙ্গ, খঞ্জ আত্মার ধূসর রং। এখন কী করবে তুমি? বাতাস থমকে দাঁড়ায়। নিশ্বাস স্থির হয়ে আসে, আলো নিভুনিভু। মাথার ভেতর ঘুরপাক খায় একটিই বেয়াড়া প্রশ্ন—কোনো মানুষ যদি তার সারল্যকে হুবহু দেখতে পায়, তবে কি তাকে আর ততখানি সরল বলা চলে?

২.

গোলিয়াথের মাথা ও ডেভিড, ক্যারাবাজ্জিও (David with the head of Goliath by Michelangelo Merisi da Caravaggio.)


দাউদ, ও মেষপালক দাউদ তুমি কি প্রশস্ত প্রান্তরে ঘাসেদের কোলাহল শুনেছিলে? তুমি কি শুধুই টান গুলতি ও ছুটে যাওয়া শিলা? বেদানাফল শুয়ে আছে ফলের রেকাবে, তুমি কি ঘুমন্ত ওই রক্তিম বিষাদ, ন্যায়তরবারি?
চেয়ে দেখো, বেলা পড়ে এল। চেয়ে দেখো বেরসিক জালুতের কাটা গোল মাথা, চিৎকার করে ডাকে—“বালক দাউদ!”

সেই প্রথম, সেই কবে থেকে ক্যারাবাজ্জিও-র আত্মপ্রতিকৃতি ঝুলে আছে, টপটপ রক্ত ঝরে পড়ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি গ্রেট আর্টিস্ট সিরিজের ব্যাককভার। তখনও কিশোর, দিদির হাতে প্রথম দেখি। অঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার পুরস্কার৷ তখন থেকে এই ছবি আমার মাথা জুড়ে বসে আছে। সেসময় লোডশেডিং হত নিয়মিত, হ্যারিকেনের আলোয় দপদপ করত পতঙ্গেরা, আচমকা ড্রয়ার থেকে আমি একদিন খুঁজে পাই দাদুর বিয়ের অচল ঘড়ি। কী করব বুঝে উঠতে না পেরে সেটাকে পাচার করে দিই অ্যান্টিকের বাক্সে। মাঝেমধ্যে কল্পনা করবার চেষ্টা করতাম ওর প্রকৃত যৌবনের দিনগুলো, যখন সচল ছিল ওর প্রতিটা চাকা।

ছো্টবেলা থেকে আমি জানি, ইতিহাসের উত্তরপত্রে যখন সকলই বিরূপ, তখন একমাত্র রক্ষাকর্তা ভিনসেন্ট স্মিথ। এবং কে না জানে, কবিদের ভিনসেন্ট স্মিথ এক এবং অদ্বিতীয়, অকৃত্রিম বু.ব.। বুদ্ধদেব বসু একজায়গায় লিখেছেন, কবি কী? অংশটা বিস্তৃত, কতটুকু রাখব, কী বাদ দেব বুঝতে না পেরে আমি প্রায় পুরোটাই তুলে ধরলাম।

‘বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা নতুন ধারণা আনেন পৃথিবীতে—বিশ্ব, অথবা ভগবান, অথবা সমাজ ও রাষ্ট্র বিষয়ে নতুন ধারণা; আর সে-সব ধারণা যে মূর্ত হবারও ক্ষমতা রাখে, তার প্রমাণ মানুষের প্রিয় অথবা ঘৃণ্য, কিন্তু ব্যবহারযোগ্য, প্রতিষ্ঠানসমূহ। কিন্তু একজন কবি—তিনি? কী তাঁর কাজ? কোথায় তাঁর ক্ষমতা? একজন বিজ্ঞানীর তুলনায়, এমনকী একজন দার্শনিকের তুলনায়, কী দরিদ্র তিনি, প্রায় শিশুর মতো রিক্ত ও দুর্বল; পাণ্ডিত্য নেই, নেই যুক্তির যাথার্থ্য বা তথ্যের স্পর্শসহতা, একটা নতুন ধারণাও নেই বেচারার তল্পিতে। এমন কোনো চিন্তা নেই যা তার আগে বহু কবি প্রকাশ ক’রে না গেছেন। তার বর্ণিল, অনিশ্চিত ও অস্পষ্ট জগৎ থেকে মানবজাতিকে কোনো বাণী তিনি শোনাতে পারেন না। পারেন না উপদেশ দিতে, উপায় জোগাতে, কোনো সংকটে পথ ব’লে দিতে পারেন না। চরম যা পারেন তিনি, তা শুধু নিজেকে অবলম্বন করে: নতুন ক’রে তুলতে পারেন শুধু নিজেকে, আর কাব্যকলাকে। ব্যাপারটা ওখানেই শেষ: কবিতা থেকে কোনো প্রতিষ্ঠান গ’ড়ে উঠবে না, চাঁদে যাবার যান তৈরি হবে না, মানবজীবনে আর কোনো প্রতিফলন হবে না তার। কবিতা নিজেই মূর্ত, মূর্ত না-হ’লে সে কবিতাই হ’লো না।’
(‘এক গ্রীষ্মে দুই কবি’, বুদ্ধদেব বসু)

বুদ্ধদেব কোথাও এ-ও বলেছিলেন যে—জীবনানন্দের ইন্দ্রিয় ছিল প্রায় জন্তুর মতো প্রবল, যিনি ঘাসের ভিতর নিমজ্জিত হয়ে পান করতেন ঘাসের সারাৎসার।

এখন প্রশ্ন হল ছবির আলোচনায় এত কবিতা কেন? সে উত্তরও আমি দেব বুদ্ধদেব থেকে ধার করে—‘এমন কোনো শিল্পকলা নেই যা কবিতার দ্বারা আক্রান্ত না হয়।’ (পূর্বোক্ত)

শিল্পী — ভাস্করপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

ভাস্করপ্রসাদের যৌবনের একটা আত্মপ্রতিকৃতির কোনো এক কোণায় ছিল এক অফুরন্ত ফড়িং। এই মহাপ্রাণ ওই পরিসরে ঠিক কী ষড়যন্ত্র করছিল, তা আমার না-জানা। আমি জানি না, আমার দাদুর ঘড়ির সঙ্গে, ক্যারাবাজ্জিও-র আত্মপ্রতিকৃতির টপটপ রক্ত আর এই ইহজগত–পরকালের সাথে তার কী সম্পর্ক। জানি না মধ্যপ্রাচ্যে ডেভিড, গোলিয়াথরূপী শিল্পীর মাথা তার নিজেরই তরবারি দিয়ে কেটে ঠিক কী অর্জন করেছিল, কী তার রাজনীতি। আমি শুধু জানি, ওরা যখন আসে পরপর একসাথে আসে, ফড়িং তো আর একা আসে না! তাছাড়া বিকেলের শেষে ছাদের আকাশে একে একে ওরা যে সক্কলে চলে আসবে তা তো মেজদির-ও বিলক্ষণ জানা—‘ও মা, ওরা সবাই এসে গেছেন, পড়ন্ত আলোর দেবতা, কমলে কামিনী, রাত্রির কিন্নর, বরাহ অবতার, রাক্ষসদল, অশ্বিনীকুমার দু-জন, তাঁদেরও আড়ালে মারাংবুরু পাহাড়ের সিঁদুরমাখা পাথরখণ্ড, শিরীষগাছের ঝুলন্ত নরদেহ, গায়ে আগুন লাগা অসুরপত্নী—তখন এ পুণ্য শহর কলকাতার উপর, সবাইকে নমস্কার জানাতে জানাতে ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসে।’
(১০নং কবিতা, ‘সলমা জরির কাজ’, উৎপলকুমার বসু)

৩.


ওই দূরে ছড়ানো ধাপার মাঠ। ওখানে, অতি নির্জনে, প্লাস্টিক মুড়ে ফেলে গেছে অ্যাম্বুলেন্স—আমার এক কাছের আত্মীয়কে। মধ্য বয়সের হুড়োহুড়ি, ভিড়, পথশ্রম দু’হাতে সরিয়ে রেখে—বিব্রত তথা সুচারু ভঙ্গিমায় আমি নিবেদন করি অবিচুয়ারি, মাইক্রোওয়েভের পায়ে, ফ্রিজের হাতলে, বন্ধ এটিএম-এর কাচের প্রতিফলনে।

সীগ্রাম মুর‍্যালস্, মার্ক রথকো(Seagram murals by Mark Rothko)

ডায়ানাইসিস ছিলেন সুরার দেবতা। চাষাবাদকালে তার মেজাজ থাকত ফুরফুরে, অথচ হেমন্ত এলেই এক বিষণ্ণতা, শুধুই বিষণ্ণতা গিলে ফেলত তাকে। তার নামে উৎসর্গীকৃত মন্দির ছিল গ্রিসে, রোমে। পম্পেই-এর দগ্ধস্তূপ সরলে জানা গেল মন্দিরের দেওয়ালের রং ছিল উৎসবের, লাল।

নিউইয়র্ক শহরের মধ্যবয়স্ক ইহুদি আর্টিস্ট মার্ক রথকো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কোনো এক বসন্তে অনুভব করেন, স্বপ্নে বহুবার প্রাচীন গ্রিসের মন্দিরগুলির দেওয়াল ঝলসে তুলেছিলেন রক্তাভ রঙে। সেই রঙে ছিল না প্রসন্নতা, ছিল কেবল গভীর বিষাদ। রথকো ছিলেন প্রগতিশীল বামধারার পথিক, জাতিগত দাঙ্গায় রাশিয়া থেকে শৈশবে দেশান্তরী, অ্যাবস্ট্র‍্যাক্ট এক্সপ্রেশনিস্ট ও মোজার্টের অন্ধ অনুরাগী।

ভাস্করপ্রসাদ সরলপ্রাণ। সৃষ্টি তত্ত্ব নিয়ে ওর দেবতাদের সাথে গভীর মতপার্থক্য ছিল। “ঈশ্বর বন্ধ কৌটোর মতো”, একথা সে জানিয়েছিল আড্ডায়। মৃত্যু বিষয়ে ওর অবশ্য কোনোদিন কিছুই বলার ছিল না।

সীগ্রাম মুর‍্যালস্, মার্ক রথকো(Seagram murals by Mark Rothko)

মধ্যবয়স অবধি আপাত অসচ্ছলতার পর হঠাতই শিঁকে ছেঁড়ে তার জীবনে। ম্যানহাটন শহরের চার ঋতুর বিলাসী রেস্তঁরা সিগ্রাম ডিস্টিলারিস ছ’শো বর্গ মিটার ছেড়ে দেয়, শুধু তার ছবির নাম করে। এত বড়ো কমিশনের খবর ছড়িয়েছিল হাওয়ায়, মধ্য পঞ্চাশের মার্কিন আঁকাআঁকির জগতে। যথারীতি তার বামপন্থী বন্ধুরা প্রবল বিরক্ত হয় এই বিশ্বাসঘাতকতায়। রথকোকে সেইবার ছেড়ে গেল সমস্ত উজ্বল রং, একেএকে পেয়ে বসল মেরুন, ঘন লাল ও কৃষ্ণবর্ণের দেবতারা।

নিজের মামার মৃত্যুসংবাদ যদি পেয়ে থাকেন ফেসবুকে, কেমন লাগবে আপনার? আপনার সন্তান তখন অ্যাবাকাসের ক্লাস করছে, স্ত্রী ভাতঘুমে, মা সিরিয়ালে—আর আপনি দ্রুত স্ক্রল করে চলেছেন নিশ্চিত হতে।

অনামাংকিত, জঁ মিশেল বাস্কিয়া(Untitled. By Jean-Michel Basquiat)

রথকো পারেননি, টাকা ফেরত দিয়ে তিনি ছবিগুলো ফিরিয়ে আনেন অ্যাপার্টমেন্টে। তিনি কল্পনা করতেন তাঁর ছবি হয়ে উঠবে নাস্তিক পৃথিবীর একান্ত নিজস্ব আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা, যন্ত্রসভ্যতার মধ্যে জেগে থাকা প্রাচীন গ্রিক মন্দির। শেষ বয়সে দাম্পত্য বিপর্যয়ের সাক্ষী, মদ্যপ, ডিপ্রেশনগ্রস্ত শিল্পী ছবিগুলো তুলে দেন লন্ডনের কোনো এক মিউজিয়ামের হাতে। আর অবশ্যই সুইসাইড-ও করেন। ষাঁড়ের রক্তের মতো গাঢ় লাল রং তাঁর অপেক্ষায় বসে ছিল, সেই কোন ডায়ানাইসিসের সময়কাল থেকে, অবশেষে তিনি ধরা দিলেন।

ভাস্কর মৃত্যু নিয়ে কিছুই বলেনি, শুধু বলেছিল, “ঈশ্বর বন্ধ কৌটোর মতো”। প্রতিকৃতির অবয়বী দৃঢ়তায় এবং আঙ্গিকে-ও ছিল কিছুটা সনাতন। কোথায় জঁ মিশেল বাস্কিয়া-র ‘অ-নামাঙ্কিত’ ঘোর কৃষ্ণ মুখাবয়ব, আর কোথায় প্রায় মধ্যযুগীয় ধারার ভাস্কর। এ আক্ষেপ লুকানোর নয়। তবু পৈত্রিক ভিটের প্রতি মানুষের মায়া থেকে যায়।

বেশ কিছু বই বাপ্পামামার কাছে থেকে গেল, ফেরত দেয়নি। ওরও তো বাড়িভর্তি বই, কী হবে অতগুলো বইয়ের! কথাটা মাথায় এলে উঠে গিয়ে বেশ কিছুটা জল খাই। স্পষ্ট দেখতে পেলাম অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিন, থরেথরে পড়ে আছে, ধুলো ও মাকড়সার জালের মধ্যে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ছে।

জার্মান দার্শনিক নিৎসের ধারণা ছিল, শিল্পের কর্তব্য হল মানবিক অস্তিত্বের লড়াই ও নাটকীয় আতঙ্কসমূহকে ধারণ করে রাখা। রথকো পাশাপাশি আরো যোগ করেন, “I’m interested only in expressing basic human emotions. Tragedy, ecstasy, doom and so on.” রথকো ছিলেন অ্যাবস্ট্র‍্যাক্ট, অথচ ধ্রুপদী। মোজার্ট যেমন অবলীলায় কঠিনকে সরল বন্ধনে বেঁধে ফেলেন, তিনিও তাই। তাঁর ছবি আমাদের গভীর–গোপনকে দেখতে পায়, আমরা তাঁর ছবির সামনে সংকুচিত, আড়ষ্ট হয়ে যাই। আর এই বিন্দুতেই রথকোর সঙ্গে ভাস্করের পথ এসে মিশে যায়। ভাস্করের ছবিতেও প্রাথমিক আবেগের ঘনঘটা; ওর আত্মপ্রতিকৃতি কখন আমাদের অতিব্যক্তিগত প্রতিকৃতি হয়ে ওঠে, আমরা বুঝে উঠতে পারি না। আমাদের মনে মৃত্যুচিন্তা ফিরে আসে।

বহুক্ষণ জানলায় একমনে চেয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারি, ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে। আমাদের পোষা পেলু কলতলায় কুঁকড়ে শুয়ে আছে। ওর গায়ের লোমগুলো জলেভেজা, খাড়া। ওর শরীরের বক্রতা আমি লক্ষ করতে থাকি। আস্তে আস্তে ওইদিকে মন চলে যায়।

৪.


ভাস্কর পড়ে আছে সাঁকোর উপরে, উপুড় হয়ে। মাটির দিকে মুখ নিচু। পায়ের পাতার রং উজ্জ্বল। সরুসরু আঙুল সমেত রেলিংয়ের বাইরে ঝুলে আছে। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে খালের ক্ষীণকায়া স্রোত। দূরে জলে বক ও মহিষ। জলের রং মিশকালো, প্রান্তে সামান্য সাদা ফেনা তৈরি হচ্ছে স্রোতের কারণে। এভাবে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হলে আমি নিশ্চিতই খুশি হতাম। কিন্তু আচমকা ভাস্কর যে দাবি করে বসবে, “নাচ কই?”—তা আমি বিলক্ষণ জানি। আর তাছাড়া ভাস্করের মৃগীরোগ আছে। ওর দশফুট বাই দশফুট ঘরে, তাকিয়ায়, তোশকের নীচে অগুনতি হ্যান্ডমেড পেপার শুয়ে আছে গুপ্তসংকেতের অপেক্ষায়। এখন কে কার পাহারাদার—তা এখান থেকে বলা দুষ্কর। একদিন যেমন দেখলাম বিশ্বস্ত নীল গাত্রবর্ণ, তবে পরনের গেঞ্জিটা উজ্জ্বল সাদা। মাথাভর্তি চুল আর আশ্চর্য চোখে, ঠোঁটে হাসিখুশি কমলা রং। ছবিটা যৌবনের এবং স্বচ্ছ। পিছনে ছেয়ে আছে বিস্তৃত প্রতিস্পর্ধী নীল। আবার কখনও জাপানি ফুলের বনে টানাটানা চোখ। প্রাচ্যের ম্যাজিশিয়ান বলে ভ্রম হয়। উজ্জ্বল খয়েরি রং ধারণ করেছে তাকে, যেন থলেবন্দি পাহাড়ি নকশা। কখনও ঝড়ে এলোমেলো সাদাকালো রেখা ভেঙে যা উঠে আসে তা ভাস্করই তো। মৃত্যুশয্যার আইরিশ নীল ছেয়ে আছে বাসনে, মশারি অথবা চ্যাঁচারির বেড়ায়। দূর থেকে রুগ্ন আলো এসে পড়েছে ঘরময়। এসবই বিক্ষিপ্ত মুদ্রা। নিয়মনিষ্ঠ আসন পেতে রাখা, ধূপের কৌমার অন্য কারো হতে পারে, ওর নয়। কারণ আগেই বলেছি মৃগীরোগ, দাঁতে দাঁত লেগে যায়, শরীর খামচে ধরে, আশেপাশে সরঞ্জাম চুরচুর করে ভেঙে পড়ে। এখানে নিয়তিই শখ৷ শখ ঈশ্বর উন্মাদনা। আল্ট্রামেরিন ফিস জার জুড়ে কর্কট পোষা থাকে পিশাচ বন্দনায়। পার্শ্ববর্তী নাইটল্যাম্প মাথা কাত করে চেয়ে আছে অন্যত্র। আর তখন সে, ভাস্কর, কেবলই প্রসাধন। কোলাজের ছেঁড়াছেঁড়া টুকরোয় মিশে যাচ্ছে মৃত্যুকালীন নীলে।

শিল্পী — ভাস্করপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী — ভাস্করপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

নীল প্রতারণার এই যে নানারকম শেড, মজার কথা এর পরিণতিতেও যা পড়ে থাকে, তা হল নাচ।

বিপরীতধর্মী এক ক্রিয়ায় ভাস্কর বেঁধে ফেলেন আমাদের। তার উন্মার্গদর্শিতার পোর্টেটগুলোয় রং ঝরে পড়ে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, আলো ক্রমশ শুষে নেয় ত্বক। এই পর্যাপ্ত ক্লস্ট্রোফোবিক কন্ডিশন থেকে মুক্তি পেতে আমরা চোখ ফেরাই তার প্রথম যৌবনের সেই অফুরন্ত ফড়িংয়ের দিকে।

প্রথম যৌবনের এই উচ্ছ্বল পতঙ্গটি আদতে কিন্তু পরবর্তী প্রলয়নাচনের সূচনাবিন্দু মাত্র। পরবর্তী বহু পথ, মুখের বহু আদল বদল করে যা অনিবার্যভাবে এসে দাঁড়ায় সেই মুহূর্তে, যেখানে অন্তরাত্মার বিবর্ণ রং দেখা দেবে, প্যারানইয়া ছড়িয়ে পড়বে সমগ্র ক্যানভাসে। আমরা স্বস্তিবোধ করি, বিপন্ন শিল্পীর পরিচিত আদলটি হাতে পেয়ে। অথচ আমরা ভাবতে ভুলে যাই, এই নাচ বিস্ময়ের, অপরিণামদর্শিতার।

শিল্পী — ভাস্করপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী — ভাস্করপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

বর্তমানে ভাস্কর প্রতিষ্ঠিত ও পাগল। করুণার দৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘরে পোষা মুরগির মতো সে দানা খায়। গল্পটা এতদূর বেশ ছোটো পরিবার, সুখী পরিবার গোছের ছিল। ঘোর কাটে, যখন সামনে এসে পড়ে তার সাম্প্রতিকতম আত্মপ্রতিকৃতি। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি বেশ কিছুক্ষণ। এ ছবি সোনালি রোদ্দুরের। এই ছবিতে হাওয়া বাতাস খেলে উত্তরের খোলা ঘরের মতন। চারিপাশে ছেয়ে আছে নীল, তবে তা মাধুর্যময়। মধ্যে-মধ্যে পেন্সিলের, ইঙ্কের নিঁখুত কাজ। এমনকি পোশাকে ফুলের বিভিন্ন মোটিফ। সারাজীবনে যে পরিচিত আর্টিস্টিক অ্যাংস্ট(artistic angst), তা বিলকুল গায়েব। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকালে বোঝা যায়, মুখের চামড়ায় উজ্জ্বল রৌদ্রের মতো ওই ছোপগুলো বোধহয় বিক্ষিপ্ত ক্ষত, অথচ স্বভাবে হাসিখুশি।

হঠাতই শুনশান রাস্তায় মাথায় হেডক্যাপ, মুখে মাস্ক সব ভেদ করে পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে। অকুণ্ঠিত রোদের দিন, নীল আকাশে চিকচিক করছে সাদামেঘ। সে কী হাসি! বালকের নাচ—তালি দিয়ে দিয়ে—কখনও আমার মাস্ক দেখে, কখনও আমার হেডক্যাপ, আর কখনও কেবলই নিজের চারপাশে ঘুরে ঘুরে—নাচ।
‘সুন্দর গৌরাঙ্গ রায়!’

শিল্পী — ভাস্করপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী — ভাস্করপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

৫.


শিল্পী — ভাস্করপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

আমাদের সমস্ত উৎসব তার ব্যতিরেকে, দীর্ঘ গ্রীবা মরালের, অপরিচ্ছন্ন মুখ, কপালে সিঁদুরটিপ ঘামে এলোমেলো, বিষণ্ণ স্তনজোড়া বিরহউলের মতো গড়িয়ে দাঁড়ায় কিছু দূরে। মরলোকে সে ফিরেফিরে এসেছে বহুবার। তার পায়ের ছাপ পড়েছে চৌকাঠে, পড়েছে গোয়ালের কাদায়।

‘সে খাচ্ছে, যেভাবে
সারাদিন রোদে খেটে-আসা নারী খায়; যদিও সে
খাচ্ছে রক্ত, মুখে কোনো শোক বা আনন্দ নেই, দিব্যতা-ও নেই
নালার এপাশে ব’সে ক্ষুণ্ণিবারণের জন্যে স্পৃহাহীন মুখে
রক্ত খেয়ে যাচ্ছে। একবার আমাকে দেখলো।’
(‘শক্তি’, ‘টেবিল, দূরের সন্ধ্যা’, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল)

অথচ বেমালুম আমাদের নজর এড়িয়ে গেল আত্মপ্রতিকৃতির এই বিপরীত প্রান্তটি। আমরা টেবিল সাজিয়ে বসলাম, উৎসবে, পানাহারে—অথচ সে কোথাও নেই। বাতিল পরিচারিকার ফোন নম্বরের খোঁজ পড়ে ঠিক তখন, যখন তা খোয়া গেছে চিরতরে। অল্প নেশার প্রহরে সে হয়তো বাস ধরল ঘরের। আমাদের হাত সামান্য নড়ে উঠল যখন ব্লাউজের ভেতর থেকে সে বার করল ছোট্ট বটুয়া। যখন বাথরুমের দরজা ধরে বসে পড়েছি মেঝেয়, খেয়াল হল তার ঠোঁটের কোণে রক্ত লেগেছিল।

শিল্পী — ভাস্করপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী — ভাস্করপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

পুনশ্চ—
এতদিনের যে দীর্ঘ আনুষ্ঠানিকতা, রক্তমাংসের কুস্তি, আজ তার শেষ পর্ব। শেষ করব যে পঙ্‌ক্তি ক’টি দিয়ে তার কেন্দ্রেও বাসা বেঁধে আছে চিরউজ্জ্বল এক মুখচ্ছবি…

“There rose a tree. O pure transcendence!
O Orpheus sings! O tall tree in the ear!
And all was silent. Yet still in this silence
proceeded new beginning, sign and transformation.”

[Sonnets to Orpheus, First Sonnet, Rainer Maria Rilke, Translated by A. Poulin.]

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *