কিংস গ্যামবিট – আলভী আহমেদ
সেলফোনের ছয় ইঞ্চি স্ক্রিনে চোখ দুটো আটকে আছে আমার। অপোনেন্ট ব্রাজিলের এক মেয়ে।
সাদা নিয়ে খেলছে সে। রাজার সামনের পন দুই ঘর সামনে বাড়ানো। যারা সাদা নিয়ে খেলে তাদের বেশিরভাগের প্রিয় ওপেনিং হল, e4। এই ওপেনের বিপক্ষে সাধারণত আমি খেলি সিসিলিয়ান, c5। ডিফেন্সের পাশাপাশি কাউন্টার অ্যাটাকেরও সুযোগ থাকে তাতে। কালোর জন্য এটাই সবচেয়ে ডায়নামিক ডিফেন্স। অন্তত আমার তা-ই মনে হয়।
কিন্তু আজ বোধ হয় দু-একটা ঝুঁকি নেওয়া যায়। সকাল থেকেই মেজাজ বেশ ফুরফুরে আমার। হাওয়ায় উড়ছি। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, আজ সবকিছুতে জিতে যাব। কেউ আমাকে হারাতে পারবে না।
এক একটা দিন এমন হয়। ঘুম থেকে উঠে আপনার গা ম্যাজম্যাজ করবে না। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামবেন। ঠিক তখনই কলবেল বাজবে। বুঝতে পারবেন, নিউজ পেপার এসে গেছে। পত্রিকাটা তুলে নিয়ে আয়েশ করে সিগারেট ধরাবেন। কমোডে বসে খেলার খবরের পাতায় চোখ বোলাচ্ছেন, সিগারেট অর্ধেক শেষ হয়নি তখনও, আবিষ্কার করবেন যে পেট ক্লিয়ার আপনার। যদি ভাগ্য খুব ভালো হয় তো দেখতে পাবেন জানালার ওপাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি নামবে। পৃথিবীকে সেদিন নিজের ক্রীতদাস বলে মনে হবে।
আজ আমার ফুরফুরে মেজাজের পেছনে আরও একটা কারণ যোগ হয়েছে। বেড়াতে যাচ্ছি। ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে প্রথমে যেতে হবে মুম্বাই। চার ঘণ্টা যাত্রাবিরতি সেখানে। তারপর ডোমেস্টিক ফ্লাইট ধরে গোয়া। অবশেষে আমি আমার গর্ত থেকে বের হয়েছি। সাড়ে তিন বছর পর।
কিছুদিন গা-হাত-পা ছেড়ে দিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করব এবার। ক্লায়েন্টের সাথে ফালতু মিটিং-সিটিং নেই। বসের বোরিং জোক শুনে গা দুলিয়ে হাসতে হবে না। নীলের সাথে প্রেমটা হব হব করছে। সেটা থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করব, সে-ই প্রেমটা আদৌ জরুরি কি না।
মন চাইলে গল্পের বই পড়ব। ইশিগুরোর ‘নেভার লেট মি গো’ কিনে রেখেছি গত অক্টোবরে। তিন মাসে তিন পাতাও পড়িনি। এবার শেষ করতে হবে। টেবিলের ওপর বইটা দেখে নিজের কাছেই অপরাধী মনে হয় নিজেকে। ইশিগুরো চোখ পাকিয়ে আমাকে বলে, কী ব্যাপার? তুমি কি আমার বইটা পড়বে না? তাহলে কিনেছ কেন?
রবিবার সকালে রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম হওয়ার কথা। এক ঘণ্টা সময় হাতে রেখে উবার কল করেছিলাম। বাইরে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই রকম হয়। আপনার যেদিন মেজাজ ফুরফুরে থাকবে সেদিন জানুয়ারি মাসেও সকালবেলা বৃষ্টি পেয়ে যাবেন।
উবারে চড়ার পর আবিষ্কার করলাম, রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। সম্ভবত শীত আর বৃষ্টির দোহাই দিয়ে সবাই আজ কাজে ফাঁকি দেবে। বাসা থেকে বের হয়নি। থাকুক, ওরা সব বাসাতেই থাকুক। খিচুড়ি-ডিমভাজি খাক। প্রতিদিন কাজে বের হওয়া মোটেই হেলদি ব্যাপার নয়। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুব খারাপ।
আবিষ্কার করলাম, পথের দেবতা আমার ওপর ভর করেছে। কারওয়ান বাজারে জ্যাম নেই। প্রাইম মিনিস্টার অফিসের সামনে গাড়িতে বসে থাকতে হল না। মহাখালী ফ্লাইওভার ছিল ফাঁকা, শ্মশানের মতো। এয়ারপোর্ট পর্যন্ত একটানে চলে এসেছি। লক্ষণগুলো স্পষ্ট। আজ আমার জিতে যাবার দিন। ভাগ্য আমার সাথে আছে। এমন দিনে একটু ঝুঁকি নেওয়া যায়। আমি সিসিলিয়ান ডিফেন্স না খেলে রাজার সামনের পন দুই ঘর বাড়িয়ে দিলাম, e5।
অপোনেন্ট চুপ করে আছে। থমথমে নীরবতা। সাথে সাথে কোনো চাল দিল না। সময় নিচ্ছে। ভাবছে কী করবে।
আমরা চেজ ডট কমে গেমটা খেলছি। একেকজনের জন্য বরাদ্দ সময় ২০ মিনিট। ভাবার মতো যথেষ্ট সময় তার হাতে আছে। অনেক ভেবে মেয়েটা লাইট স্কয়ার বিশপের সামনের পন দুই ঘর বাড়াল, f4। এই পনের কোনো ডিফেন্ডার নেই। একলা দাঁড়িয়ে আছে। অসহায়। মেয়েটা আমাকে পন অফার করেছে। কোনো কিছুর বিনিময়ে নয়। একদম ফ্রিতে। কিংস গ্যামবিট।
কোনো একটা কিছু ফ্রিতে দিলেই যে সেটা আমি হাত পেতে নেব, তেমন হ্যাংলা আমি নই। এত দিনে এই একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছি যে পৃথিবীতে কোনো কিছুই ফ্রি নয়। আপাতদৃষ্টিতে ফ্রি বলে মনে হতে পারে। ভালো করে খুঁজলেই এর পেছনে অন্য আরেকটা উদ্দেশ্য টের পাওয়া যাবে। ভয়ংকর কোনো উদ্দেশ্য। সাদাচোখে দেখা যায় না।
মেয়েটা আমাকে কিংস গ্যামবিটে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এখন আমি দুই ধরনের খেলা খেলতে পারি। এই আমন্ত্রণে সাড়া দিতে পারি। তখন সে আমাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করবে। আমি যদি সতর্ক থাকি তাহলে হয়তো তার উদ্দেশ্য সফল হবে না। আবার গ্যামবিট অফারকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে নিজের মতো করে খেলতে পারি। কোন্টা করব?
এয়ারপোর্টের দোতলায় এমেক্স লাউঞ্জে বসে আছি আমি। ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ। বোর্ডিং শুরু হতে ৪৫ মিনিট বাকি তখনও। চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে মনে হল, দরকার নেই ফাঁদে পড়ার। কিংস গ্যামবিট ডিক্লাইন করে দেব বলে যখন স্থির করেছি, পেছনে একটা গলার স্বর শুনতে পেলাম। আমি যে সোফায় বসে আছি তার ঠিক দুহাত পেছনে একটা মেয়ে কথা বলছে, আধা ঘণ্টা আছে এখনও। কফি নিয়ে আসি?
আমি প্রায় জমে গেলাম সে-ই স্বর শুনে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। পুরো এমেক্স লাউঞ্জে আমার জন্য একটুও অক্সিজেন জমা নেই। এই স্বর আমার বহুদিনের চেনা। ঘাড় না ঘুরিয়েও বলে দিতে পারি, মেয়েটা দিপা। বুকের মধ্যে ঝাঁকি খেল বেশ কয়েকটা। আটত্রিশ বছর বয়সে এসেও আমার বুকে ঝাঁকি খায়। হঠাৎ খুব গরম লাগতে শুরু করল। টের পেলাম, ঘামছি আমি। একবার ভাবলাম, উঠে বেরিয়ে যাই সেখান থেকে। সাথে সাথেই সে সম্ভাবনা বাতিল করতে হল। এখন আমি উঠে উলটো ঘুরে হাঁটতে শুরু করলে দিপা আমাকে দেখে ফেলবে।
একটা ভারী পুরুষকণ্ঠ বলল, ওদের বললেই কফি দিয়ে যাবে। আমি বলছি। তুমি বরং ওয়াশরুম থেকে ঘুরে আসো। তিন ঘণ্টা মতো প্লেনে বসে থাকতে হবে। যাও, একটু ফ্রেশ হয়ে নাও।
এবার আমি আমার হুডিটা মাথার ওপরে টেনে দিলাম। মাথা নীচু করে মোবাইল স্ক্রিনের ওপর ঝুঁকে পড়লাম। ওয়াশরুমে যেতে হলে দিপাকে আমার পাশ দিয়ে যেতে হবে। আমি চাই না সে দেখে ফেলুক এখানে আমি বসে আছি।
দিপা আমার পাশ দিয়ে টুক টুক করে হেঁটে চলে গেল। আমি ওর শাড়ির সরসর শব্দ শুনতে পেলাম। একবার মনে হল, আঁচল ছুঁয়ে গেছে আমাকে। কী একটা পারফিউম দিয়েছে শরীরে। আগে সে দিত শ্যানেল। সেই গন্ধের সাথে তার শরীরের নিজস্ব গন্ধ মিশে এক সুবাস তৈরি হত। অন্যরকম একেবারে। সে-ই বুনো গন্ধ আমার বড়ো চেনা।
দিপা টের পেল না কিছু। ফিরেও তাকাল না। আমি আড়চোখে দেখলাম। শরীর সামান্য ভারী হয়েছে। অন্তত পেছন থেকে দেখে তা-ই মনে হল। ওজন বেড়েছে। অন্তত পাঁচ কেজি। তাহলে কি এক্সারসাইজ করা ছেড়ে দিয়েছে? এমন তো হবার কথা নয়। দিপা নিজেকে খুব ভালো মেইনটেইন করতে পারে। তাহলে কি খুব বেশি সুখে আছে? শুনেছি, সুখে থাকলে মেয়েরা প্রচুর ঘুমায় আর ফুলতে থাকে। দিপা সুখে আছে, এই জিনিসটা জানতে পেরে আমার কি একটু হিংসা হওয়া উচিত নয়? হচ্ছে না তো। একটু মন খারাপ অবশ্য হচ্ছে। সেটা ঠেকানোর উপায় নেই।
দিপার মধ্যে আরও কিছু পরিবর্তন হয়তো হয়েছে। অন্তত একটা পরিবর্তন তো ইতিমধ্যে ধরতে পেরেছি। সে এখন কফি খায়। অথচ দিপা ছিল চায়ের পোকা। দিনে আট-দশ কাপ চা খাওয়া ছিল তার জন্য খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। রং চা। দুধ চা ছিল তার দুই চোখের বিষ। বারান্দায় টবে তুলসীচারা লাগিয়েছিল বেশ কয়েকটা। পানিতে তুলসীপাতা ছেড়ে দিয়ে প্রায় ১৫ মিনিট ধরে ফোটাত সে। তুলসীর নির্যাস মিশে যেত পানিতে। তারপর একটা টি-ব্যাগ ছেড়ে দিত। নো সুগার।
কফি খেতে কেমন লাগে এখন দিপার?
আমি নিজেকে আড়াল করতে চেয়েছিলাম ওর কাছ থেকে। এবং সফল হয়েছি সেই চেষ্টায়। যখন বুঝতে পারলাম সফল হয়েছি, সাথে সাথে মনে হল, মাটিতে মিশে যাই। দিপা! আর ওর সাথে সংসার করেছি ৫ বছরের বেশি। বিয়ের আগে প্রেমও করেছি ৩ বছর। সব মিলিয়ে ৮ বছরের কম না। সেই মেয়ে আমার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল। অথচ বুঝল না, আমি বসে আছি! এক ভয়ংকর অভিমান আমাকে পেয়ে বসল।
আমি কি এতই তুচ্ছ একজন মানুষ নাকি? এ কেমন ফাজলামি? একসাথে এক রুমে এক বিছানায় থেকেছে দিনের পর দিন। আমরা দুজন দুজনের শরীরের প্রতিটা সেন্টিমিটার চিনি। হাজার মানুষের ভিড়ে অন্ধের মতো গন্ধ শুঁকে আমি দিপাকে চিনে নিতে পারব। অথচ সে আমার ঠিক পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল। ঘাড়টা বাঁকাও করল না। আমি যে একটা মানুষ এখানে বসে আছি সে কি অদৃশ্য কেউ? এইচ জি ওয়েলসের উপন্যাস থেকে নেমে এসেছি ঢাকা এয়ারপোর্টে? এসব মামদোবাজি চলবে না আমার সাথে। দিপা কেন বুঝতে পারবে না আমি এখানে বসে আছি?
আসলে আমি কী আশা করেছিলাম? দিপা পেছন থেকে আমার বসে থাকার ভঙ্গি দেখেই চিনে ফেলবে? তারপর এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করবে, কেমন আছো?
সেলফোন টেনে নিয়ে কিংস গ্যামবিট অ্যাকসেপ্ট করলাম। f4 পন তুলে নিলাম- exf4। আসল খেলা শুরু।
এখন আমাকে বুঝেশুনে খেলতে হবে। লোভে পড়ে একটা পন তুলে নিয়েছি। এর মাশুল দিতে হতে পারে। খুব সাবধানে বুঝেশুনে নেক্সট মুভের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করব। কী করা যায়? দিপা ফিরে এলে সরাসরি তার টেবিলে গিয়ে বলব, হাই দিপা, কেমন আছো?
আমাদের শেষ দেখা হয়েছে সাড়ে চার বছর আগে। সেবার আমরা দুজন মুখোমুখি বসে আমাদের ডিভোর্সের কাগজপত্রে সাইন করেছিলাম। আমি যদি ওর টেবিলে গিয়ে হাজির হই, ও কী ধরনের রিঅ্যাকশন দেবে? ওর হাজব্যান্ডই-বা কী মনে করবে? সে কি বিব্রত হবে? ওই ভদ্রলোকের সাথে আমার পরিচয় নেই। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই আমার ব্যাপারে জানেন। আমি যেমন জানি, দিপা বিয়ে করেছে এক ইঞ্জিনিয়ারকে। এরিকসনের সাপোর্ট ইঞ্জিনিয়ার। এখন পোস্টিং মালয়েশিয়ায়। ডলারে কামায়। আমার মতো কেবলাকান্ত মিডল ক্লাস সিটিজেন না।
এ ধরনের তথ্যগুলো আপনি চান বা না চান কেউ একজন এসে আপনার কানে পৌঁছে দেবে। আমি যেহেতু ওই ভদ্রলোকের ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্য জানি, সে-ও আমার ব্যাপারে জানবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাকেও নিশ্চয়ই কেউ একজন এসে বলেছে, দিপার এক্স হাজব্যান্ড একটা অ্যাড ফার্মে কাজ করে। খুবই বাজে লোক। কথায় কথায় মেজাজ দেখায়। প্রয়োজন ছাড়া তর্ক করে। আর প্রচুর মদ খায়।
ধরা যাক, হ্যাংলার মতো গিয়ে আমি ওদের টেবিলের সামনে দাঁড়ালাম। তারপর? না না, চিনি না, জানি না এমন লোকের সামনে গিয়ে পড়তে চাই না। নিজে বিব্রত হব, তাকেও একটা ঝামেলায় ফেলে দেব। কী দরকার?
ওয়াশরুমের কাছে গিয়ে দাঁড়াব? মেল এবং ফিমেল ওয়াশরুমে ঢোকার দরজা মুখোমুখি। সেখানে গিয়ে দাঁড়ানো যেতে পারে। দিপা বেরিয়ে এলে ওর হাজব্যান্ডের অগোচরে দু-একটা কথা বলব? কিন্তু কী কথা বলব? বেশ মোটা হয়ে গেছ তুমি—এমন কথা দিয়ে শুরু করব? নাকি অন্য কিছু?
হাই, দিপা কেমন আছ? এটা বলা যেতে পারে। এটুকু নাহয় বললাম। পরের কথাটা কী হবে? মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম অপোনেন্ট খেলেছে Bc4। আমি একই সাথে দুটো বিষয় নিয়ে ভাবছি। আমার পরের মুভ কী হবে? আর দিপাকে কেমন আছ জিজ্ঞেস করার পর কী বলব? কথা কীভাবে চলবে? এমন একটা কথা আমাকে খুঁজে বের করতে হবে যে কথায় অনেক কথা বলা হয়ে যায়। কৌশলী কোনো কথা। অব্যর্থ কিছু শব্দ। কাগজ হল একটা টু ডাইমেনশনাল জিনিস। কিন্তু কৌশল জানা থাকলে সেখানে থ্রি ডাইমেনশনাল ছবি আঁকা যায়। তেমন একটা ছবি আমাকে আঁকতে হবে কথার পিঠে কথা জুড়ে দিয়ে।
কথা চালাতেই-বা হবে কেন? দিপা কেমন আছ—এ কথা জিজ্ঞেস করার পর সেখানেই আলাপ শেষ হয়ে যেতে পারে। তাতে ক্ষতি কী? গত সাড়ে চার বছরে তার সাথে কথা হয়নি। তাতে কি আমার কিছু অসুবিধা হয়েছে? ওজন কমেছে? রাতে ঘুম হয়নি? নাকি নতুন করে প্রেমে পড়তে সমস্যা হয়েছে? এই যে আমি এখন দিপার মুখোমুখি দাঁড়াতে চাচ্ছি, সেটা কেন? সে আমাকে চেনেনি বলে? এই অভিমানে তাকে যন্ত্রণা দেব? দিতেই হবে? প্রশ্নগুলো আমার মাথার ভেতরে ভাসতে লাগল, কুয়াশার মতো।
সেলফোনে বিপ বিপ করে একটা ওয়ার্নিং টোন পেলাম। আমার চাল দেবার সময় ফুরিয়ে আসছে। আগে-পরে কিছু না ভেবে কুইন টু এইচ ফোর খেললাম। এবং ব্যাগটা কাঁধে তুলে বেরিয়ে গেলাম এমেক্স লাউঞ্জ থেকে। কিংস গ্যামবিট অ্যাকসেপ্ট করা উচিত হয়নি আমার। লোভ করা ভালো না।
এখন যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, সেখান থেকে পালাতে হবে। দিপা ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসার আগেই। যে আমাকে চিনতে পারেনি তার সামনে গিয়ে বোকার মতো দাঁড়াব, এ আমার পোষাবে না। পালাই বরং। এই একটা কাজ আমি খুব ভালো পারি। যেকোনো ঝামেলা থেকে লেজ গুটিয়ে পালাই।
মানুষ প্রথম প্রেম নিয়ে এত মাতামাতি করে কেন কে জানে? আমার কাছে কিন্তু সর্বশেষ প্রেমটাই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। আমি যখন প্রেমে পড়ি, তখন পুরোটাই পড়ি। ফিফটি ফিফটি কিছু হয় না। আগের স্মৃতি ধুয়েমুছে নতুন করে পড়ি। প্রতিটা প্রেমই একই রকম তীব্র মনে হয়। যখন যার সাথে সম্পর্ক সেই মেয়েই আমার জগৎজুড়ে থাকে। পুরোনো স্মৃতিগুলো রিসাইকেল বিনে চলে যায়। দীর্ঘদিন ধরে আমি এভাবেই বেঁচে আছি। এভাবে সবকিছু খুব সহজ মনে হয়।
কোনো কোনো পাখি আছে যারা সঙ্গীর মৃত্যুর পর আর নতুন সঙ্গীর খোঁজে বের হয় না। সারা জীবন একা থাকে। সমস্যা হচ্ছে, আমি মানুষ। আমার অনেক রকম প্রয়োজন আছে। আমি প্রেম করি। বিয়ে করি। ডিভোর্স খাই। তারপর নতুন করে প্রেমে পড়ি। আরও নানা কেচ্ছা-কাহিনি করি।
দিপার সাথে প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেছে আলাদা হয়েছি। মাঝখানে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম করেছিলাম। নুসরাতের সাথে। সেটা ভাঙার পর নতুন আর একটা প্রেম হব হব করছে। সে-ই হিসেবে দিপার নামটা রিসাইকেল বিনে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকার কথা। অথচ মনে হল, বিন থেকে সেই স্মৃতিগুলো কেউ কুড়িয়ে এনে আমার সামনে গুছিয়ে রেখে গেল। এখন এই স্মৃতিগুলোকে ইগনোর করি কীভাবে?
দাবায় হেরে গেছি ততক্ষণে। ১৩ নম্বর চালের মাথায় রুক স্যাক্রিফায়েস করতে হয়েছে। এরপর আর খেলার মানে নেই। রিজাইন করলাম। অসম প্রতিযোগিতা আমি এড়িয়ে চলি।
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে দিপা তার বিশপের সামনের পন দুই ঘর বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেদিন যদি আমি কিংস গ্যামবিট ডিক্লাইন করতাম? কী হত? আমি তো বরাবরই সেফ সাইডে থাকি। সেদিন কেন পারলাম না? একবার কি বলতে পারতাম না, দিপা যেয়ো না?
সেকেন্ডের ভগ্নাংশের ভুল। আমি গ্যামবিট অ্যাকসেপ্ট করেছিলাম। লোভ সামলাতে পারিনি।
দিপার সাথে বিয়ে হয়েছিল প্রেম করে। বিয়ের আগে তিন বছর প্রেম করেছিলাম আমরা। তুমি-আমি, আমি-তুমি টাইপ প্রেম না। সে প্রেম ছিল ঝড়ের মতো। ভাসিয়ে নিয়ে যেত আমাদের। দিপা একটা খুবই নম্রভদ্র গোছের মেয়ে। পড়ালেখায় ভালো। ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হয় না। পাস করে বের হবার সাথে সাথে ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করবে—এ কথা আমরা সবাই আগে থেকেই জানতাম। মুখ দিয়ে কখনও কোনো স্ল্যাং বের হয় না তার। সে আর আমি অনেকটা মূল শব্দ আর বিপরীত শব্দের মতো। কোনো মিল নেই দুজনের। তাই আমার সাথে তার প্রেম হবার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছিল না। তবু হয়ে গেল। চুম্বকের দুই বিপরীত মেরু পরস্পরকে আকর্ষণ করে। এ কথা আমরা ছোটোবেলায় শিখি। আর বড়োবেলায় প্রমাণ পাই।
কিন্তু আকর্ষণ কত দিন থাকে? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বিয়ের মাস দুয়েকের মাথায় দিপার ঘোর কাটতে শুরু করল। তখন সে একটা কর্মসূচি হাতে নেয়। আমাকে মানুষ করার কর্মসূচি। ঘষেমেজে পিতলকে সোনা বানাবে। আমি সিগারেট খাই, কেন খাই? ড্রিংক করি মাঝেমধ্যে, কেন করি? ঠাস ঠাস শব্দে হাসি। ও বলে, আস্তে হাসতে পারো না?
সেলফোনে চেজ খেলি, পোকার খেলি। এটা তার পছন্দ না। আমি আয়রোজগারের ব্যাপারে উদাসীন। অফিস যে কাজটুকু করতে বলে তার বাইরে কিছু করি না। ও আমাকে বলে, মোটিভেশনের অভাব। তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না।
আমিও জানি, আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। কিন্তু সে কথা প্রিয়জনের মুখে শুনতে কার ভালো লাগে? বিয়ের আগে আমার যে উদাস উদাস ভাব দেখে সে প্রেমে পড়েছিল, বিয়ের পর প্রথম ধাক্কাতেই সেগুলো শোধরানোর চেষ্টা করল দিপা। আমি মেনে নিলাম, মনে নিলাম না।
ফলাফল হিসেবে আমার সাথে তার প্রতিদিন কথা-কাটাকাটি হত। আসলে কথা-কাটাকাটির জন্য একজনের কথাকে আরেকজনের কথা দিয়ে কাটতে হয়। আমি তা করতাম না কখনও। দিপা বেশি রেগে গেলে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরাতাম। এতে সে আরও রেগে যেত। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে একদিন আমি আবিষ্কার করলাম, আমাদের কিছু মিলছে না।
সুখ কী জিনিস, তা সে আমার সাথে থেকে বোঝেনি। এক দিনের জন্যও না। হয়তো সে সুখের আশায় আমার কাছে আসেওনি। তাহলে কেন এসেছিল? সম্ভবত সুখের অনুপস্থিতি কী, এই ব্যাপারটা বোঝার জন্য।
আমি খুব ধীরে ধীরে এমন এক মানুষে পরিণত হচ্ছিলাম, যে মানুষটা আমি হতে চাইনি। মুখোশ পরে থাকতাম সব সময়। আমার উচিত ছিল মুখোশটা ছুঁড়ে ফেলা। কিন্তু তার আগেই দিপা আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সেদিন ছিল শনিবার। দুজনের কারোরই অফিস নেই। কী কী কারণে আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত সে ব্যাপারে দিপা আমাকে ছবক দিল কিছুক্ষণ। তারপর ঠান্ডা মাথায় বলল, আমি বরং কয়েকটা দিন মার বাসায় কাটিয়ে আসি।
আমি বললাম, আচ্ছা।
ততক্ষণে প্ল্যান করতে শুরু করেছি, দিপা মার বাসায় যে কদিন থাকবে, সে কদিন কী কী করব। সুমন কয়েকদিন ধরেই বলছে সে এক বোতল জনি ওয়াকার গিফট পেয়েছে। আমার যেদিন সময় হবে সেদিন তার বাসায় বসব। বোতল খোলা হবে। দিপা যখন কথা বলছিল, আমি সুমনকে টেক্সট করে দিলাম, আজ রাতে আসছি।
দিপা f4 পন সামনে বাড়িয়েছিল। আমি ফাঁদে পা দিলাম। কিংস গ্যামবিট অ্যাকসেপ্ট করলাম- exf4। লোভ!
দিপা একটা ছোটো ব্যাগে তিন-চার দিনের কাপড় গুছিয়ে নিয়ে গিয়েছিল মার বাসায়। আর ফেরেনি।
প্রত্যেকের জীবনেই এমন একটা সময় আসে যখন কোনো লোভে পড়া যাবে না। একদম কম্পাস দিয়ে মেপে একটা বৃত্ত এঁকে তার মধ্যে থাকতে হবে। শক্ত করে কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে হবে, যেন সেই সীমানার বাইরে কেউ টানতে না পারে। কিছু মানুষ আছে যারা এ কাজটা করতে পারে। যারা পারে না তারা আমার মতো হয়।
স্পিকারে এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইটের যাত্রীদের বোর্ডিংয়ের জন্য ডাকা হচ্ছে। ২ নম্বর গেটে বোর্ডিং। কিন্তু আমাকে এই মুহূর্তে একটা সিগারেট খেতে হবে। না খেতে পারলে মরে যাব আমি। আমি হাঁটছি স্মোকিং জোনের দিকে। হাঁটছি তো হাঁটছিই। শেষই হচ্ছে না পথ। ঢাকা এয়ারপোর্ট হঠাৎ করে আকারে এত বড়ো হয়ে গেল কীভাবে? তাহলে কি আমি মুম্বাই এয়ারপোর্টে চলে এলাম?
একটু পরে খেয়াল হল, আসলে আমি হাঁটছি না। ডিউটি ফ্রি শপগুলোর এক পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। একবার মনে হল, চারদিকে অনেক লোক, তারা প্রচুর কথা বলছে। আবার মনে হল, কেউ নেই। সুনসান নীরবতা চারদিকে। মানুষ আসছে। মানুষ যাচ্ছে। টার্মিনালের এ-মাথা ও-মাথা পর্যন্ত তারা কোনো কারণ ছাড়াই ছুটছে। আমি তাদের দেখছি, আবার দেখছি না। তারা কথা বলছে। কোন্ ভাষায় কথা বলছে বুঝতে পারছি না।
কে যেন বাঁ দিক থেকে এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সামনে চলে গেল। কাঁধ থেকে ল্যাপটপের ব্যাগ নীচে পড়ল। আমি ব্যাগটা তুলে নিলাম। তারপর সোজা হেঁটে গেলাম সিঁড়ির দিকে। আমাকে আবার এমেক্স লাউঞ্জে ফিরে যেতে হবে। দিপার চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করতে হবে, কী ব্যাপার? আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে, চিনতে পারলে না? এ রকম কথা ছিল?
সিঁড়ি বেয়ে উঠছি আমি। একটা একটা করে ধাপ পার হচ্ছি। আর চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে। দিপা যখন আমাকে ডিভোর্স দিল তখন আমার মন খারাপ হয়নি। মন খারাপ হয়েছে আজ। সে আমাকে চিনতে পারেনি। সে এটা করতে পারে না। কোনোভাবেই না।
সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে যখন পৌঁছেছি, টুং টুং করে আমার মেসেঞ্জারে অ্যালার্ট টোন বাজল। মেসেঞ্জার ওপেন করে থমকে গেলাম। দিপা লিখেছে, কথা বললে না যে? আর ওভাবে পালালে কেন? সব ঠিকঠাক?
আমার সেই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হল, ঠিক নেই দিপা। কিছু ঠিক নেই। কিচ্ছু না…। কিছু ঠিক হবে না… কোনোদিন না।