জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ৫ )
মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদঃ অরুন্ধতী ভট্টাচার্য
পর্ব – ৫
কলা কোম্পানির আমলে এটাই ছিল সবচেয়ে ভালো ফার্মেসি। কিন্তু ফাঁকা আলমারিতে আগেকার অসংখ্য শিশি-বোতলের মধ্যে অবশিষ্ট আছে শুধু গুটিকয় পোর্সেলিনের বড়ো বোতল, তাদের গায়ে সোনালি অক্ষরে কিছু লেখা। সেলাই মেশিন, ছোটো দাঁড়িপাল্লা, ক্যাডিউসিয়্যাস[১], তখনও দুলতে থাকা পেন্ডুলাম দেওয়া ঘড়ি, লিনৌলিয়াম কাপড়ের উপর লেখা হিপোক্রেটিক শপথ, ভেঙে পড়া কতগুলো রকিং চেয়ার–ছোটোবেলায় যেমন দেখেছি সবকিছু ঠিক তেমনই যে যার জায়গায় বিরাজমান, শুধু তাদের গায়ে সময়ের মরচে পড়ে গেছে।
আদ্রিয়ানা নিজেও এই সময়ের শিকার। যদিও আগের মতোই বড়ো বড়ো ফুলের নক্সা করা পোশাক পরে আছেন, কিন্তু যে উচ্ছ্বলতা ও রহস্যময়তা যৌবনের অনেকটা সময় পর্যন্ত তাঁকে সকলের মধ্যমণি করে রেখেছিল, তার কণামাত্র আজ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। একমাত্র অক্ষত আছে তাঁর গায়ের ওষধি তেলের গন্ধ। সে গন্ধে বিড়ালও পালায়। আর সেই গন্ধের স্মৃতি আমার বাকি জীবনে ধ্বংসের অনুভূতি বয়ে এনেছে।
মা ও আদ্রিয়ানার কান্নাকাটির পালা শেষ হলে কাঠের পার্টিশানের ওপার থেকে শোনা গেল বুক চাপা কাশির শব্দ। ফার্মেসির ভেতরের অংশ আর আমাদের মাঝে রয়েছে এই পার্টিশান। সেই মুহূর্তে আদ্রিয়ানার মধ্যে পুরোনো উচ্ছ্বলতার একটা ঝলক যেন উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। পার্টিশানের অপর পারে যাতে শোনা যায় এমনভাবে গলা তুলে বললেন:
—‘ডাক্তার, বলো তো কে এসেছে।’
ওপার থেকে একটা কর্কশ পুরুষ কণ্ঠ নিষ্পৃহভাবে উত্তর দিল:
—‘কে?’
আদ্রিয়ানা উত্তর না দিয়ে ইশারায় আমাদের ভেতরে যেতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে ছোটোবেলার ভয়ের স্মৃতি আমাকে সেখানেই নিশ্চল করে দিল আর মুখ ভরে উঠল তিক্ত লালায়। তবুও মায়ের সঙ্গে ভেতরে ঢুকলাম। জায়গাটা খুবই অবিন্যস্ত। আগে ওখানে ওষুধ তৈরি হত। জরুরি প্রয়োজনে শুয়েও পড়া হত কখনও কখনও। সেখানেই ছিলেন ডা. আলফ্রেদো বারবোসা–জল ও স্থলের সমস্ত বৃদ্ধ মানুষ ও পশুদের চেয়েও অনেক বেশি বৃদ্ধ। শনের তৈরি তাঁর চিরন্তন হ্যামকে শুয়ে আছেন, খালি পা আর পরনে মোটা সুতির ঐতিহাসিক পাজামা যাকে কয়েদিদের পোশাক বললেও ভুল হবে না। তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল ছাদে। আমাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে মাথা ঘোরালেন ও জ্বলজ্বলে দুটো হলুদ চোখ দিয়ে আমাদের নিরীক্ষণ করে চললেন, যতক্ষণ না চিনতে পারলেন মাকে।
—‘লুইসা সান্তিয়াগা!’ সবিস্ময়ে বলে উঠলেন।
তারপর উঠে বসলেন হ্যামকে। শরীরে যেন তাঁর পুরোনো আসবাবের স্থবিরতা। তবে দ্রুত ফিরে পেলেন মানুষী সত্তার পূর্ণাবয়ব ও গরম হাত দিয়ে আমাদের সঙ্গে করমর্দন করলেন। আমার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে বললেন, ‘গত এক বছর ধরে আমার জ্বর হচ্ছে।’ হ্যামক ছেড়ে এবার বিছানায় এসে বসলেন। তারপর প্রায় এক নিশ্বাসে বলে গেলেন:
—‘এই শহরের যে কী অবস্থা হয়েছে তা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না।’
এই একটা বাক্য, একটা গোটা জীবনের সংক্ষিপ্তসার, কিন্তু সেটাই যথেষ্ট ছিল তাঁকে বুঝে নিতে, যেমনটা সম্ভবত তিনি সারাজীবন ছিলেন–একজন নিঃসঙ্গ ও দুঃখী মানুষ। তাঁর রোগা, লম্বা চেহারা, যেমন তেমন করে কাটা তামাটে রঙের সুন্দর চুল আর গভীর পীতাভ দুটো চোখ। ছোটোবেলায় আমি ওই চোখদুটোকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পেতাম। বিকেলবেলায় স্কুল থেকে ফেরার পথে তাঁর শোবার ঘরের জানলায় উঁকি দিতাম। সে ছিল ভয়ের আকর্ষণ। তিনি তখন হ্যামকে শুয়ে জোরে জোরে দোল খেতেন গরমের হাত থেকে রেহাই পেতে। আমাদের খেলাটা ছিল তাঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা যতক্ষণ না তিনি তা বুঝতে পারছেন আর কটমটে চোখে আমাদের দিকে ফিরে তাকাচ্ছেন।
ডাক্তারকে যেদিন প্রথম দেখি তখন আমার বয়স পাঁচ কি ছয়। সেদিন সকালে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর বাড়ির পেছনের বাগানে গিয়েছিলাম বিরাট বড়ো এক আমগাছ থেকে আম চুরি করতে। হঠাৎই বাগানের কোনায় কাঠের যে বাথরুম ছিল তার দরজা খুলে গেল আর বেরিয়ে এলেন ডাক্তার, লিনেনের অন্তর্বাসের দড়ি বাঁধতে বাঁধতে। হাসপাতালের সাদা শার্ট পরা তাঁর শীর্ণ, বিবর্ণ চেহারাটা দেখে মনে হয়েছিল যেন অন্য এক জগৎ থেকে আবির্ভূত হয়েছেন। আর দেখেছিলাম তাঁর সেই হলুদ রঙের নারকীয় দুটো চোখ যা আমার দিকে সারাজীবন ধরে তাকিয়ে থাকবে। অন্য বন্ধুরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু তাঁর নিশ্চল দৃষ্টির সামনে আমি স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইলাম। গাছ থেকে সদ্য পাড়া আমগুলোর দিকে তিনি তাকালেন ও আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন:
—‘ওগুলো দাও!’ তারপর অত্যন্ত অবজ্ঞার সঙ্গে আমার আপাদমস্তক পরীক্ষা করে বললেন, ‘হতচ্ছাড়া আমচোর কোথাকার।’
আমগুলো তাঁর পায়ের কাছে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্রচণ্ড ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম।
তিনি ছিলেন আমার নিজস্ব ভূত। একা একা কোথাও যেতে হলে অনেকটা ঘুরে যেতাম, যাতে তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে না হয়। আর বড়ো কারুর সঙ্গে গেলে ভয়ে ভয়ে আড়চোখে তাকাতাম ডাক্তারখানার দিকে। আদ্রিয়ানাকে দেখতাম কাউন্টারের পিছনে সেলাই মেশিনের সামনে বসে তাঁর যাবজ্জীবন কারাবাসের মেয়াদ খাটছেন আর শোবার ঘরের জানলা দিয়ে দেখতাম ডাক্তার হ্যামকে শুয়ে জোরে জোরে দোল খাচ্ছেন। ওই এক ঝলক দেখাতেই আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠত।
এই শতাব্দীর প্রথম দিকে তিনি এ শহরে আসেন। ভেনেসুয়েলার যে অসংখ্য মানুষ হুয়ান বিসেন্তে গোমেসের স্বৈরতন্ত্রের অত্যাচার থেকে বাঁচতে লা গুয়াখিরার সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তিনি তাদেরই একজন। ভেনেসুয়েলার স্বৈরতন্ত্রের আক্রমণ ও আমাদের দেশের কলা কোম্পানির সমৃদ্ধির মোহ–এই দুই বিপরীত শক্তির আকর্ষণে ঘরছাড়া প্রথম দিকের মানুষদের মধ্যে একজন এই ডাক্তার। এখানে আসার পর থেকেই তাঁর রোগ ধরার ক্ষমতা আছে বলে, যেমনটা তখন সবাই বলত, আর আন্তরিক ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি প্রায়ই আমার দাদুর বাড়িতে আসতেন। সে বাড়িতে তো একটা খাবার টেবিল সব সময় প্রস্তুত থাকত–ট্রেনে করে কে কখন এসে পড়ে তা কি বলা যায়! আমার মা ছিলেন তাঁর বড়ো ছেলের ধর্ম-মা (মাদ্রিনা[২]) আর আমার দাদু সেই ছেলেকে শিখিয়েছিলেন আত্মরক্ষার প্রাথমিক কৌশল। আমি এঁদের মধ্যেই বড়ো হয়েছিলাম, ঠিক যেমনভাবে অনেক পরে লালিত হয়েছিলাম স্পেনের গৃহযুদ্ধে নির্বাসিত মানুষদের সান্নিধ্যে।
এই নির্বাসিত, বিস্মৃতপ্রায় মানুষটি সেই কোন্ ছোটোবেলায় আমার মধ্যে যে ভয়ের বোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন তার শেষ চিহ্নগুলোও মুহূর্তে অন্তর্হিত হয়ে গেল যখন মা আর আমি তাঁর বিছানায় বসে শুনতে লাগলাম কীভাবে এই জনপদ ধ্বস্ত-বিদ্ধস্ত হয়ে গেছে তারই করুণ বৃত্তান্ত। তাঁর স্মৃতি-রোমন্থনের এমনই প্রবল এক ক্ষমতা ছিল যে তাঁর বলা গল্পগুলো যেন সেই গরম ঘরের মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠছিল। সমস্ত দুর্ভাগ্যের মূল উৎস ছিল, নিঃসন্দেহে, রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা শ্রমিকদের গণহত্যা। যদিও সেই হত্যার সংখ্যা নিয়ে তখনও সন্দেহের অবকাশ রয়ে গিয়েছিল। কতজন মারা গিয়েছিল–তিন না তিন হাজার? হতে পারে প্রকৃত সংখ্যা অত বেশি নয়, তিনি বললেন, কিন্তু প্রত্যেকে তার নিজস্ব বেদনার নিরিখে সংখ্যাটাকে বাড়িয়ে তুলেছে। এখন কোম্পানি চলে গেছে চিরদিনের জন্য।
—‘গ্রিংগোরা আর ফিরে আসবে না,’ বলে কথা শেষ করলেন তিনি।
তবে একমাত্র নিশ্চিত যা ছিল তা হল গ্রিংগোরা সবকিছু নিয়ে চলে গেছে–টাকা, ডিসেম্বরের মৃদুমন্দ বাতাস, পাউরুটি কাটার ছুরি, বিকেল তিনটের মেঘগর্জন, জুঁইফুলের সুবাস, ভালোবাসা, এই সব, সবকিছু। শুধু রয়ে গেছে ধূলিধূসরিত বাদাম গাছেরা, উত্তাপ ঠিকরে পড়া পথ, কাঠের দেওয়াল ও জং ধরা টিনের চালের বাড়ি আর স্মৃতির ভারে বিপন্ন, বিষণ্ণ সব অধিবাসীরা।
সেই দুপুরে টিনের চালের উপর বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ার মতো শব্দে আমি চমকে উঠলাম। তখনই ডাক্তার প্রথম আমার দিকে মনযোগ দিয়ে তাকালেন। ‘ওগুলো সব টার্কি,’ আমাকে বললেন, ‘সারাদিন ওরা ছাদের উপর ঘুরে বেড়ায়।’ তারপর একটা নির্জীব আঙুল তুলে বন্ধ দরজার দিকে দেখিয়ে বললেন:
—‘রাতে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়, তখন মৃতের দল রাস্তায় রাস্তায় যেমন খুশি ঘুরে বেড়ায়।’
তিনি দুপুরে আমাদের খেয়ে যেতে বললেন আর আমাদেরও কোনো অসুবিধে ছিল না। কেন-না বাড়ি বিক্রির জন্য অন্য সব কথা ফোনেই হয়ে গিয়েছিল, কাগজ-কলমের কাজটাই শুধু বাকি ছিল। যাঁরা ওখানে ভাড়া থাকেন তাঁরাই কিনছেন। কিন্তু আমাদের হাতে কি সে সময় আছে?
—‘যথেষ্ট সময় আছে,’ আদ্রিয়ানা বললেন, ‘ফেরার ট্রেন যে কখন আসবে তার কোনো ঠিক নেই।’
তারপর আমরা একসঙ্গে খেতে বসলাম। ওই এলাকার অতি সাধারণ খাবার, পরিমাণেও বাহুল্য নেই। তবে তা দারিদ্র্যের জন্য নয়, সারাজীবন ধরে সর্ব ব্যাপারে যে সংযমী জীবনযাপনের কথা ডাক্তার বলতেন এবং ব্যক্তি জীবনেও যে সংযমের চর্চা করেছেন, এ তারই প্রকাশ। যে মুহূর্তে আমি স্যুপটা মুখে দিলাম, মনে হল যেন গোটা একটা ঘুমন্ত পৃথিবী আমার স্মৃতির সত্তায় জেগে উঠল। এই স্বাদ একান্তই আমার ছেলেবেলার, যা হারিয়ে গিয়েছিল গ্রামছাড়ার মুহূর্ত থেকে, তা আবার ফিরে আসছিল, সম্পূর্ণরূপে, প্রতিটি চুমুকে, আর আমার হৃদয়কে দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছিল।
ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার শুরু থেকেই নিজেকে মনে হচ্ছিল যেন সেই ছোট্ট আমি, যে জানলা দিয়ে তাঁকে দেখে হাসাহাসি করত। তাই যখন তিনি মায়ের সঙ্গে যে গুরুত্ব ও স্নেহের সঙ্গে কথা বলছিলেন আমার সঙ্গেও সেইভাবে কথা বলতে শুরু করলেন আমি একটু ভয়ই পেয়ে গেলাম। যখন ছোটো ছিলাম জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে অস্বস্তি লুকানোর জন্য চোখ পিটপিট করতাম। ডাক্তার আমার দিকে তাকাতেই সেই পুরোনো অভ্যাসটা আচমকা ফিরে এল। গরম ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠছিল। কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে রইলাম। মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করলাম কী করে এই অমায়িক, স্মৃতিকাতর বৃদ্ধ মানুষটিকে আমি অত ভয় পেতাম। তারপর এক দীর্ঘ নীরবতা ও কিছু মামুলি কথাবার্তার শেষে তিনি হঠাৎই আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন–এক স্নেহশীল পিতামহের হাসি।
—‘তুমিই তাহলে সেই বিখ্যাত গাবিতো,’ আমায় বললেন, ‘পড়াশুনো কী করছ?’
নিজের অস্বস্তি ঢাকতে অদ্ভুতভাবে আউরে গেলাম আমার পড়াশুনোর হাল-হকিকত। সরকারি আবাসিক বিদ্যালয় থেকে ভালো নম্বর নিয়ে সেকেন্ডারি পাস, এরপর দু’বছর কয়েক মাসের গোলমেলে ল’-এর পাঠ এবং সবশেষে গবেষণামূলক সাংবাদিকতা। মা আমার কথাগুলো শুনলেন। পরক্ষণেই ডাক্তারের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টায় বললেন:
—‘ভেবে দেখুন, কোম্পাদ্রে[৩], এরপর ও লেখক হতে চায়।’
শুনেই ডাক্তারের চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
—‘কী দারুণ ব্যাপার, কোমাদ্রে!’ তিনি বললেন, ‘এ তো ভগবান দত্ত উপহার।’ তারপর আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী লেখো, কবিতা?’
—‘না, উপন্যাস আর গল্প,’ তাঁকে উত্তর দিলাম। হৃদপিণ্ডটা তখন প্রায় আমার গলার কাছে।
তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন।
—‘দোন্যিয়া বারবারা পড়েছ?’
—‘অবশ্যই’, আমি বললাম, ‘রোমুলো গাইয়েগোসের প্রায় সবই পড়েছি।’
যেন আকস্মিক উৎসাহে জেগে উঠেছেন, এমনভাবে তিনি গল্প করতে লাগলেন যে মারাকাইবোর[৪] এক সভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় রোমুলো গাইয়েগোসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল এবং তাঁকে তাঁর বইগুলোর যোগ্য লেখক বলেই মনে হয়েছিল। সত্যি বলতে কী মিসিসিপি সাগার একশ চার ডিগ্রি জ্বরে আচ্ছন্ন আমি সেই মুহূর্ত থেকেই দেখতে শুরু করেছিলাম আমাদের লোকায়ত উপন্যাসের প্রথম বুননের আভাস। কিন্তু ছোটোবেলায় যাঁকে অত ভয় পেতাম তাঁর সঙ্গে সহজ ও সাবলীল এই কথাবার্তা আমার কাছে জাদুকরী বলে মনে হচ্ছিল। তাই আমিও তাঁর উৎসাহে তাল মেলাচ্ছিলাম। তাঁকে বললাম ‘এল এরালদো’ পত্রিকায় আমার লেখা রোজনামচা ‘জিরাফ’-এর কথা। আরও বললাম যে খুব শীঘ্রই একটি পত্রিকা প্রকাশের কথা ভাবছি। আমরা খুবই আশাব্যঞ্জক সে ব্যাপারে। এমনকি আমাদের সব পরিকল্পনা ও পত্রিকার সম্ভাব্য নাম ‘ক্রোনিকা’ সব কিছুই তাঁকে জানালাম।
তিনি আমার আপাদমস্তক খুঁটিয়ে দেখলেন।
—‘জানি না তুমি কেমন লেখো,’ তিনি বললেন, ‘তবে কথা বলছো একজন পাকা লেখকের মতোই।’
মা তখন আসল কথাটা বলতে শুরু করলেন যে আমার লেখক হওয়ার ব্যাপারে কারুরই কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু তার আগে পড়াশুনা করে ভবিষ্যতের ভিতটা পাকা করে নেওয়া দরকার। কিন্তু ডাক্তার আর সব কিছু বাদ দিয়ে লেখকের ভবিষ্যৎ আলোচনায় মগ্ন হলেন। তিনি নিজেও লেখক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বাবা-মাও আমার মায়ের মতো একই যুক্তিতে প্রথমে তাঁকে সেনাবাহিনীতে পাঠাতে চেয়েছিলেন। সে কাজে ব্যর্থ হলে ডাক্তারি পড়তে বাধ্য করেন।
—‘তারপর দেখুন, কোমাদ্রে,’ তিনি বললেন, ‘আমি ডাক্তার হয়ে আজ এই এখানে এসেছি। জানি না আমার রুগিদের মধ্যে কতজন ভগবানের ইচ্ছায় আর কতজন আমার চিকিৎসায় মারা গেছে।’
মা তখন একেবারেই পর্যুদস্ত।
—‘সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হল,’ মা বললেন, ‘ওর লেখাপড়ার জন্য আমরা এত কষ্ট করার পরে ও কলেজ ছেড়ে দিল।’
কিন্তু ডাক্তারের মতে এই ছেড়ে দেওয়াটাই সৃজনশীল কাজের এক চমৎকার প্রমাণ। কেন-না একমাত্র সৃষ্টির ক্ষমতাই পারে ভালোবাসার শক্তির মুখোমুখি হতে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা পৃথিবীর সমস্ত কাজের মধ্যে এই শিল্পসৃষ্টিই হল সবচেয়ে বেশি রহস্যময়, তার জন্য পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করতে হয়, কোনো কিছুর প্রত্যাশা না রেখে।
—‘এ এমন একটা জিনিস যা মানুষ জন্ম থেকে নিজের ভেতরে বহন করে আর এর উলটো পথে যাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষেও খুব খারাপ,’ তিনি বললেন। তারপর এক মনোমুগ্ধকর হাসি হেসে এই বলে শেষ করলেন, ‘যাজকের কাজও এমনটাই হওয়া উচিত।’
আমি বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে রইলাম। যেভাবে তিনি ব্যাখ্যা করলেন তা হাজার চেষ্টা করেও আমি করতে পারতাম না। মায়েরও নিশ্চয়ই একই অনুভূতি হয়েছিল। কারণ তিনি বেশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে চেয়ে রইলেন আমার দিকে আর তারপর সবই নিজের ভাগ্যের হাতে সঁপে দিলেন।
—‘কেমন করে তোমার বাবার কাছে এই কথাগুলো বললে ভালো হয়?’ মা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন।
—‘ঠিক যেভাবে আমরা শুনলাম,’ আমি উত্তর দিলাম।
—‘না, এভাবে কাজ হবে না,’ বললেন মা। তারপর অন্য একটা কিছু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘তবে তুমি চিন্তা কোরো না, তাঁকে বোঝানোর একটা ভালো উপায় আমি বের করব।’
জানি না মা তা-ই করেছিলেন না অন্য কিছু, তবে সেখানেই এ বিতর্কের সমাপ্তি ঘটে। দুটো কাচ পড়ার মতো দুটো শব্দ করে ঘড়ি সময় ঘোষণা করল। মা চমকে উঠে বললেন, ‘হে ভগবান! যে কাজের জন্য এসেছি সেটাই ভুলতে বসেছি।’ তারপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন:
—‘এবার আমাদের যেতে হবে।’
টীকাঃ
১। ক্যাডিউসিয়্যাস: গ্রীক উপকথা অনুযায়ী দেবতাদের সংবাদবাহক হার্মিসের হাতের দণ্ড। চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রতীক হিসাবে এটি ব্যবহৃত হয়।
২। মাদ্রিনা: খ্রিস্টধর্মের নিয়ম অনুযায়ী ব্যাপ্টিসিজম বা একটি শিশুকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষাদানের সময় এবং বিয়ের সময় যে মহিলা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রধান হন বা সহায়তা করেন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করেন।
৩। কোম্পাদ্রেঃ খ্রিস্টধর্মের নিয়ম অনুযায়ী একটি শিশুকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষাদান বা ব্যাপ্টিসিজমের সময় যে পুরুষ এটি করেন করে তার সঙ্গে ওই শিশুটির আসল বাবা ও মায়ের সম্পর্ক।
৪। মারাকাইবো: ভেনেসুয়েলার একটি শহর।