জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ৪ )
মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য
চতুর্থ পর্ব
ট্রেনটা একটা স্টেশনে থামল, কিন্তু সেখানে কোনো জনপদ নেই। তার একটু পরেই পার হয়ে গেল এই যাত্রাপথের একমাত্র কলাখেত যার ঢোকার মুখে নাম লেখা আছে: মাকোন্দো। দাদুর সঙ্গে প্রথম দিকে যখন এই পথ দিয়ে যেতাম তখনই এই শব্দটা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। তবে অনেক পরে, বড়ো হয়ে বুঝতে পারি যে আমার যেটা ভালো লাগত তা হল এই শব্দটির কাব্যিক ধ্বনিমাধুর্য। আর কারুর মুখে এই শব্দটা কখনও শুনিনি। নিজেরও কৌতূহল হয়নি এর অর্থ কী তা জানার। এমনকি আমার তিনটি উপন্যাসে কাল্পনিক একটি গ্রামের নাম হিসাবে শব্দটি ব্যবহার করার পরে জেনেছিলাম এর অর্থ। একদিন ঘটনাচক্রে একটা বিশ্বকোষে দেখলাম মাকোন্দো হল সেইবার মতো এক ধরনের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় গাছ, যার ফুল বা ফল হয় না আর এর নরম কাঠ দিয়ে শালতি জাতীয় নৌকা ও কারুকার্য করা রান্নার জিনিসপত্র তৈরি হয়। এরও অনেক পরে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় পড়েছিলাম যে টাঙ্গানিকার এক যাযাবর সম্প্রদায়ের নাম মাকোন্দো। ভেবেছিলাম সেটাই হয়তো মাকোন্দো শব্দের উৎস। তবে তা কখনও খুঁজে দেখিনি আর গাছটাও দেখা হয়নি আমার। তবে কলা কোম্পানির এলাকায় অনেককে শব্দটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু কেউই কিছু বলতে পারেনি। হতে পারে কোনো দিনই এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না।
ট্রেন মাকোন্দোর খেত পার হয়ে গেল এগারোটার সময়। তার দশ মিনিট পরে আসবে আরাকাতাকা। মায়ের সঙ্গে বাড়ি বিক্রি করতে যাওয়ার দিন ট্রেন দেড় ঘণ্টা লেট ছিল। আমি বাথরুমে গেলাম আর তখনই ট্রেনটা জোরে চলতে শুরু করল। ভাঙা জানলা দিয়ে এক ঝলক শুকনো গরম হাওয়া ঢুকে এল ভেতরে। তার সঙ্গে মিশে আছে পুরোনো বগির প্রবল শব্দ ও ট্রেনের বাঁশির তীব্র আওয়াজ। আমার বুকের ভেতরটা তখন ধকধক করছে আর পেটের মধ্যে যেন ঠান্ডা বমি জমাট বেঁধে আছে। ভূমিকম্পে মানুষ যেমন ভয়ে পালায় তেমনভাবে ছুটে বাইরে এলাম। মাকে দেখলাম তাঁর জায়গায় বসে আছেন নির্বিকারভাবে আর জানলার বাইরে যে জায়গাগুলো সরে সরে যাচ্ছে তাদের কথা বলে চলেছেন উচ্চৈঃস্বরে, এক সময় যে জীবন বহমান ছিল এবং যা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, বিদ্যুতের মতো ওরা তারই ক্ষণস্থায়ী ঝলক।
—‘ওই সব জমিগুলো বাবাকে বিক্রি করেছিল ভেতরে সোনা আছে বলে’, মা বললেন।
চলে গেল আদভেনতিস্তা[১] শিক্ষকদের বাড়ি, তারা খসে পড়ার মতো দ্রুতগামিতায়, তাদের ফুলের বাগান আর দরজার মাথার লেখাটি: The sun shines for all.
—‘ইংরাজিতে তুমি প্রথম পড়তে শিখেছিলে এই লেখাটা’, মা বললেন।
—‘না, প্রথম নয়’, আমি বললাম, ‘একমাত্র’।
পার হয়ে গেল সিমেন্টের সেতু আর কর্দমাক্ত জলের নালা। গ্রিংগোরা এই নালা দিয়ে নদীর জল নিয়ে যেত কলাখেতে জলসেচের জন্য।
—‘এটা সেই সস্তার মেয়েদের জায়গা, যেখানে ছেলেরা মোমবাতির বদলে টাকার গোছায় আগুন ধরিয়ে সারা রাত কুম্বিয়াম্বা[২] নাচত’, মা বললেন।
পার্কের বেঞ্চ, রৌদ্রদগ্ধ বাদাম গাছ, ছোট্ট মন্টেসরি স্কুলের উঠোন যেখানে প্রথম পড়তে শিখি। মুহূর্তের মধ্যে ফেব্রুয়ারির সেই উজ্জ্বল রবিবারে ট্রেনের ছোটো জানলার মধ্যে দিয়ে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল গোটা শহরের পরিপূর্ণ এক চিত্র।
—‘স্টেশন এসে গেছে!’ চিৎকার করে বললেন মা, ‘সব কিছু এত বদলে গেছে যে এখন আর কেউ ট্রেন ধরার জন্য অপেক্ষা করে না।’
তারপর ধীরে ধীরে ট্রেনের গতি কমে এল, বন্ধ হল বাঁশির আওয়াজ এবং বড়ো একটা নিশ্বাস ফেলে শেষ পর্যন্ত থেমে গেল। প্রথমে যে জিনিসটা আমাকে অবাক করল তা হল নিস্তব্ধতা। সে এমন এক বাস্তব নৈঃশব্দ যে চোখ বন্ধ করেও পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত নৈঃশব্দের মধ্যে থেকে একে চিনে নিতে পারতাম। গরম এত তীব্র হয়ে উঠেছিল যে মনে হল সব কিছু যেন একটা ঢেউ খেলানো কাচের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে। যতদূর দৃষ্টি যায় কোথাও কোনো জনজীবনের চিহ্ন মাত্র নেই। এমন কিছু নেই যা ধূলায় ধূসরিত নয়। আমার মা আরও কিছুক্ষণ তাঁর জায়গায় বসে রইলেন। দেখছিলেন শূন্য পথের উপর এলিয়ে পড়ে থাকা মৃত শহরকে। শেষে ভয়ার্ত স্বরে বললেন:
—‘হে ভগবান!’
ট্রেন থেকে নামার আগে এই একটি মাত্র কথা তিনি বলেছিলেন।
যতক্ষণ ট্রেনটা স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল নিজেদেরকে সম্পূর্ণ একা মনে হয়নি। কিন্তু যেই ট্রেন ছেড়ে দিল, হৃদয়ভেদী আর্ত চিৎকারে বেজে উঠল তার বাঁশি, প্রখর সূর্যের নীচে অসহায়ের মতো রয়ে গেলাম আমি আর মা আর শহরের সমস্ত দুঃখ ঘিরে ধরল আমাদের। কিন্তু আমরা কেউ কথা বলছিলাম না। কাঠের তৈরি স্টেশন, তার মাথায় টিনের চাল, সঙ্গে ঝুল বারান্দা, ঠিক যেন কাউবয় সিনেমায় দেখা স্টেশনের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সংস্করণ। স্টেশনের মেঝের টালি ভেদ করে গজিয়ে উঠেছে ঘাস। পরিত্যক্ত সেই স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম আর বাদাম গাছের ছায়া খুঁজতে খুঁজতে ডুবে গেলাম সিয়েস্তার অলস প্রহরে।
ছেলেবেলা থেকেই এই নিষ্ক্রিয় সিয়েস্তাকে অপছন্দ করতাম। কেন-না বুঝে উঠতে পারতাম না কী করব। ঘুমোতে ঘুমোতেই লোকে বিড়বিড় করে বলত, ‘চুপ, চুপ, আমরা ঘুমোচ্ছি।’ দোকান-বাজার, সরকারি অফিস, স্কুল সব দুটো বাজতে না বাজতেই বন্ধ হয়ে যেত আর খুলত সেই তিনটের একটু আগে। বাড়ির ভেতরটা তখন ভেসে বেড়াত তন্দ্রার আলস্যে। কোনো কোনো বাড়ির লোক এতোই ঘুমকাতুরে যে বাগানে হ্যামক টাঙিয়ে কি রাস্তার মধ্যে বাদাম গাছের ছায়ায় চেয়ার পেতে তাতে বসেই ঘুমিয়ে পড়ত। শুধু খোলা থাকত স্টেশনের সামনের একটা হোটেল, তার খাবার জায়গা ও বিলিয়ার্ড খেলার ঘর। আর খোলা থাকত গির্জার পেছনের টেলিগ্রাফ অফিস। আমার স্মৃতির সঙ্গে সব কিছু মিলে যাচ্ছিল, শুধু জিনিসগুলো যেন একটু ছোটো, বিবর্ণ ও এক ভয়ংকর ঝড়ে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। পুরোনো সেই বাড়িগুলো এখন অবক্ষয়িত, মরচে ধরা ফুটো টিনের চাল, পার্কের ভেঙে পড়া গ্রানাইটের বেঞ্চ, বিষাদগ্রস্ত বাদাম গাছ আর এই সবকিছুর রূপান্তর ঘটিয়েছে যে তাপদগ্ধ অদৃশ্য ধুলো তা দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে দেয় আর ঝলসে দেয় গায়ের চামড়া। রেল লাইনের অপর পারে কলা কোম্পানির ব্যক্তিগত স্বর্গরাজ্যে বৈদ্যুতিক তারের বেড়া আর নেই, পাম গাছও উধাও হয়ে গিয়ে এখন সেখানে বিস্তীর্ণ ঝোপ-জঙ্গল, পোস্ত গাছের ফাঁকে ফাঁকে ভেঙে পড়া বাড়ি-ঘর আর একটা পুড়ে যাওয়া হাসপাতালের ধ্বংসাবশেষ। সেখানে একটা দরজা কি একটা দেওয়ালের ফাটল কি একটা মানুষের মুখ, সব যা কিছু আছে তা আমার মধ্যে এক আধিভৌতিক অনুরণন সৃষ্টি করছিল।
মা হাঁটছিলেন হালকা পদক্ষেপে, কিন্তু খুব ঋজুভাবে। শোকের পোশাকের মধ্যেও খুব একটা ঘামছিলেন না। তিনি হেঁটে যাচ্ছিলেন সম্পূর্ণ নিঃশব্দে, কিন্তু তাঁর মুখের বিবর্ণ, তীক্ষ্ণভাব বলে দিচ্ছিল কী ঘটে চলেছে তাঁর মনের অন্তরালে। বড়ো রাস্তার শেষে দেখতে পেলাম প্রথম একজন মানুষকে: ছোটোখাটো এক মহিলা, চেহারায় দারিদ্র্যের সুস্পষ্ট ছাপ। হাকোবো বেরাকাসার মোড় থেকে আবির্ভূত হয়ে সে একটা অ্যালুমিনিয়ামের পাত্র হাতে আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল আর তার চলার ছন্দের সঙ্গে বাজতে লাগল পাত্রটার বেমানান ঢাকনার আওয়াজ। তার দিকে না তাকিয়েই মা আমাকে ফিসফিস করে বললেন:
—‘ও ভিতা।’
আমি ওকে দেখেই চিনতে পেরেছিলাম। ও যখন ছোট্ট মেয়ে তখন থেকেই আমার দিদিমার রান্নাঘরে কাজ করত। সেও যদি একবার আমাদের দিকে তাকাত, আমাদের শত পরিবর্তন সত্ত্বেও ঠিক চিনতে পারত। কিন্তু সে তাকাল না; যেন এক অন্য জগত দিয়ে হেঁটে চলে গেল। এখনও মনে প্রশ্ন জাগে, ভিতা কি ওই দিনটার অনেক আগেই মারা যায়নি।
রাস্তার শেষে গিয়ে যখন বাঁক নিলাম চটির মধ্যে দিয়ে ধুলো ঢুকে আমার পায়ের পাতা পুড়িয়ে দিচ্ছিল। পরিত্যাজ্য হওয়ার অনুভূতি তখন আমার কাছে ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠেছে। আমি নিজের দিকে তাকালাম। তাকালাম আমার মায়ের দিকে। ঠিক যেভাবে, সেই কোন্ ছোটোবেলায়, তাকিয়েছিলাম সেই চোরটার মা ও বোনের দিকে। চোরটা তার এক সপ্তাহ আগে বাড়ির দরজা ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করলে মারিয়া কোনসুয়েগ্রা তাকে একটা গুলি করে মেরে ফেলেছিল।
ভোর তিনটের সময় একটা শব্দে মারিয়া কোনসুয়েগ্রার ঘুম ভেঙে যায়। কে যেন বাইরে থেকে সদর দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। আলো না জ্বালিয়েই তিনি বিছানা থেকে উঠে পড়লেন। আলমারির মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে লাগলেন বহু পুরোনো একটা রিভলবার, হাজার দিনের যুদ্ধের পর থেকে যেটা আর কেউ ব্যবহার করেনি। অন্ধকারের মধ্যেই তাক করলেন শুধু দরজার দিকেই নয়, একেবারে ঠিক তালার উচ্চতায়। তারপর দুহাতে অস্ত্রটা ধরে চোখ বন্ধ করে ট্রিগার টিপলেন। তিনি আগে কখনও বন্দুক চালাননি, কিন্তু দরজার মধ্যে দিয়ে তাঁর গুলি অব্যর্থভাবে লক্ষ্যভেদ করল।
সেটাই আমার দেখা প্রথম মৃত্যু। সকাল সাতটার সময় যখন স্কুলে যাচ্ছি, মৃতদেহটা তখনও পর্যন্ত পড়েছিল রাস্তার পাশে ফুটপাতে, একদলা শুকনো রক্তের মধ্যে। গুলিটা নাক দিয়ে ঢুকে কান দিয়ে বেরিয়ে গেছে, তাই মুখটা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। ছেলেটার পরনে ছিল নাবিকদের রংচঙে টি-শার্ট, অত্যন্ত সাধারণ একটা প্যান্ট, সেটা বেল্টের বদলে দড়ি দিয়ে বাঁধা আর খালি পা। তার পাশে রাস্তার উপরে পড়ে আছে একটা ঘরে তৈরি তালা ভাঙার যন্ত্র, যা দিয়ে সে তালা খুলতে চেষ্টা করেছিল।
শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা মারিয়া কোনসুয়েগ্রার বাড়িতে জড়ো হলেন চোরকে মেরে ফেলার জন্য তাঁকে সান্ত্বনা দিতে। সেই রাতে আমিও পাপালেলোর সঙ্গে তাঁর বাড়ি গিয়েছিলাম। তাঁকে দেখলাম ম্যানিলা থেকে আনা একটা আরামকেদারায় বসে আছেন। কেদারাটা অনেকটা বেতের তৈরি বিরাট বড়ো ময়ূরের মতো। বন্ধুরা সবাই তাঁকে ঘিরে বসে আছেন আর তাঁর কাছ থেকে গোটা ঘটনাটা অন্তত হাজার বার ধরে শুনছেন। সকলেই একমত হলেন যে প্রচন্ড ভয় পেয়েই তিনি গুলি চালিয়েছিলেন। তখন আমার দাদু তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন যে গুলি করার পরে কিছু শুনতে পেয়েছিলেন কিনা। তিনি বললেন যে প্রথমে কয়েক মুহূর্তের জন্য ছিল শুধুই এক বিরাট নৈঃশব্দ, তারপর তালা ভাঙার যন্ত্রটার সিমেন্টের মাটিতে পড়ার ধাতব আওয়াজ আর পরক্ষণেই খুব আস্তে কিন্তু যন্ত্রণাকাতর একটা ধ্বনি: ‘ওঃ মাগো!’ সম্ভবত দাদু জানতে চাওয়ার আগে অবধি মারিয়া কোনসুয়েগ্রা ওই হৃদয়বিদারক কথাটা ঠিক উপলব্ধি করতে পারেননি। তাই কথাটা বলার পরেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
এক সোমবারে এই ঘটনাটা ঘটেছিল। পরের সপ্তাহের মঙ্গলবারে দুপুরবেলা সিয়েস্তার সময় আমি যখন আমার জীবনের সবচেয়ে পুরোনো বন্ধু লুইস কারমেলো কোররেয়ার সঙ্গে লাট্টু নিয়ে খেলা করছি, অবাক হয়ে দেখলাম যে ঘুমন্ত মানুষগুলো সময়ের আগেই উঠে পড়েছে আর জানলা দিয়ে বাইরে উঁকি মারছে। তারপর দেখলাম নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে শোকের পোশাক পরা এক মহিলা ও তার সঙ্গে রয়েছে একটি বছর বারোর মেয়ে। মেয়েটির হাতে খবরের কাগজে মোড়া নেতিয়ে যাওয়া এক থোকা ফুল। তারা খর রৌদ্রের তাপ থেকে বাঁচার জন্য একটা কালো ছাতা মাথায় দিয়েছে। তাদেরকে দেখতে থাকা মানুষগুলোর অশিষ্ট আচরণের প্রতি তারা সম্পূর্ণ উদাসীন। ওরা সেই মৃত চোরটির মা ও ছোটো বোন—ফুল নিয়ে এসেছে কবরে দেওয়ার জন্য।
একটা গোটা শহর জানলা দিয়ে মা-মেয়েকে যেতে দেখছে—এই দৃশ্যটা স্বপ্নের মতো বহু বছর ধরে আমাকে তাড়া করে বেরিয়েছিল যতদিন পর্যন্ত না ঘটনাটা নিয়ে আমি একটা গল্প লিখেছিলাম। কিন্তু ওই মহিলা ও বাচ্চা মেয়েটির জীবন বা তাদের অবিচল আত্মমর্যাদাবোধের প্রকৃত স্বরূপ, এর কোনোটাই উপলব্ধি করতে পারিনি যতক্ষণ না মায়ের সঙ্গে বাড়ি বিক্রি করতে যাওয়ার দিনে ওই একই প্রহরে, একই নির্জন রাস্তায় নিজেকে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছিলাম।
—‘মনে হচ্ছে আমিই যেন সেই চোরটা’, আমি বললাম।
মা আমার কথাটা বুঝতে পারলেন না। এমনকি মারিয়া কোনসুয়েগ্রার বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দরজাটার দিকে একবার তাকালেনও না। যদিও কাঠের দরজায় তখনও পর্যন্ত রয়ে গিয়েছিল সেই গুলির চিহ্ন। বহু বছর পরে, মায়ের সঙ্গে এই যাত্রার কথা স্মরণ করতে গিয়ে বুঝতে পারি যে ঘটনাটা মায়ের মনে ছিল না তা নয়, আসলে তিনি তা ভুলতে চেয়েছিলেন। এটা আরও ভালো করে বোঝা গেল যখন দোন এমিলিয়োর বাড়ির সামনে দিয়ে গেলাম। দোন এমিলিয়ো বেলগা[৩] নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একজন সৈনিক। নর্ম্যান্ডির যুদ্ধে তাঁর দুটো পা-ই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এক পেন্টিকোস্টের[৪] রবিবারে সোনার সায়নাইডের বিষাক্ত ধোঁয়া নিয়ে জীবনের নিদারুণ স্মৃতির হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। আমার বয়স তখন বড়োজোর ছ’ বছর। কিন্তু মনে হয় যেন এই গতকালের ঘটনা। সকাল সাতটার মধ্যেই খবরটা তোলপাড় করে ফেলেছিল সারা শহর। ঘটনাটা এতই স্মরণীয় ছিল যে বাড়ি বিক্রি করতে যখন আবার সেখানে ফিরে গেলাম কুড়ি বছর পরে, শেষ পর্যন্ত মা তাঁর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন।
—‘বেচারা বেলগা’, ফিসফিস করে বললেন, ‘ঠিক যেমন তুমি বলেছিলে, আর কোনোদিনও সে দাবা খেলবে না।’
আমাদের ইচ্ছে ছিল সোজা বাড়িতে যাব। কিন্তু আর যখন মাত্র একটা ব্লক বাকি, হঠাৎই মা থমকে দাঁড়ালেন আর আগের মোড়েই বাঁক নিয়ে নিলেন।
—‘এদিক দিয়ে যাওয়াই ভালো’, আমাকে বললেন। আমি অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইলে বললেন, ‘আমার ভয় করছে।’
তখনই বুঝতে পারলাম আমার বিবমিষার কারণ—ভয়। শুধু আমার প্রেতাত্মাদের মুখোমুখি হওয়ার ভয় নয়, ভয় সবকিছুকে। আমরা যে সমান্তরাল একটা রাস্তা দিয়ে ঘুরপথে যাচ্ছিলাম তার উদ্দেশ্য একটাই—সরাসরি বাড়ি না যাওয়া। ‘কারুর সঙ্গে কথা বলার আগে বাড়িতে যাওয়ার আমার সাহস হচ্ছিল না’, পরে মা আমাকে বলেছিলেন। তাই ওইভাবে যাওয়া। আমাকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে কোনো কিছু না জানিয়েই ঢুকে পড়লেন ডাক্তার আলফ্রেদো বারবোসার ডাক্তারখানায়। মোড়ের মাথার এই বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি বড়োজোর একশো পা দূরে।
ডাক্তারের স্ত্রী আদ্রিয়ানা বেরদুগো পুরোনো আমলের একটা হাতে চালানো সেলাই মেশিনে সেলাই করছিলেন। কাজে এতটাই মগ্ন ছিলেন যে তিনি বুঝতেই পারেননি কখন মা এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর সামনে আর তাঁকে প্রায় ফিসফিস করে ডাকলেন:
—‘কোমাদ্রে!’[৫]
আদ্রিয়ানা চোখ তুলে তাকালেন। দূরে দেখার মোটা কাচের চশমার আড়ালে তাঁর চোখদুটো ঘোলাটে দেখাচ্ছিল। তিনি চোখ থেকে চশমাটা খুললেন, মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করলেন আর তারপরেই লাফ দিয়ে উঠে দুহাত বাড়িয়ে চিৎকার করে উঠলেন:
—‘ওঃ কোমাদ্রে!’
মা ততক্ষণে কাউন্টারের ওপারে চলে গেছেন। আর কোনো কথা না বলে দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। কাউন্টারের বাইরে দাঁড়িয়ে আমি ওঁদের দেখছি, জানি না আমার কী করণীয়, শুধু ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠছি এই নিশ্চয়তার আভাসে যে নিঃশব্দ অশ্রুতে সিক্ত এই যে দীর্ঘ আলিঙ্গন তা অপূরণীয় এক অনুভূতি এবং তা আমার জীবনেও সব সময় ফিরে ফিরে এসেছে।
টীকা:
১। আদভেনতিস্তা: খ্রিস্টানদের একটি অংশ যাঁরা যিশুর দ্বিতীয়বার আবির্ভাবে বিশ্বাস করেন।
২। কুম্বিয়াম্বা: কলোম্বিয়ার ক্যারিবিয়া অঞ্চলের একটি নাচ, অ্যাকর্ডিয়ান ও বাঁশি সহযোগে।
৩। বেলগা: বেলজিয়ামের অধিবাসী।
৪। পেন্টিকোস্ট: খ্রিস্টানদের একটি ধর্মীয় উৎসব, ইস্টার রবিবারের পরের সপ্তম রবিবারে অনুষ্ঠিত হয়।
৫। কোমাদ্রে: একটি শিশুকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষাদান বা ব্যাপ্টিসিজমের সময় যে মহিলা এটি করেন তার সঙ্গে ওই শিশুটির আসল বাবা ও মায়ের সম্পর্ক।