|

জীবনের কথা বলিতে ব্যাকুল (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্মজীবনী) – অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ( পর্ব ১৫ )

শেয়ার করুন

মূল স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: অরুন্ধতী ভট্টাচার্য

পর্ব – পনেরো

আমাদের বাড়ির গুয়াহিরো দাসী মেমেকে আমি দেখিনি। বাররানকাস থেকে তাকে আনা হয়েছিল। এক ঝড়বৃষ্টির রাতে সে তার ছোটো ভাই আলিরিয়োর সঙ্গে পালিয়ে যায়। সবাই বলত যে বাড়িতে কথ্য ভাষার সঙ্গে গুয়াহিরো ভাষার মিশেল সবথেকে বেশি তারাই করেছে। মেমের মুখে জগাখিচুড়ি কাস্তেইয়ানো[১] শুনলে কবিরাও বোধহয় অবাক হয়ে যেতেন। একদিন আমার মামা হুয়ান দে দিয়োস দেশলাই হারিয়ে ফেলেছিলেন। মেমে তা খুঁজে পেয়ে মামাকে ফিরিয়ে দিয়ে তার সেই বিখ্যাত দুর্বোধ্য ভাষায় বলল:

—‘এই যে আমি এখানে, তোমার দেশলাই।’

আমাদের পরিবারের আয়ের উৎস যখন ক্রমশ তলানিতে এসে ঠেকল, মিনা তখন বাড়ির অর্থনৈতিক দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। এটা বেশ অবিশ্বাস্য একটা কাজ। এ কাজে তাঁর সহযোগী ছিলেন বাড়ির সব হতবুদ্ধ মহিলারা। এদিক-ওদিকে কর্নেলের কিছু জমি অবশ্য ছিল। কিন্তু কাচাকো ভাগচাষিরা সেসব অধিকার করে রেখেছিল আর কর্নেলও তাদের ওঠাতে রাজি ছিলেন না। তাছাড়া এক সন্তানের সম্মান বাঁচাতে কর্নেল কাতাকার বাড়ি বাঁধা রেখেছিলেন। অনেক টাকা খরচ করে তবে তা উদ্ধার করা হয়। তারপর যখন আর কোনো উপায় হাতে রইল না মিনা এগিয়ে এলেন তাঁর বেকারির ভরসায়। তাঁর তৈরি লজেন্সের ছোটো ছোটো জন্তু-জানোয়ার বিক্রি হত সারা শহর জুড়ে। তার সঙ্গে ছিল ছোপ দেওয়া মুরগি, হাঁসের ডিম ও পেছনের বাগানে উৎপাদিত শাকসবজি। পরিচারিকাদের অনেককেই তিনি ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন। রয়ে গিয়েছিল শুধু তারাই যাদের ছাড়া কাজ চলবে না। এমনকি বাড়িতে কথোপকথনের ভাষায় ‘টাকা’ শব্দটার ব্যবহারও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কারণ শব্দটার আর কোনো অর্থই তখন ছিল না। তাই আমার মা স্কুলের পাঠ শেষ করে বাড়ি ফিরে এলে তাঁর জন্য একটা পিয়ানো কেনার কথা উঠলে তিয়া মা তার দাম নির্ধারণ করলেন বাড়ির নিজস্ব মুদ্রায়, ‘একটা পিয়ানোর দাম হল পাঁচশোটা ডিম।’

এই সব ধার্মিক মহিলাকুলের মধ্যে দাদুই ছিলেন আমার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। তাঁর সঙ্গে থাকলেই আমার সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর হয়ে যেত আর মনে হত যেন মাটির উপর পা রেখে বাস্তব জীবনে দাঁড়িয়ে আছি। এখন ভাবলে অদ্ভুত লাগে যে তখন আমি সব সময় দাদুর মতো হতে চাইতাম, ওইরকম বাস্তববাদী, সাহসী ও নিঃসংশয়, কিন্তু দিদিমার জগতের প্রতি যে তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতাম তাকেও কোনোদিন উপেক্ষা করতে পারিনি। দাদুর চেহারাটা মনে পড়ে, গোলগাল, লালচে গায়ের রং, মাথার উজ্জ্বল টাকে কয়েক গাছি পাকা চুল, ভালো করে ছাঁটা মোটা গোঁফ আর চোখে সোনা দিয়ে তৈরি গোল চশমা। শান্তির সময়ে তিনি খুবই সহনশীল, বন্ধুত্বপূর্ণ ও কথাবার্তায় সুচিন্তিত, কিন্তু রক্ষণশীল বন্ধুরা তাঁকে মনে রেখেছিলেন যুদ্ধের প্রলয়কালের সেই ভয়ংকর শত্রু হিসাবেই।

তিনি কখনও সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম পরতেন না, কারণ তাঁর পদ ছিল বৈপ্লবিক, শিক্ষায়তনিক নয়। তবে যুদ্ধের অনেক পরে লিকলিকে (একধরনের সুতির শার্ট) পরতেন। এই পোশাকটা তখন ক্যারিবীয়ার অবসরপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের মধ্যে খুব চালু ছিল। যুদ্ধের সৈনিকদের জন্য অবসরভাতা দেওয়ার কথা ঘোষণা হতেই দাদু প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জমা দিয়ে দেন। কিন্তু তিনি, তাঁর স্ত্রী ও নিকট উত্তরাধিকারী সবাই সেই ভাতার অপেক্ষা করতে করতে মারা যান। দিদিমা ত্রাঙ্কিলিনা মারা যান কাতাকার বাড়ি থেকে বহু দূরে, তখন তাঁর অনেক বয়স, অন্ধ ও প্রায় অর্ধোন্মাদ অবস্থা। শেষের সেই সময়ে সজ্ঞান অবস্থার এক মুহূর্তে তিনি আমায় বলেছিলেন:

‘আমি শান্তিতে মরতে পারব এই জেনে যে তোমরা নিকোলাসিতোর অবসরভাতাটা পাবে।’

সেই প্রথম আমি সেই অলীক শব্দটি শুনি–অবসর। আমাদের পরিবারে এই শব্দটি এক অনন্ত মরীচিকার বীজ বপন করেছিল। বাড়িতে শব্দটি প্রবেশ করেছিল আমার জন্মের আগে, যখন সরকার হাজার দিনের যুদ্ধের সৈনিকদের জন্য অবসরভাতা দেওয়ার কথা বলে। সঙ্গে সঙ্গেই দাদু নিজে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সঙ্গে অতিরিক্ত অনুমোদিত সাক্ষ্য ও তার প্রমাণ সমস্ত কিছু এক জায়গায় করলেন ও সান্তা মার্তায় নিয়ে গেলেন যাতে ভাতার টাকা পাওয়ার সুবন্দোবস্ত হয়। একেবারে কম করে হিসেব করেও দেখা গেল, যে টাকা তিনি পাবেন তা তাঁর ও পরবর্তী দুই প্রজন্মের জন্য যথেষ্ঠ। ‘আর কোনো চিন্তা নেই’, দিদিমা আমাদের বলতেন, ‘অবসরের টাকায় সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ তারপর থেকে যে চিঠি আসাটা আগে কখনোই এত জরুরি ছিল না তাই হয়ে উঠল স্বর্গ-প্রেরিত এক দুর্লভ ধন।

এমনকি আমিও সেই স্বর্গীয় বস্তুর হাতছানিকে উপেক্ষা করতে পারিনি। কেন-না মনের ভেতরে সব সময় এক অনিশ্চয়তার ভার বহন করতাম। যাই হোক, মাঝে মাঝে দিদিমা ত্রাঙ্কিলিনার মেজাজ এমন বিগড়ে যেত যা তাঁর নামের সঙ্গে একেবারেই মানানসই ছিল না। হাজার দিনের যুদ্ধের সময় রিওয়াচায় রক্ষণশীল বাহিনীর যে অফিসার দাদুকে গ্রেফতার করেছিলেন তিনি ছিলেন দিদিমার এক তুতো ভাই। দিদিমা ও তাঁর উদারপন্থী আত্মীয়স্বজনরা এই ঘটনাকে যুদ্ধের অংশ হিসাবেই দেখেছিলেন, যেখানে ব্যক্তিগত আত্মীয়তার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু যে মুহূর্তে দিদিমা খবর পেলেন যে তাঁর স্বামীকে সাধারণ চোর-ডাকাতদের সঙ্গে একই জায়গায় বন্দি করে রেখেছে, তিনি একটা চাবুক হাতে নিয়ে সেই তুতো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করলেন এবং তাঁকে বাধ্য করলেন দাদুকে ঠিকঠাক অবস্থায় তাঁর হাতে তুলে দিতে।

আমার দাদুর জগৎ ছিল একদম স্বতন্ত্র। জীবনের শেষ কয়েক বছরেও তিনি বেশ ক্ষিপ্রগতিতে কাজ করতেন। কোথায় কী ভেঙে গেছে তা মেরামত করার জন্য সারাইয়ের বাক্স হাতে নিয়ে বাড়ির সর্বত্র ঘুরে বেড়াতেন বা বাগানের পেছনে হাতে চালানো পাম্প দিয়ে স্নানের জল উপরে তোলার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতেন কিংবা ব্যারেলে কতটা জল আছে দেখার জন্য লম্বা মই বেয়ে উঠে যেতেন। কিন্তু আমাকে বলতেন জুতোর ফিতে বেঁধে দিতে, সেটা করতে গেলেই তিনি নাকি আর দম পেতেন না। একদিন বাড়ির অন্ধ টিয়াপাখিটা উড়তে উড়তে ব্যারেল পর্যন্ত চলে গেল। দাদু তাকে ধরতে উপরে ওঠেন। ধরেও ফেলেছিলেন পাখিটাকে, কিন্তু পা পিছলে প্রায় চার মিটার উঁচু থেকে মাটিতে পড়ে যান। সেদিন যে তিনি মরে যাননি এটাই আশ্চর্য। কেউ বলতে পারবে না পঞ্চাশের উপর বয়সে নব্বই কিলো ওজন নিয়েও কী করে সেদিন তিনি অক্ষত অবস্থায় বেঁচে গিয়েছিলেন। সেদিনটা আমিও জীবনে কখনও ভুলতে পারব না। ডাক্তার এসে তাঁকে পরীক্ষা করছেন, তিনি সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় শুয়ে, সারা শরীরটা দেখার পর কুঁচকির কাছে একটা পুরোনো ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন সেটা কী।

—‘ওটা যুদ্ধের সময়ের গুলির ক্ষত’, দাদু উত্তর দিলেন।

এখনও অবধি আমি সেই ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ঠিক যেমন এখনও ভুলতে পারিনি সেই দিনটা যেদিন দাদু তাঁর অফিস ঘরের জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে পেলেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে বিক্রির জন্য নিয়ে আসা একটা অসাধারণ ঘোড়া আর হঠাৎ তাঁর চোখ জলে ভরে গেল। তিনি হাত দিয়ে চোখ ঢাকতে গেলে কয়েক ফোঁটা স্বচ্ছ জল তাঁর হাতের তালুর উপর এসে পড়ল। শুধু যে তাঁর ডান চোখটা নষ্ট হয়ে গেল তাই নয়, দিদিমা তাঁকে ওই ঘোড়াটাও কিনতে দিলেন না, কারণ সেটার উপর শয়তান ভর করেছিল। অনেক দিন যাবৎ সেই ঘোলাটে চোখের উপর জলদস্যুদের মতো পটি বাঁধতেন। তারপর চোখের ডাক্তার পটি পালটে সঠিক লেন্সের চশমা করে দেন এবং লাঠি নিয়ে হাঁটার পরামর্শ দেন। পরবর্তীকালে সেই লাঠিই হয়ে উঠেছিল তাঁর পরিচয়ের নির্দেশক, যেমন ছিল তাঁর জামার পকেটে রাখা সোনার চেন দেওয়া ঘড়ি। ঘড়ির উপরের ঢাকনা খুললেই আচম্বিতে বেজে উঠত গানের সুর। তবে একটা কথা সবাই জানত যে বয়স হয়ে যাওয়ার কারণে দাদুর আর যাই সমস্যা হোক না কেন, তাঁর গোপন ও জনমোহিনী প্রেমিক সত্তাটি ছিল অপরিবর্তনীয়।

দাদু নিয়ম করে প্রতিদিন সকাল ছ’টায় স্নান করতেন। তাঁর জীবনের শেষ কয়েক বছরে আমি ছিলাম সেই স্নানের সঙ্গী। ট্যাঙ্ক থেকে লাউয়ের খোলার বাটি করে জল তুলে আমরা মাথায় ঢালতাম। স্নান শেষ হত ল্যানম্যান ও কেম্প কোম্পানির ‘আগুয়া ফ্লোরিদা’[২] গায়ে ছিটিয়ে। এই সুগন্ধির বোতল বাক্স করে বাড়িতে পৌঁছে দিত কুরাসাওয়ের[৩] চোরাকারবারিরা। একইভাবে তারা বিক্রি করত ব্র্যান্ডি ও চিনা সিল্কের শার্ট। একবার তিনি বলেছিলেন যে একমাত্র এই সুগন্ধিটাই ব্যবহার করেন, কারণ এটা যে মাখে সে ছাড়া আর কেউ তার গন্ধ পায় না। কিন্তু পরে তাঁর এ বিশ্বাস ভেঙে গিয়েছিল। কেন-না কেউ একজন অন্য একটা লোকের বালিশে এই গন্ধ দিয়ে তাঁকে চিনে ফেলেছিল। আরেকটা গল্প অনেকবার বলতে শুনেছি যে একদিন রাতে আলো নিভে যাওয়ায় অন্ধকারের মধ্যে আগুয়া ফ্লোরিদা ভেবে এক বোতল কালি গায়ে ঢেলে ফেলেছিলেন।

বাড়িতে দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য দাদু পরতেন মোটা সুতির প্যান্ট, তাতে ইলাস্টিকের গ্যালিস দেওয়া, নরম জুতো ও সূচালো অগ্রভাগের একটা কাপড়ের টুপি। আর রবিবারে গির্জার প্রার্থনাসভায়, যা তিনি বিরাট কোনো অসুবিধা ছাড়া বাদ দিতেন না এবং অন্যান্য বাৎসরিক অনুষ্ঠান বা স্মৃতিসভায় তিনি পরতেন শক্ত কলার দেওয়া সাদা লিনেনের স্যুট ও কালো টাই। তবে সন্দেহ নেই যে এইসব বিরল অনুষ্ঠানগুলোর দৌলতেই লোকে তাঁকে অপব্যয়ী ও অহংকারী বলে ভাবত। এখন আমার মনে হয় যে সেই বাড়ি ও তার অভ্যন্তরের সবকিছুর অস্তিত্বই বিরাজমান ছিল দাদুকে কেন্দ্র করে। কারণ দাদু-দিদার বিয়েটা ছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজে পুরুষতান্ত্রিক বিয়ের এক আদর্শ উদাহরণ। যেখানে পুরুষটি হচ্ছে বাড়ির সর্বময় কর্তা, কিন্তু প্রকৃত শাসন যে করে সে হল তার স্ত্রী। সোজা ভাষায় বললে তিনি ছিলেন পুরুষালি ধরনের, অর্থাৎ অন্তরে কোমল প্রকৃতির হলেও তা বাইরে প্রকাশ করতে লজ্জা পেতেন আর অন্যদিকে তাঁর স্ত্রী তাঁকে খুশি করার জন্য দিবারাত্র পরিশ্রম করতেন।


টীকা:

১। কাস্তেইয়ানো: স্প্যানিশ ভাষা।

২। আগুয়া ফ্লোরিদা: এক ধরনের সুগন্ধি যা স্নানের সময় ব্যবহার করা হয়।

৩। কুরাসাও বা Curaçao: ক্যারিবীয়ান সাগরের একটি দ্বীপরাষ্ট্র।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *