কার্লোস ফুয়েন্তেস-এর সঙ্গে কিছু কথাবার্তা – অনুবাদ গৌতম চক্রবর্তী
প্রাথমিক
১৯২৮ সালের ১১ই নভেম্বর মেক্সিকো শহরে কার্লস ফুয়েন্তেস-এর জন্ম হয় । একজন ছোটোগল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক এবং রাজনৈতিক প্রবক্তা হিসেবে খ্যাত ফুয়েন্তেস-এর আখ্যানগুলোয় সামাজিক সচেতনতা, রূঢ় বাস্তব, মনস্তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টি এবং কল্পনার মিশ্রণ থাকে । ‘দা ডেথ অফ আর্তেমিরো ক্রুজ’, ‘আউরা’, ‘টেরা নস্ট্রা’,’দা ওল্ড গ্রীনজো’ ও ‘ক্রিস্টোফার আনবর্ন’ তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ । বিংশ শতাব্দীর ষাট এবং সত্তরের দশকের লাতিন আমেরিকান বুম-এর একজন উল্লেখযোগ্য লেখক কার্লোস ফুয়েন্তেস সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য বহু পুরস্কার পান । ২০১২ সালের ১৫ই মে তাঁর মৃত্যু হয় ।
নিচের অনূদিত সাক্ষাৎকারটি ১৯৮৮ সালের গ্রীষ্মে অধ্যাপিকা ডেবরা ক্যাস্টিলো নিয়েছিলেন ।
সাক্ষাৎকার
ডেবরা এ কাস্তিলো: সমালোচকরা যখনই আপনার কাজ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেন তখন তাঁরা আপনার বৈচিত্র্যে ভরা বাচনভঙ্গি এবং একই সঙ্গে কথাসাহিত্যের ভিন্ন ধারাগুলোর ভেতরে আপনার অনায়াস ও অবাধ যাতায়াতের প্রসঙ্গ তোলেন। আপনার উপন্যাস ‘উনা ফ্যামিলিয়া লেজানা’-তে একটি চরিত্র যেমন বলছে,”আখ্যান শিল্প আসলে হলো ভিন্ন বস্তুদের মধ্যেকার বিভেদকে জলাঞ্জলি না দিয়ে তাদের ভেতরের সাদৃশ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবার একটা মরিয়া প্রচেষ্টা মাত্র ।” আপনার নিজের কাজের ক্ষেত্রে এই কথাগুলো ঠিক কতটা প্রাসঙ্গিক?
কার্লোস ফুয়েন্তেস : যার থেকে আমার যাবতীয় আখ্যান চর্চা ভাবনার উদ্ভব অর্থাৎ সারভান্তেস, তাঁর রচনার ক্ষেত্রে এই কথাগুলো ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক । সত্যি কথা বলতে কী এখানে আমি ‘ডন কিহোতে’ সম্পর্কে আমার ভাবনাগুলোকে কতগুলো শব্দ দিয়ে ধরবার চেষ্টা করেছি । – বোঝাবার চেষ্টা করেছি কেন এই উপন্যাসটিকে আধুনিকতার জনক মনে করি । আমি মনে করি ডন কিহোতের ভাবনার উৎস হলো মধ্য যুগ । সেই মধ্য যুগ যার বীরগাঁথাগুলো ডন কিহোতে বারংবার পাঠ করেছে, যা তার ভেতরের আবেগকে উসকে দিয়েছে ; আর যা সে বাস্তব জীবনে প্রণয়ন করবার চেষ্টা করেছে । মধ্য যুগ তো আদতে হলো উপমার ঘনঘটায় ভরা এক অনন্য জগৎ । যেখানে সবকিছুই কোনও না কোনও অর্থ বহন করে । সেখানে প্রতিটি কথার বিশেষ অর্থ আছে, নির্দিষ্ট কাজ আছে, আর প্রতিটি বস্তুর জন্য বিশেষ স্থান প্রদান করা আছে । এই সবকিছুর মধ্যেকার ভারসাম্য, সূক্ষাতিসূক্ষ সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের বিন্যাস বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে কেবল মাত্র উপমার সুপরিকল্পিত এবং সুনির্দিষ্ট পরিমাণে ব্যবহৃত হওয়ার সৌজন্যে যা আবার সেই যুগের মানুষের সামনে খুলে দিয়েছিল ঈশ্বর অন্বেষণের পথ । অথচ ডন কিহোতে এমন এক দুনিয়া পরিক্রমণ করবে বলে বের হয় যেখানে এই ভাবনাটারই মৃত্যু ঘটেছে । সাদৃশ্যের অন্বেষণ করতে করতে সে পৌঁছে যায় এমন এক পৃথিবীতে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে সবকিছুর মধ্যেকার বিভেদ বেড়ে চলেছে; অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে বেড়ে চলেছে । রাস্তার পাশের সরাইখানাগুলোয়, চলার পথে যে সব মানুষজনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় যেমন আটপৌরে মানুষ ,ডিউক ইত্যাদি কিংবা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ডন কিহোতে পাঠ করেছে এমন মানুষজন, তারা সবাই তাকে বলে, ” এখন আর তোমার পৃথিবীর কোনও অস্তিত্ব নেই । তোমার সেই অখণ্ড পৃথিবী আর সেই পৃথিবীর উপমা আজ ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে । তার পরিবর্তে আমরা তোমায় প্রদান করছি এক অসীম বৈচিত্র্যময়তা ।” ডন কিহোতে হলো কথাসাহিত্য এবং দর্শনের প্রেক্ষিতে এক অনন্যসাধারণ নায়ক;- আমার তো মনে হয় ভাবনার ক্ষেত্রেও সে এক মহান নায়ক কারণ সে বর্তমান জগতের বৈচিত্র্যময়তা বুঝবে বলে তাঁর অখণ্ডময় জগতের ভাবনাকে ত্যাগ করে না। অথচ তাকে নিজের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হলে পরে পারিপার্শ্বিক পৃথিবীর বৈচিত্র্যময়তাকেও স্বীকার করতেই হবে; আর তার কারণ সে আজ ‘ডন কিহোতে’ এইজন্যই যে কেবল একজন নয়, তাকে আজ বহু পাঠক পাঠ করছে । আমার কাছে ‘ডন কিহোতে’ আর আধুনিক উপন্যাস-এর ক্ষেত্রে সেই অসাধারণ মুহূর্তটি তখনই আসে যখন ডন কিহোতে আর সাঞ্চ জানতে পারে, মানুষজন তাদের যাপনগাঁথা পাঠ করছে । যখন সাঞ্চ কারাসকো এসে সাঞ্চ পাঞ্জাকে বলে,” আরে তোমাদের নিয়ে একটা বই আছে ।” আর সাঞ্চ পাঞ্জা বলে, “সবই দেখছি এখানে লেখা হয়েছে । এমনকি গোপনে যে কথাগুলো আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছি, সেগুলোও ! এতদিন ঈশ্বরই এসব জানতো আর এখন আমাদের পাঠকরাও জানে ।” পাঠক সংখ্যা দ্বিগুণ বা চতুর্গুণ হয়ে ওঠার এই মুহূর্ত, যে মুহূর্তে এই পাঠ চলে যাচ্ছে জনতার কাছে, যারা পাঠ করছে বিবিধ এবং অবশ্যই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে, ঠিক সেই মুহূর্তে জন্ম হচ্ছে আধুনিক পৃথিবীর, আধুনিক উপন্যাসের আর উপমা এবং বিভেদকামিতার মধ্যেকার এই অবিরাম টানাপোড়েন, আমাদের আধুনিক পৃথিবীর চরিত্র নির্ধারণ করছে ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: আপনার নিজের লেখার ক্ষেত্রে, সে ভাবে যদি দেখেন, আপনার কী কখনও এমন মনে হয়েছে যে এই এখন যা বললেন ঠিক তার উল্টোটা ঘটেছে বা ঘটছে । ধরুন যেখানে আপনি উপমার বাড়াবাড়ি দেখেছেন সেখানে অখণ্ডতা’র বদলে বস্তুদের মধ্যেকার বিভেদকেই প্রতিষ্ঠা করা সমীচীন মনে করেছেন ?
কার্লোস ফুয়েন্তেস : হ্যাঁ । এক অর্থে দেখলে আমি নিজেও তো একজন ডন কিহোতে । এও বলা যেতে পারে, স্প্যানিশ ভাষী সমস্ত লেখকই আদতে এক একজন ডন কিহোতে । তার কারণ আমাদের সকলের উৎস একটাই । আমাদের সবার সংস্কার তৈরি হয়েছে এক সনাতন, ও গোঁড়া ভাষার ওপর ভিত্তি করে যেখানে কোনও সমান্তরাল সংস্কারের স্থান নেই । আমার মনে হয় হিস্প্যানিক দুনিয়ার সাহিত্য সঠিকভাবে বুঝতে হলে এটা দেখতে হবে, যখন গোটা ইউরোপ ডন কিহোতের পথ বা বলা ভালো সারভান্তেস-এর পথ অনুসরণ করবার সিদ্ধান্ত নিলো এই ভেবে যে গোটা দুনিয়া এবার থেকে এই বিভেদাকীর্ণ পথ ধরেই হাঁটবে, ঠিক তখনই স্পেন সিদ্ধান্ত নিলো যে সে অখণ্ডতা’র পথ অনুসরণ করবে; সে তার জন্য তাকে যাই মূল্য দিতে হোক না কেন । এর ফলে তৈরি হলো বাকি ইউরোপের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক বিকল্প স্প্যানিশ সংস্কৃতির দুনিয়া এবং এক বিকল্প স্প্যানিশ ভাষা যা এক অর্থে তখনকার মতো খুন করলো স্প্যানিশীয় উপন্যাসকে । তাই সারভান্তেস এবং পেরেজ গালদোস আর ক্লারিন-এর মধ্যেকার সময়ে তেমন কোনও কথাসাহিত্য নেই । সময়ের হিসেবে এ হলো আখ্যানের জগতে প্রায় দুশো বছরের নীরবতা । এ যে কী বিরাট মাপের শূন্যতা, সেটা বোঝা যায় যখন আমরা দেখি এর পাশাপাশি ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষার আখ্যানের ক্ষেত্রে একই সময় রয়েছে এক নিরলস বহমানতা । তাই স্পেন এবং হিস্পানিক আমেরিকায় আমাদের এই মধ্যেকার দুশো বছরের আখ্যানকে নিজেদের মতন করে কল্পনা করে নিতে হয়েছে । আমার নিজের ধারণা এটা করবার উপায় একটাই; আবার ডন কিহোতের কাছে ফিরে যাওয়া এবং ধরে ধরে এই সনাতন, গোঁড়া ভাষাকেই মাধ্যম করে সেই দুশো বছরের সময়কালের বিভেদকামী জগৎকে পুনরায় স্থাপন করা; আর এটা করতে হবে এই অখণ্ডতার চেতনাকে পুরোপুরি বিসর্জন না দিয়ে; এটা যদি কেউ করতে পারে তাহলে তার থেকে ভালো আর কিছু হয় না ।
প্রায় বাখতিনীয় অর্থে আমি এই বিস্তীর্ণ বহুতাকে জায়গা করে দিতে আগ্রহী । ঠিক এইখানে আমরা আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপককারী বিষয়ের সামনে এসে দাঁড়াই । এই বিশাল বৈচিত্র্যময়তা আদতে বাখতিনীয় উক্তি “প্রতিদ্বন্দ্বী ভাষাদের যুগ”-এর দিকেই ইশারা করে; অর্থাৎ যে যুগে আমরা বাস করি আর আমি চাই ‘প্রতিদ্বন্দ্বী ভাষাদের যুগ’ তাঁর সবকিছু নিয়ে আমার উপন্যাসের মধ্যে নিজেকে ব্যাক্ত করুক । আমি মূলত বিশুদ্ধতার ভাবনাকে বর্জন করবার চেষ্টা করি;বর্জন করবার চেষ্টা করি খুঁতহীনতার ভাবনাকেও; এড়িয়ে যেতে চাই কোনও গোঁড়া ব্যবস্থাকেও; সেইসব চিহ্নকেও যা আমাকে ঠেলে দিতে পারে কোনও অবরুদ্ধতার ঘেরাটোপের ভেতরে । আমি ঠিক এর উল্টোটাই চাই আর সেই চাওয়া থেকে পাওয়া ফল যদি মাত্রাতিরিক্ত হয়, তাহলে সেটা মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসার মতন; এমনটা ভাবতেই আমি ভালোবাসবো ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: যে সব উপাদান আপনার লেখায় বৈচিত্র্যময়তা নিয়ে আসছে সেগুলো মনে হয় আপনার কাজের ক্ষেত্রে বেশ নতুন । আপনার বর্তমান সময়ে লেখা উপন্যাসগুলো যদি ধরি তাহলে দেখা যাবে যে আপনি সমস্ত বৈচিত্র্যময়তাকে একত্র করে একটা হেডিং-এর তলায় নিয়ে আসছেন । আর সেটা হলো “লা ইদাদ দেল তিয়েম্প” (মহাকালের যুগ) ।
কার্লোস ফুয়েন্তেস: ঠিক ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: আমি চাই এরকমটা করবার মধ্য দিয়ে আপনি এর ভেতরে কী ধরনের বিবর্তন, কী ধরণের ঐক্য দেখাতে চেয়েছেন, সেটা বলুন । এছাড়া এই নামকরণ করবার মধ্যেও মানে “লা ইদাদ দেল তিয়েম্প”-এর ভেতরে তিয়েম্প (কাল) শব্দটির গুরুত্ব অপরিসীম মনে হয় ।
কার্লোস ফুয়েন্তেস: আমার সমস্ত লেখার বিষয় হলো একটাই । আর সেটা হলো কাল বা সময় । হ্যাঁ বাখতিন অবশ্যই বলেছেন যে প্রতিটি কথাসাহিত্যের মধ্যে ক্রোনোটোপিয়া বর্তমান; অর্থাৎ স্থান এবং কাল দুটোই থাকে। আমি মূলত কাল-এর ওপর বেশি মন দিই । এটা হয়তো ভুল বলছি আমি, হয়তো স্থান-এর ক্ষেত্রে যে মনোযোগ আমি দিয়ে থাকি, সেদিক থেকে আপনার নজর সরানোর জন্যই এমনটা বলছি! সত্যি কথা বলতে কী এই স্থান এবং কাল-এর আলাদা-আলাদা ভাবে কোনও অস্তিত্ব হয় না । তবে আমি সচেতন ভাবে কালের ওপর বেশি মনোযোগ দিয়ে থাকি । আর এই কালের ওপর মনোযোগ দেওয়ার ফলে যদি আমার স্থানকে নিয়ে কেন্দ্রীভূত হওয়া ভাবনাগুলো অচেতনভাবে প্রকাশ পায়, তাহলে বলতে হবে এই পুরো প্রক্রিয়াটাই বেশ সুন্দর। ব্যাক্তিগত ভাবে আমি সবসময়ই চাইবো ‘কাল’-এর বিষয়ে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে থাকতে আর সেই কারণে এটাও চাইবো যে তার প্রভাবে স্থান স্বতঃস্পুর্তভাবে সবার সামনে ব্যাক্ত হোক । কিন্তু মুশকিল হলো, যে নীতির ওপর ভিত্তি করে আখ্যানের কায়াটিকে খাড়া করা হয়ে থাকে সেটা আদতে একটা সাময়িক ধারণা মাত্র।
ডেবরা এ কাস্তিলো : বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে আপনি নিজের কাজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন যে সেগুলো নিছকই বালজাকের এক একটি মেক্সিকান সংস্করণ । ‘অউরা’ যেমন একটি বিশেষ বালজাকীয় ধরন তেমন ‘হোয়ার দা এয়ার ইস ক্লিয়ার’ আরেকরকমের বালজাকীয় ধরন ইত্যাদি ইত্যাদি । আপনার বিগত দুয়েকটি উপন্যাসের রূপরেখা কিন্তু অন্যকিছুর ইঙ্গিত দেয় । এই উপন্যাসগুলোর আদরা ইশারা করে যে আপনার মাথায় এই ব্যাপারে অতি সুপরিকল্পিত কোনও ভাবনা আছে । এগুলো নিছকই কোনও বালজাকীয় ভাবনাকে তার জায়গা থেকে সরিয়ে এনে ম্যুরাল পেন্টিং-এর মতন অন্য কোথাও প্রতিস্থাপন করবার মতন ব্যাপার-স্যাপার নয় ।
কার্লোস ফুয়েন্তেস : হ্যাঁ, উপন্যাসগুলোকে একটার সঙ্গে আরেকটাকে সংযুক্ত করবার প্রচেষ্টার ভেতরে একটা বালজাকীয় ধারণার ব্যবহার খানিকটা হলেও আছে; মানে একটা অস্থায়ী ও স্থানিক ধারণার প্রয়োগ, যা করা হয়েছে মেক্সিকোর ঐতিহাসিক এবং ভৌগোলিক সীমাকে ভিত্তি করে । এটা এক অর্থে হয়তো এই একীকরণের কারণবিশেষ, কিন্তু কেবল দিতে হয় বলে আমি নিছকই এই আখ্যানের শরীরের ওপর ‘লা ইদাদ দেল তিয়েম্প’ এই নাম বসাই নি । যদিও এই নামের অর্থ কোনও ভাবেই ‘কালান্তক সময়’ নয়, তবু এর মধ্যে এই নামের ধূসরতার আমেজ কিছুটা হলেও আছে । ফরাসি ভাষায় এর অর্থ ‘লে দু মাল টেম্পেস’ অর্থাৎ ‘সময় জনিত ঝঞ্জা’। আমি এখানে সময় বা কালকে কোনও ঐতিহাসিক পটভূমিকার অন্তর্গত হিসেবে দেখছি না বা কোনও স্থানের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে এমন সময় বলেও মনে করছি না । – ধরা যাক আমাদের মেক্সিকো, সময়কে কেন্দ্র করে আমাদের যাবতীয় শ্রম, আমাদের নিরন্তর সংঘর্ষ যাতে তাকে একটা অর্থ প্রদান করা যায়, একটা স্থান দেওয়া যায়, হয়তো আমার কথাগুলো পরস্পরবিরোধী হয়ে যাচ্ছে তবুও । তার কারণ যে যাই বলুক, মেক্সিকোর ইতিহাস, লাতিন আমেরিকার ইতিহাস, এই নতুন পৃথিবীর ইতিহাস যার অন্তর্গত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও আসলে তো একটা ইউটোপিয়ান প্রকল্প বই আর কিছু নয় ! এই কারণে আমাদের কোনও দুঃখদায়ক ঘটনাও নেই; হায় রে! তবে আমাদের ভেতরে বিস্তর কল্পরাজ্য আছে; অসুস্থ ভাবনায় জারিত কল্পরাজ্য আছে । সেইসব কল্পরাজ্য যা কার্যকরী করা যায় নি কারণ তাদের সাধন করবার জন্য চিরকাল কোনও স্থানকেই বেছে নেওয়া হয়েছে যা এইসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই অসম্ভব । আসলে U – topos কথাটার অর্থ হলো ‘এরকম কোনও জায়গা নেই’ আর এমন জায়গা কাল-এর শরীরে ধারণ করাতে আমরা ব্যর্থ । তাই আমি তিনটে গল্প দিয়ে শুরু করি যাদেরকে খুব সহজে ঐতিহাসিক অথবা কালানুক্রমিকভাবে রাখা যাবে না । গল্পগুলো হলো অউরা, কাম্পিল্যানস (জন্মদিন ) এবং ডিস্ট্যান্ট রিলেশনস । গল্পগুলোয় আমি মূলত বলতে চেয়েছি যে সময় নিয়ে আমরা ঠিক স্বচ্ছন্দ নই । সময় অথবা কাল সত্যিই এক সমস্যা । কীভাবে আমরা এই সমস্যার বিস্তার ঘটাবো, কি করেই বা আমরা সময়কে সৃষ্টি করবো, সময়ই বা আমাদের কী করে সৃষ্টি করে কিংবা কি করে আমরা সময়কে কল্পনা করি বা সময়কে আমরা কীভাবে পাঠ করি অথবা সময় কি করে আমাদের যারা তাঁর ভেতরে বাস করি তাদেরকে পাঠ করে প্রভৃতি ? এই ভাবনাগুলোই এই তিনটে গল্পকে যুক্ত করেছে । সুতরাং এই গল্পগুলো ‘টেরা নোস্ত্রা’ উপন্যাস-এর আগে লেখা হয়ে যায় বা সেইসব উপন্যাসের আগে লিখে ফেলা হয় যারা এক অর্থে মেক্সিকোর ইতিহাসের একটা কালানুক্রম ভাবনার অনুসারী হওয়ার চেষ্টা করে । এই উপন্যাসগুলোর সূত্রপাত ‘এল তিয়েম্প রোমান্টিকও’ (রোমান্টিক কাল) থেকে যা ঊনবিংশ শতাব্দীর মেক্সিকোর ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে । তবে একটা কথা আমি বারবার বলতে চাই এই গল্পগুলো কালানুক্রমিকভাবে লেখা হয় নি ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: একটা জিনিস হঠাৎ করে আমার মাথায় এলো । এই যেমন ‘দা ডেথ অফ আর্তেমিও ত্রুজ’-কে ‘এল তিয়েম্প রেভোলুশনারিও’ (বিপ্লবের কাল) সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি অথচ অনেক পাঠক এই উপন্যাসটিকে বিপ্লব বিষয়ক উপন্যাস হিসেবে দ্যাখে এবং পাঠ করে ।
কার্লোস ফুয়েন্তেস : আপনি বিষয়টা তুললেন বলে বলি, আমি মনে করি আর্তেমিও ত্রুজ বিপ্লবকে ঘিরে আমাদের যে আদর্শগত ভাবনা আছে সেটাকে সযত্নে এড়িয়ে যায় । এখানে মূল উদ্দেশ্য ছিল আদর্শের গণ্ডি পেরিয়ে সময়কে কেন্দ্র করে আমাদের মধ্যে যে ঐতিহাসিক ভাবনা থাকে তার ভেতরে প্রবেশ করা । আর্তেমিও ত্রুজ-এর গুরুত্ব আমার কাছে অসীম । আর এটা কেবল এই জন্য নয়, যে সে আমার লেখা আখ্যানের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র । এর কারণ একটাই; – সে অধিকাংশ সমালোচক যা দৃঢ়তার সঙ্গে বলে থাকে, তার সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলে; ক্রমাগত বলে তাঁর ভাবনার আদর্শগত দিকগুলোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা সম্ভব । আবার এর সঙ্গে এটাও যোগ করে, এর ইতিহাস নিজের সঙ্গে কিন্তু এমন ধরণের প্রতারণা করে না । তার কারণ ইতিহাস বিকশিত হয় । – বিকশিত হয় একটি অসঙ্গত, নমনীয়, সৃজনশীল ছন্দের প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে; প্রসারিত হয় তাঁর সকল খুঁত ও ব্যাধিকে আত্মস্থ করে; – আদতে সে ইতিহাসের এই নমনীয় ধারণার অন্তর্ভুক্ত । সে কোনোভাবেই আদর্শের একমাত্রিক, নিরেট আবরণ পরিহিত সংস্করণ নয় । এই বিংশ শতাব্দীতে, আমরা যখন বিপ্লবের সঙ্গে প্রতারণার কথা বলি, তখন আমরা আসলে বকধার্মিক বা ভণ্ডের মতো আচরণ করি । আমরা কোনো বিশেষ আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলি; যদিও আমাদের নিজেদের সেই আদর্শের প্রতি এতটুকুও শ্রদ্ধা নেই; যদিও আমরা কখনও কোনোভাবেই সেই আদর্শের সঙ্গে নিজেকে জড়াই নি; জড়াই না। ব্যাপারটা এরকম, ” আহা ! ওদের আদর্শ যে অনুশাসনগুলো অনুসরণ করবার কথা বলে, সেগুলোর প্রতি ওদের অন্তত দায়বদ্ধ থাকা উচিত ছিল!” আমি বলি না । তুমি ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধ থাকো । আর্তেমিও ত্রুজ-এর ক্ষেত্রে এই বিশ্বাসটাই কাজ করেছে বলে আমার মনে হয় ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: কেবল ইতিহাসের সঙ্গে সংলাপ বিনিময় নয়, মিথের গুরুত্ব বা একজন গল্পকারের স্মৃতিশক্তি কেন ইতিহাসকেন্দ্রিক স্মৃতির থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? এছাড়াও আমি চাই মুখফেরতা উপাখ্যানের গুরুত্ব, একজন কথকঠাকুরের ভূমিকার গুরুত্ব, এইসব যেমন আপনার লেখায় বিশেষত ‘ডিস্ট্যান্ট রিলেশনস’, ‘ক্রিস্টোফার আনবর্ন’ প্রভৃতি আখ্যানে এসেছে, সেই বিষয়ে আপনি কিছু বলুন ।
কার্লোস ফুয়েন্তেস : মুখফেরতা উপাখ্যান এবং মিথ মোটামুটিভাবে একই সঙ্গে সহাবস্থান করে । তাঁরা কাল’কে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা কাহিনী কিংবা কাল প্রোথিত যুগের মধ্যেই অবস্থান করে । তার কারণ সবকিছুর শেষে সময় এবং ভাষা, এই দুয়েরই উৎপত্তি মিথের গর্ভে । তাদের উদ্ভব একইসঙ্গে । ভিকো* বলেছেন, যে কোনো উপজাতি সবার আগে সৃষ্টি করে তাঁর ভাষা; আর সবার প্রথম ভাষা থেকে সৃষ্টি করে মিথ । অথবা এর উল্টোটাও বলা যায় যে সবার আগে কোনো উপজাতি সৃষ্টি করে তাঁর মিথ আর তারপর তাঁর মিথ থেকে সৃষ্টি করে তার ভাষা । তাদের আলাদা করা এককথায় অসম্ভব । উৎপত্তির সময় থেকে তাঁরা একজন আরেকজনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আর তাই তাদের জন্মলগ্ন থেকে আমাদের মধ্যে তাদেরকে কেন্দ্র করে একটা বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়ে ওঠে । মূলত মিথকে কেন্দ্র করে আমাদের যে ধারণা তৈরি হয় সেটা এক অর্থে সেই ভিত্তি যার ওপর নির্ভর করে কোনও কৌম বিশেষত কোনও আদিবাসী কৌম তাদের দৈনন্দিন জীবন এক চিরন্তন প্রবাহের অংশ মনে করে যাপন করে । আর সবশেষে আমরা যত সময়কে কেন্দ্র করে কাজ করবো তত উপলব্ধি করবো সে অর্থে সময় বলে আলাদা করে কিছু নেই; আছে কেবল বর্তমান । এই বর্তমানে বসেই আমরা অতীতকে মনে করি; সুতরাং অতীতও বর্তমানের মধ্যে অবস্থান করছে । আর এই বর্তমানে থেকেই আমাদের কোনোকিছুর প্রতি ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা জাগে । অতএব এর থেকে এটাও বলা যায় যে ভবিষ্যৎও বর্তমানের ভেতরে অবস্থান করে । – মানে আমি বলতে চাইছি সবকিছুই আদতে হলো বর্তমান । কোনও শ্রেণী, কোনও সাহিত্যগত ফর্ম যা এই চিরন্তন মিথিক শ্রেণীবিন্যাসের দিকে ইশারা করে এই সবই বর্তমান । সেটা কোনওভাবেই সাংবাদিকতা নয় সেটা আদতে মিথ ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: তাহলে ভবিষ্যৎ আদতে কী?
কার্লোস ফুয়েন্তেস : ভবিষ্যৎ আকাঙ্খার অংশ মাত্র । আর আকাঙ্খা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ । আমি মনে করি আমার উপন্যাসদের ক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা ব্যাপার । ভবিষ্যৎ মূলত একটা ইচ্ছা, কিছু একটা পাবার জন্য আকুতি যার জন্য আমরা মেহনত করি । সেই ধূসর জিনিসটিকে কব্জা করবার তীব্র বাসনা যাকে আমরা কামনা করি । এটা অবশ্য যে খুব সহজ সরল একটা প্রক্রিয়া তা বলা যাবে না কারণ এ শুধু আমাদের কাঙ্খিত বস্তুটিকে হাসিল করার ব্যাপার নয়; এ আদতে হলো আমাদের এই বস্তু সম্পর্কে করা ধারণা অনুযায়ী তাকে বদলে ফেলা; – অপরকে বদলে ফেলা । আর এখানে এই অপর ব্যক্তি শুধুমাত্র আমাদের ইচ্ছেটাকে প্রতিহত করবে না; সে আমাদের অধিগ্রহণ করবার আর তাকে বদলে ফেলবার ইচ্ছেটাকেও আটকানোর চেষ্টা করবে । আর এইজন্যই এত সংঘর্ষ; এইজন্যই এতসব আখ্যান, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি, ইত্যাদি । কিন্তু আকাঙ্খা’র ওপর নির্ভর করে তৈরি করা শ্রেণীবিন্যাস ছাড়া আর সেই সূত্রে করা ইশারাগুলোকে বাদ দিয়ে আমি ভবিষ্যৎকে ভাবতে পারি না ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: ভবিষ্যত বিষয়ক কিছু বলবেন বলে আপনি এই যে একটা ভ্রূণকে কথক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সেটার সঙ্গে এর ঠিক কী সম্পর্ক?
কার্লোস ফুয়েন্তেস : পুরো সম্পর্কটাই তো ভ্রূণ-এর ওপর নির্ভরশীল । ভ্রূণ হলো আমাদের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের মধ্যেকার সংযোগস্থাপককারী ।’ক্রিস্টোফার আনবর্ন’ উপন্যাসে ক্রিস্টোফার চরিত্রের যে বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে সেটা হলো বীর্যপাতের পরের মুহূর্ত থেকে সে তার চারপাশে ঘটে যাওয়া সবকিছু সম্পর্কে ভীষণরকম সচেতন ।সেই থেকে, গানের কলিটি যেমন বলছে, ‘সকলই বিষয়ে তুমি যে পরিজ্ঞাত’, আদতে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে খুবই জোলো একটা ব্যাপার, তবে সাহিত্যগত দিক থেকে দেখলে এর কার্যকারিতা আছে । তার কারণ সে এখানে এমনই চৈতন্যের ধারক যা সবকিছু মনে রাখে; বা সে সবকিছুর বিষয়ে জ্ঞাত যেহেতু সে তাঁর সৃষ্টি-সম্বন্ধীয় ধারা সম্বন্ধে অবগত; নিজের জন্ম-সম্বন্ধীয় যাবতীয় তথ্য তাঁর নখদর্পণে । অথচ ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরমুহূর্তে তালমুদের** ফেরেস্তাদের জ্বলন্ত তরবারির আঘাতে সে এই সবকিছু ভুলে যাবে । তারপর এই সবকিছু পুনরায় মনে করবার জন্য তাকে আবার অধ্যায়ন করতে হবে। অবশ্য এ নেহাতই এক কল্পকাহিনী; আশা করি এই লেখাকে কেউ এক গর্ভপাত বিরোধী আখ্যান ভেবে বসবে না । তবু আমি চেয়েছিলাম এই সবকিছু একজনের চেতনার গোচরে থাকার সম্ভাবনা, তারপর সেইজনের এই সবকিছু ভুলে যাওয়া, এবং তারপরে চিরাচরিত শিক্ষার মাধ্যমে এর কিছুটা জানা ও আগের কোনোকিছুকেই মনে না রাখাকে একসঙ্গে এনে কেমনটা হয় দেখবো । তাই …
ডেবরা এ কাস্তিলো: কারণ জন্মমুহূর্ত একই সঙ্গে সমাপ্তি এবং আরম্ভ?
কার্লোস ফুয়েন্তেস: উম, এটা মূলত ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগের ন’মাস বাসের সমাপন । জন্মাবার সময় আমাদের বয়স তো আসলে ন’মাসই হয় ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: আপনি উল্লেখ করেছেন যে আপনি চান নি কেউ ক্রিস্টোফার আনবর্ন’কে এক আদর্শগত সংঘাত, এমন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখুক । কিন্তু আমার মনে হয় বর্তমানে আমেরিকা এবং মেক্সিকোর যে সম্পর্ক কিংবা এখন যা মেক্সিকোর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তাতে ক্রিস্টোফার আনবর্ন-এর যে কোনো পাঠক এটাই অনুভব করবে যে আপনি কোনোকিছু ঘটতে চলেছে ভবিষ্যতে, তারই পূর্বাভাস দিচ্ছেন । মেক্সিকোতে এখন সবাই খুবই চিন্তিত; সবাই এক সংকটের কথা বলছে । আপনার এই উপন্যাস যেন মনে হয় সেই সংকটের ছবি তা ঘটবার আগে তুলে ধরছে ।
কার্লোস ফুয়েন্তেস : মেক্সিকোয় আমার কর্মজীবনে, যা আমার নিজেরই এখন বেশ লম্বা মনে হয়, তাতে আমার সঙ্গে দুটো ব্যাপার হয়েছে । এক হলো আমি মোটামুটি ভাবে তিন প্রজন্মের সমালোচককে গ্রাস করেছি । চিরকাল আমি আমার সমালোচকদের থেকে বেশি ওয়াকিবহাল । আমি সবসময় আমার সমালোচকদের আপত্তি অথবা টেনে দেওয়া গণ্ডি অমান্য করেছি । কিন্তু আবার ইতিহাস আমাকে গ্রাস করেছে । সে আমার যে কোনো পূর্বাভাস তা যতই হঠকারী কিংবা উদ্ধত মনে হোক না কেন, শেষমেশ সেগুলো একসময় অত্যন্ত মামুলি এবং স্বাভাবিক ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে । এই সেদিন আমি হোসে এমিলিও পাচেচো’র সঙ্গে কথা বলছিলাম । সে আমাকে বললো, “এবিসি ‘র জন্য আমি একটা লেখা লিখেছি । সেখানে বলেছি এই ‘হোয়ার দা এয়ার ইস ক্লিয়ার’ থেকে ‘ক্রিস্টোফার আনবর্ন’ অব্দি তুমি যা যা ভবিষ্যৎবাণী করেছো সেসবই সত্যি হয়েছে ।”
তুমি কি জানো ‘হোয়ার দা এয়ার ইস ক্লিয়ার’ যখন প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল তখন এমনও অভিযোগ উঠেছিল যে এটা একটি অতি অশ্লীল কাজ! অনেক খবর কাগজে; বিশেষত রক্ষণশীল খবর কাগজগুলোয় বলা হয়েছিল সাহিত্যের নামে করা এই অশ্লীল কর্মের জায়গা একটাই হওয়া উচিত । আর সেটা হলো টয়লেটের ভেতরে; এবং সকলের কর্তব্য সেটাকে তারপর ফ্লাশ করে দেওয়া । এরপর একদিন আমি হঠাৎই আবিষ্কার করলাম যে সেক্রেড হার্ট কনভেন্টে পড়া মেয়েরা মাত্র পনেরো বছর বয়সেই ‘হোয়ার দা এয়ার ইস ক্লিয়ার’ পড়ছে । তার কারণ তারা মনে করে এই বইটা একটি অতি শান্ত, নম্র, নিরস বই এবং এটা মেক্সিকান সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাদের জন্য প্রবেশপথের কাজ করবে । এছাড়াও আরো কত কি! ক্রিস্টোফার আনবর্ন’-এর ক্ষেত্রেও যে তা এত তাড়াতাড়ি ঘটবে আমি ভাবি নি । আমি ১৯৯০ সনে’র সংকটের কথা বলছিলাম আর এই দেখো এখন আমরা ১৯৮৭-৮৮ সনের সংকটের মধ্যে বসে আছি । এক বন্ধু আমাকে সেদিন ফোন করে বললো,”গত এক মাসে মেক্সিকোয় যে কী কী হয়েছে সে ব্যাপারে তোমার কোনো ধারণা নেই! যা হচ্ছে, তার পাশে ক্রিস্টোফার আনবর্ন’কে প্রেমের উপাখ্যান মনে হবে ।”
ডেবরা এ কাস্তিলো: আপনি আপনার উপন্যাস ‘ক্রিস্টোফার আনবর্ন’-এ তিরিশ লক্ষ মানুষের শহরের সমস্যার কথা বলেছেন; এমন একটা শহর যা জনসংখ্যার মাপকাঠিতে প্রায় একটা দেশের সমতুল্য । আর ‘হোয়ার দা এয়ার ইস ক্লিয়ার’ উপন্যাসেও এইসময় একটা শহর কীভাবে ধীরে ধীরে বদলে যায় সেই প্রক্রিয়ার ওপর সুন্দর ভাবে মনোনিবেশ করেছেন । এই দুই উপন্যাসকে বিশেষ করে বা ব্যাপক অর্থে আপনার আখ্যানকে সমকালীন শহরের প্রেক্ষিতে ভাবাদর্শগত দিক দিয়ে কীভাবে সংযুক্ত করবেন?
কার্লোস ফুয়েন্তেস : আমি এমন এক পাঠক যাকে নগরকেন্দ্রিক সাহিত্য চিরকাল মুগ্ধ করেছে । আমি মনে করি সাহিত্য তাঁর পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে আমার কাছে ধরা দিয়েছিল যে মুহূর্তে আমি বালজাক পড়ি, ডিকেন্স পড়ি, দস্তয়ভস্কি পড়ি, গোগোল পড়ি । এক কথায় সেইসব লেখকেরা যারা আধুনিক শহরের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় করিয়েছিল । পরে’র দিকে দোস প্যাসোস, ডবলিন, জয়েস তাদের আখ্যানে আধুনিক শহর নিয়ে কাজ করেছেন । কিন্তু এদের আগে, এই যে চারজন : গোগোল, দস্তয়ভস্কি, বালজাক আর ডিকেন্সকে আমি সবসময় রাখবো । তার কারণ এরা আমাকে প্রথম দেখিয়েছিল; উপলব্ধি করিয়েছিল আধুনিক শহরের স্পন্দন। এদের সাহায্যে আমার কল্প জগতে গড়ে উঠেছিল একান্তই আমার নিজের প্যারিস, লণ্ডন আর সেন্ট পিটারবার্গ’স । এইভাবে এদের সম্বন্ধে কেউ আগে বলে নি । যেমন বালজাক-এর দৌলতেই আমরা পাই ‘হিস্ট্রি অফ থার্টিন’ বা ‘ফেরাগাস’-এর মতো প্রারম্ভ অথবা রাতের প্যারিসের অসাধারণ গীতিকাব্যসুলভ বর্ণন। প্যারিস সম্বন্ধীয় অনন্যসাধারণ সব উপমা একটার পর একটা সাজিয়ে গেছেন বালজাক পাঠকের সঙ্গে আলাপ আলোচনার ছলে । আমার কাছে হিউমান কমেডি’র আসল আরম্ভ আদতে ‘হিস্ট্রি অফ থার্টিন’-এর সূচনাসুর থেকেই । এছাড়া ডিকেন্সের মানস জগতের লণ্ডন । বিশেষ করে ‘আওয়ার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড’ – এর সেই অসামান্য দৃশ্যটার কথা আমি ভাবি যেখানে হেক্সাম এবং তার মেয়ে লিজই ভোর তিনটের সময় টেম্পসের বুকে নৌকোয় করে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর নদীর শরীরের ভেতর থেকে মাছ ধরার মতন করে শিকার করছে ডুবে যাওয়া মানুষদের শব এবং তারপর একে একে তাদের ঘড়ি, টাকা পয়সা ও যাবতীয় সবকিছু নিজেরা হাতিয়ে নিচ্ছে; কিংবা গরমকালের ফ্যাকাশে হলুদ, দুর্গন্ধময় সেন্ট পিটার্সবার্গ – এ রাসকলনিকভ; এই সবকিছু আমার কল্পজগতকে ভীষণ ভাবে নাড়া দেয় । আপনি হয়তো খেয়াল করছেন আমি বেছে বেছে রাত্রিকালের দৃশ্যগুলোকে কেবলি তুলে আনছি । আমি তাই নিজের মনে বলি,”কে সেই সৃষ্টিশীল ব্যাক্তি যে কখন ঘুমোয় না ? দু চোখের পাতা এক করে না?” আপনি জানেন কী, কে সে?
ডেবরা এ কাস্তিলো: ঈশ্বর?
কার্লোস ফুয়েন্তেস: উঁহু, না । ঈশ্বর মাঝে মধ্যেই চোখ বোজেন; ঈশ্বর সময় অসময়ে ঘুমিয়েও পড়েন । শয়তান কেবল ঘুমোয় না । ঈশ্বর তো ছোটখাট ঘুম দেন বটেই; ভাতঘুমও সুযোগ পেলেই দেন । বোঝাই যায় তিনি এসব করেন; নইলে কী আর এত ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটে! উল্টোদিকে শয়তান সর্বক্ষণ জেগে থাকে । এই বিষয়ে আমি ফ্যাঙ্গারের রোমান্টিক রিয়ালিজম বইটি পড়েছি । সেখানে বিশদ এবং সুন্দরভাবে এই সবকিছু ব্যাক্ত করা আছে । মূলত শয়তান কীভাবে মূর্ত হয় ভাউট্রিনএর মধ্যে, রাসকলনিকভ-এর মধ্যে, ফাগান-এর মধ্যে সেটাই বিবেচ্য । এরা সবাই শয়তানের অবতার যে রাতের নগরীতে ছদ্মবেশে আমাদের পথপ্রদর্শক হয়। ‘হোয়ার দা এয়ার ইস ক্লিয়ার’-এর ইক্সা সাইনফ্যুগসকে আমি আমার ভাউট্রিন, আমার রাসকলনিকভ, আমার ফাগান বলি । সুতরাং ইউলিসিস বা আলেক্সাণ্ডার প্লাটজ কিংবা বার্লিন অথবা ম্যানহাটান ট্রান্সফার-এর সঙ্গে নাগরিক জীবনের সাদৃশ্য খোঁজার থেকেও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এইসব নগরীর নির্মাণকর্তাদের, যাদের আমি উল্লেখ করলাম তাদের কাছে ফিরে যাওয়াটাই মনে হয় আমার লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: প্রশ্নটা কতকটা ঘুরপথে আবার আপনার ইউটোপিয়া নিয়ে যে চিন্তাভাবনা, সেখানে ফিরে এলো। যে কথাটা একটু আগে আপনি বলছিলেন । একটা স্থান যার আদতে বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই । তাহলে এই যে বিশেষ স্থানগুলো যেমন মেক্সিকো শহর যাদের সম্বন্ধে এত কথা বলা হচ্ছে তাঁরা কি মূলত কল্পনা অথবা কালের প্রেক্ষিতে স্থানচ্যুত ?
কার্লোস ফুয়েন্তেস : আমার মনে হয় ইউটোপিয়া মূলত প্রকৃতি নিয়ে আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠা ধারণার সঙ্গে যুক্ত; মানে আমি বলতে চাই এটা দেখার দুটো পন্থা আছে । ইউটোপিয়া’র যে স্ববিরোধ সেটা আদতে জানুস মুখী***। একদিকে সেটা যেমন স্বর্ণযুগের দিকে ফিরে তাকায় অর্থাৎ যেখানে ব্যক্তি এবং প্রকৃতির মধ্যে মনে করা হয় এক নিখুঁত সঙ্গতি ছিল, তেমনি সে আরো এক স্বর্ণযুগের দিকে দেখে যা ভবিষ্যতে স্থাপিত এবং মনে করা হয়ে থাকে যে সেখানেও ব্যক্তি এবং প্রকৃতির মধ্যে এক নিখুঁত সঙ্গতি থাকবে । আমার ধারণা এই দুটো প্রস্তাবই ব্যর্থ হয়েছে; তার কারণ প্রকৃতিকে আমরা অতীতে ব্যবহার করেছি এবং ভবিষ্যতেও করবো । এছাড়া আমাদের আর কোনো পথ নেই । আমরা যা কিছুই করি না কেন, নিজেদের জন্য প্রকৃতিকে ব্যবহার করা আমরা থামাতে পারবো না কারণ আমাদের এই বেঁচে থাকাটাও তাঁর ওপর নির্ভরশীল । যেমন আদর্ণ বলেছেন, আমরা প্রকৃতিকে নিজ কণ্ঠে নিজ কথা বলতে দিই না; নিজেকে ব্যাক্ত করতে দিই না । আসলে এমনটা করলে আমাদের নিজেদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না । সুতরাং আমরা আদর্ণ থেকে বেঞ্জামিন-এ চলে যাই । তার কারণ বেঞ্জামিন বলছেন একজন লেখক তাঁর কর্তৃত্ব আহরণ করেন মৃত্যু থেকে আর এখানে তিনি প্রকৃতির মৃত্যুর কথা বলছেন, সেই প্রাকৃতিক বিশ্ব’র মৃত্যু যা আদপে একজন লেখককে বেঁচেবর্তে থাকবার অনুমতি দেয় । এইজন্য এই যে শহর যা আসলে এক কৃত্রিম সৃষ্টি, জায়গা এবং না-জায়গার মধ্যেকার আপস; যা মূলত আধুনিক সমাজে আমাদের এই জৈব এবং কৃত্রিম যাপনের ভেতরে এক অনন্য নায়ক হিসেবে পদার্পন করে, সে আমার মতে একসময় ইউটোপিয়ার ধারণাকে পরিহার করে । এর থেকে সে কি আমাদের ট্রাজেডির ধারণা প্রদান করে ? আমার তা একেবারেই মনে হয় না । আমার মনে হয় না এর থেকে আমরা পুনরায় কোনোভাবেই জীবন সম্পর্কিত কোনো করুণ বোধ পুনরুদ্ধার করতে পারবো, যা আদতে আমার এক সুপ্ত আকাঙ্খা এমনটা বলা যেতে পারে। মানবাত্মার এ এক বিরাট কৃতিত্ব যে সে জীবনকে বুঝতে পারে । আর তাকে তারপরে এক বিয়োগান্ত রূপ দিতে পারে । কিন্তু বর্তমানে আমরা তা আর পারি না । তাই প্রহসন ও বিড়ম্বনাই আমাদের নিয়তি; আমাদের ক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: পাস (অক্টাভিও পাস) কোথাও একটা বলেছেন, মেক্সিকোর নাগরিকেরা প্রায় দু-শতাব্দীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে পরাজয়ের পর এখন কেবল গুয়াডালুপের ভার্জিন ও ন্যাশনাল লটারিতে বিশ্বাস করে । ক্রিস্টোফার আনবর্ন-এ এই ব্যাপারটার উল্লেখ পাওয়া যায় । গুয়াডালুপের ভার্জিনকে নিয়ে তার বদলে সেখানে মামাদককে বসিয়ে দেওয়াটাকে বেশ একটা কৌতূহলদ্দীপককারী পদক্ষেপ বলা যায় । এই উপন্যাসে এর থেকে নারীসত্তাকেন্দ্রিক এক সমান্তরাল ডাইস্টোপিক দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায় ।
আপনার সব আখ্যানের কেন্দ্রেই মূলত মেক্সিকো থাকে; যদিও ইউরোপের পটভূমিকাতেও আপনার লেখা আছে। আপনার জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই আপনি মেক্সিকোর বাইরে কাটিয়েছেন, অথচ আপনার লেখাপত্তর ঠিক ঘুরেফিরে এখানেই ফিরে আসে যেটাকে আমার মনে হয় আপনার ইউটোপিক দৃষ্টিভঙ্গির ফসল বলা যেতে পারে । এই বিষয়ে আপনি কী আরেকটু বিস্তারিত ভাবে বলতে পারবেন?
কার্লোস ফুয়েন্তেস : আপনি অনেকগুলো প্রশ্ন করেছেন । তার মধ্যে একটা হলো মেক্সিকোকে কেন্দ্র করে; আর আমার নিজের মেক্সিকোর বাইরের জীবনযাপনকে নিয়ে । তাই এখানে আমার জীবন নিয়ে কিছু বলার মধ্যে দিয়ে শুরু করাটা সমীচীন হবে । মেক্সিকোতে থাকবার আগে, আমায় নিজের মনে কল্পনার সাহায্যে মেক্সিকোর একটা ছবি নির্মাণ করে নিতে হয় বা আমি করে নিয়েছিলাম; এরপর যখন সত্যি সত্যি মেক্সিকোতে এলাম থাকবার জন্য তখন প্রাথমিক ভাবে এই আমার নির্মাণ করা মেক্সিকো আর বাস্তবের মেক্সিকোর মধ্যে একটা প্রতিতুলনা স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে । আর এই ধরণের চাপা উত্তেজনাই তো শেষ পর্যন্ত সাহিত্যের জন্ম দেয় । আমার সাহিত্যের জন্ম সেই নাটকীয় বৈপরীত্যের মধ্যে যা ঘটেছিল আমার নির্মিত মেক্সিকীয় ইউটোপিয়া, সেই মেক্সিকো যাকে আমায় রক্ষা করতে হবে ( যখন এই মার্কিন দেশে আমি বড় হচ্ছিলাম, তখন আমার মনে হয়েছিল আমাকে মেক্সিকোকে রক্ষা করতে হবে; মেক্সিকোর বিপ্লবকে রক্ষা করতে হবে; মেক্সিকোর সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হবে এইসব গ্রীনজোদের থেকে যাদের সঙ্গে কোনো মেক্সিকীয় বালকের যে কোনো ধরণের আদানপ্রদান শেষমেশ মানসিক পীড়নের নামমাত্র হয়ে দাঁড়ায় ।); যে কারণে আমাকে আমার বাবার দর্শন যা তিনি নিজের মধ্যে লালন করতেন এবং মেক্সিকোর ইতিহাস, ভৌগোলিকতা এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে যে শিক্ষা দিতেন তার বিরুদ্ধাচারণ করে করতে হয়েছিল। তারপরে আমি গেলাম আর সত্যিকারের দেশটাকে দেখলাম । এর ফলে আমার মধ্যে একটা দ্বন্দ দেখা দিলো । এই দ্বন্দ থেকেই ‘হোয়ার দা এয়ার ইস ক্লিয়ার’-এর আখ্যানের জন্ম । আমি অবশ্য এও মনে করি সমালোচনা করার মধ্য দিয়েই মেক্সিকোর মতন ক্রমবর্ধমান দেশে আশাবাদকে জিইয়ে রাখা যায় । সমালোচনায় রত হওয়া আর বর্তমানে নাগালের মধ্যে থাকা তথ্য এবং পরিসংখ্যান ঘাটা এবং একটা দেশের কাজ নিয়ে মন্তব্য করা কার্যত এক ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: আপনার কি মনে হয় লাতিন আমেরিকা, যাকে এতদিন ধরে প্রান্তিক করে রাখা হয়েছিল, এখন কিছুটা হলেও অন্য সংস্কৃতিদের বিচার করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে?
কার্লোস ফুয়েন্তেস : ডিসকোর্সটা মূলত এরকম । যখন আপনি সমালোচনার অনুশীলন করছেন, তখন আপনি সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছেন। এমন কোনো আধুনিক সংস্কৃতি নেই যা সমালোচনার উর্দ্ধে । আর লাতিন আমেরিকায় সংস্কৃতির সমালোচনা লাতিন আমেরিকানদের একটা বিষয় উপলব্ধি করাতে সফল হয়েছে । সেটা হলো যে এই বারবার রাজনৈতিক বিপর্যয় হওয়া সত্ত্বেও, এই ছোট ছোট রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং ভাবাদর্শের দিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন হওয়া সত্ত্বেও, এত অনৈক্য এবং অবজ্ঞা সত্ত্বেও আমরা এক অনন্যসাধারণ ধারাবাহিকতা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাখতে পেরেছি । সংস্কৃতির সমালোচনা থেকে একটা ব্যাপার আমাদের সামনে উঠে আসে; সেটা হলো সংস্কৃতিই আমাদের শক্তি । সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা একটা চমৎকার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছি, এটা জানা প্রয়োজন; এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ । যেহেতু বর্তমান অবস্থায় বেশিরভাগ আর্থসামাজিক প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং বর্তমান সংকটে ভেঙে গেছে; তখন আমরা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যা সৃষ্টি করেছি, তাই একমাত্র তাদের নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম হয়েছে : আমাদের কবিতা, আমাদের উপন্যাস, আমাদের সঙ্গীত, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের ছবি, আমাদের ফিল্ম, আমাদের নৃত্য … এই যা আছে এখন, বাকি সবই কেবল সমস্যা । যা সত্যি, যা দাঁড়িয়ে আছে তা হলো সংস্কৃতি ।
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য কারণ আমার মনে হয় একবিংশ শতাব্দীতে যে দুনিয়া আমরা পেতে চলেছি সেখানে এই আজকের কালজনিত বৈষম্য, দুই মহাশক্তির মধ্যেকার য়ালটা চুক্তির দ্বারা চালিত কোনো দ্বিমাত্রিক পৃথিবী কখনোই পাওয়া যাবে না । সেই পৃথিবী হবে বহুমাত্রিক এবং বহুসংস্কৃতি দ্বারা চালিত । আর আমি মনে করি একটা বহুমাত্রিক পৃথিবী ততক্ষণ সম্ভব নয় যতক্ষণ না এক বহুসাংস্কৃতিক পৃথিবী সৃষ্টি হচ্ছে । যা আদতে সম্ভব হবে যখন সব উজ্জ্বল নক্ষত্ররা যেমন লাতিন আমেরিকা, কৃষ্ণাঙ্গদের আফ্রিকা, ইসলামী দুনিয়া, ইউরোপ, জাপান, চীন, ভারত তাদের নিজ নিজ সাংস্কৃতিক রত্নরাজির প্রতিনিধিত্ব করবে । তারা প্রতিনিধিত্ব করবে সংস্কৃতির সেই বৈচিত্রময়তার যা মূলত বহুমাত্রিক শক্তিরই প্রতিনিধিত্ব করে । সুতরাং এই একবিংশ শতাব্দীর পাদুর্ভাবে এই বিষয়টা আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের সবকিছুর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলো যা এই বিংশ শতাব্দীর শেষ সময় এসে আমাদের কাছে স্বচ্ছ ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: আপনার নিজের লেখায় মনে হয় আপনি এই বহু সাংস্কৃতিকতা বা জটিলতার দিকে আরো এগিয়েছেন । আপনি আপনার এক উপন্যাসে যেমন একজন ফরাসি কথক ব্যবহার করেছেন, তেমনই আরেক উপন্যাসে একজন গ্রীনজোকে কথক করেছেন । স্প্যানিশ ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় লিখবেন এমনটা কী কখনও ভেবেছেন?
কার্লোস ফুয়েন্তেস : না, তবে ইংরেজিতে লিখবার ইচ্ছে যে মাঝে মাঝে হয় না, তা নয় । যেহেতু স্পানিশের পর ইংরেজিটাই আমি সবচেয়ে ভালো জানি । কিন্তু আমার মনে তো ইংরেজির ওপর ভিত্তি করে কোনো স্বপ্ন কখনও আসে নি, তাই ইংরেজিতে লেখাটা আমার কাছে খুব শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে । কিংবা এটা বলা যেতে পারে যে ইংরেজিতে করা গালাগাল আমাকে ঠিক ছোয় না যতটা স্প্যানিশে করা গালাগাল আমাকে স্পর্শ করে। এছাড়া ইংরেজিতে প্রেম জনিত কথাবার্তা আমার কাছে সম্পূর্ণ অন্য জগতের ব্যাপার-স্যাপার আর যেহেতু প্রেম নির্ভর সবকিছু আজ অব্দি আমি স্প্যানিশে করেছি তাই : এই সবকিছু আমাকে স্প্যানিশ ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় লিখতে দেয় না । যেহেতু লিখতে হলে সেই ভাষার পটভূমিতে প্রেম, অপমান ও স্বপ্ন অনুভব করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: আপনার নিজের জীবনের প্রেক্ষিতে যে বিতর্কপূর্ণ সম্পর্কের কথা আপনি বলেছেন সেদিক দিয়ে দেখলে এই ব্যাপারটা বেশ আগ্রহব্যাঞ্জক – এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তাই – মেক্সিকো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র’র মধ্যেকার যে সম্পর্ক – যেখানে মার্কিন রুচির যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব আবার একইসঙ্গে সংস্কৃতিগত দিক থেকে তাদের একের অপরের চরম বিরোধিতা করা, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আপনার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা ঠিক কোনখানে?
কার্লোস ফুয়েন্তেস : একদমই তাই । এটা আমার জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত । তার কারণ আমি দ্বিভাষী আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আমি খুব ভালো ভাবে চিনি; তাঁর সংস্কৃতি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর তারিফ করি । তবে তাঁর লাতিন আমেরিকার জন্য নির্ধারণ করা নীতিগুলো দেখে শঙ্কিত হই । সাধারণভাবে দেখতে গেলে তাঁর বাকি পৃথিবীকে বুঝবার অক্ষমতা অথবা দুনিয়ার দরবারে নিজেকে কিঞ্চিৎ খর্ব করে সকলের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে সবার প্রেক্ষিতে নিজের স্থান মেনে নেওয়া; যেহেতু আমাদের ভালো লাগুক চাই না লাগুক, আমাদের একসঙ্গেই থাকতে হবে । যেমন হুয়ান রুলফো’র উপন্যাস ‘পেদ্রো পারামোস’ – এ লা কুয়াররাকে ও ড্যামিয়েন সিসনেরস, হুয়ান প্রিসিয়াদকে বলে, “চুপ করো । আমরা সমাধিস্থ হবো এইখানে; একইসঙ্গে বহুদিন আমরা থাকবো; এসো তাই আমাকে আলিঙ্গন করো।” একই কথা প্রযোজ্য মেক্সিকো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেলাও : আমরা প্রতিবেশী হবো । সম্ভবত বহু মেক্সিকোবাসী মোটামুটি ভাবে আমেরিকার থেকে দূরে সরে হয়তো পলিনেশিয়া বা সেরকম কোথাও চলে যেতে চায়; আমেরিকাও হয়তো তাই চায় । কিন্তু না; আমরা কোথাও যাচ্ছি না । আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সমস্যা ভাগ করে নেবো, আমাদের শ্রম ভাগ করে নেবো, আমাদের কূটনীতি ভাগ করে নেবো আর আমাদের মধ্যে মতভেদও থাকবে । আমাদের সংস্কৃতি এক নয়, বিষয়-আশয়ের ব্যাপারে আমাদের ধ্যানধারণা এক নয়, আমরা একই লোকের উপাসনা করি না, কিন্তু তবু আমাদের একইসঙ্গে থাকতে হবে । আমার কাছে এ হলো আমাদের জীবনের, আমাদের অস্তিত্বের প্রেক্ষিতে চরম বাস্তব । আমি এইজন্য এই উপলব্ধিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি কারণ মেক্সিকোকে বুঝতে হবে যে সংস্কৃতিগত ভাবে, অর্থনীতিগত ভাবে এবং কূটনীতিগত ভাবে বিচ্ছিন্ন থেকে কোনোকিছু লাভ হবে না । একই কথা প্রযোজ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও । আমাদের অবলম্বনের বহু উৎস খুঁজে নিতে হবে,পরিচিতি তৈরি করতে হবে বিশেষত ইউরোপে এবং প্রশান্ত মহাসাগরের অববাহিকায় । আমাদের হাতে অনেক কাজ; আর সেই কাজ মূলত নির্ধারণ করছে ভৌগোলিক ভাবে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী দেশের পাশে আমাদের অবস্থান । পৃথিবীতে এটাই হয়তো একমাত্র দৃষ্টান্ত যেখানে সামরিক এবং শিল্পায়ণগত ভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি দেশ এবং একটি উন্নয়নশীল দেশ পাশাপাশি বিদ্যমান ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: আরেকরকমের বিরোধিতার প্রেক্ষিতে আপনাকে আমি এবার প্রশ্ন করবো । গোমব্রবীচ্ (বেটোল্ড গোমব্রবীচ্) তার একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন যে, ” একজন শিল্পী যিনি নিজেকে সম্মান করেন তাকে সব অর্থেই একজন উদ্বাস্তু হতে হবে ।” আপনার নিজের নির্বাসন সম্বন্ধে ধারণার সঙ্গে গোমব্রবীচ্-এর ধারণার প্রতিতুলনা কীভাবে করবেন ?
কার্লোস ফুয়েন্তেস : দেখুন, আমি সারা জীবনই ঘুরে বেড়িয়েছি যেহেতু আমার বাবা একজন কূটনীতিবিদ ছিলেন । সুতরাং আমার মধ্যে উদ্বাস্তুগত বোধ সবসময় ভেতরে ভেতরে কাজ করেছে । আমার মনে হয় গোমব্রবীচ্-এর থেকেও আমার এ বিষয়ে বোধ আরো গভীর যদিও তিনি বহুদিন আর্জেন্টিনা এবং ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন; তাই তিনি যা বলেছেন সে বিষয়ে তার সম্যক ধারণা আছে । এ বিষয়ে বলতে গেলে আমাকে উদ্ধৃত করতে হবে মধ্যযুগের এক উদ্বাস্তু সন্ত পণ্ডিত উগো ডি সান ভিক্টরকে যাকে উদ্ধৃত করেছেন এডওয়ার্ড সায়ীদ তার নির্বাসন সম্পর্কে মনোভাব ব্যাক্ত করবার সময়কালে । সান ভিক্টর বলছেন, যখন একজন ব্যাক্তি নিজেকে নিজের মাতৃভূমিতে শ্রেষ্ঠ মনে করেন, সুখী মনে করেন, তখন তিনি আদতে এক অতি নরম সরম শিক্ষানবিশ বই আর কিছু নয় । কিন্তু যখন একজন ব্যক্তি সব স্থানকেই তার মাতৃভূম হিসেবে দেখেন তখন বিষয়টা আরেকটু কৌতূহলোদ্দীপক এবং জটিল হয় । কিন্তু যখন একজন ব্যক্তি সবখানেই নিজেকে নির্বাসিত মনে করে এমনকি নিজভূমেও তখন তাকে একজন যথাযথ মানুষ বলা যায় । এখন আমি দ্বিতীয় পর্যায়ে আছি । আমি এখনো যথাযথ মানুষ হয়ে উঠতে পারি নি । অনেক স্থানকে আমার নিজ ভূম মনে হয় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আমার নিজ ভূম মনে হয়, ব্রাজিলকে আমার নিজ ভূম মনে হয়, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্পেনকেও তাই মনে করি । নিজের বাড়িকে আমার নিজের কম মনে হয় কারণ এখানে সবসময় আমি একটা চাপ অনুভব করি । মেক্সিকোতে আমার নিজেকে নির্বাসিত মনে হয় । সম্ভবত এখানেই কেবল আমার মধ্যে একজন যথাযথ মানুষের আভাস পাওয়া যায় । এর অর্থ হলো আমি মূলত দ্বিতীয় পর্যায়ে আছি । সেই ব্যক্তি যে বহু জায়গায় স্বচ্ছন্দবোধ করে । খুঁতে ভরা একজন মানুষ ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: জীবন এবং ইতিহাস – এই দুটো বিষয়ে আমরা বারবার ফিরে আসছি । আপনাকে আমার একটা প্রশ্ন করা প্রয়োজন যেটা ‘ডিস্ট্যান্ট রিলেশনস’ লেখাটিতে আপনার সৃষ্টি করা এক চরিত্র জিজ্ঞাসা করে: ” কি সম্পর্ক থাকতে পারে বলুন, যা যাপন করি আর যা বলি তার মধ্যে?”
কার্লোস ফুয়েন্তেস : আমার কাছে সাহিত্য ব্যাতীত জীবন অকল্পনীয় । আমার ধারণা ডন কিহোতে বাস্তব জগতে কোনোদিনই ছিলেন না । কিন্তু ১৬০৫ সনের অন্য যে কোনো কারোর থেকে তার উপস্থিতি অনেক বেশি । এই ব্যাপারে ডন কিহোতে অথবা হ্যামলেটের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেউ করতে পারবে না । অতএব সব শেষে বইয়ের বাস্তবকেই আমরা ঐতিহাসিক বাস্তব এবং এই দুনিয়ার বাস্তব হিসেবে পাচ্ছি । শুধু সাহিত্য নয়, শিল্পের যে কোনো বিভাগের ক্ষেত্রেই এই বিপুল সম্ভাবনা রয়ে যায়, যেখানে তাঁরাই অতীতের এক মাত্র প্রতিনিধি বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে । শিল্পের ক্ষেত্রে এটাই বাস্তব । মনুষ্যজাতির প্রত্যুষ থেকেই শিল্পকে সম্ভাব্য বাস্তবের প্রকল্প হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়েছে কিংবা ওই ১৬০৫ সন থেকে বর্তমান কাল অব্দি। – আমাদের নির্মিত শিল্প ছাড়া, আজ আমরা যা করছি, তার কোনোকিছুই কাল থাকবে না । বাকি সবকিছুই লুপ্ত হবে, খুব তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যাবে ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: এটা বলা যেতে পারে এই মুহূর্তে আপনি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর সাহায্যে এই যে সাংস্কৃতিক প্রকল্প, তাকে আলোচনার করে, একটা গন্ডির ভেতরে এনে ফেলেছেন । এই পুরো আলাপচারিতার পুনরাবৃত্তির মধ্যে না গিয়ে আপনি সংক্ষেপে পরের প্রশ্ন কটির প্রেক্ষিতে মন্তব্য করতে পারেন ? প্রশ্নগুলো হলো: কারা কিছু কামনা করে? কারা স্বপ্ন দেখে? কারা কথা বলে? শক্তি কাদের আছে? কি ধরণের মুখাবয়ব আমরা দেখি বা দেখতে পাই?
কার্লোস ফুয়েন্তেস : এ তো লাতিন আমেরিকারই প্রশ্ন । ভাষাগত আধিপত্য লাতিন আমেরিকায় এক জলজ্যান্ত বিষয় । আজটেক সম্রাট মন্টেজুমা একটি সরকারি উপাধি ব্যবহার করতেন যাকে বলা হতো ‘হেউতলাতোয়ানি’। এর অর্থ ‘যিনি অমিত কণ্ঠস্বরের একমাত্র অধিকারী’, একমাত্র যার আছে বক্তৃতার ওপর একচেটিয়া অধিকার, ভাষার ওপর একচেটিয়া অধিকার । পেদ্রো পারামো’র মতন চরিত্র এত গুরুত্বপূর্ণ তার কারণ তার কাছে স্বরবর্ণ ব্যবহারের পরিমণ্ডলের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য ছিল যার থেকে কেবল মাত্র একটি চরিত্র পালাতে সক্ষম হয় । সেই চরিত্রের নাম সুসানা সান হুয়ান । পেদ্রো পারামো তাকে কব্জা করতে ব্যর্থ হয় কারণ সুসানা সান হুয়ান নিজের প্রলাপ এবং পাগলামিতে ভরা মনোলোগে আচ্ছন্ন; বন্দিপ্রায় । আর পেদ্রো পারামো তো নিজে ক্রমাগত মানুষের এই স্বরবর্ণ ব্যবহারের পরিমণ্ডলের মধ্যে কে থাকবে আর কে না থাকবে নির্ধারণ করে চলেছে । তাই লাতিন আমেরিকায় একটা প্রশ্ন বার বার উঠে আসে । আর সেইজন্য সাহিত্য এখানে এত গুরুত্বপূর্ণ । এইজন্যই কবিতা এবং উপন্যাস লাতিন আমেরিকায় এত মর্যাদাপূর্ণ । একদিক দিয়ে দেখলে এই বিষয়টা একজন ফরাসি, বা একজন ইংরেজ কিংবা একজন আমেরিকান আঁচই করতে পারবে না । এটার অর্থ অনেকটা এরকম : “আমি কণ্ঠস্বর নিয়ে নিচ্ছি, ভাষা নিয়ে নিচ্ছি, স্বপ্নগুলো দেখবার বা দেখাবার অধিকার কেবল নিজের কাছে রাখছি । এতে তোমার কোনো এক চেটিয়া অধিকার নেই ।” তোমাদের মনে হবে এখানে বা পশ্চিম ইউরোপে তোমরা ব্যাপারটার এতটাই বিস্তার ঘটিয়েছো যে এটা এখন তোমাদের কাছে কোনো সমস্যায় নয়। এছাড়া তোমার কাছে প্রথম সংশোধনের রিপোর্ট আছে আর রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় ব্যবস্থা রয়েছে । কিন্তু রোমুলো গাল্লেগস-এর উপন্যাসে ভেনিজুয়েলান গায়ানায় যে মানুষের বাস অথবা হুয়ান রুল্ফো’র কোনো উপন্যাসে জালিস্কো যে সমতল ভূমিতে ঘুরে বেড়ায়, সেখানে স্বপ্ন দেখতে পারা বা নিজের কথা বলতে পারা মানবিকতার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত । সুতরাং যে কবি, যে ঔপন্যাসিক মানুষকে এই সম্ভাবনা প্রদান করে সে আমাদের সমাজের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে যায় ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: তাহলে আপনার কথা অনুযায়ী ব্যাপারটা কী এইভাবে রাখা যেতে পারে যে ইউরোপ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে এবং লাতিন আমেরিকা অন্যদিকে; অর্থাৎ তফাতটা শুধু কল্পনার ভূমিকাগত দিক নিয়ে ?
কার্লোস ফুয়েন্তেস: হ্যাঁ, আমার মনে হয় যে সমস্যাগুলোর কথা আমি এখন বলছি সেগুলো আপনাদের কাছে ঠিক আদায় করার মতন ব্যাপার আর নয় । খুব বেশি হলে এগুলো সংরক্ষণ করার কথা আপনারা ভাবতে পারেন । আর কিছু ক্ষেত্রে তাও নয় । মাঝেমধ্যে আপনাদের আয়ত্বের মধ্যে আছে এমন সব জিনিসের মূল্য সম্পর্কে সচেতনতা আপনারা হারাচ্ছেন আর সেগুলোকে অবলীলায় যেতে দিচ্ছেন। এরকম নাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর রাজনীতির কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না; এখানে কোনো বিষয়ে উদাসীন হওয়া আর চরমপন্থা নেওয়া এত সহজ! – এত সহজে ধাপ্পা দেওয়া যায় এই সমাজে ! অন্যদিকে লাতিন আমেরিকায় এ শুধুমাত্র কোনো কিছু সংরক্ষণ করার বিষয় নয় । প্রথমবার তা আদায় করে নেওয়ার মতো বিষয়ও! – এটা সম্পূর্ণ আলাদা একটা ব্যাপার ।
ডেবরা এ কাস্তিলো : এতক্ষণ আমরা ইউটোপিয়া’র কথা বলেছি; এবার আমি একটু হেটেরোটোপিয়া’র প্রসঙ্গে আসতে চাইছি । এ বিষয়ে বলতে গিয়ে ফুকো আমাদের কিছু চরম উদাহরণ দিয়েছেন । এই যেমন : বেশ্যালয় বা উপনিবেশ, এমন সব । তিনি বলছেন, যে জলযান ক্রমাগত ফিরে আসে এবং চলে যায়, সেই জলযান হেটেরোটোপিয়া’র আদর্শ উদাহরণ কারণ তা কল্পনা মজুদকারীর কাজটা করে । ফুকোর বয়ানে, যে সব সভ্যতায় জলযানের ব্যবহার নেই, সেইসব সভ্যতায় স্বপ্ন শুকিয়ে যায় আর পুলিশ একসময় জলদস্যুর স্থান অধিকার করে । এই প্রেক্ষিতে বোকাদের জাহাজ বলতে আপনি কি বলতে চেয়েছেন সেটা যদি আরেকটু বিস্তারিত ভাবে বলেন ?
কার্লোস ফুয়েন্তেস : এই প্রশ্নটি করে লাতিন আমেরিকার সংস্কৃতির বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধীয় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রসঙ্গ আপনি তুললেন । ভালো ভাবে দেখলে ভবিষ্যতে এর থেকে আদতে আমরা কি প্রত্যাশা করতে পারি সেই বিষয়ও উঠে আসে । আমার মনে হয় আমরা এখন খুব দ্রুত এমন এক পৃথিবীর মধ্যে প্রবেশ করছি যার সম্পর্কে ম্যাক্স ওয়েবার বলেছেন এ এক বহুস্তরীয় মূল্যবোধের আকর । একটা সুসম্বদ্ধ, একক, পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিতা’র ভাবনা – বা পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিতা এখন এক কথায় বললে বলতে হয় একেবারেই অসম্ভব । এখন এমন এক পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আমাদের লড়াই করতে হবে । – আমাদের নিজেদের জাতিগত পরিচয়ের সংরক্ষণ তো করতে হবেই আর সেটা করতে হবে এই পরিবর্তনশীল দুনিয়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে । নাহলে তো আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো এখনকার তাৎক্ষণিক যোগাযোগ ব্যবস্থার থেকে, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের থেকে, বিজ্ঞানের অগ্রগতি থেকে, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা থেকে; আরো কত অসংখ্য জিনিসের থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো যে তা বলার নয় । বাখতিন যে ভাষাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলেছিলেন তার থেকেও আমরা তাহলে বাদ পড়ে যাবো । আমরা হঠাৎ করে এমন এক সত্যের সম্মুখীন হয়ে পড়েছি যার সারমর্ম একটাই; – একবিংশ শতকে প্রবেশ করতে চাইলে আমাদের শুধুমাত্র নিজেদের অর্জিত এতদিনকার পরিচিতি আর ব্যাক্তিত্ব নিয়েই প্রবেশ করতে হবে । এটা অনেকটা ঠিক হঠাৎ করে তালেগোলে রোলার কোস্টার রাইডে বসে পড়ার মতন, যা চলাকালীন আপনি একদম সিঁটিয়ে থাকেন আর শেষ হওয়ার পর, আবার সেই আগের হাবভাবে ফিরে আসেন । তার কারণ এই পুরো ব্যাপারটাই এত রুদ্ধশাসকারী এবং হঠাৎ করে আরম্ভ হয় যে কেউ যদি মুখ খোলা অবস্থায় বসে পড়ে তাহলে এই পুরো সময়টায় তার মুখ খোলাই থাকবে । আবার কেউ যদি চোখঃ বন্ধ করে বসে তাহলে তার চোখ এই সময়টায় বন্ধ করা অবস্থাতেই থাকবে । আপনি যদি উঠবার সময় কোনো একরকমের মুখভঙ্গি করেন তাহলে শেষ অব্দি আপনার ওই মুখভঙ্গিই হয়ে থাকবে যতক্ষণ না আপনি আপনার গন্তব্যস্থলে পৌছচ্ছেন । সুতরাং এই যে এখন আমরা যেমন, ঠিক সেইভাবে এই দুনিয়ায় আমরা প্রবেশ করবো । আমরা প্রবেশ করবো আমাদের মেক্সিকান, আর্জেন্তেনীয়, পেরুভিয়ান পরিচিতি নিয়ে । – আমাদের লাতিন আমেরিকান পরিচিতি আর সম্মুখীন হবো এই সময়ের । নাহলে আমাদের নিজেদেরকে নির্বাসিত করতে হবে এবং একসময় সেই কারণে লুপ্ত হয়ে যেতে হবে । উম, খোলাখুলি ভাবে যদি বলি তাহলে বলতে হয় এমতবস্থায় আমি আজটেকদের মতন নয় বরং গ্রিকদের মতন হতে চাই । আমি এই পৃথিবীতে অন্যদের সঙ্গে আদানপ্রদানে জড়াবো, এই দুনিয়া যে চ্যালেঞ্জ আমার দিকে ছুঁড়ে দেবে তা স্বীকার করবো, অন্যদের সঙ্গে সংগ্রাম করবো, আমার প্রাপ্য অধিকার আমাকে দিতে অস্বীকার করা হলে তা পাবার জন্য সংগ্রাম করবো, বিরোধীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবো । এই বদলে, বিস্ময় বিহ্বল আজটেকদের মতন নিজেকে সবকিছুর থেকে গুটিয়ে নিয়ে হতবাক হয়ে, আমি মরতে পারবো না । সুতরাং এই চ্যালেঞ্জ নিতে আমি অভিলাষী; এই দুনিয়ায় ঝুঁকি নিতে আমি রাজি আর এই পৃথিবী আমাদের উদ্দেশ্যে যতগুলো জাহাজ বোকাদের বোঝাই করে পাঠায়, ঠিক তত বোকা বোঝাই জাহাজ আমরা দুনিয়ার উদ্দেশ্যে পাঠাতে পারি ।
ডেবরা এ কাস্তিলো: অটলভাবে এমন করে যাবেন আর আসবেন ?
কার্লোস ফুয়েন্তেস : হ্যাঁ, আমার মনে হয় আমি যেন এই জাহাজের মধ্যে আছি । একদমই এই জাহাজের মধ্যেই আছি । ঠিক কোনখানটায় আছি বলা মুশকিল । হয়তো যেখানে বেলচায় করে বয়লারে কয়লা ঢালা হচ্ছে সেখানে ওই কাজ করছি । ওখানে আমি কোনো মহাসভার সদস্য নই, বা মানচিত্রকার নই । টমাস মুর কিংবা ইরেমাস ও নই । ওখানে আমার ভূমিকা হয়তো হবে বাস বয়ের ।
ডেবরা এ কাস্তিলো : আপনার শেষদুটো বই নিয়ে সংক্ষেপে কথা বলে আমাদের এই আলাপচারিতা শেষ করবো । প্রথমত ‘দা ওল্ড গ্রীনজো’, যা বিক্রির প্রেক্ষিতে আপনার সফলতম বইগুলোর একটি; – এই প্রসঙ্গে আমি জানতে চাই এই উপন্যাসের টেক্সটে স্মৃতির ভূমিকা ঠিক কতখানি ? আখ্যানের ক্ষেত্রে স্মৃতি কি সবসময় হলো এক ধরণের মেটাটেক্সট?
কার্লোস ফুয়েন্তেস : এর উত্তরে আমি আপনাকে একটু বিড়ম্বনায় ফেলবো । আমার মনে হয় এই বিষয়ে আপনি নিজে আপনার একটি প্রবন্ধে সবচেয়ে ভালো বলেছেন । আসলে এই গোটা উপন্যাসটি একজন বয়স্ক আমেরিকান মহিলার স্মৃতি এবং তাঁর সেই স্মৃতির পুনর্নির্মাণের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে । আর ওই স্মৃতি বাদ পড়লে পরে এই টেক্সটের কোনো অস্তিত্বই থাকে না । এই টেক্সটের সাহায্যেই স্মৃতি রূপ পাচ্ছে এবং এই টেক্সট কিন্তু আবার স্মৃতির ওপর নির্ভরশীল । আমরা অবশ্যই এটা জানি যে সাহিত্যে কোনো কিছুর জন্যে বা কোনো কিছুর প্রভাবে স্মৃতির উৎপত্তি ঘটে না । কিন্তু লেখকেরা কোনো এক অজানা প্রক্রিয়ায় বারবার এই কার্যকারণের নীতিকে ভাঙে আর কারণের আগে তাঁর ফলাফলকে এনে ফেলেন । যাতে আপনি শুধু মনেই করেন না, আপনার অতীতকে নির্মাণও করেন । উপন্যাসের ক্ষেত্রেও অতীতের ফল হলো বর্তমান । সুতরাং স্মৃতি হলো অনেকটা আয়না নিয়ে খেলা করা বা কারসাজি করার মতন যা কোনোভাবে বর্তমানকে নির্মাণ করে, আদতে যেখানে বসে আবার আমরা আমাদের স্মৃতির সাহায্যে পাঠ করে চলি অতীতকে যা মূলত আমাদের স্মৃতিসংক্রান্ত কার্যকলাপের ফল। আসলে বাস্তবে আমরা পাই কতগুলো মেটাটেক্সট যারা একইসঙ্গে নির্মিত হয় এবং নির্মাণও করে যাতে সাহিত্যের পরিসরে তাদেরকে সমকালীন ঘটনাবলী বলে মনে হয় । সে আপনি যতই ইতিহাস, কালপঞ্জী এবং কার্যকারণ সম্পর্ক সাহিত্যে নিয়ে আসুন না কেন, দিনের শেষে কাফকা এবং সারভান্তেস সবসময়ই সাহিত্যে সহাবস্থান করবে ।
ডেবরা এ কাস্তিলো : আমার শেষ প্রশ্ন সাহায্যের জন্য আর্তি ছাড়া আর কিছুই নয় । ‘ক্রিস্টোফার আনবর্ন’ পাঠ করবার জন্য কি সতর্কীকরণ বার্তা আপনি আপনার পাঠকদের দেবেন ?
কার্লোস ফুয়েন্তেস : কোনো কিছু না ভেবে এর মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ুন । আখ্যানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতার কাটুন । লেজামা লিমার পাঠকদের খুব সম্ভবত কোর্তাজার এই উপদেশই দিয়েছিলেন । আমিও ক্রিস্টোফার আনবর্ন-এর একনিষ্ঠ পাঠকদের একই উপদেশ দেবো । অলিম্পিকের সুইমিং পুলে যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতারু ঠিক সেইভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ুন মাতৃজঠরে । আর যদি ডুবতে শুরু করেন তাহলে নিজেকে বাঁচাবার একদম চেষ্টা করবেন না । ভ্রূণকে বেষ্টিত করে থাকা তরলের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন না করে তাতে স্বচ্ছন্দবোধ করার চেষ্টা করুন । তাহলে সহজেই ভেসে থাকতে পারবেন । ডিগবাজি খান, লাফান-ঝাঁপান, যতরকমের পাগলামো আছে সব করুন । লরেন্স স্টার্ন-এর ক্ষেত্রে যে উৎকৃষ্ট মানের পাঠক, সে ক্রিস্টোফার আনবর্ন-এর ক্ষেত্রেও ভালো পাঠক হবে ।
টীকা:
ভিকো: গিয়ামবাতিস্তা ভিকো একজন ইতালীয় দার্শনিক, অলঙ্কারশাস্ত্রবিশারদ, ঐতিহাসিক এবং আইনজ্ঞ ।
তালমুদের: ইহুদিদের ধর্মশাস্ত্র
জানুস মুখী: প্রাচীন রোমের এক দেবতা, যার একটি মাথা এবং দুটো মুখ । মূলত চরিত্রের দ্বন্দ্ব বোঝাতে ব্যবহার করা হয় ।