হৃদয়ের ঠিকানা হারিয়ে গেছে – অরবিন্দ উজির অনুবাদ : তপন মহন্ত
[লেখক পরিচিতি: অরবিন্দ উজিরের জন্ম ১৯৫৯ সালে। বোড়ো সাহিত্যের বিশিষ্ট এই কবির কবিতায় একজন চিত্রবাদী এবং প্রতীকবাদীর পরিচিতি ফুটে ওঠে। ২০১০ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন ‘Swdwbni Swler’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থের জন্য। তাঁর আরও দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। Stream of consciousness শৈলীতে বেশ কিছু ছোটোগল্পও লিখেছেন। তাঁর কোনো ছোটোগল্পের সংকলন প্রকাশিত না হলেও বিভিন্ন সংকলন গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তাঁর রচিত গল্প। সাহিত্য অকাদেমি প্রকাশিত ‘বোড়ো গল্প সংকলন’ অনুবাদ গ্রন্থে তাঁর ‘চাঁদের ঘর’ গল্পটি সংকলিত হয়েছে।]
শব্দগুলো আমাকে ছেড়ে যেন চলে গেছে
আমি কেন এসব নিয়ে চিন্তা করব?
যদি শব্দগুলো আমাকে ছেড়ে না যেত
জীবন নিজেই আমাকে ছেড়ে চলে যেত।
তাঁর বন্ধুও ছিলেন একজন কবি। সে-ই উপরের কবিতাটি লিখেছিলেন। সময়ের সাথে সাথে, পরিস্থিতি তাঁকে কবিতা থেকে আলাদা হতে বাধ্য করে। শব্দ তাঁকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু সে পাত্তা দেয়নি। কারণ, এখন তিনি মনে করেন যে তিনি পরিবর্তিত সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলতে সক্ষম। এখন মানবজাতির সেবা এবং কাব্যিক উপহার ছাড়া তাঁর আর কোনো কিছুর অভাব নেই। তিনি মনে করেন, কবিতার মাধ্যমে পৃথিবী বদলানোর চেয়ে পরিবর্তিত সময়ের সাথে নিজেকে পরিবর্তন করাই ভালো। তিনি এখন বিশ্বাস করেন যে কোনো কাব্যিক শব্দের মাধ্যমে নয়, টাকপয়সা দিয়েই একজনের জীবন গড়ে তুলতে পারা যায়।
যাইহোক, ওনারুকে শব্দের আকর্ষণ ছাড়তে পারেনি। তিনি শব্দ নিয়ে খেলা করেন, শব্দকে তাঁর জীবন বলে মনে করেন। কিন্তু আজ তিনি বুঝতে চান—কে ভুল করেছে? ভুলটা কি তাঁর অথবা তাঁর বন্ধু দহার, যে কারণে, আজ তাঁকে শুকনো পাতার মতো তীরে ফেলে রাখা হয়েছে
চাকরি নেয়ার অজুহাতে তিনি বহু বছর ধরে গুয়াহাটির উজান বাজারে অবস্থান করছেন। এখানে তিনি কবি-মণ্ডলীর অংশ হয়েছেন। তিনি তাঁর মনের মতো বন্ধুদের সাথে মিশতে পেরে খোশমেজাজে আছেন।
রাতে ছিঁটেফোটা ঘুম ছাড়াই তিনি সকালের মুখের দিকে তাকান। সূর্য তখনও আকাশে তার কিরণ ফোটায়নি। তিনি বাইরে আসেন কিন্তু তাঁর জন্য কেউ অপেক্ষা করে ছিলেন না। শহুরে জীবন শুরু হয় খুব ভোরে। কাউকে তাঁর দুঃখের কথা বলতে না পেরে তিনি আবার তাঁর ঘরে ঢোকেন।
তিনি তাঁর বইগুলোর দিকে ভালোভাবে তাকান। এই বইগুলো তিনি এক বা দুই বছরে কিনতে পারেননি। অনেক প্রচেষ্টার পর তাঁর লাইব্রেরী রূপ নিয়েছে অবশেষে। এর মাঝে তিনি অনেক জায়গায় গিয়েছিলেন। তাঁর যাওয়ার সুযোগও ছিল। আসার সময় তিনি কোনোদিন খালি হাতে ফিরে আসেননি। এভাবেই এই বইগুলি জমা হয়েছিল। কিন্তু এখন দুঃখের বিষয় হল এই যে, এখন সব বই পানবাজারের পুরোনো বইয়ের দোকানে যাবে যেখানে পুরোনো বই বিক্রি হয়, পিপাসু পাঠকের তৃষ্ণা মেটাতে। তিনি তাক থেকে বইগুলো নামিয়ে মেঝেতে রাখলেন। তিনি প্রথমে পুরোনো বই বের করেন। তার মধ্যে ছিল তাঁর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনের সব বই। এর সাথে মিশেছিল তাঁর প্রারম্ভিক জীবনের অনেক স্মৃতি। কিন্তু সেগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই কারণ সেই স্মৃতি তাঁকে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই দেবে না।
পুরোনো বই বের করার পর তিনি তাঁর সর্বশেষ সংগ্রহ বের করতে শুরু করেন। টলস্টয়ের ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ বইটিতে তাঁর হাত থেমে যায়। তিনি বইটির প্রচ্ছদে হাত বুলিয়ে রাশিয়ার মস্কোর দিনগুলোতে ফিরে যান, যেখানে তিনি কবি হিসেবে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই সময় রাশিয়ায় কবিতা, ছোটোগল্প এবং উপন্যাসের কদর করার মতো পরিবেশ ছিল। মানুষ এই কাজগুলো সম্বন্ধে ভালো ধারণা পোষণ করতেন। তিনি অনেক রাশিয়ান কবির সাথে দেখা করেছিলেন। তিনি সেই কবিদের সাথে দেখা করে খুশি হয়েছিলেন এবং তাঁদের কাছ থেকে প্রচুর প্রশংসা পেয়েছিলেন। বিদায়ের সময় তাঁরা তাঁকে টলস্টয়, পুশকিন এবং শোলোকভের বই দিয়েছিলেন। আমাদের দেশে উপলব্ধ অনেক ক্লাসিকও তাঁর গ্রন্থাগারের ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু এখন এই বইগুলো অন্য কারও পাঠতৃষ্ণা মেটাতে পারবে।
আরেকটি আলমারিতে দেখা যাচ্ছে লোরকা এবং পাঁজের কবিতা সংকলন। তিনি লোরকা চোখ দিয়ে দেখে বৈঁচিফলের দেশ কিন্তু তিনি কখনও ভাবেননি যে একদিন তিনি এটিই নিজের চোখে দেখবেন। তিনি লোরকার বারান্দা দেখেছিলেন এবং স্পেনের মাটিতে দেখেছিলেন লোরকার রক্তের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। তাছাড়া, তাঁর আলমারি কালো এবং সাদা লেখকদের বই দিয়েও ভর্তি ছিল। এখন তিনি আলমারিকে এই বইগুলোর বোঝা বওয়া থেকে মুক্ত করে দেবেন।
দেশের একটি সম্মানজনক পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি। তাঁকে একটি প্রশংসাপত্রের সাথে এক লাখ টাকা পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। সে টাকার একটি বড়ো অংশ ব্যয় করেছিলেন কলকাতার বইমেলায়।
যখন তিনি বইগুলি বের করলেন তখন সেগুলো একটি পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে গেল। এমনকী তিনি তাঁর নিজের লেখা বইগুলোও রাখেননি। মাটিতে পড়ে থাকা বইগুলোর দিকে তাকানোর পর, তিনি আবার অনুভব করেন, যে বইগুলি স্তূপের উপরে ছিল সেগুলো হঠাৎ তাঁকে জোর ধাক্কা দিল। তিনি মাটিতে বসে পড়েন এবং কিছুক্ষণ সেখানেই বসেই থাকেন। একটু সুস্থ অনুভব করার পর তিনি বাইরে বেরিয়ে যান। কাছাকাছি কোনো ছোটো ট্রাক খুঁজে না পেয়ে তিনি কিছুটা দূরে গিয়ে একটি মিনি ট্রাক পেতে সক্ষম হলেন। কুলিরা বইগুলো ট্রাকে তোলে। তিনি পানবাজারের বইয়ের দোকানের ঠিকানা লিখে ড্রাইভারকে দেন।
কিছুক্ষণ পর তিনি বইয়ের দোকানে পৌঁছান। যদিও তিনি আগেই তাঁদের জানিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু দোকানটি তাঁর পৌঁছানোর পরেই খোলা হল। যে অর্থ বই সংগ্রহে লেগেছিল তার মাত্র এক চতুর্থাংশ বই বিক্রি করে পেয়ে তিনি তা নিয়ে বাড়ি চলে যান। উদ্গত অশ্রু সম্বরণ করে তিনি ধীরে ধীরে উজান বাজারের দিকে হাঁটতে থাকেন। তিনি কোথায় যাবেন এবং কী করবেন তা অনিশ্চিত। তাঁর মনে হল যেন তাঁর মন তাঁকে পরিত্যাগ করেছে। তিনি মানুষের ভিড়ে একটি শহরে একাকীত্ব অনুভব করেন। তিনি ভয়ে ভয়ে তাঁর বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবেন তিনি যেন একটি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটছেন।
তিনি তাঁর পড়ার ঘরে ঢোকেন যা কিছুক্ষণ আগে খালি করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাঁর পড়ার চেয়ারে বসে, চোখ অর্ধেক বন্ধ করে তিনি বিগত দিনগুলির কথা ভাবতে থাকেন—
যখন তিনি একটি কলেজের ছাত্র ছিলেন তখন থেকেই কবিতার পাখিরা তাঁর হৃদয়ে বাসা বাঁধে। নির্বাসন এবং সময়হীন মানুষের উপর তিনি কবিতা লিখেছেন। এরপর তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন ছাপা হয়ে আসে প্রেস থেকে। উদীয়মান কবিদের জন্য কলকাতায় একটি কবি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। অনেক প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন কবির মাঝে সেখানে তাঁর দেখা হয়েছিল মধুমিতার সাথে। মধুমিতা ছিলেন আসামের কবি। যদিও ওনারুর কথা শুনেছিলেন তবু পরস্পরের সাথে তাঁদের আগে দেখা হয়নি। এই সম্মেলনে তাঁদের পরিচয় পরবর্তী সময়ে প্রণয়ে পরিণত হয়েছিল। একটা সময় ছিল যখন তাঁদের বিয়েও সুষ্ঠুভাবে হয়েছিল। তাঁরা সুখে ভরা একটি পারিবারিক জীবন শুরু করেন। একে অপরের অনুপস্থিতিতে তাঁরা কখনোই পরিম্পূর্ণ বোধ করেননি। তাঁরা অনুভব করেছিলেন যে বাকি অর্ধেক ছাড়া তাঁদের অস্তিত্বের কোনো মানে নেই। তবে সম্ভবত শান্তি এবং সুখ দীর্ঘকাল বিরাজ করে না। কারো পরোয়া না করে সময় বয়ে যায়। তাঁদের সংসারে আশীর্বাদ স্বরূপে দুটি সন্তানের আগমন ঘটে। অনাহার আর কষ্টও সন্তর্পণে তাঁদের ঘরে ঢোকে। ফলে ঝগড়া শান্তির আশ্রয়কে দূরে সরিয়ে দেয়। কাল রাতে তাঁদের ঝগড়া চরমে পৌঁছেছিল। এক ঘণ্টা ঝগড়া করার পর মধুমিতা তাঁকে বলেন—
“কোনো ভালোমানুষ তোমার সাথে সংসার করতে পারে না। একদিন আমাদের মধ্যে একজন মারা যাবে। এরকম কিছু ঘটার আগে আমাদের আলাদা থাকা ভালো।”
ওনারু তখন জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কি ভেবে দেখেছো তুমি কী বলছ?”
“আমার আর ভাবার কিছু নেই। আমি অনেক চিন্তা করার পর এই কথা বলেছি”, মধুমিতা উত্তর দিলেন।
ওনারু বলেন, “ডিভোর্স ফর্ম নিয়ে এসো এবং আমি তাতে স্বাক্ষর করে দেবো।”
মধুমিতা গতকাল সন্ধ্যার বাসে বাড়ি চলে গিয়েছেন। তিনি তাঁর দুই সন্তানকেও সঙ্গে নিয়ে গেছেন। তিনি মধুমিতাকে সন্তানদের রেখে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু মধুমিতা পাত্তা দেননি। কবে ফিরে আসবেন সে কথাও তাঁকে জানাননি। তিনি জানতেন না তিনি ফিরে আসবেন কিনা। তিনি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন যে কীভাবে একসময় প্রেমে একত্রিত একটি সংসার এখন জাম গাছের মতো ভেঙে যেতে পারে। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল কিন্তু ওনারু বুঝতে পারেন না কীভাবে তিনি তাঁর বসার অবস্থান থেকে উঠবেন। তিনি ভেবেছিলেন কীভাবে মধুমিতা এত ভালোবাসা নিয়ে এসেছিলেন কিন্তু তাঁকে অনেক দুঃখ দিয়ে ছেড়েও গিয়েছেন। যদিও মধুমিতাকে ভুলে থাকা সম্ভব ছিল কিন্তু তাঁর পক্ষে তাঁর সন্তানদের ভুলে যাওয়া অত সহজ ছিল না। মধুমিতা তাঁর কাছ থেকে তাদের কেড়ে নিয়ে গেছেন। এবং তাই তাদের ফিরে পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তিনি এখন কার সাথে বসবাস করবেন? যাদের জন্য তিনি চিরসবুজ কবিতা লিখেছিলেন, এমনকী তাদের জন্য অন্যান্য বিষয়ও এখন প্রাধান্য পেয়েছে। চারদিকে হিংসা আর হিংসা। মানুষ একে অপরের সাথে শূকরের মতো ব্যবহার করে এবং একে অপরকে হত্যা করে। চারদিকে হত্যা আর ভয়। তিনি অনুভব করেছিলেন যে জীবন শেক্সপিয়ারের নাটকের মতো। জীবনও তাঁর কাছে অর্থহীন মনে হয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন–
“Life’s but a walking shadow, a poor player
That struts and frets his hour upon the stage
And then is hrard no more; it is a tale
Told by an idiot, full of sound and fury,
Signifying nothing.”
ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তিনি উঠে পড়েন। তিনি বই বিক্রি থেকে যে টাকা পেয়েছিলেন তা মধুমিতাকে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন কারণ অর্থের অভাবেই তাঁরা যে শান্তি ও সুখ চেয়েছিলেন তা পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁদের শোবার ঘরে গিয়ে আলমারি খোলেন। সেই একই জায়গায় টাকাগুলো রাখেন যেখানে মধুমিতার গয়না স্তূপ করা থাকত। আলমারিটা বন্ধ করে তালা মারেন। তিনি বিছানার আলুলায়িত বালিশের নীচে চাবি রেখে চারদিকে তাকিয়ে দেখেন। তিনি রুমের ঝুলন্ত কাপড়ে তাঁর বাচ্চাদের মুখ অনুভব করতে চান। তিনি তাঁদের স্মৃতিবিজড়িত পোশাকগুলো দেখে সান্ত্বনা পেতে চান। রুমে পড়ে থাকা তাদের খেলনাগুলি দেখে তিনি অবাক হয়ে ভাবেন যে সেই খেলনাগুলি নিয়ে খেলাধুলা করে কীভাবে তারা বড়ো হয়েছে! তাঁর ভাবনার উপর তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাঁর চোখ দিয়ে অবিরাম অশ্রু ঝরছিল। কারণ তাঁর অশ্রু বেদনার উৎস থেকে প্রবাহিত হচ্ছিল।
তিনি আবার পড়ার ঘরে প্রবেশ করেন। দেয়াল ঘড়ি জানান দেয় রাত হয়ে আসছে। তিনি তাঁর চোখের জল মুছে দরজার হুক খোলেন। তাঁর মনে হল বাইরে থেকে কেউ তাঁকে ডাকছে। তিনি হাঁটতে হাঁটতে রাস্তা পর্যন্ত চলে গেলন। তিনি পানবাজার, কাছারিঘাটের দিকে শহর এবং ব্রহ্মপুত্রের দিকে, যতদূর তাঁর চোখ যায়, হাঁটতে থাকলেন। তাঁর জন্য পিছন ফিরে দেখার কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।