হৈমন্তিক ভ্রমণ – অর্ঘ্য দে
রোদ হাওয়ার সলমা জরি জড়িয়ে যাচ্ছে আমার গায়ে। খামারবাড়ির পাকা রাস্তার দু’পাশে সোনারঙের ধানক্ষেত। ফাঁকে ফাঁকে ন্যাড়া কাদাজমি, ছড়ানো ছেটানো সবুজ। আলপথে সাদা বকের সারি। তাদের নিরীহ চঞ্চল ডানায় ঝলমলিয়ে উঠছে সোনারোদ। দল বেঁধে ছড়িয়ে যাচ্ছে উজ্জ্বল নীলে। ধানক্ষেতের কিছু দূরে সমতল শুকনো ঘাসজমিতে গুটিকয়েক পুরুষ আর মহিলা। খামার গড়তে ব্যস্ত। আমন ধানের পার্বণে তারা মশগুল। আমার অখণ্ড অবসরে ঢুকে পড়েছে আস্ত একটা হেমন্তকাল। একটা খেজুর গাছের সামনে দেখি দুটো ছোটো মেয়ে আপনমনে খেলনাবাটি খেলছে। তাদের হাতময় ধুলো, কাগজের কাপে ভরছে। খেজুর পাতার ছায়ায় সংসার পেতেছে ওরা। ধুলোমাটির সংসার, হয়তো খেলা শেষে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবে। উড়তে উড়তে মিলিয়ে যাবে।
পরিত্যক্ত কোয়ার্টারের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকটা দেবদারু গাছ। কেউ যত্ন করে শখে হয়তো পুঁতেছিল। দেখলে মনে হয় যেন নওল শ্যামল কিশোর। গাছের গুঁড়িতে দড়ি দিয়ে ছাগল বাঁধা। উল্টোদিকের জমির আলে ঝোপে আরও কয়েকটা ছাগলছানা। মনের সুখে ঘাস চেবাচ্ছে। আর থেকে থেকে ব্যাস্ত হয়ে ম্যা…ম্যা…করে ডাকছে। দেবদারুর অল্প ছায়ায় একটা মাঝবয়স্ক লোক। উবু হয়ে বসে আছে। হাতে সরু কঞ্চি। দেখে বোঝা যায় প্রান্তিক মানুষ। দাঁড়িয়ে পড়লাম। লোকটার সাথে আলাপ করলাম। শুনলাম রোজ এখানে ছাগল চড়াতে আসে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এখানেই কেটে যায় দিনের একটা বড় সময়। সে খামারবাড়ির পাশে বিনয়পল্লীর বাসিন্দা। সেখানে সে বছর চল্লিশ আছে। কথার ফাঁকে লোকটা একটা বিড়ি ধরালো। আমি ক্ষেতের পাশে বসতে যাচ্ছিলাম। একজন লোক যাচ্ছিল, সে বসতে মানা করল। এখানে জোঁক থাকতে পারে বলে আমায় সাবধান করে দিল। তার পরনে মলিন ধুলোটে লুঙ্গি। খালি গা। দেখে বুঝলাম সেও মাঠফেরতা। বয়সে জোয়ান। হাতে সরু একটা কাস্তে। লোকটা আমার উল্টোদিকে বসে পড়ল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। অবাক চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে মাটির মানুষ দেখছিলাম। কোয়ার্টারের প্রসঙ্গে জানতে পারলাম। আগে এই সরকারি কোয়ার্টেরে কর্মচারিরা থাকত। দু’হাজার সালে নাকি কোয়ার্টারে ডাকাত পড়ে। তারপর থেকেই কোয়ার্টারগুলো একে একে ফাঁকা হতে থাকে। ভাঙা পাঁচিলের পাশে প্রাচীন আমগাছ। বিল্ডিংয়ের আশেপাশে এদিক ওদিক খেয়ালখুশি মতো বেড়ে উঠেছে জামরুল, অশথ গাছের মতো জানা-অজানা গাছগাছালি, আগাছা আর ঝোপঝাড়। তাদের নিবিড় ছায়ায় হাঁ করে চেয়ে আছে পাল্লাহীন দরজা জানালা। পরিত্যক্ত কোয়ার্টারটাকে সূর্য দীঘল বাড়ি মনে হয়। যেখানে কোনও নারীর ছায়ার বসত। মুক্তির সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় আলো-আঁধারিতে। সুযোগ পেলেই পায়রার মতো উড়ে যাবে অন্যপূর্বা সেই ছায়া। দিনের বেলাতেও গা-ছমছম করে। মাঝখান দিয়ে একটা ইটের রাস্তা কিছুটা গিয়েই হারিয়ে গেছে। সবুজের ভিতর দাঁড়িয়ে থাকা ভগ্নপ্রায় বিল্ডিংগুলো বিগত বসন্তের দলিল।
ছাগলছানাগুলো অধৈর্য হয়ে ফের ম্যা..ম্যা.. ডাকতে লাগল। একটা-দুটো ছাগলছানা ধানক্ষেতে ঢুকে পড়তেই মাঝবয়স্ক লোকটা গেল গেল রব তুলে কঞ্চি নিয়ে তেড়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বলতে লাগল, “এ কী আমার বাপের ধান? নাকি রে…” ছায়ায় ফিরে এসে জোয়ান লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আসলে ওরা ওদের মাকে খুঁজছে”। সন্তানের প্রতি মায়ের অথবা মায়ের প্রতি সন্তানের টান এতটুকু কমে না। প্রত্যেক জীবের ক্ষেত্রেই এই টান অকৃত্রিম এবং শাশ্বত।
জংলা ঘাসঝোপের ভিতর একচিলতে ঘাসজমি নজরে পড়ল। সেখানে একটা মাঝারি মাপের বাবলা গাছ। ধূসর শাখা মেলে আকাশের নীচে যেন নিঃসঙ্গ অবস্থায় দাঁড়িয়ে। হয়তো যেকোনও দিন লুপ্ত হয়ে যাবে। বড়বড় ঘাসের গা ঘেঁষে কাদামাটির উচু-নিচু, অগভীর গর্তের পথ পেরিয়ে সেই ঘাসজমিতে এলাম। ছোট্ট একটা মাঠ। মাঠের দু’প্রান্তে কোমরের উচ্চতায় দুটো লাল রঙের গোলপোস্ট। বুঝলাম এখানে ফুটবল খেলা হয়। আশেপাশের মাঠগুলোতে যখন খেলার চল উঠেই গেছে, তখন এই নিরালা এক খণ্ড মাঠে এখনও খেলা হয় ভেবে খুব ভালো লাগল। বাদামি-কালো কয়েকটা ছাগল। কয়েকটা বসে আছে। কয়েকটা আবার ইতিউতি ঘুরে ঘাস খাচ্ছে। একপাশে চালচুলোহীন এক কিশোর বসে থেমে থেমে আড়-বাঁশি বাজাচ্ছে। খণ্ড খণ্ড সে সুর। গায়ে ফ্যাকাশে একটা গেঞ্জিজামা। হাঁটু অব্দি লম্বা বারমুডা। মাথায় রংচটা জিন্সের টুপি। জায়গায় জায়গায় সেলাই খুলে গেছে। তার চোখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। দৃষ্টিতে অসীম এক শূন্যতা। ওর বাঁশির উদাসী সুর হয়তো এখনও গাছটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। শুনতে শুনতে আমার ভিতরে যেন জন্ম নিচ্ছিল তেপান্তরের মাঠ, তাল সুপারির সারি। তাদের পাতা ছুঁয়ে ভাসা ভাসা মেঘ। সবুজ সীমান্ত রেখা, রেখার ওপারে সেই নিশ্চিন্দিপুর। হাওয়ায় উড়ছিল অদ্ভুত সেই উপন্যাসের পাতাগুলো। একটা একটা করে হারিয়ে যাচ্ছিল পাণ্ডুলিপির পাতা। আমি তার নাম জানতে চাওয়ায় সে বাঁশি নামিয়ে রাখল। ওর মুখ থেকে কাটাকাটা কয়েকটা স্বর বেরিয়ে এল। কোনও বর্ণ বা শব্দ নয়। বুঝলাম ছেলেটি কথা বলতে পারে না। কিন্তু নাম বলার চেষ্টায় ওর মুখে ফুটে উঠল অপার আনন্দ।
এইসব মানুষগুলোরও তো ঘর আছে, পরিচয় আছে। ওদেরও নাম আছে আমাদের জানা নেই। অনেক নামের ভিড়ে হারিয়ে গেছে। ওদের কোনও বিশেষত্ব নেই বলে নাম জানা হয়ে ওঠে না। প্রান্তিক ওরা, প্রত্যন্ত সাধারণ। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ছাগল চরায়। হাতে কঞ্চির লাঠি অথবা খেজুর ডালের ছপটি নিয়ে দেখভাল করে। কচি ছাগলের দল এদিক ওদিক চড়ে ঘাস খায়। দিন কেটে যায় সবুজমাখা আলোতে ছায়াতে। ওদের সহজ-সরল কথার ভিতর লুকিয়ে থাকে ছিমছাম একটা হেমন্তকাল। রোদ মখমল দিন। শুনতে শুনতে আমার সমস্ত বৈভব ফিকে হয়ে যায়। বাতাস বইছে, বাতাসে যেন বাউলের গান। আমার বুকের ভিতরে ঘনিয়ে উঠছে মাটির গান। ভুলতে বসি আত্ম-পর। দূরে আলপথের ওপারে আধভাঙা পথের ওপর দিয়ে ধুলো উড়িয়ে একটা ফাঁকা ট্রাক চলে যাচ্ছে। উড়ন্ত ধুলোয় আবছা হয়ে যাচ্ছে দিগন্তরেখা, আমার ঘরে ফেরার রাস্তা।