ঘুণমাটি – বনমালী মাল (পর্ব ৮)

শেয়ার করুন

অষ্টম পর্ব

২১.

একদিন শহরের রাজপথে লাল নীল আলোগুলো জ্বলে উঠতেই হঠাৎ নিজেকে অবাক করে দিয়ে পঞ্চু মায়াময় হয়ে পড়ে। এমন সন্ধ্যাকে রামচকের ঝাউ আঁধারের সঙ্গে মেলানো যায় না। রামচকে সন্ধ্যা এলে জানান দেয় মিলিয়ে যাওয়া ঝাউ ছায়া, খোলা মাঠ কুঁরগির কালো জল আর রাজহাঁসের কালো পালক। এখানে সন্ধ্যা আসে প্রসাধনের হাত ধরে। যা কিছু কালো, তার সরলতা অজানা থেকে যায় পরের সকাল অব্দি। রঙিন আলো আর মানুষের আদিমতা বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যাকে ডেকে আনে।

—কী হচ্ছে?

কুশলের পর্দা ঘেরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসা খেয়াল করেনি পঞ্চু। চমকে ওঠে তার এই অতর্কিত প্রশ্নে। প্রথমে চোখ লুকোয় পঞ্চু। ফাঁকি লুকোনোর সুযোগ পায় না। মালিকের অধীনে কাজের হাত বন্ধ রেখে খেয়াল ঘুড়ি ওড়ানো নিজের কাছে খুব অন্যায় কাজ মনে হচ্ছে তার।

—না মানে…

—আমি একটু বেরোচ্ছি…

—ভেতরে গিয়ে একটু শুধু জল দিয়ে হাতদুটো আর বুকের কাছটায় পালিশ করে দাও।

হতভম্ব হয়ে কুশলের দিকে তাকিয়ে আছে পঞ্চু। রামচক ছেড়ে আসার পর থেকে তার মন পড়ে আছে সেখানেই। এই কদিনে মনমরা পঞ্চুর মন ভিজে যাওয়ার মতন কিছুই হয়নি। নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে সে ক্রমে যেন নেমে যাচ্ছিল এক অন্ধকার চক্ষুহীন কোটরে। এখানে এসে অব্দি কুশলের এমন সাজগোজ বোধহয় এই প্রথম দেখল সে। ঝকঝকে পাঞ্জাবির ওপর সুগন্ধির বয়ে যাওয়া নীল নীল রেখায় কুশলকে কুঁরগির রাজহাঁসের নরম নিষ্পাপ পালকের মতন দেখাচ্ছিল।

ইলেকট্রিকের হলুদ আলোর ঝারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুশল। এই ক’দিন এখানে আসা অব্দি পঞ্চু ভালো বেশে দেখেনি কুশলকে। পঞ্চু স্থির তাকিয়ে আছে তার হাত আর চোখের দিকে। মূর্তি গড়ে যে! একজন শিল্পীর মনে যে দ্বন্দ্ব আর তন্ময়তা থাকে—তা এড়িয়ে এমন সচেতন সাজ পঞ্চুর কাছে অমূলক কিংবা ফাঁকি মনে হয়। রামচক ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর মানুষের আচার সর্বস্বতা কিংবা জনে জনে মানুষ ছাড়িয়ে আরও আরও ভালো সুস্থ মানুষ হয়ে উঠতে দেখেছে পঞ্চু। এই দেখার রেশ প্রথমদিকে পঞ্চুর ভেতরকে নাড়িয়ে দিলেও, নিজেকে কোনো দর্শনের মুখোমুখি সে করতে পারেনি। একটা অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে খুঁজে একজন বিজ্ঞ মানুষ শেষে যেমন নির্লিপ্ত কিংবা আপনভোলা হয়ে পড়ে, পঞ্চু প্রথমেই সেই দশায় পৌঁছে গিয়েছিল। এখন সে এইসব দেখতে দেখতে অভ্যস্ত। ঢেউহীন। কিন্তু খুব পরিচিত কুশলের কাছ থেকে একটা প্রায় না মানতে পারা অনভ্যস্ত পোশাক আর সুবাস বেরিয়ে আসা! পঞ্চু যেকোনো একটা নিরীহ গাছ হয়ে যাচ্ছে…

এই আনন্দের মুহূর্তটাকেও সহজভাবে নিতে পারছে না পঞ্চু। কুশলের এমন চকিত ভাবনা আর অন্য সন্ধ্যার থেকে নিজেকে এমন মুক্ত বিহঙ্গ করে তোলার পেছনে পঞ্চু তার সমস্ত ভাবনাকে নিয়োজিত করেছে। নিজের এতদিনের স্বপ্ন আর সাধ মাটি পেতে চলেছে, তা নিয়ে তার কোনো স্বস্তি নেই। আজ সন্ধে এসেছে রহস্যের চাদরে ঢাকা মায়াময় শরীর নিয়ে। মায়ায় এখন পঞ্চু দিন দিন অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। আধো অন্ধকারে সাধের সেই সুতোটা নিয়ে কুশলের অস্থির ছায়ার ওপর পাক দিতে দিতে নিজের উল্লাসকে উস্কে দিচ্ছে পঞ্চু। বটগাছটার আড়ালে নিয়ন আলোর তামাশা লুকোচুরি খেলছে। ছায়া এসে পড়েছে কুশলের দালানে। পঞ্চু এখন স্থির পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুয়ারটাতে। নিয়নের ছায়া আর আলো মাড়িয়ে কুশল বেরিয়ে গেল।

২২.

বাজারে সন্ধ্যার চেঁচামেচি ঠিকরে এসে দেহ ফেলছে দালানে।

পঞ্চু এখন ছায়া আর মানুষের শব্দের কিলবিলে ছায়া থেকে ভয় পেতে শুরু করল।

দালান থেকে পর্দা ঘেরা একান্তে মূর্তির কাজে যেতে তার পা নড়ছে না। যে মূর্তি গড়তে তাকে সাধের রামচক ছাড়তে হয়েছে। বলাই, নন্দবাবা কিংবা কবিকে কষ্ট পেতে হয়েছে। মালিনী এখন নিশ্চিত এক সরা চাপা পোকা হয়ে ঘরের কোণে ঢিবি তুলছে একান্তে। সেই মূর্তির কাছে যাওয়ার আদেশ এসেছে তার!

মূর্তিকে সাজাতে হবে তাকে!

পঞ্চাননকে নিজেকে!

এক ঘুণ লাগা শূন্যতা তাকে পেয়ে বসছে।

বর্ষার অবিরাম মৃদু ফোঁটায় গাছেদের পাতা ফোটানোর মহোৎসব শুরু হয়। লক্ষ লক্ষ স্নায়ু কোমর বেঁধে তাদের বুঝিয়ে দিতে চায়। বোঝায়, তার কাছে জীবনের কী মানে? প্রতিবছর যৌবন ফিরে ফিরে আসার এই ছবি তাদের সকলকে শুঁড় দোলানো উন্মাদ করে তোলে। শিরায় শিরায় রক্তের বেগ এখন চরমে।

কেউ কেউ জানে। সন্দেহ করে। কুশলের রক্ষিতা আছে। পালা করে বছরের পর বছর সে বোধহয় তাকে নিত্য নতুন করে তুলছে। এই গোপন অভিসারের পেছনে পেছনে চোখ যায় বাজারের মুদি থেকে ময়রা সকলের। শিরশির করে ওঠে তাদের কোমরের নীচটা। একটা অজানা তারার আলো প্রতি সন্ধ্যায় বাজারের দক্ষিণ পূর্ব কোণে কিছু সময়ের জন্য দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে যায়। কুশল হাঁটছে বাজারের বুকে। এখন সোজা উত্তরে যাবে সে। পায়ে পালিশ করা জুতো। পুরো পা ঢাকা। গায়ের পাঞ্জাবির ওপর থেকে ছিটকে পড়ছে দোকান থেকে বেরিয়ে আসা রঙিন আলো। কুশল এখন কারো দিকে স্পষ্ট তাকাচ্ছে না। লজ্জা, অপরাধবোধ আর উত্তেজনা একসাথে তার মুখে একটা মিশ্রিত ভাব ফুটিয়ে তুলছে।

২৩.

কোঁকড়ানো চুলগুলো পাটি করে টানটান বিনুনি নেমে এসেছে কাঁধ পেরিয়ে সামনে। বাম স্তনের উচ্চতা বুঝিয়ে দিচ্ছে স্পষ্ট। শুধু এক টুকরো চুল চোখের ওপর দিয়ে সামনে নেমে এসে একচুল ছায়া ফেলেছে মুখে। সুজাতার মুখে মৃদু হাসি। সাদামাটা নীল রঙের একটা কাপড়। শত জায়গায় ভাঁজ হাঁ করে তাকিয়ে আছে। যাহোক করে মুড়ে রেখে দেওয়া এই কাপড়টা শুধু কুশলের জন্যই বের করে সে। মুখে সামান্য প্রসাধন। এক লহমায় দেখলে মন হয়, চুল আর শরীরের মতন শরীর ছাড়া সুজাতার গর্ব করার মতন কিছুই নেই।

একটা কালো মূর্তি দ্বিধার সঙ্গে অন্ধকার আঁকড়ে সুজাতার উঠোনের দিকে এগিয়ে আসছে। পৃথিবীতে এইমাত্র আলো আর অন্ধকারের মিলন ঘটল। এই সময়টা গোধূলির থেকেও উচ্চমার্গীয়। কয়েকগুচ্ছ মনোরম সুর সাথে নিয়ে উৎরাই পার হয়। ভোগপর্ব কিংবা ত্যাগপর্বের ভোর এই সন্ধ্যাবেলা। মানুষের মন এবং শরীর থিতিয়ে তলে চলে যায়নি। অথচ মনের কোথাও একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করে সন্ধ্যা নামলে। আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের নিজ নিজ সক্রিয় কোষগুলো মাথা নেড়ে নেড়ে জানান দিতে থাকে। সুজাতার উঠানে পা দেওয়ার আগে সুজাতা আর কুশল যেন পৃথিবীর সকল মানুষকে তন্ন তন্ন করে দেখে নিতে চাইছে চারপাশে। এই সন্ধানের মুহূর্ত অলীক। কাউকে মনে মনে না দেখার আশায় প্রতিটি কণাকে যেন হাতড়ে বেড়ানো।

সুজাতার স্বামী আছে। স্বামীর সুজাতা আছে। সন্ধ্যায় প্রদীপের আলো মুখে নিয়ে সে সবদিন স্বামীর মুখের দিকে তাকাতে পারে না। তার স্বামী থাকে দূরে। কাজের তাগিদে। সপ্তাহান্তে বাড়ি আসে। রাত কাটায় একটা। পরদিন সকালে শুধু বাসি মুখ ধোয়া অব্দি দিনের আলো মাখা সুজাতাকে দেখতে পায়। সে আলোও কত মায়াবী। জোনাকিরা একে অন্যকে ভালোবাসে খুব। তাদের ঐক্য আর বিশ্বাস বোধহয় ওই মৃদু আলোর জন্যই। টিমটিমে আলো নিয়ে তারা এখনও অবিশ্বাসী বা ঘাতক হয়ে যায়নি। অপুত্রক সুজাতা তাই মনের দুয়ারে শরীর ঘষার জন্য কুশল পেয়েছে।

কতগুলো রুপোলি মাছই হবে হয়তো, ঘাই দিয়ে আবার অতলে লুকিয়ে যায়। পুকুর পাড়ের এই একলা ঘরে ওদের শব্দ নিয়েই রাতে সুজাতা বিছানা পাতে। লক্ষ্মী প্যাঁচার পাশাপাশি কাল প্যাঁচা ডাক তুলে মুখর করে তোলে সন্ধ্যা আর রাত। মশারি টাঙায়। তারপর এলিয়ে পড়া। এই ক্লান্তির কোনো রং হয় না। শরীরে ঘাম নেই। এঁটো হয়ে পড়া বাসি গন্ধ নেই। অম্লান। সুজাতার ঘুমে নিজেদের সংসার গোছায় জোনাকি, রুপোলি মাছ আর প্যাঁচারা।

দুয়ার ভেঙে কুশল সেঁধিয়ে যায় সুজাতার ঘরে।

—কেউ দেখেনি…

—না মনে হয়। ব’লে সুজাতা নিজের ঘরে একান্ত এক অতিথি আসার মতন ক’রে শুরু করে আতিথেয়তার। কতবার কুশল এসেছে তার বাড়িতে। অথচ এই ভাণটুকু না করলে যেন নিজেকে কেমন লাল আলোর নীচে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকজনের একজন বলে মনে হয় সুজাতার। এই দাঁড়িয়ে থাকার ভাব তাকেও করতে হয়। দুয়ারে। অপেক্ষায়। কিন্তু ভালোবাসার…

—কাছে এসো।

সুজাতা এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আরও অনেক ভাবনার গভীরে যেতে পারত। কুশল, যে এতক্ষণ তারিয়ে তারিয়ে গোপন দেখা দেখছে, খুব প্রাসঙ্গিকভাবে কাজ মিটিয়ে এই ঘর ছাড়তে চায়।

সুজাতাকে কাছে টেনে বসায় কুশল। কারিগরের চোখ প্রায় সময় মিইয়ে থাকে। ভাবনা আর কারিগরি মন যে সন্ধান আর নির্মাণ চালিয়ে যায়, তাতে অগাধ আলো একসঙ্গে চোখের ভেতর প্রবেশ করতে দেওয়া যায় না। দিনের পর দিন মূর্তির পর মূর্তি গড়ে তোলার গর্ব নিয়ে কুশল এখন বসে আছে অধিপতি সেজে। এরপর অন্ধ আলোয় চোখ মুদে একের পর এক ছুঁয়ে যাওয়া। গলা বুক কোমর কুঁদে কুঁদে তৈরি করা কুশল এখন যেন সেগুলোর হিসেব বুঝে নিচ্ছে। এখন কুশল আপেলের লালচে সাদা মাংসের মতন নরম অথচ ঠাসা। মনের মধ্যে ঝড় বইছে দুজনেরই। একে অপরের মধ্যে মিশে কাদা হয়ে গিয়ে অন্য একটা রূপের অপেক্ষায়।

কারিগর কুশল নিবিড় সংসারী। বেশ আর কেশে কোনো বাহুল্য নেই। ঘরে স্ত্রী আছে। সুখী। পুত্র আছে। সোহাগী। মাটির লেপ দেওয়া দু-কামরা ঘর। স্বচ্ছল। বন্ধু-বান্ধব আছে। মদের নেশা করে না। বছর পাঁচেকের সংসার কুশলের। একদিন এক অবিবাহিত রাতে উড়তে উড়তে একটা বেগুনি ছাপ পায়রা মাঝ আকাশে চলে গেছে বেখেয়ালে, এমন একটি স্বপ্ন দেখেই মাঝ রাতে একলা বিছানায় উঠে বসে কুশল। কাউকে স্বপ্নের কথা না জানিয়ে নিজে থেকেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে। স্ত্রীকে সে ভালোবাসে। এখনও। কিন্তু মনের নিরেট পর্দায় একটা পোকা এসে কবে কুরে দিয়ে গেছে।

এই সম্পর্কে কোনো আর্থিক লেনদেন নেই। সবটাই শরীরী। কুশল কিংবা সুজাতার মনের দুরান্তের বিপরীত মেরুগুলোও যেন কোন্ এক অদৃশ্য টানে একে অপরকে টেনে রেখেছে।

সন্ধ্যা যখন রাতের দোরগোড়ায় নেমে আসে কালো কালো চুল ছেড়ে, কুশল সুজাতার বিছানা ছাড়ে। বিছানার চাদরের একটা জায়গা গোল হয়ে ভিজে যাওয়ার সাথে সাথে আলগা হয় কুশলের হাত। মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ভঙ্গি অন্ধকারেও সুজাতাকে অসহায় করে তোলে। কুশলের পিঠের ওপর এক অমানুষিক কান্না নিংড়ে নিংড়ে ছড়িয়ে পড়ে সুজাতার নখর আঙুল বেয়ে। নিজেকে পুরুষ প্রমাণ করতে যে পুরুষ পরীক্ষায় নেমেছিল, দৌড় শেষে সে পুরুষ হয়েই সুজাতার ওই হাত টেনে ছাড়িয়ে দেয়। চিটে থাকা দুটো শরীর আলাদা হতে গিয়ে শুধু অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। যে পড়ে থাকা অনুভূতি মৃত শিকারকে পেছন পেছন টেনে আনা একজন মানবিক শিকারির হয়ে থাকে। দৃপ্ত অথচ অসহায়। পরিস্থিতির নাম দিয়ে কোণে কোণে কত নির্বাক ছায়া এলিয়ে পড়ে থাকে। অন্ধকারে কুশল এখন নিজে একটা ছায়া হয়ে তলিয়ে যাচ্ছে। বিছানা ছেড়ে সোজা দুয়ারে এসে দাঁড়ায় সে। এই মুহূর্তে নিজেকে গোপন রাখার সমস্ত প্রক্রিয়া সে ভুলে গিয়েছে। এই মেঘলা আর্দ্র কালেও ঘেমে একাকার। কোনোমতে কাপড়টা গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে আসে সুজাতা। ততক্ষণে দুয়ার ছেড়েছে কুশল। তার পক্ষে এখন বোঝা সম্ভব নয়, আলো থেকে অন্ধকার নাকি অন্ধকার থেকে বেরিয়ে, পেরিয়ে যাচ্ছে সে।

কুশলের এই একলা রাতে রাস্তায় কেউ যেন নেই। যা যা পেরিয়ে যাচ্ছে সে, তা কেবল স্থির বস্তুর এক একটা ছায়া হতে পারে। জীবিত যারা, মানুষ যারা, তারা সবাই এখন ঘরের ভেতর। বাচ্চা আর সংসারের সবথেকে প্রিয়জন। নিজের ভেতর থেকে তাকে জানান দিয়েই আঁত বেরিয়ে আসছে। শরীরের সব জায়গায় ছিদ্র থাকলেও তাদের বেরোনো ফুরোবে না কোনোদিন। একলা সে, জীবন্মৃত, অর্ধদগ্ধ অবস্থায় চিতা ছেড়ে পালাচ্ছে। কুশলের হুঁশ ফিরে এল বাজারের রাস্তায় চলতে গিয়ে। ল্যাম্পপোস্টের রঙিন আলোর একটা কালো ছায়া তার পায়ে পায়ে জড়িয়ে এগিয়ে চলেছে।

আর কোনোদিন সুজাতার কাছে যাবে না কুশল, এমন এক প্রলেপ মাথা থেকে পা পর্যন্ত কেউ বুলিয়ে দিচ্ছে কুশলের সারা গায়ে।

অশ্বত্থ গাছের মাথা থেকে কতগুলো রাতচরা ধুলো ঝেড়ে কীসের খোঁজে উড়ে গেল। ওরা ঝেড়ে ফেলতে পারে কি সমস্ত ধুলো! পারে কি এক ঝাপটে একটা রাত্রি পার হতে! পিণ্ডের মতন কুকুরের পর কুকুর পড়ে আছে নিরলস রাস্তার ধারে। অসময় কিংবা অবৈধতা নিয়ে তাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।

রাস্তাটা ভেঙে একটা শিরা যেখানে কুশলের দোকানের দিকে গেছে, একটু থামে সে। মায়াময় চোখগুলো থেকে এখুনি যেন কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে আসবে। জল-জলে অস্বচ্ছ দৃষ্টিতে সামনের বেঁকে যাওয়া রাজপথের চেনা বস্তুগুলোকে অন্ধকার মেখে পড়ে থাকার কল্পনা করে। এই মুহূর্তে দোকানের ভেতর আলো জ্বলছে। পঞ্চু লেপ দিচ্ছে কিংবা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন দোকানে গেলে প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে পারবে না সে। সবার কাছে লুকিয়ে রাখতে চায়। সেই প্রথম মোলাকাত থেকেই পাতার পর পাতা ঢেকে একটা বিষফল ঢেকে রাখছে। এখন এই মুহূর্তে কুশলের কাছে সুজাতা শুধু একটা নামমাত্র। তার শরীর নেই। মন নেই। ভালোলাগা, ভালোবাসা নেই। নেশা কেটে যাওয়া ল্যাদল্যাদে একটা পোয়াতি আলো। আর কোনোদিন সুজাতার কাছে যাবে না, এই মর্মে ধীর ছন্দে মাথা নাড়ে কুশল। এলিয়ে থাকা কুকুরগুলো একটা ধীর নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

অস্তিত্বের চরম প্রকাশ অন্ধকারে। দৃষ্টি যখন বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন না হয়ে থিতিয়ে বসে, তখন। অন্ধকার ভেদ করতে পেরে রাতচরাদের উল্লাস কাঁপিয়ে তুলছে ঝাঁকড়া মাথার কালো কালো গাছগুলোকে। নিজেকে এখন সবথেকে পাপী মনে হয় কুশলের। একটা পাত্র থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া অমৃতের জন্য মন খারাপ করছে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা একজন নিরুপায় অসহায়। তার নিজের তৈরি পাত্র থেকে যেন নিজে ঝরে পড়ছে। এতখানি অসহায় যে, মেরামতের উপায় হারিয়ে ফেলেছে সে। মূর্তির পর মূর্তি গড়ে তোলা কুশল মনে মনে খুন করতে যাচ্ছে নিজেকে। এই অন্ধকারে। কাউকে সাক্ষী না রেখে। নির্বল অথচ উদ্ধত একটা ছুরি শূন্যে তুলে প্রথমে কাটাকুটি করে নিচ্ছে চামড়া। চেপে বসিয়ে দিচ্ছে গোপন বিষ হৃদয়ে। এখন সুজাতা নয়, বেশি করে মনে পড়ছে স্ত্রী আর পুত্রকে। শূন্যে ছুরিটা ছুঁড়ে ফেলে পা ঘষে ঘষে নেমে যায় রাজপথ থেকে। ঘরের শিরা-পথে।

ডানে একটা খাল। বামে একটা পুকুরে ঘন গাছ আর ঝোপের অন্ধকার ছায়া। অন্ধ অন্ধকার পথহারা হয়ে মুখের কাছে গুঁজে যাচ্ছে। পুকুরের দিকে এক নজর পড়তেই, কুশল বুঝতে পারে, একটা দীর্ঘ কালো নির্দয় জলোচ্ছ্বাস ধেয়ে আসছে তারই দিকে। জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে মিলে মিশে আছে কিছু অজানা প্যাঁচাদের আর্তি। দ্রুত পা চলে কুশলের।

দুয়ার খোলা রেখে কুশলের ঘর ঘুমিয়ে পড়েছে। অন্ধকারের ভিজে বীজ কেউ যেন ছড়িয়ে ছড়িয়ে স্তূপ করে গেছে। স্তূপের ভেতর সেঁধিয়ে গেল কুশল। এরপর একটার পর একটা বীজ জাগিয়ে তাদের কানে কানে মন্ত্র দেবে জাগরণের। একটা বীজ, যে সারাজীবন এই মন্ত্রের জন্যই অপেক্ষা করে ছিল, জেগে ওঠে। ডালপালা মিলিয়ে দেয় নিমেষে। একটু আলোর খোঁজে হাঁটতে শুরু করে জড়ানো পায়ে। পৃথিবীর সকল শস্যের পুরানো বীজ এভাবেই পচা গলা মাটিতেও এমন মন্ত্রের আশায় থাকে। আবার তার এই জীবনদাতা তাকে ঘুম পাড়িয়ে অন্য বীজে ফুঁ দিতে যাবে তাকে গোপনে রেখে, এই কষ্টের সত্যে বিশ্বাস করেও সে জাগে। সে ঘুমায়। সে আশা করে।

আগেও কুশল রাতচরাদের সাথে মিশে রাস্তা পেরিয়েছে। এত রাতেই। প্রতিবার তার বোধ জাগে সুজাতার সাথে মিলনের শেষে। সব বারেই বাড়ি ফিরে এমন মন্ত্র পড়ে ঘুমন্ত বীজের কানে। মায়া আর নিজেকে অভিশাপ দেওয়ার দৃষ্টি লেপে থাকে তার চোখে। কিন্তু এই বোধ টিকে থাকে না পাখিদের ঘরে ফেরা অব্দি। পরদিন গোধূলির রং মেখে পাখিরা গাছের সঙ্গে মিলিয়ে গেলেই আবার দানা বাঁধে মুখছবি আর মাছেদের ঘাই দেওয়ার স্থির চিত্র।

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *