ঘুণমাটি – বনমালী মাল (পর্ব ৫)
১৩.
দুপুরের একটা নিজস্ব গুমোট থাকে। ভ্যাপসা গরমে মুখের ভাষা পড়ার জো নেই। তবে মালিনীর মুখ বৃষ্টি ঝরিয়েও যে পরিষ্কার হয়নি তা বেশ স্পষ্ট। পঞ্চু মালিনী মুখোমুখি হয়, পাশাপাশি হয়। তবুও কোনো কথা যেন পথ খুঁজে পায় না। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত মালিনী নিজে নিজে কথা বলে ক্লান্ত। কোনো সৎ উত্তর না পেলেও উত্তর পাওয়ার ইচ্ছেটা মৃতপ্রায় হয়ে গেছে তার। ভাত বেড়ে দেয় পঞ্চুকে। নীরবে পঞ্চুর প্রয়োজনের জিনিসপত্রের জোগান দিতে থাকে। মালিনী আর মুখোমুখি হতে চায় না পঞ্চুর। পঞ্চু যাবেই। এই অনিবার্য সত্যিকে মালিনী যেমন মেনে নিতে পারছে না তেমনি বাধা দেওয়ার ইচ্ছেটুকুও আর যেন নেই।
–মানুষটার কাছে রামচক এতখানি মিথ্যে হয়ে গেল ভেতরে ভেতরে!
খাওয়া সেরে অন্যমনস্ক হাতে জল ঢালতে ঢালতে পঞ্চু মনে মনে স্মৃতি আর সখ আওড়ায়।
–আমি রামচকের। রামচক আমার কিন্তু…
মালিনীর চোখের অনুরোধ রাখেনি পঞ্চু। একটা চাপা ক্রোধ তাকে তলে তলে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। কারো কাছে সে এর জবাবদিহি করবে না – করতে পারবে না। পঞ্চু যখন বেরিয়ে যায় মালিনী তখন বাড়ি ছিল না। মালিনীকে না জানিয়েই পঞ্চু এই দুঃসাহসিক কাজটি করে ফেলে। এছাড়া জবাব যদি কেউ চায়ও, তার কাছে কেন! পঞ্চুর কাছে জবাব চাও। মালিনী তো সত্যিই এই চোরা সখের কিছুই জানে না। বা জানলেও তেমন জোয়ার দিয়ে ভাবেনি। কোনো কাজ ছাড়াই মালিনী ঘরের বাইরে বেরিয়ে যায় কিছু সময়ের জন্য। পঞ্চুর যেখানে সাধ, বেরিয়ে গেলে ফিরে আসবে।
নির্জন চাক। একপাশে হেলান দিয়ে পড়ে আছে। শুকনো মাটি ঝুরঝুর পড়ছে। ভেজা হাত ভেজা মাটি গায়ে মাখার সাধে সে কি আতুর! সামনের একটা হাত খানেক জানালা দিয়ে মেঘলা রোদ এসে পড়েছে। সেই রোদ আড়াল করে দাঁড়ায় পঞ্চু। পঞ্চুর দু’ হাতের অস্পষ্ট ছায়া পড়েছে চাকের উপর। কিন্তু সেই ছায়ায় আঙুলগুলো স্পষ্ট নয়। সকল অতীত এবং গুরুজনদের প্রণাম করার অভ্যাস নিয়ে সে হাত জোড় করে চাকের দিকে। ছলছল চোখে শেষ বিদায় জানাচ্ছে। আজ থেকে সে মাটির জিনিস তৈরি করবে না। কুঁরগি পেরিয়ে মূর্তি গড়ার কাজ নেবে। মনে মনে এই কথাগুলো আওড়ায় পঞ্চু। চাকের উপর থেকে হাত জোড়ের চিহ্ন, আঙুল আর পঞ্চুর বিদায়ী শব্দ আড়াল করে তুলেছে মেঘলা রোদের আবছায়া।
কুঁরগি পেরিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো সেতু নেই। সেতুর প্রয়োজন পড়ে না কারো। পঞ্চু বিদায়ের মুহূর্তে মালিনীকে দেখতে পায়নি। তার সঙ্গে নিজের সাক্ষাতের একটা দূর ছেদ টানা দুজনের কাছেই বেদনা বয়ে আনত। মালিনী যে উদ্দেশ্য নিয়ে নিজেকে আড়াল করেছে, পঞ্চু সেই ভাবনার কাছেই যেতে পারেনি। তারা দুজন আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য নিয়ে বিচ্ছেদের আগে বিচ্ছেদ টেনে আনল। এক অপার সম্ভাবনা আর অজানা আনন্দ পঞ্চুকে ঘর থেকে কুঁরগি অব্দি প্রায় দ্রুত নিয়ে যায়। এখন শুধু কুঁরগি পেরোনো বাকি। রাজহাঁসগুলো কোথাও দেখতে পাচ্ছে না পঞ্চু। স্থির নির্মল জল। স্রোত যেন কবে মরে গেছে এখানে। কোনোদিন এই নদী জীবন নিয়ে ছন্দে ছন্দে চলাফেরা করত বলেও বিন্দুমাত্র বোঝা যায় না। এখন সে স্থবির। যে ঝোলা নিয়ে পঞ্চু ঘর থেকে বেরিয়েছিল, গামছা বের করে পরে নেয়। পেছন ফিরে একবার তাকায় সে।
কুঁরগির বুকে অক্লান্ত অথচ ধীর ভঙ্গিতে সাঁতার দিতে শুরু করে পঞ্চু। একটু সাঁতার দেওয়ার পর সে দেখতে পায়, ডানদিকে কুঁরগি যেখানে সামান্য বাঁক নিয়েছে, সেই বাঁকের কোলে অগুনতি রাজহাঁস তারই দিকে চেয়ে নীরব হয়ে আছে। তারা ভুলে গেছে তাদের রূপের গর্ব। তারা জানে না, কীভাবে এতদিন রামচক এত ছলনা লুকিয়ে রাখতে পেরেছে! তাদের চোখ শুকনো। কতকাল জল না লেগে সে চোখ যেন পাথর হয়ে গেছে। কোমল পালকগুলো যা মানুষের কাছে তাদের অহংকার ব্যক্ত করত, বিবর্ণ আর ফ্যাকাশে হয়ে ঝরে পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাশি রাশি শ্যাওলা তাদের সামনে উঁচু ভিড় করে আছে। সে শ্যাওলা ক্রমে অভেদ্য পাহাড়ের আকার নেবে বলে মনে হয়। সে পাহাড় চিরে আত্মাও জয়ী হতে পারে না কোনোদিন।
পঞ্চুর কুঁরগির বুকে নামার সময় উন্মত্ত মাথা দোলাতে শুরু করে ঘোড়া মাঠের ঝাউগাছগুলো। হঠাৎ কোথা থেকে এক দমকা বাতাস যেন উপড়ে ফেলতে চায় কত বছরের ধ্যানমগ্ন মূর্তিকে। বলাই নন্দবাবা তাদের নিজের নিজের বাড়িতে ভাতঘুম নেওয়ার সময় একটা সাজানো মৌমাছির বর্ণিল ডানা খসে পড়তে দেখছে। নির্লিপ্ত সেই মৌমাছির যন্ত্রণা কিংবা অতীত ঝরানোর বেদনা হলেও সে প্রকাশ করছে না। একটু স্থির বসে আবার সে উড়ে যাওয়ার জন্য শুঁড় ফোলাচ্ছে। কবি একটি নতুন ছন্দ মেলাতে গিয়ে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। একটা পর একটা শব্দ অযাচিতভাবেই আসছে কিন্তু চরণে বসার আগেই তারা ভেঙে পড়ছে শরীরে-মনে।
পঞ্চুর ঝোলায় দিন চালানোর জামা লুঙ্গি আর চাক থেকে মাটি কেটে নেওয়ার সুতো। এই সুতো সে কোনোদিন কাছ ছাড়া করবে না। লাল রঙের নাইলন সুতো কাদা খেয়ে খেয়ে রঙ পাল্টেছে।
১৪.
কাঁচা পিচের রাস্তা। বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেছে। কাঁচা করে গেছে। আলো ঝলমলে রাস্তা। জোনাকি তাড়িয়ে এখানে জোনাকির মত মৃদু আলো দিয়ে ঘর সাজানো। চোখ ঝলসে যাওয়া আলোর পাশাপাশি চোখে মায়া সাজানো রঙিন মৃদু আলো। পঞ্চু তার ঝোলাটা বাম কাঁধ থেকে পিঠে ফেলে রেখেছে। সে এই প্রথম রামচকের বাইরের পৃথিবী দেখছে। সবকিছু যেন রাতারাতি বদলে যাওয়া আরব্য উপন্যাস। কোনোদিন সে ভাবেনি, রামচক ছেড়ে বেরোবে। এখানে আকাশ অন্ধকার নয়। ইচ্ছেমতো আলো দিয়ে আকাশ সাজানো যায়। বিকেলের পর মৃদু গতিতে সন্ধ্যে নামে না। বিকেলের ওই মৃদু মৃত দুর্বল আলোটিকে ধরে রাখার ব্যস্ততা এদের।
সারি সারি কংক্রিটের ঘর, সুদৃশ্য, সাজানো গোছানো। কাচ দিয়ে এরা স্বচ্ছ করে তুলতে চায় সবকিছু। রামচক আর মনে পড়ছে না তেমনভাবে পঞ্চুর। এইতো একবেলাও হয়নি এখনও! তবু যেন নতুন চকচকে একটা শরীর নিজেকে আলাদা করে নিতে চায় কিংবা আলাদা হয়ে যাচ্ছে নিজে নিজেই। পঞ্চুর চেতনায় বা অচেতনে। রামচক অস্পষ্ট হওয়ার পেছনে এই ঝাঁ চকচকে বাজারের, এই মনোহারী দুনিয়ার একটা বাতাস আছে। যা বালিয়াড়ির বালিকে অন্য জায়গার প্রতিবেশী কিংবা একনিষ্ঠ প্রতিবেশী করে তোলে। রামচক পঞ্চুর মনে আজীবন কোনো ছাপ ফেলেনি, এমন ভেবে নেওয়া ভুল। হতে পারে, রামচক থেকে এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়ে পড়া পঞ্চু এক অনাগত ঘোরের মধ্যে আছে। জীবনের সবথেকে পরম লক্ষ্যের সামনে সে এখন পদ্মাসনে বসেছে। হাতখানেক দূর থেকে সেই পরম তাকে হাতছানি দিতে প্রস্তুত। এই ভাবনা পঞ্চুকে দারুণভাবে জিইয়ে রেখেছে। রামচকের পঞ্চু করেই বাঁচিয়ে রেখেছে। ভাবাচ্ছেও।
এখানে এখন ভোর সন্ধ্যায় কাচ সাজানো দোকান যেন কখনোই মরবে না, মরার ভয় নেই, এমনভাবে নিজেদের মেলে ধরেছে। ল্যাম্পপোস্টের নিশানা ধরে পঞ্চু বুঝতে পারে, এই বাজার কিছু দূরে গিয়ে ডানদিকে মোড় নিয়েছে। রাস্তার দুই ধারে আলো ঝলমলে দোকান। আতরের খনি। প্রথম দিকে পঞ্চুর ঘোর লাগে আতরের তীব্র গন্ধে। তারপর অবাক বনে যায়,
এত সুগন্ধির দরকার হয়, মানুষের বেঁচে থাকতে!
তবে নিজেকে এভাবে অবাক করে বাইরের জগতের অনেক কিছুই সে হারিয়ে ফেলছে। চোখের সামনে দিয়ে কত মানুষ বিচিত্র ভঙ্গিতে হেঁটে দৌড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এগুলো সে বুঝতে চায়। এখানে হাতের কাজ দেখাতে এসেছে সে। নিজের সুপ্ত প্রতিভা ছড়িয়ে দিতে সে কত মায়া কত মুখ ফেলে এসেছে রামচকে।
দোকানে দোকানে আলোর রোশনাই। কাচের পাত্রে আতর। সারা বাজার ম ম করছে গন্ধে। পঞ্চু হারিয়ে যাচ্ছে। রামচক কত ঘন হয়ে বসেছিল তার মধ্যে। এখন সে টের পাচ্ছে, হালকা একটা আস্তরণ যেন ছেড়ে পড়ছে টুকরো টুকরো অতীত নিয়ে। সন্ধ্যার ভিড় শুধু মানুষে মানুষে। এত মানুষ একসাথে কোনোদিন দেখেনি সে। সাদা পাঞ্জাবি আর ফতুয়া পরা লোকগুলো আনন্দে বিষাদে একে অপরকে অভিবাদন জানাচ্ছে। দোকানে গিয়ে কিনে নিচ্ছে আতরের শিশি। কেনার আগে গায়ে ছড়িয়ে নিচ্ছে কিংবা তুলোয় ভিজিয়ে কানে গুঁজে রাখছে।
আতর বাজার দেখা তো দূরের কথা কোনোদিন পঞ্চু এ নাম শোনেনি পর্যন্ত। তাকে শুধু অবাক করেছে, লোকগুলোর পোশাক। তারা সবাই একই রকম পোশাক পরে যেন যন্ত্রের মতন কথা বলছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ তল্লাটে কি তবে অন্য পোশাকের লোকের কোনো আনাগোনা নেই। কুঁরগি পেরিয়ে সে প্রথম এখানেই এসে পৌঁছেছে। রাস্তার ক্লান্তি, মনে অসুখ আর সুখের দ্বন্দ্ব। তার ওপর আতরের তীব্র বাতাস তাকে যেন ভেতরে ভেতরে দুর্বল করে দিচ্ছে। রামচক থেকে বেরিয়ে আসার কয়েকদিন আগে থেকে তার মনের যে জোর তাকে নিজেকেই অবাক করে দিয়েছিল, সেই জোর এখন তাকে ধোঁকা দিচ্ছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না পঞ্চু। মাথার তালু চেপে বসে পড়ে দুই দোকানের মাঝের গলির আধো অন্ধকারে।
কতক্ষণ এভাবে বসেছিল, পঞ্চু জানে না। একটা হাত এসে তাকে জাগিয়ে তোলে। চোখ তুলে তাকে দেখে সে। সেই একই ফতুয়া পাঞ্জাবি পরা এক মাঝবয়েসী লোক। আতর বাজারে এসে এই প্রথম পঞ্চু কোনো মানুষের মুখোমুখি হয়েছে। রামচকের বাইরে এই প্রথম। একটু ভয় পাচ্ছে বইকি! দুর্বল ক্লান্ত চোখে মুখে সেই ভয় চাপা বরফ হয়ে আছে। অনেকক্ষণ পর চোখ খোলার জন্য আবার সেই চোখ ধাঁধানো আলো তাকে হকচকিয়ে দেয়। এই মুহূর্ত থেকে আস্তে আস্তে তার মন থেকে রামচক উধাও হয়ে যাচ্ছে। সামনে একটা পা ফেলতে হলে তাকে এই বাজার এই দুনিয়া বুঝে নিতে হবে মন দিয়ে। লোকটা এমন ভাবে দাঁড়িয়েছে যেন সব আলো সে একা শুষে নিয়ে পঞ্চুকে একটা গভীর ছায়া উপহার দিয়েছে।
ভিড় একটু ফিকে হয়েছে। শীর্ণ বাজারের মানুষজন টলমল পায়ে এদিক সেদিক হচ্ছে। আগন্তুক লোকটা পঞ্চুর দিকে ঝুঁকে প্রথমে একটা দ্বিধা কাটাচ্ছে বলে মনে হল। তারপর
–তুমি কে! এখানে কী করছ!
এত বিস্ময়মাখা প্রশ্নে কোনো মতলব লুকিয়ে থাকতে পারে না। এই প্রশ্নে কোনো অমানুষ লুকিয়ে নেই। কোনো দ্বেষ এই স্বরকে স্পর্শ করেনি। পঞ্চু একটু সচেতন হয়েই রামচক থেকে বেরিয়েছিল। বাইরের দুনিয়া তার কাছে এক অজানা রহস্যের মতন। নির্বিষ আর বিষাক্ত সাপের প্রভেদ করতে শিখতে হয়। আঙুল কেমন ভাবে আদর করলে একই চাক থেকে হাঁড়ি আবার সরা বের হয়, সেই ভাবনাটুকু মাথায় নিয়েই তাকে পা ফেলতে হয়েছে কুঁরগির এপারে। কিন্তু এরকম প্রশ্নের কাছে সে যেন শেষ দেখা মালিনীর মতন নিশ্চুপ হয়ে গেছে।
–রামচক থেকে আসছে!
–নাম পঞ্চানন পাল!
–দেবতার মূর্তি গড়তে চায় সে!
–কেমন ভাবে নেবে লোকটা!
মুখে একটা দৈবী মুচকি হাসি হেসে লোকটা তখনও পঞ্চুর জবাবের আশায় নত হয়ে আছে। তার মুখ ভর্তি কাঁচা পাকা দাড়ি নরম আতর-বাতাসে দুলছে।
–আমি পঞ্চানন পাল। বাড়ি রামচক।
পলকের মধ্যে আগন্তুকের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঘৃণার স্রোত খেলে যায়। আবার ভয়েও তার মুখ বিবর্ণ হয়ে ওঠে। রাজপথের যে জোরালো আলো এতক্ষণ সে গর্বে শুষে নিচ্ছিল, এক পা টেনে গলির অন্ধকারকে জড়িয়ে ধরে। এখন দুজন দুজনকে অনুভব করতে পারে কেবল। আগন্তুকের বুকে যে প্রপাতের জোরালো শব্দ তৈরি হচ্ছে, তা নিশ্চিত টের পাচ্ছে পঞ্চু। দুঃস্বপ্নের একান্তে বৃথা সহায়হীন চিৎকারের মতন লোকটা অনেককিছু বলতে চায়, পারে না। বর্ষার তেমন গুমোট নেই। লোকটার কপাল আর হাতের ভাঁজে যে ঘাম জমেছে, অন্ধকার সয়ে যাওয়া চোখে বুঝতে পারে পঞ্চু। কী সান্তনা দেবে পঞ্চু! এইভাবে দুটো দোকানের আলো বন্ধ হয়।
–বাবা, রামচক কোথায় আমি জানিনা কিন্তু তুমি এখন আলো মেখো না।
একটানে এই কথাগুলি বলে একসাথে অনেকগুলো পূর্নচ্ছেদে টানা একটা বিরাম নিতে চাইল আগন্তুক। পঞ্চু এসব শুনে দেখে শুধু অবাক বনে যেতে পারে। ভ্রু কুঁচকে তাকাতে পারে। তার বেশি সে কিছুই বলতে পারে না। করতে পারে না।
সন্ধ্যা ধীরে ধীরে রাত্রির গর্ভে তলিয়ে গেলে তারা দুজনেই স্বাভাবিক হয়।
–এটা আতর বাজার বাবা। এটা আমাদের বাজার। মুসলমানদের। এখানে আমরা ছাড়া কেউ বড় একটা আসে না। এলে যে খুব ক্ষতি হবে, তা নয়, কিন্তু তিলের মতন একটা কথা নিয়ে এখুনি ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে যেতে পারে। তুমি তো হিন্দু কিনা! তাই বললাম।
পঞ্চু এসব কথা আগেও শুনেছে। হিন্দু মুসলমান জাত ধর্ম বিবাদ। বলাই নন্দবাবা কথা প্রসঙ্গে সন্ধ্যের ঘোড়া মাঠে এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা করে। কিন্তু পঞ্চু কখনো নিজে এই অভিজ্ঞতার সামনে পড়েনি। রামচকে অনেকে জানেই না এসব শব্দ। এসব বিবাদের কথা। পঞ্চুর পক্ষেও এসব জানা সম্ভব ছিল না, যদি সে ঘোড়া মাঠে দু’ একবার কান পেতে তাদের আলোচনা না শুনত।
–রামচক কোথায়, তা আমি জানি না। তবে তোমার নাম শুনেই বুঝেছি তুমি হিন্দু! আর এটা…
এই প্রথম পঞ্চুর গলাটা পেঁচিয়ে ধরল কেউ, যেমনভাবে সে আঙুলগুলো পেঁচিয়ে ধরে হাঁড়ি কলসির নরম গলায়।
–পঞ্চু ছাড়াও আমি আরো একজন! আমি হিন্দু! ও মুসলমান! এখানে এই আলো অন্ধকারে একটা ভুল ছায়া আমাদের মধ্যে বিবাদ লাগিয়ে দিতে পারে!
একটা বিড়াল অন্ধকার থেকে আলোর নির্জন রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে চোখ চারিয়ে পেটের কাছের নরম লোমে মুখ ঘষে। চোখ দুটো ক্ষীণ। ম্যাও ডাকে এখন কোনো ইচ্ছে নেই তার। একটা মায়াহাত বুলিয়ে আগন্তুক পঞ্চুকে এগিয়ে দেয় আলোর দিকে। রাস্তায় নামার আগে পঞ্চু জেনেছে এই দুনিয়ার আংশিক রূপ। মানুষের জাত হয়! ধর্ম হয়! মুখোমুখি হতে গেলে সমান ধর্মের হতে হয়! আগন্তুকের কাছ থেকে সে জেনেছে রামচক নামে কোনো জায়গার নাম সে আগে কখনো শোনেনি। পৃথিবীতে এমন কত না দেশ কত সমাজ আছে, সে সম্পর্কে সবার জানা সম্ভব নয়।
আগন্তুক নির্ঘাত ভালো মনের মানুষ। তা নাহলে এখুনি কোনো একটা ব্যাঘাত ঘটে যেতেই পারতো পঞ্চুর সঙ্গে। পঞ্চুর সারা শরীর থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। যতটা সম্ভব অন্ধকার আঁকড়ে চলার চেষ্টা করছে সে। রাত কত হয়েছে সে জানে না। নিজের এতদিনের অজ্ঞাত নতুন পরিচয় জানার পর সে সুখী না দুঃখী এই ভাবনা তাকে স্থিরতা দিতে পারছে না। শুধু মনের বিরুদ্ধে পা ফেলছে সে। নির্জন রাস্তা। একটা দুটো কুকুর নিজেদের মত বিনিময় থামিয়ে পঞ্চুকে অবাক চোখে দেখে। ডাক ছাড়ে হিংস্র সুরে। পঞ্চুর সেসবে কোনো হেলদোল নেই। মাথা ভার হয়ে আছে। তার এতদিনের স্বপ্নের চারপাশে যেন একদল শিকারি তাক করে আছে ধনুকের মুখ।
আতর বাজার পেরিয়ে পাকা রাস্তার একটা খালি কোল শুয়ে আছে গাছপালা মেলে। রাত এখানে রূপসী কন্যার মতন। মায়া দিয়ে ভোলায়। আলো অন্ধকারের এই লুকোচুরি পঞ্চুকে সন্ধ্যার দিকে অবাক করলেও, ক্রমে সে ধাতস্থ হচ্ছে। পিঠে পড়ে থাকা ঝোলার ভার অসহ্য মনে হয়। পিঠের একটা জায়গায় ঘষা খেতে খেতে জ্বালা বোধ হচ্ছে। পিঠ পাল্টায় পঞ্চু। অবসন্ন পা-গুলো আর টানতে পরে না। থামে। বসে পড়ে। আতর বাজারের ভয় আর নেই তার।