গল্পগুচ্ছ-র ‘আমি’ : কিছু ভাবনা – রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
বিশ্বভারতী গ্রন্থন-বিভাগ প্রকাশিত চার খণ্ড (অখণ্ড সংস্করণও পাওয়া যায়) গল্পগুচ্ছ-য় আছে পঁচানব্বইটি গল্প। তার প্রথম দুটি (‘ভিখারিনী’ আর ‘করুণা’) নেহাতই কিশোর বয়সের রচনা। ‘কর্মফল’ পুরোটাই আর ‘শেষের রাত্রি’-র বেশির ভাগই সংলাপে লেখা, বিবরণ প্রায় নেই। কয়েক বছর বাদে দুটি গল্পরই নাট্যরূপ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ : যথাক্রমে ‘শোধবোধ’ আর ‘গৃহপ্রবেশ’। ‘মুকুট’ সম্পর্কে বিশ্বভারতী সংস্করণের সম্পাদকীয় টীকায় লেখা হয়েছে : “ইহা ছোটো উপন্যাস বলিয়াও বিবেচিত হইতে পারে।” ‘হইতে পারে’ কেন, অবশ্যই বিবেচিত হইবে।
‘দালিয়া’ আর ‘নষ্টনীড়’-কেও ছোটোগল্প বলা যায় না, বড় গল্প বা নভেলা বলাই সঙ্গত। ‘শেষকথা’ আসলে ‘ছোটোগল্প’র নতুন করে লেখা রূপ। প্রথম প্রকাশের দুমাস পরেই রবীন্দ্রনাথ গল্পটি ঢেলে সাজান। দুঃখর কথা, গল্পগুচ্ছ-য় দুটি গল্পরই রচনাকাল দেওয়া হয়েছে ৪. ১০ [১৯৩৯]। আর শেষ চারটি গল্প, ‘বদনাম’, ‘প্রগতি সংহার’, ‘শেষ পুরস্কার’ ও ‘মুসলমানীর গল্প’-কে খসড়া বলেই ধরা উচিত, যদিও রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতেই প্রথম দুটি ছাপা হয়েছিল।
এই হিসেবে বাদ-সাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প তাহলে তিরাশিটি।
আশি বছর বেঁচেও রবীন্দ্রনাথ ছোটোগল্প লিখেছেন মাত্র তিরাশিটি—এতে একটু আশ্চর্য লাগতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটি অপ্রত্যাশিত নয়। কবিতা ও গান তিনি লিখতেন প্রায় অবিরত, নিজেরই তাগিদে। কিন্তু গল্প লেখায় মাঝে মাঝে কমবেশি লম্বা ছেদ পড়েছে। যেমন, পৌষ ১৩২৪-এর পরে আট বছরের ছেদ পড়ল। ছ বছরের ছেদ পড়েছে আরও তিনবার। দেড়, আড়াই, তিন বা চার বছরের ছেদ পড়েছে আরও তিনবার। এক এক পর্বে পর পর পাঁচ থেকে বারোটি গল্প বেরিয়েছে। কোনো কোনো বছরে আবার মাত্র একটি বা দুটি, বড়জোর তিনটি। কোন্ পত্রিকা গল্প চাইছে—এটাই বোধহয় এমন ছেদ-অছেদের প্রধান কারণ। অর্থাৎ বাইরের তাগিদ ছাড়া শুধুই ভেতরের তাগিদে খুব বেশি গল্প লেখা হয় নি।
তবু দেখবার এই যে, এমন কোনো পর্ব নেই যখন রবীন্দ্রনাথ ‘আমি’র আঙ্গিকে গল্প লেখেন নি। বহু লোকের প্রিয়তম গল্পগুলি এই আঙ্গিকেই লেখা; ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘দুরাশা’, ‘মণিহারা’, ‘বোষ্টমী’, ‘অপরিচিতা’, ‘ছোটোগল্প’, ‘শেষকথা’ এমন অনেক গল্পই এই দলে পড়ে। যে কটি গল্পকে কেউ কেউ অতিপ্রাকৃত বলেন সেগুলির অনেক কটিই উত্তম পুরুষের বয়ানে (অবশ্য ‘মাস্টারমশাই’ ছাড়া কোনোটিকে সত্যিকারের অতিপ্রাকৃত বলা যায় না, কারণ গল্পর মধ্যেই সেগুলিকে নেহাতই গল্প, অর্থাৎ ‘সত্যি নয়’, এমন স্পষ্ট ইঙ্গিত দেওয়া থাকে।)
দেখবার বিষয় হলো : তিরাশিটি গল্পর মধ্যে তিরিশটি গল্পই ‘আমি’-র আঙ্গিকে লেখা। অর্থাৎ মোট গল্পের তিন ভাগের এক ভাগেরও বেশি উত্তমপুরুষ-এর আঙ্গিকে, বাকি দুভাগ প্রথমপুরুষ-এর আঙ্গিকে। ‘আমি’-র আঙ্গিকে লেখা গল্পগুলি নিয়েই এই আলোচনা।
কথাসাহিত্য ও কবিতার ‘আমি’ নানা রকমের হতে পারে। পুরুষ লেখকও স্ত্রীর বয়ানে ‘আমি’ হয়ে উঠতে পারেন (যেমন, রবীন্দ্রনাথের ‘দৃষ্টিদান’)। তার উল্টোটাও হতে বাধা নেই : লেখিকাও পুরুষের বয়ানে লিখতে পারেন। যদি একই গল্পের ভেতরে আর একটি গল্প থাকে, অর্থাৎ গল্পর-ভেতরে-গল্পেও দুরকমের ‘আমি’ পাওয়া যায় : কেন্দ্রিক ‘আমি’ আর প্রান্তিক ‘আমি’। প্রথমজন মূল গল্পটির লেখক ও ভেতরের গল্পটির বক্তা—এমন গল্প রবীন্দ্রনাথ কিন্তু লেখেন নি। জোর করে হয়তো ‘একটি ক্ষুদ্র পুরাতন গল্প’র কথা বলা যায়। কিন্তু এ গল্প পাঠকের উদ্দেশে লেখা, কোনো শ্রোতা গল্পর মধ্যে হাজির নেই। আর প্রান্তিক ‘আমি’ মানে মূল গল্পটির লেখক কিন্তু ভেতরের গল্পটির শ্রোতা (যেমন, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘মণিহারা’)। এখানে ভেতরের গল্পটির কথক মূল গল্পর অন্য কোনো চরিত্র, লেখক নিজে নন।
কবিতা ও কথাসাহিত্যের ‘আমি’ নিয়ে অনেক পাঠকই ধন্দে পড়েন। লেখক যে ‘আমি’-র মুখোশ পরে নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে অন্য, কাল্পনিক অভিজ্ঞতার কথা লিখছেন—এই সহজ কথাটি অনেকে মানতে পারেন না। তাঁদের কাছে মুখোশ বলে কিছু নেই, সব ‘আমি’-ই লেখকের নিজের মুখ। এতে যে লেখককে কত বিভিন্ন বয়সের পেশার সঙ্গে যুক্ত হতে হচ্ছে—রবীন্দ্রনাথই কখনও ডাক্তার (‘দুর্বুদ্ধি’, ‘নিশীথে’) কখনও স্কুলশিক্ষক (‘একরাত্রি’), কখনও ঔপন্যাসিক (‘কাবুলিওয়ালা’), কখনও মুন্সেফ (‘দর্পহরণ’), কখনও ব্যাঙ্ক-এর অংশীদার (‘চোরাই ধন’), কখনও পাশ-না-করা পণ্ডিত (‘পয়লা নম্বর’), কখনও বা রাজনৈতিক নেতা (‘নামঞ্জুর গল্প’), কখনও ব্যর্থ কারবারি (‘ভাইফোঁটা’)–এ সমস্যা তাঁদের মনে জাগে না। নানা রবীন্দ্রনাথের মালা-ই বটে! ঘাট আর রাজপথ-কেও যে রবীন্দ্রনাথ বলে কেউ ধরেন না—এই যথেষ্ট।
এর পেছনে কাজ করে আর-একটি ধারণা। সেটি এই প্রতিটি গল্পই বাস্তব জীবনে ঘটা কোনো ঘটনার প্রতিচ্ছবি, কোনো গল্পই বানানো হয় না; যা কোথাও না কোথাও, কখনও না কখনও ঘটেছে তারই বিবরণ দেওয়া যায়। বড়জোর, নামধাম পাল্টে দেওয়া থাকে।
সাহিত্যকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা হচ্ছে না—এমন ধারণার এটি একটি ভালো দিক। কিন্তু সাহিত্য আর বাস্তবকে এক করে ফেলা—এও তো ঠিক নয়। যা ঘটেছে তা ছাড়াও যা ‘ঘটতে পারত’ বা ‘ঘটলে বেশ হতো’— সাহিত্যে এমন ঈপ্সিত চিন্তাও প্রকাশ পায়। তাই সাহিত্য মানে বাস্তবের হুবহু প্রতিচ্ছবি—এমন ভাবনা অচল।
‘আমি’-র আঙ্গিকে লেখার একটা সুবিধে হলো : গল্পটি আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়। লেখক স্বয়ং যেন ঘটনার সাক্ষী, বা অন্য লোকের জীবনের ঘটনা তার মুখ থেকে নিজে শুনেছেন—এতে গল্পর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে। বিশেষ করে যে সব গল্প প্রথমপুরুষ বা ‘সে/তিনি’-র আঙ্গিকে লিখলে বিশ্বাসের অযোগ্য বা সংশয়যোগ্য মনে হতো, উত্তমপুরুষ অর্থাৎ ‘আমি’-র আঙ্গিকে লিখলে সেই গল্পই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। বিশেষ করে অলৌকিক ঘটনা নিয়ে গল্প লিখলে ‘আমি’ প্রায় অনিবার্য।
কবিতা ও কথাসাহিত্যের ‘আমি’-র সঙ্গে মূল গল্পটির এক দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক থাকে। লেখক জানেন তিনি বানিয়ে বলছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি চাইছেন গল্পটা যেন বিশ্বাসযোগ্য হয় : বাস্তব হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য নয়, গল্প হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য। অনেক পাঠকই গল্পর নিজস্ব জগৎটি বাস্তব জগৎ থেকে আলাদা করেন না : গল্পটি বিশ্বাসযোগ্য মানেই বাস্তব ঘটনা হিসেবে সেটি বিশ্বাসযোগ্য, বিশেষ করে যখন লেখক-‘আমি’ নিজে সেটি বলছেন।
বোঝা দরকার : বাস্তবের মতো কল্পনারও নিজস্ব একটি জগৎ আছে। সেই জগতেরও নিজস্ব যুক্তিপরম্পরা আছে, বিশ্বাস-অবিশ্বাস-এর মাপকাঠি আছে, বাস্তবের যুক্তি ও বিচারের সঙ্গে সেগুলো পুরোপুরি এক নয়।
রবীন্দ্রনাথ নিজেও ‘বাস্তবের সত্য’ আর বানানো গল্পর সত্য—এ দু-এর তফাত করতে চাইতেন। মজার ব্যাপার হলো : অনেক পাঠক-পাঠিকাই সেটি করেন না। কুচবিহারের মহারানি ছিলেন এমনই এক শ্রোতা। তাঁর দৃঢ়বিশ্বাস ছিল রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই ভূত দেখেছেন। তাঁর অনুরোধ রাখতে তিনটি গল্প তৎক্ষণাৎ বানিয়ে বলতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথকে। সে তিনটি হলো : ‘দুরাশা’, ‘মণিহারা’ আর ‘মাস্টারমশাই’। সেগুলি লেখা হয় পরে। প্রথম দুটিই ‘আমি’-র আঙ্গিকে। মাস্টারমশায়-এর গল্পটি শুনে মহারানি আঁতকে উঠে বলেছিলেন : “এ্যাঁ, সত্যি নাকি?” রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেছিলেন: “না, মোটেই সত্য নয়, গল্প করিলাম মাত্র।” কিন্তু ভবী কি সহজে ভোলে? ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ পড়ে ক্ষীরোদচন্দ্র রায়চৌধুরী ধরেই নিয়েছিলেন : ডা: অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ছাড়া আর কেউ তরুণী ইরাণী ক্রীতদাসীর গল্পটির কথক হতে পারেন না। শুধু যে তাঁর আদলেই শ্রী সবজান্তা-র চরিত্রটি গড়া হয়েছে তা-ই নয়, অলৌকিক গল্পটিও তিনি নিজে রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন। তাই ক্ষীরোদচন্দ্রর দৃঢ় সিদ্ধান্ত : “ডাক্তারই রবীন্দ্রবাবুকে ঐরূপভাবে ঐ উদ্ভট গল্পটি বলেন। যাঁহারা ডাক্তারকে ভালো করিয়া জানিতেন তাঁহারা এ খবরে কিছুমাত্র আশ্চর্যান্বিত হইবেন না।” এরকম যে কেউ ভাবতে পারেন—এতেই অবশ্য আশ্চর্যান্বিত হতে হয়। এ গল্পে ‘আমি’ অবশ্য নিতান্তই মুগ্ধ নিষ্ক্রিয় শ্রোতা। ‘নিশীথে’র শ্রোতা ‘আমি’ও নিষ্ক্রিয়, বাধ্য হয়েই তাঁকে দক্ষিণাচরণের গল্প শুনতে হয়। পেশাগত কারণে যেন অনিচ্ছুক। হলেও শুনতে বাধ্য।
পুপে বা রানুর বয়স যখন অল্প তারাও সব গল্পকে সত্যি ভাবত। কিন্তু সাবালকরাও যে গল্প মাত্রকেই সত্যি বলে মনে করেন—বিশেষ করে সে গল্প যদি ‘আমি’-র আঙ্গিকে লেখা হয়—এটাও ঘটনা। অথচ ‘মণিহারা’-য় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে স্থানীয় ইস্কুলমাস্টার-এর ভৌতিক গল্পটাকে মনগড়া বলে দাগানো হয়েছে। ‘দুরাশা’ ও ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এ কাঠামো গল্প বা ফ্রেম স্টোরি-কে ভেতরের গল্প বা এম্বেডেড স্টোরি-র শেষে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ পাঠককে বোঝাতে চেয়েছেন ভেতরের গল্পগুলো নেহাতই বানানো, সেগুলির কথকও লেখক-‘আমি’ নয়, অন্য লোক। তবু, বয়সে-সাবালক হলেও অন্তরে নাবালক শ্রোতা/পাঠক ভেতরের গল্পদুটি সত্যি বলেই ধরে নেন। গল্পের শুরু ও শেষে কাঠামো গল্পে যে ইঙ্গিত দেওয়া থাকে সেটি তাঁরা খেয়ালই করেন না, করতেও চান না।
‘আমি’-র আঙ্গিকে লেখার আরও একটি বাড়তি সুবিধে আছে। কোনো মার্কামারা চরিত্রকে হেয় করে দেখাতে চাইলে ‘আমি’-র আঙ্গিক খুব কাজে দেয়। যেমন, ‘দুর্বুদ্ধি’, ‘ভাইফোঁটা’, ‘হৈমন্তী’, ‘অহঙ্কার’। আর অবশ্যই ‘অপরিচিতা’। কোনো এক বাপের সুপুত্তুরকে দিয়ে গল্পটি বলিয়ে রবীন্দ্রনাথ আত্মশ্লেষ ও আত্মধিক্কারের সুযোগ পেয়েছেন। প্রথমপুরুষ-এর আঙ্গিকে সেই সুযোগ হতো না। বাইরের লোক কাউকে খাটো করে দেখাচ্ছে—এ হলো এক ব্যাপার। আর সেই চরিত্রই নিজের অক্ষমতা ও দুর্বলতা নিজ মুখে স্বীকার করছে—এ হলো আর-এক। এর ফলে গল্প অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়। গল্প হিসেবে তো বটেই, ব্যঙ্গরচনা হিসেবেও।
___________________________________________
★ গল্পগুচ্ছ-র শেষে গ্রন্থপরিচয়-অংশে ও রবীন্দ্র-রচনাবলী (পশ্চিমবঙ্গ সরকার, খণ্ড ১৬, ২০০১)-তে এই প্রবন্ধে উদ্ধৃত ও উল্লিখিত যাবতীয় কথা পাওয়া যাবে।
★ কৃতজ্ঞতাস্বীকার : সিদ্ধার্থ দত্ত, সুনীশ দেব, পার্থসারথি মিত্র ও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় (শেষ অনুচ্ছেদের বক্তব্যটি তিনিই ধরিয়ে দিয়েছিলেন)।