একলব্য – মালবিকা মিত্র
(১)
মোবাইলটা অনেকক্ষণ ধরে বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে। আদিত্রি পেপার রেডি করার সময় সাধারণত ফোন ধরেন না। কাজের মধ্যে অন্য কোনও বিষয়ে মাথা ঘামাতে চান না। তাতে কনসেন্ট্রেশন নষ্ট হয়। কিন্তু ফোনটা বারবার আসছে, এদিকে পেপারটা আজকের মধ্যেই রেডি করে সাবমিট করতে হবে… খানিকটা বিরক্ত হয়েই ফোনটা হাতে তুলে নিলেন আদিত্রি। আর তক্ষুনি ফোনটা আবার বেজে উঠল। এবারে কিন্তু স্ক্রিনের উপর ভেসে ওঠা নামটা দেখে মুখের বিরক্তি মিলিয়ে গেল নিমেষেই। স্পেশাল সেক্রেটারি, ইনফরমেশন অ্যান্ড কালচারাল ডিপার্টমেন্ট,
“বলুন স্যার।” আদিত্রির গলা এখন মখমলের মতো মসৃণ।
“ডঃ ভট্টাচার্য কি ব্যস্ত ছিলেন?” স্পেশাল সেক্রেটারি মনীশ দত্ত, দু দুবার ফোন না ধরায় বিরক্ত কি না ঠিক বোঝা গেল না কথা শুনে।
“আসলে স্যার, সামনের মাসের ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার আছে একটা ডেলহিতে। তার জন্যই একটা পেপার রেডি করছিলাম। সিনোপসিসটা কালকের মধ্যেই পাঠাতে হবে অর্গানাইজারদের কাছে, তো…”
“সেমিনারটা কবে মিসেস ভটচার্য্যি?”, আদিত্রিকে কথা শেষ করতে দিলেন না মনীশ দত্ত।
“ফেব্রয়ারীর সেকেন্ড উইকে। কেন স্যার?”
“তাহলে শুনুন, এই সেমিনারে আপনার পার্টিসিপেট করা সম্ভবত হয়ে উঠবে না।”
“কিন্তু কেন স্যার? এনি প্রবলেম?”
“প্রবলেম ঠিক নয়… তবে আপনি যদি দায়িত্ব নেওয়াকে প্রবলেম মনে করেন তো…”
“আমি ঠিক বুঝছি না স্যার……”
“আদিত্রি দেবী, হামবোল্ডট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অফ হিস্টোরিক্যাল লিঙ্গুইস্টিকস একটা কনফারেন্সের আয়োজন করেছে। অবশ্যই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে। কনফারেন্সের প্রতিপাদ্য বিষয় হল, দ্য কি নোট অ্যামোঙ্গস্ট অল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজেস। বুঝতেই পারছেন, সংস্কৃত এই মাদার ল্যাঙ্গুয়েজগুলির মধ্যে অন্যতম। জার্মান কনস্যুলেট থেকে আমন্ত্রণপত্র এসে পৌঁছেছে। আর দিল্লীর মিনিস্ট্রি অব কালচার একটা পাঁচ জনের টিম তৈরি করতে চাইছে। প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি স্পেশিফিক্যালি আপনার নাম করেছেন।” একটানা এতগুলো কথা বলে মনীশ দত্ত হাঁপাচ্ছিলেন।
“দ্যাটস মাই প্লেজার স্যার।“
“এখন যে পেপারটি রেডি করছিলেন, সেটা কী বিষয়ের উপর?” প্রশ্নটা করেই ফেললেন স্পেশাল সেক্রেটারি।
“কন্ট্রিবিউশন অফ আদার ল্যাঙ্গুয়েজেস টু বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ।“
“ফেয়ার এনাফ। তো এই পেপারটাই কনফারেন্সের জন্য রেখে দিন। কনফারেন্সের তারিখ ফিক্স করা হয়েছে ফোরটিন্থ থেকে টুয়েন্টি ফার্স্ট অব্দি। আর টুয়েন্টি ফার্স্টে একটা গ্র্যান্ড সেলিব্রেশন আছে। বাংলাদেশের একটা টিম সারা বিশ্বের প্রায় পঞ্চাশটি আঞ্চলিক ভাষায় একটি গান গাইবে। শুধু তাই নয়, পঞ্চাশজন ডিফারেন্ট কমিউনিটির মেম্বার আছ এই টিমে। তারা প্রত্যেকে নিজেদের মাতৃভাষায় গান গাইবে। ভারত থেকেও বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক ভাষা সিলেক্ট করেছে ওরা।”
“কী গান? স্যার?”
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে… ইন ফ্যাক্ট এই গানটা তো ভাষা আন্দোলনের এন্থেম বলা যায়। কী তাই তো?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই।”, খানিকক্ষণ থেমে আদিত্রি বললেন, “টিমের বাকি মেম্বার কারা, যদি একটু বলেন…”
“শিওর। আপনি ছাড়াও আছেন, এন পি আইয়ার মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি থেকে, দিল্লী ইউনিভার্সিটি থেকে যাচ্ছেন অশোক পান্ডে, সাবিত্রিবাঈ ফুলে ইউনিভার্সিটি থেকে এম কে কার্ভে আর বেনারাস হিন্দু ইউনিভার্সিটি থেকে অমোলশঙ্কর শাস্ত্রী।“
“স্যার কী দায়িত্বের কথা বলছিলেন?” আদিত্রি অনুমান করছিলেন, হয়তো ওঁকে টিম লিডার হতে হবে। কারণ যারা যাচ্ছেন তাঁদের মধ্যে আদিত্রিই বয়সে সিনিয়র মোস্ট। অভিজ্ঞতাতেও। কিন্তু টিম লিডার হওয়ার অনুরোধটা স্বয়ং স্পেশাল সেক্রেটারির মুখ থেকেই শুনতে চাইলেন।
“হুম, দায়িত্ব তো বটেই, দেশকে রিপ্রেজেন্ট করা তো আর কম দায়িত্বের নয়।” মনীশ দত্তের গলায় হাসির আভাস।
আদিত্রি নিশ্চিত হতে পারলেন না। আবার নিশ্চিত না হয়ে কোনও কাজ তিনি করতে পারেন না। বাকিরা বয়স এবং অভিজ্ঞতায় তাঁর অনুজপ্রতীম। তাঁদের কারুর নেতৃত্বে তিনি কোথাও যেতে পারবেন না। তা দেশকে রিপ্রেজেন্ট করা যতই গর্বের হোক না কেন? তাই এবারে সরাসরি প্রশ্ন করলেন,
“টিম কে লিড করছে স্যার?”
“দেখুন হিসেব মতো টিম আপনারই লিড করার কথা…” মনীশ দত্তর গলায় সামান্য অস্বস্তি কি? “কিন্তু… এখানে একটা কিন্তু আছে।”
“ঠিক বুঝলাম না স্যার।”
“দিল্লী অন্য একজনের নাম রেকমেন্ড করেছে। অবশ্য দিল্লীও খুব শিওর নয় তিনি আদৌ টিম লিড করতে রাজি হবেন কি না। কারণ চোদ্দ থেকে কুড়ি তিনি অ্যাভেইলেবল নন। একেবারে একুশে, গ্র্যান্ড সেলিব্রেশনের দিন তিনি আপনাদের সঙ্গে জয়েন করবেন। ইন ফ্যাক্ট, ভদ্রলোক একটু পাগলাটে গোছের, অবশ্য শুনেছি জিনিয়াসরা ঠিক আর পাঁচজনের মতো হন না…”
“কার কথা বলছেন বলুন তো?” আদিত্রির গলায় কৌতূহল।
“দেখুন ভদ্রলোকের আসল নাম জানি না। গত দু বছরে ওঁর বেশ কয়েকটি লেখা পণ্ডিতমহলে সমাদৃত হয়েছে। গেল বছর তো ওঁর একটা বই জ্ঞানপীঠ পুরষ্কারও পেয়েছে। ‘রামায়ণ, দ্য টেল অফ দ্য ভিক্টরি অফ আরিয়ানস’।”
“কী যেন নাম ভদ্রলোকের? কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ না?”
“ওটা ছদ্মনাম। আসল নাম কী জানি না। ইন ফ্যাক্ট কেউই জানে না। কেউ দেখেওনি ওঁকে কোনও দিন। ওঁর পরিচিত একটি ছেলের মারফৎ ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয় নাকি। সে বিদঘুটে ব্যপার ম্যাডাম। কিছু বছর আগে অব্দিও তো ওঁকে কেউই চিনত না। ভদ্রলোক যেন হঠাৎ আবির্ভূত হয়েছেন। এমনকি ভাষাতত্ত্বের উপর ওঁর একটা পেপার শুনলাম অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিও রেকমেন্ড করেছে। তবে ম্যাডাম, আপনি চিন্তা করবেন না, যতখানি শুনেছি ভদ্রলোকের সম্বন্ধে, তাতে মনে তো হয় না উনি জনসমক্ষে আসবেন। আর তাই যদি হয় তাহলে আপনি ছাড়া আর কাউকে টিমের দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভাবাই যায় না। এমনিতেও যে লোক সাত দিনের মধ্যে ছয় দিনই উপস্থিত থাকবেন না, সেই লোকের উপর কী করে দায়িত্ব দেওয়া যায় কে জানে? মিনিস্ট্রির রকম সকম বোঝা দায় বুঝলেন না?” ব্যপারটাকে সহজ করতে চাইলেন স্পেশাল সেক্রেটারি।
কিন্তু আদিত্রি তাতে খুব একটা আস্বস্ত হলেন বলে মনে হল না। যদিও স্পেশাল সেক্রেটারির মুখের উপর উনি আর কিছু বললেন না, তবুও উনি যে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন তা বোঝা গেল ওঁর পরের কথাতেই,
“এখন মিনিস্ট্রি যাকে যোগ্য ভাবছে স্যার। এ বিষয়ে আমার কোনও মন্তব্য করা শোভা পায় না। আর এখানে তো স্কুলের কোনও বাচ্চারা যাচ্ছে না, যে দায়িত্ব নিয়ে যেতে হবে। যারা যাচ্ছে তারা প্রত্যেকেই শিক্ষিত এবং যার যার সাবজেক্টে স্বনামধন্য। তাই…”
“না না ম্যাডাম। শুধু যাওয়া, খাওয়া আর পেপার পড়ার ব্যাপার তো এটা নয়। নানান দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও এই কনফারেন্স অ্যাটেন্ড করবেন, জার্মানির চ্যান্সেলর স্বয়ং এই কনফারেন্সের উদ্বোধক, তাই একজন লিডার না থাকলে তো চলে না। যদিও শুনেছি মিনিস্টার অব স্টেটও না কি থাকছেন আপনাদের সঙ্গে আর সেক্রেটারি বা অ্যাডিশনাল সেক্রেটারির মধ্যে কেউ একজন তো থাকবেনই।” মনীশ দত্ত বুঝিয়ে দিলেন প্রশাসনিক অধিকর্তারাও থাকবেন এই টিমে, তাই আদিত্রির নিজেকে প্রধান ভাবার কোনও যৌক্তিকতা নেই।
আদিত্রি মানুষটা একটু দাম্ভিক প্রকৃতির, তাঁর উপর কেউ ছড়ি ঘোরাবে এটা তাঁর পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ নয়। কিন্তু এই সব ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার নিজে থেকে বাতিল করা মানে নিজের উন্নতির পথে নিজে বাধা সৃষ্টি করা। তাও এমন একটা সেমিনার যেখানে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকার পার্টিসিপেন্ট নির্বাচন করছে। এমনিতেও আন্তর্জাতিক সেমিনারে আর কতই-বা যোগ দেওয়া হয়? অন্যান্য সাবজেক্টে বছরে বেশ কয়েকটা আন্তর্জাতিক মানের কনফারেন্স হলেও সংস্কৃতর উপর তো খুব বেশি হয় না। আর একজন অধ্যাপকের জীবনে এই ন্যাশনাল আর ইন্টারন্যাশনাল সেমিনারের কতখানি গুরুত্ব তা একজন অধ্যাপকই জানেন। আর যদি তিনি আদিত্রি ভট্টাচার্যের মতো উচ্চাকাঙ্খী মানুষ হন, তাহলে তো…
শুতে যাওয়ার আগে আদিত্রি ভাবলেন কাল একবার ওঁর বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। মানুষটা এখনও তাঁর থেকে অনেক বেশি জানেন। আদিত্রির আজও মনে হয় উনি মেয়েকে সবটুকু শেখাননি। আর এখানেই বাবার উপর ভয়ানক রাগ আদিত্রির। কিন্তু দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে হলে আর নিজেকে সবার থেকে আলাদা প্রমাণ করতে হলে আউট অব দ্য বক্স কিছু প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। তাই নিজের রাগ অভিমান বুকে চেপে, গিয়ে দাঁড়াতেই হবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান ও স্বনামধন্য অধ্যাপক ধূর্জটিপ্রসাদ ভট্টাচার্যের সামনে। মাথা ঝুঁকিয়ে। প্রাণে এটাই বেশি লাগছে।
কিন্তু আদিত্রির উপায় নেই।
(২)
“ভালো-বাসা” নাম লেখা গেটের মধ্য দিয়ে যখন আদিত্রির হন্ডা সিটিটা ঢুকল, ঘড়ির ডিজিটাল নাম্বার বলছে সাড়ে দশটা বেজেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। যাক, বাবাকে কিছু সময়ের জন্য পাওয়া যাবে। নয়তো ধূর্জটিপ্রসাদের জীবন ঘড়ির অনুশাসন মেনে চলে। সময়ের একটু এদিক-ওদিক হলেই তাঁর সঙ্গে আর দেখা হবে না। স্নান খাওয়া সেরে নিজের লাইব্রেরীতে ঢুকে গেলে, ধূর্জটিপ্রসাদের দেখা বিকেলের আগে মিলবে না।
আদিত্রি ভিতরে ঢুকে দেখলেন সদ্য স্নান পুজো সেরে তাঁর বাবা খেতে বসেছেন। মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের শীতলতা দিন দিন বাড়ছে ধূর্জটিপ্রসাদের। সম্পর্কের আড়াল কবে থেকে, তা আদিত্রি নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও ধূর্জটিপ্রসাদ নিজে জানেন। যেদিন নিজের হাতে গড়া কন্যার মনে মিথ্যে অহংকার আর দূর্নীতির মালিন্য দেখলেন… যাক সে কথা। আপাতত এত সকালে মেয়েকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে একটু অবাকই হলেন তিনি। সেই সঙ্গে হয়তো বা খানিক বিরক্তও। প্রশ্নালু চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন।
বাবার সঙ্গে সাধারণ কথা বলতেও আজকাল অস্বস্তি হয় আদিত্রির। কিন্তু এবারে তাঁর নিজের গরজ। কী বলবেন গাড়িতে আসতে আসতে তা নিজের মনেই একটা খসড়া বানিয়ে নিয়েছিলেন। শাড়ির আঁচলে মুখটা মুছে নিয়ে বললেন,
“কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে একটা ইনভিটিশন পেয়েছি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে একটা কনফারেন্স অর্গানাইজ করেছে হামবোল্ডট ইউনিভার্সিটি।”
“তো?” ভাতে ডাল মাখতে মাখতে প্রশ্ন করলেন ধূর্জটিপ্রসাদ।
“তো… টিমের প্রধান হিসেবে আমাকে পেপার পড়তে হবে…”
“সে তো যারা যারা ভারতের প্রতিনিধি হয়ে যাচ্ছেন সকলকেই পড়তে হবে। মানে সকলেই পড়বে। এতে সাত সকালে আমার কাছে দৌড়ে আসার কী দরকার?”
“তা নয়… কিন্তু প্রধান হিসেবে আমি এমন একটা পেপার রেডি করতে চাই যা গড়পড়তা সাধারণের ভাবনার বাইরে। আর তা ছাড়া এর সঙ্গে আমাদের দেশের ভাবমূর্তিও জড়িয়ে আছে। একজন ভারতীয় হিসেবে তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না বাবা, যে ভারতের অসম্মান হোক। আর…”
“কিন্তু তুমি তো গড়পড়তা সাধারণই ছিলে। হ্যাঁ তুমি পরিশ্রমী ছিলে, আর মেথডিক্যাল ছিলে। কিন্তু অসাধারণ মেধা তো তোমার নয়।”
“আমি বরাবরই তোমার কাছে নিম্নমেধার। আমি কিন্তু নিজেকে প্রমাণ করে দিয়েছি বাবা…”
“তাই কি?” আদিত্রিকে কথা শেষ করতে দিলেন না ধূর্জটিপ্রসাদ।
চোখ নামিয়ে নিলেন আদিত্রি। বাবা কোন্ দিকে ইঙ্গিত করছেন তা বুঝতে তাঁর অসুবিধা হল না, “কিন্তু এই পেপার রেডি করার সঙ্গে আমার মেধার কী সম্পর্ক?”
“সম্পর্ক আছে বই-কি?” ধূর্জটিপ্রসাদ বললেন, “অসাধারণ পেপার তৈরি করতে গেলে পরিশ্রমের পাশাপাশি অসাধারণ মেধার প্রয়োজন হয়! সাধারণের হাতে পড়লে সেই অসাধারণত্ব আর থাকে না। আর একটা কথা জেনে রাখো, টপিক, সাবজেক্ট ইত্যাদি অনাদিকাল থেকেই আছে। এটা তো গবেষকের মেধা, যে সে চোখের সামনে পড়ে থাকা একটা সাবজেক্টের উপর অসাধারণ একটা থিসিস রেডি করার ক্ষমতা রাখে। গাছ থেকে আপেল মাটিতে পড়ে সেটা কি নিউটনের আগে কেউ জানত না? নিশ্চয়ই জানত। কিন্তু নিউটনের মেধা তাকে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করিয়েছিল।”
বৃদ্ধ চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। আদিত্রি বললেন,
“কিন্তু সন্তান হিসেবে তোমার অর্জিত জ্ঞানের উপর কি আমার কোনও অধিকারই নেই? আমি জানি তুমি আমাকে সব শেখাওনি। কিন্তু কেন? তোমার অর্জিত জ্ঞান তো আমারই পাওয়ার কথা ছিল। বাবা হয়ে, সেটাই কি তোমার প্রথম কর্তব্য ছিল না?”
“না ছিল না। বাবা হিসেবে সন্তানের প্রতিপালন করা আমার কর্তব্য। কিন্তু আমার অর্জিত সম্পদ, তা সে জ্ঞানই হোক বা অর্থ তার উত্তরাধিকার আমি কাকে দিয়ে যাবো, সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আর শোনো, সন্তান হলে পিতার অর্থে অধিকার জন্মাতে পারে, অন্তত আইন তাই বলে, কিন্তু পিতার অধীত জ্ঞানে জন্মসূত্রে কোনও অধিকার জন্মায় না।”
“এটা তোমার অহংকারের কথা বাবা। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে তুমি আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে গেছ। প্রমাণ করার চেষ্টা করেছ আমি তোমার থেকে কত কম জানি।”
“আমাকে মিথ্যা দোষারোপ করছ। আসলে তুমি নিজেই জানতে চাওনি। যদি তোমার শেখার আগ্রহ আর ক্যাপাবিলিটি দেখতাম, তাহলে তোমাকে না শেখানোর কোনও কারণই ছিল না। কিন্তু তুমি আমার সন্তান বলে তোমাকে আমার বাকি ছাত্রছাত্রীদের থেকে বেশি প্রায়োরিটি দেবো… আমি যে তেমন শিক্ষক ছিলাম না, তা তুমি ভালো করেই জানো। শুধু একবার… শুধু একবার তোমার জন্যে আমাকে আমার শিক্ষক ধর্ম থেকে সরে আসতে হয়েছিল… এই যন্ত্রণা মৃত্যুকাল অব্দি আমার থাকবে।”
“নিজের সন্তানকে সামান্য একটু সাহায্য করেছ বাবা, তাকে তুমি শিক্ষক ধর্ম থেকে বিচ্যুতি বলছ?”, গলায় বিস্ময় আদিত্রির।
“হ্যাঁ, বলছি। গাছের উপর একবার বাজ পড়ুক কি বারবার… তাতে কিছুই আসে যায় না। কারণ গাছ তো প্রথমবারেই জ্বলে যায়। তেমনই আদর্শ থেকে একবার বিচ্যুত হওয়াই অপরাধ। আর কাকে সামান্য সাহায্য বলছ তুমি? ওই সাহায্যটুকুর জন্যই যে করে-কম্মে খাচ্ছ… ভুলে গেলে কি সে কথা?” ধূর্জটিপ্রসাদের গলায় ব্যঙ্গ স্পষ্ট।
আদিত্রির আর সহ্য হল না। তিনি একটা কলেজের সংস্কৃতের বিভাগীয় প্রধান, নিজে ডক্টরেট ডিগ্রীধারী। বারবার এই অসম্মান সহ্য করার মতো বয়সও তিনি পেরিয়ে এসেছেন। কবে কী করেছিলেন, যাকে তিনি নিজে দুর্নীতি বলে স্বীকার করেনও না, তার জন্যে এতদিন পরেও খোঁটা শুনতে তিনি রাজি নন। পেপারের বিষয়বস্তু নিজেই খুঁজে নেবেন। বেরিয়ে আসছিলেন, পিছন থেকে ধূর্জটিপ্রসাদ বলে উঠলেন,
“জন্মসূত্রে শিক্ষার অধিকারী হওয়া যায় না। একমাত্র উপযুক্ততার ভিত্তিতেই শিক্ষার অধিকার দেওয়া যেতে পারে। মনে রেখো, দ্রোণাচার্য ব্রহ্মশির অস্ত্রের জ্ঞান শুধু অর্জুনকেই দিয়েছিলেন, অশ্বত্থামাকে নয়। অশ্বত্থামা জোর করে সেই অস্ত্র আদায় করেছিল ঠিকই, কিন্তু দ্রোণাচার্য ভালো মতোই জানতেন, তাঁর পুত্র ব্রহ্মশিরের মতো মারণাস্ত্রের উপযুক্ত নয়। আর হলও তাই। অর্জুনের মত সম্যক জ্ঞান না থাকায়, অশ্বত্থামা শুধু প্রয়োগই জানতেন, সম্বরণ করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। আর তাই অমরত্বের অভিশাপ ছিল তাঁর কপালে। অনপযুক্ত ব্যক্তিকে জ্ঞানের উত্তরাধিকার দেওয়া যায় না, তাতে জ্ঞানের অপপ্রয়োগ ঘটে।”
(৩)
হামবোল্ডট ইউনিভার্সিটির দৈত্যাকার অডিটোরিয়াম করতালির শব্দে ভরে উঠেছে। এইমাত্র যিনি তাঁর প্রেজেন্টেশন কমপ্লিট করলেন, ও প্রশ্নোত্তর পর্বে সকলের সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিলেন , তাঁর নাম সকলে জানেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। সেই নামেই তিনি সুপরিচিত। নিজের আসনে সুপ্তোত্থিতার মতো বসে আছেন আদিত্রি। ওই রস্ট্রামের সামনে দাঁড়িয়ে স্মিতহাস্যে সবার অভিনন্দন কুড়োচ্ছেন যে মানুষটি, আজ থেকে কুড়ি বছর আগে, ওই রকমই স্মিতহাস্যে সহপাঠীদের বিদ্রুপও গ্রহণ করেছিল সে। আদিত্রি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন, পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা অতি মেধাবী অথচ দরিদ্র এক অপ্রতিভ তরুণকে; দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে তার অশিক্ষিত, হতদরিদ্র পিতার সঙ্গে বসে আছে। কালো শরীরে আধময়লা জামা, তেলে চুবানো চুল পাটপাট করে আঁচড়ানো। প্রথমবার কলকাতা শহরে আসার দরুণ দুই জনেই সমান অপ্রতিভ। আদিত্রি দেখতে পাচ্ছেন, ইউনিভার্সিটির সামনের ওই ছোট্ট রাস্তাটুকু পেরোতেই দুজনের নাকাল হওয়া চেহারা, সেই সঙ্গে দেখতে পাচ্ছেন প্রেসিডেন্সি, জেভিয়ার্স আর স্কটিশের থেকে স্নাতকোত্তর পড়তে আসা এক ঝাঁক রঙিন প্রজাপতির মতো ছেলেমেয়েকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়িয়ে যারা ওই দুজনের নাকাল হওয়া দেখছে, আর নিজেদের মধ্যে গা টেপাটেপি করে হাসছে।
চ্যান্সেলার এগিয়ে এসে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের হাত চেপে ধরলেন—সমস্ত সরকারী প্রোটোকল ভেঙে। প্রাচীন কিংবদন্তিগুলোর মধ্যেকার মিল, এত সহজে আর এত তথ্য দিয়ে আগে কেউ ব্যখ্যা করতে পারেনি। মিনিস্ট্রি অব কালচারের প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি বিগলিত মুখে এগিয়ে গেলেন, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণকে অভিনন্দন জানাতে। এতগুলো বাঘা বাঘা পণ্ডিতের বাঘা বাঘা প্রশ্নের উত্তর যে হাসিমুখে দিয়েছে, সকলের সব অস্ত্রের ঝনঝনানি যে হেলায় প্রতিহত করেছে, তাঁর যোগ্যতা নিয়ে কারুর কোনও দ্বিধা নেই। এক অদ্ভুত আলোকবৃত্ত ঘিরে রেখেছে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নকে।
আদিত্রি জানেন, ছেলেটি আক্ষরিক অর্থেই মেধাবী ছিল। আদিত্রির বিদ্বেষমিশ্রিত ঈর্ষাও তা অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চোখের মণি। স্নাতক স্তরে চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট, প্রেসিডেন্সিয়ান, বিতর্কসভার চৌখস ডিবেটার, সর্বোপরি সংস্কৃতের এইচ ও ডি ধূর্জটিপ্রসাদের একমাত্র কন্যা আদিত্রিকে ডিপার্টমেন্টের সবাই মাথায় তুলে রেখেছে। তিনি যা করবেন, যা লিখবেন তাতেই সবাই ধন্য ধন্য করবে। সত্যি বলতে কি, প্রশংসা পাওয়াটা আদিত্রির এক রকম অভ্যেসে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু যে প্রশংসা তিনি ডিপার্টমেন্টের বাকি অধ্যাপকদের কাছ থেকে পেয়েছেন, তাঁর বাবা কোনও দিন তা করেননি। না, নিজের মেয়ে বলে উনি প্রশংসা করতেন না, এমনটা নয়। আসলে ধূর্জটিপ্রসাদের চোখে শ্রেষ্ঠ ছাত্র ছিল এই কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। নিজের মেয়েকে এই ছাত্রের সমতুল্য তিনি কোনও দিনই ভাবেননি। আদিত্রির সবথেকে বড়ো ক্ষোভের জায়গা এটাই।
কনভেনর ঘোষণা করছেন, জার্মানির চ্যান্সেলর কৃষ্ণ দ্বৈপায়নকে সংবর্ধনা দেবেন। সারা বিশ্বের প্রাচীন কিংবদন্তি দুই মলাটের মধ্যে গ্রন্থিত করেছেন তিনি। বহুদিন ধরেই মিউনিখের লাডউইং ম্যাক্সিমিলিয়াস ইউনিভার্সিটিতে তিনি গবেষণারত। ‘মিথোলজিক্যাল রেজেম্বেলন্স’ নামের বইটি পাবলিশ করেছে অক্সফোর্ড ইউনিভারসিটি পাবলিশারস। আদিত্রি ভাবছেন, তাঁর শিক্ষার মধ্যে খামতি কোথায় থেকে গেলো? তিনিও তো ইউনিভার্সিটি স্কলার ছিলেন, হ্যাঁ সে বছর ফার্স্ট তিনি হতে পারেননি। কিন্তু ওই কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন না থাকলে প্রথম স্থান তাঁর বাঁধা ছিল। আর এও তো হতেই পারে, এইচ ও ডির মেয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলে ইউনিভার্সিটির অন্দরেই কথা উঠত। তাই তাঁর বাবা ইচ্ছে করেই মেয়েকে প্রথম স্থান পেতে দেননি। কিন্তু তাই কি? আদিত্রি কি নিজের অন্তর দিয়েই অনুভব করেন না, যে মেধার বিচারে তিনি কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের চেয়ে কয়েকশো মেইল পিছিয়ে ছিলেন। ওর সংস্কৃতে ব্যুৎপত্তি, ফটোগ্রাফিক মেমরি, তার থেকেও বেশি সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতি ওর অদম্য ভালোবাসাই ওকে আদিত্রির চেয়ে অনেক গুণ এগিয়ে দিয়েছিল।
ডায়াসের দিকে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। আদিত্রি চোখের সামনে দেখতে পেলেন, জুলাইয়ের এক বর্ষণমুখর দুপুরে দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিংয়ের সংস্কৃত ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। মাস্টার্সের রেজাল্ট সদ্যই প্রকাশিত হয়েছে। কৃষ্ণ শুধু প্রথম হয়েছেন তাই নয়, নম্বরের ক্ষেত্রে একটা মাইলেজ তৈরি করেছেন। ধূর্জটিপ্রসাদের ঘর থেকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসাবাক্য ভেসে আসছে তাঁর কানে। কান পুড়ে যাচ্ছে আদিত্রির। শৈশবে মাতৃহীনা আদিত্রিকে প্রায় তুলোয় মুড়ে বড়ো করেছিলেন ধূর্জটিপ্রসাদ। বাবার উপর একমাত্র তাঁরই একাধিপত্য, এই জেনেই বড়ো হয়েছেন আদিত্রি। কিন্তু ধূর্জটিপ্রসাদ বুঝতে পারেননি, অতিরিক্ত স্নেহের ফলে তাঁর আদরের কন্যাটি কখন জেদি, অবুঝ আর অহংকারীতে পরিণত হয়েছে। তিনি বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন, বলার চেষ্টা করেছিলেন সত্যকে সহজেই গ্রহণ করতে হয়। সত্যকে অহংকারের বশে অস্বীকার করে কোনও লাভ নেই। কিন্তু আদিত্রি তা বুঝতে পারেননি। বলা ভালো, বোঝার চেষ্টাই করেননি। তাই মাস্টার্সের রেজাল্ট যেদিন বেরোল, আদিত্রি হতচকিত হয়ে গেলেন। এতদিন জেনে এসেছেন স্তাবকতা কেবল তাঁরই প্রাপ্য। কিন্তু দেখলেন, এক নিমেষেই সবটুকু আলো শুষে নিলেন কৃষ্ণদাস মুর্মু। হ্যাঁ, আজকের কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের প্রকৃত পরিচয় এটাই। আর আদিত্রির রাগ আরও বেশি হত, যখন তিনি ভাবতেন দেবভাষায় তাঁর চেয়েও বেশি পারদর্শিতা দেখাচ্ছে একটা সাঁওতাল ছেলে।
সেদিন সহ্যের সব সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল। একটা অশিক্ষিত পিতার সন্তান কৃষ্ণদাস, যার পারিবারিক জীবিকা শালপাতা কুড়োনো, সে কি না ইউনিভার্সিটি টপার হয়ে পাড়ি দেবে হামবুর্গ ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ করতে, মানতে পারেননি। যেমন মানতে পারেননি নেহরু-ফুলব্রাইট স্কলারশিপের জন্য একটা সাঁওতাল ছেলের নাম বিবেচিত হবে, এই তথ্যও। ইউনিভার্সিটি টপারের পজিশন তো তিনি ছিনিয়ে নিতে পারবেন না, কিন্তু একটা কালো মানুষের বিদেশ যাত্রা তো তিনি আটকাতেই পারেন। তাই প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর শেষ অস্ত্র…
“সেদিন তুমি, আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিলে তোমার বাবাকে তাই না আদিত্রি?”, একটা পরিচিত গলা শুনে চমকে পিছন দিকে তাকালেন আদিত্রি। একটা চব্বিশ পঁচিশ বছরের ছেলে, তাঁর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কাকে দেখছেন তিনি? এই তো সেই কৃষ্ণদাস। কিন্তু তাহলে তাঁর সামনে ডায়াসে কে দাঁড়িয়ে আছে?
“তুমি… তুমি কী করে জানলে?” আদিত্রির কথা আটকে আটকে যাচ্ছে।
“স্যার সেদিন গভীর রাত্রে এসেছিলেন আমার হোস্টেলে। বলেছিলেন, দিনের আলোয় তো মুখ দেখাতে পারব না কৃষ্ণদাস, কিন্তু কথাটা যে আমাকে বলতেই হত। যদি ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে খুকীর নাম না পাঠাই তাহলে সে আত্মহত্যা করবে বলেছে। আর খুকীর নাম আমি তখনই পাঠাতে পারবো, যদি তুমি নিজে এই স্কলারশিপ নিতে অস্বীকার করো। করবে বাবা? আমাকে না হয় এই গুরুদক্ষিণাই দাও। নিজে হাতে নিজের স্বপ্নের সমাধি ঘটিয়েছিলাম আদিত্রি। অস্বীকৃতি পত্রে নিজের হাতে সই করেছিলাম।”
“কিন্তু তুমি তো হারিয়ে গেলে না? আমি তো চেয়েছিলাম তুমি যাতে ধ্বংস হয়ে যাও। যখন, তোমার প্রিয় অধ্যাপকের কাছ থেকেই তুমি বঞ্চনা পাবে, তখন তুমি আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু তা তো হল না?”
“হল না। কারণ স্যার আমাকে হারিয়ে যেতে দিলেন না। তুমি হামবুর্গে গবেষণা করতে চলে গেলে, স্যারের চিঠি নিয়ে আমি চলে গেলাম বেনারসে, হিন্দু ইনিভার্সিটির অধ্যাপক শিব নারায়ণ শাস্ত্রীর কাছে। সেখানে তিন বছর ধরে শিখলাম সংস্কৃত সাহিত্যের নানান অলিগলি। জানলাম, বেদ উপনিষদ, আরণ্যক, সংহিতা সহ নানান পুরাণ উপপুরাণ। শাস্ত্রীজি শুধু সংস্কৃত সাহিত্যেই পারদর্শী ছিলেন তা নয়। উর্দু, ফারসী, পালিসহ একাধিক ভাষায় তাঁর দখল ছিল। মৃত্যুর আগে নিজে যা যা জানতেন আমাকে সব শিখিয়েছিলেন। আর স্যার তো সবসময় আমার ছায়া হয়েই ছিলেন। তাই আমার আর হারিয়ে যাওয়া হল না।”
“বাবার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ ছিল?”
“এখনও আছে। তিনি আমার গুরু। আমার যা কিছু অ্যাচিভমেন্ট তা তো তাঁরই জন্যে। স্কলারশিপ ছেড়ে দেওয়ায় আমার উচ্চশিক্ষা তো বন্ধই হয়ে যেত। কারণ আমার বাবার এত সামর্থ্য ছিল না যে, আমাকে আরও পড়াতে পারে। যদি স্যার আমার হাতটা শক্ত করে না ধরতেন, এত দিনে হয়তো পুরুলিয়ায় ফিরে গিয়ে শালপাতা কুড়োতে হত আমাকে। কিন্তু তা তিনিই হতে দেননি। তোমার আত্মহত্যার হুমকিতে নিরুপায় হয়ে আমার প্রাপ্য সম্মান থেকে আমকে বঞ্চিত করতে হয়তো বাধ্য হয়েছেন, কিন্তু আদিত্রি, সব গুরুই দ্রোণ হন না। আর সব ছাত্রই একলব্যের পরিণতি পায় না।”
করতালির আওয়াজে চমকে গেলেন আদিত্রি। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ তখন ডায়াসে দাঁড়িয়ে তাঁর বাবার নাম বলছেন। বলছেন, ডঃ ধূর্জটিপ্রসাদ ভট্টাচার্যের জন্যই তিনি এই সাফল্য পেয়েছেন। বলছেন, যখনই কোনও প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন, ধূর্জটিপ্রসাদই প্রথম ব্যক্তি যিনি সেই প্রবন্ধ পড়েছেন, প্রয়োজনে কারেকশনও করে দিয়েছেন।
“কী ভাবছ আদিত্রি? ভাবছ বুঝি, এক সময়ে তোমার তীব্র অপমানের পাত্র আজ এই জায়গা কী করে পেল? তোমরা বড়ো ঘরের ছেলেমেয়ে ছিলে, তোমাদের কাছে আমি সেদিন উদারতাই আশা করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম তা হল না। তোমরা উদার তো নয়ই বরং আরও কূপমণ্ডূক। দলিতকে পায়ের নীচে রাখতেই তোমরা বেশি স্বচ্ছন্দ। তোমরা দূর থেকে দলিতদের প্রাপ্য মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার আন্দোলন করো ঠিকই, কিন্তু নিজের পরিসরের মধ্যে যখন অধিকারের প্রশ্ন ওঠে, তখন তোমরা সেই মধ্যযুগে ফিরে যাও। তোমাদের দাঁত নখ বেরিয়ে পড়ে।”
“কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন? নামের পাশে দ্বৈপায়ন বসালেই ব্রাহ্মণত্ব পাওয়া যায় না কৃষ্ণদাস। তা বোধ করি তুমি জানো না।”
মৃদু হাসির শব্দ শুনলেন আদিত্রি, “বেদে ব্রাহ্মণত্ব বংশানুক্রমিক নয়, এ কথা তুমিও পড়েছ নিশ্চয়ই। আর, দ্বৈপায়ন কোনও কুলনাম নয় আদিত্রি। দ্বীপের মধ্যে জাত বলে দ্বৈপায়ন। আর তিনিও যে আমার মতোই কালো মানুষ ছিলেন। ঋষি পরাশর আর দাসকন্যা সত্যবতীর সন্তান।”
(পরিশিষ্ট)
“ম্যাডাম, আর ইউ ওকে?” সামনে থেকে কারভের গলার স্বরে সচেতন হয়ে বসলেন আদিত্রি।
“ইয়েস, আই অ্যাম অ্যাবসোলিউটলি ফাইন। হোয়াটস হ্যাপেন্ড?”
“নাথিং সিরিয়াস ম্যাম।” কারভে একটু আমতা আমতা করে বললেন, “আপনি একটু অন্যমনস্ক হয়ে আছেন। তো ভাবলাম কি, আপনার শরীর খারাপ হল কি না? আর কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন। অনেকক্ষণ থেকেই আপনাকে ডাকছি। কিন্তু আপনি সাড়া দিচ্ছেন না। তো…”
সামনের দিকে সোজা হয়ে তাকালেন আদিত্রি। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন সামনে দাঁড়িয়ে। মুখে সেই কুড়ি বছর আগের সরল হাসি। আগের মতো চুলে চুপচুপে তেল নেই, বরং ঘন কোঁকড়ানো কাঁচা পাকা চুল ঈষৎ উস্কোখুস্কো। চোখে একটা মোটা ফ্রেমের চশমা উঠলেও তার আড়ালের চোখ জোড়া আগের মতোই গভীর। কষ্টিপাথরে কোঁদা শরীরে সামান্য আয়েসী মেদ। মুখে কোনও রাগ বা অভিমান নেই কৃষ্ণদাসের। হেসে বললেন,
“কাছেই আমার কোয়ার্টার, কালকের দিনটা তো আছোই। এসো না। নিজে হাতে ভিন্দালু করে খাওয়াবো। আগের মতোই ভালোবাসো তো?”
আদিত্রি উত্তর দিলেন না। কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যে সাধ্যের অতীত।