এই লভিনু সঙ্গ তব – পার্থপ্রতিম মজুমদার

শেয়ার করুন

কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাদের সান্নিধ্যে আসলেই মন ভালো হয়ে যায়। গৌতমদা ছিলেন সেই বিরল গোত্রের একজন মানুষ।

কবে, কীভাবে গৌতমদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তা আর এখন মনে পড়ে না। কিন্তু প্রথম দর্শনেই মানুষটিকে মনে হয়েছিল এই সেই ‘মনের মানুষ’।

খুব বড়ো মনের মানুষ না হলে বড়ো কবি বা বড়ো লেখক হওয়া যায় না—গৌতমদা ছিলেন তার মূর্ত প্রতীক। সদাহাস্যময়, অজাতশত্রু গৌতমদা প্রকৃতই ছিলেন তরুণ কবিদের একান্ত আশ্রয়স্থল। খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করতেন তরুণ কবিদের বই। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন তাদের বই। শুধু তাই-ই নয়, তাদের বই পড়ে নিজস্ব মতামতও জানাতেন যাতে তারা সমৃদ্ধ হতে পারে। এত বড়ো মাপের একজন কবি হয়েও জ্ঞানান্বেষণে কোনো আপস করেননি কোনোদিন। যখনই কোনো জিনিস জানতে বা বুঝতে অসুবিধা হয়েছে গৌতমদার দ্বারস্থ হয়েছি। তৎক্ষণাৎ শত অসুবিধার মধ্যেও গৌতমদা উত্তর দিয়েছেন, হয় ফোনে, নয় ই-মেইলে, নয় মেসেজ করে। কত যে বই পড়তে সাহায্য করেছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। প্রকৃত অর্থেই বিশ্বপড়ুয়া যাকে বলে গৌতমদা ছিলেন তাই।

স্মৃতিচিত্র লিখবার একটা অসুবিধা হল যে এর কোনো পারম্পর্য রক্ষা করা যায় না। আগেরটা পরে, পরেরটা আগে এসে যায়।

কৃশকায় কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা তিনি। ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’, ‘অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে’, ‘রসাতল’, ‘নয়নপথগামী’ প্রভৃতি কয়েকটি চটি কবিতার বই। অথচ তার যে সুদূর, বিশাল অভিঘাত তা বঙ্গীয় কাব্যজগতকে চিরকাল মনে রাখতে হবে। পরে ‘স্বর্ণগরুড়চূড়া’ ও ‘মঞ্জুশ্রী’ প্রকাশিত হয়। কবি গৌতম বসুকে নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ।

এক্ষুণি মনে পড়ছে বছর দুই আগের কথা। সেপ্টেম্বর মাস। ব্যারাকপুর থেকে আরও কয়েকটা স্টেশনের পরে একটা লিটল ম্যাগাজিনের অনুষ্ঠান। বেশ ঘরোয়া, ছিমছাম, আন্তরিক একটি পত্রিকার শারদসংখ্যা প্রকাশের অনুষ্ঠান। পৌঁছে তো আমি অবাক! গৌতমদা সেখানেও উপস্থিত! কিছুদিন আগেই তাঁর হার্টের অপারেশান হয়েছে, চলাফেরায় অনেক বাধানিষেধ। আমি কৌতূহল না চাপতে পেরে অনুষ্ঠান শেষে স্টেশনে চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম, গৌতমদা এখন এইরকম শরীরের অবস্থায় এতদূ্র কেন এলেন? গৌতমদা বললেন, দেখো পার্থ, এইসব অনুষ্ঠানে এলে আমার বিরাট একটা লাভ হয়। কত তরুণ ছেলেমেয়ে কত ভালো লেখে, এইসব জায়গায় এলে তাদের লেখার সঙ্গে পরিচয় হ্য়। এই লেখাগুলি আমার লেখার ক্ষেত্রে অক্সিজেনের কাজ করে। এদের কবিতা শুনবার জন্যই দৌড়ে দৌড়ে আসি।আমি আর কী বলব, বাক্যহারা! যেখানে আমাদের সুবিখ্যাত কবিদের (সকলেই নন অবশ্য) তরুণ কবিরা বই দিলে সেটা কিছুদিনের মধ্যেই কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে চলে আসে, সেখানে গৌতমদার মতো খ্যাতিমান কবির এই উক্তি যে কত অর্থবহ তা আর বলে বোঝানোর দরকার পড়ে না। সেদিন ওই যাত্রাপথে অনেকটাই গৌতমদাকে পেয়েছিলাম। তার পরেও অনেকবারই দেখা হয়েছে—বইমেলায়, বিভিন্ন কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে।
কিন্তু বহু মানুষের ভিড়ে সেরকমভাবে আর নিবিড় করে পাইনি। সেদিনের সেই অনুষ্ঠান, সেই যাত্রাপথ, সেই
কথোপকথন আজীবন মনে থেকে যাবে।

ফোনেও অনেক কথাই হত, কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই দেখতাম গৌতমদা ফোনে বেশি কথা বলতে পারছেন না। হাঁপিয়ে যাচ্ছেন। তখন এস এম এস এই কথা হত। আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বপড়ুয়া এই মানুষটা ফোন করলেই বলে উঠতেন, লেখালেখি কেমন চলছে, এর মধ্যে কী পড়লে, কী ভাবলে, কী লিখলে?

এই যে নিয়ত জানতে চাওয়া, পড়া, লেখা, ভাবা—সবসময় নিজেকে চলমান রাখা, কোনো কিছুতেই বদ্ধ না হয়ে থাকা—এই-ই ছিলেন গৌতমদা।

আর কোনোদিনই হঠাৎ করে সেই ফোনটা আর আসবে না। কেউই আর সেইরকম করে জিজ্ঞাসা করবে না ‘পার্থ, কী খবর তোমার? এর মধ্যে কী কী বই পড়লে? কী ভাবলে, কী লিখলে?’

শেয়ার করুন

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *